ফার্মির কূটাভাস হলো বহির্জাগতিক সভ্যতা থাকার উচ্চ সম্ভাবনার বিপরীতে আপাতদৃষ্টিতে এর কোনো নিদর্শন না পাবার, অথবা ভিন্ন কোনো সভ্যতার সাথে মানুষের যোগাযোগ না হবার কূটাভাস (Paradox)।
কার্ল সেগানের মতে, মহাবিশ্বের বয়স এবং এতে অবস্থিত বিপুল পরিমাণ তারকারাজির সংখ্যা নির্দেশ করে যে, পৃথিবীর মতো গ্রহ যদি সাধারণ হয়, তবে বহির্বিশ্বিক প্রাণও তেমনই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।[১] ১৯৫০ সালে পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মি সেগানের এই কথায় মন্তব্য করেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে প্রাণ যদি এতই সহজলভ্য হবে, তবে কেন এখনো কোন গ্রহান্তরের মহাকাশযান অথবা স্পেসপ্রোব দেখা যায় নি। এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা শুরু হয় যখন ১৯৭৫ সালে মাইকেল হার্ট এর ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন যা ফার্মি-হার্ট কূটাভাস নামে পরিচিত।[২] এরকম আরো একটি আলোচিত বিষয় হলো "অসীম নিস্তব্ধতা"।[৩] এই তত্ত্বটি এটা নির্দেশ করে, যে যদি ভ্রমণ অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ও, কিন্তু প্রাণ তো আছে, তবে কেন মানুষ কখনোই পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণীদের কোন রেডিও ট্রান্সমিশন ধরতে পারেনি?
বহির্জাগতিক সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে ফার্মি কূটাভাস সমাধান করার নানান প্রচেষ্টা হয়েছে, আবার মানব জ্ঞানের বাইরে এমন প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব, এমনটি ধারণা করা হয়েছে। আবার এর বিপক্ষেও যুক্তি দাঁড় করানো হয় যে, পৃথিবীর বাইরে প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই, অথবা থাকলেও তা সংখ্যায় এতই কম যে মানুষের পক্ষে কখনোই তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না।
মাইকেল হার্টের মতানুসারে, এখন পর্যন্ত বহির্বিশ্বিক প্রাণ এবং এর সম্ভাব্য বিভিন্ন মডেল নিয়ে প্রচুর বৈজ্ঞানিক ধারণা তৈরি করা হয়েছে, এবং ফার্মি কূটাভাস এই সংক্রান্ত কাজের প্রসঙ্গ কাঠামোয় পরিণত হয়েছে। নানান বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণায় এ কূটাভাস অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, বাস্তুবিজ্ঞান এবং দর্শন ইত্যাদি বহুমুখী শাখায় এ নিয়ে অনুসন্ধান উস্কে দিয়েছে। জ্যোতিঃজীববিজ্ঞান নামক একটি নতুন শাখায় ফার্মি কূটাভাস এবং পৃথিবীর বাইরের প্রাণের সম্ভাবনা সংক্রান্ত আন্তঃবৈষয়িক গবেষণা হচ্ছে।
ফার্মি কূটাভাস হলো স্কেল এবং সম্ভাব্যতা ও প্রমাণের অভাবের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ফলাফল। এর পূর্ণতর সংজ্ঞা হতে পারে:
মহাবিশ্বের আকার এবং বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে বহু সংখ্যক উন্নত বহির্জাগতিক প্রাণের সম্ভাব্য উপস্থিতি।
কিন্তু এই ধারণা অযুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়, কারণ পর্যবেক্ষণগত ফলাফল তা সমর্থন করে না।
কূটাভাসটির প্রথম বিষয়টি হলো "আকারের যুক্তি", যার সাথে বিশাল সব সংখ্যা জড়িত: আকাশগঙ্গা ছায়াপথে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন (২৫,০০০ কোটি বা ১০১১) এবং দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ৭০ সেক্সটিলিয়ন (৭ x ১০২২) তারকা আছে।[৪] যদি এসব তারার চারপাশে ঘূর্ণায়মান গ্রহসমূহের অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশেও প্রাণের অস্তিত্ব থাকে তবে কেবল আকাশগঙ্গা ছায়াপথেই বিপুল সংখ্যক সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ যুক্তিতে ধরে নেয়া হয়েছে পৃথিবী কোন বিশেষ গ্রহ নয়, বরং এটি অন্যান্য সব গ্রহের মতোই সাধারণ।
১৯৫০ সালে লস আলামস ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে দুপুর বেলায় খাবার খেতে যাবার সময় ফার্মি তার সহকর্মী এমিল কনপিনস্কি, এডওয়ার্ড টেলার এবং হার্বার্ট ইয়র্কের সাথে আলাপ করছিলেন। তাদের আলাপের বিষয় ছিল সাম্প্রতিক সময়ে শোনা যাওয়া ইউএফও সংক্রান্ত খবর এবং এ নিয়ে অ্যালান ডানের ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে মজা করে মিউনিসিপ্যালের আবর্জনা-বাক্স হারিয়ে যাবার পেছনে ছোঁক ছোঁক করা এলিয়েনদের হাত আছে দেখানো হয়।[৫] এরপর তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন-মানুষ পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলমান কোন বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে পারবে কিনা তার সম্ভাব্যতা, যা টেলারের মতে ছিল দশ লাখে এক, আর ফার্মির মতে দশ ভাগের এক ভাগ। তারপর আলোচনা অন্যদিকে মোড় নেয়, তবে খাবার খেতে খেতে হঠাৎ ফার্মি মন্তব্য করেন, তারা কোথায়?[৬] সে সময়ে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এরপর ফার্মি আসন্ন মান ব্যবহার করে খুব দ্রুত কিছু হিসাব করতে শুরু করেন (ফার্মির অত্যন্ত স্বল্প তথ্য থেকে প্রায় সঠিক ধারণা করার প্রতিভা ছিল, ফার্মি সমস্যা উল্লেখ্য)। অতঃপর তিনি মন্তব্য করেন এর মধ্যেই পৃথিবীতে বহুবার ভিনগ্রহের প্রাণীদের দেখা যাওয়ার কথা ছিল।[৬][৭]
ফার্মির কূটাভাস সম্পর্কিত বহু তত্ত্ব ও নীতি বর্তমান, তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হলো ড্রেকের সূত্র বা ড্রেকের সমীকরণ।
এ সমীকরণটি তৈরি করেছিলেন ড. ফ্রাঙ্ক ড্রেক, ১৯৬০ সালে, এনরিকো ফার্মি কর্তৃক সেই অসামঞ্জ্যস্যতা উত্থাপিত হবার এক দশক পর। তিনি একটি পদ্ধতিগত উপায়ে বহির্জাগতিক প্রাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাবনা গুলো খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। তার সমীকরণের বিবেচ্য বিষয়গুলো ছিল: ছায়াপথে তারকা সৃষ্টির হার (%); গ্রহ সংবলিত তারকার সংখ্যা এবং এদের মধ্যে যেসব গ্রহ বাসযোগ্য তার হিসাব; সেসব গ্রহের কতগুলোতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে এবং সেসব প্রাণী যোগাযোগ করার মতো বুদ্ধিমান কিনা তার সংখ্যা; এবং সর্বশেষে সেসব সভ্যতার আয়ুষ্কাল। তবে এই সূত্রটির মূল সীমাবদ্ধতা হলো এর শেষ চারটি পদ – জীবন আছে এমন গ্রহের ভগ্নাংশ, সেই প্রাণের বুদ্ধিমান হবার সম্ভাবনা, এবং তেমন প্রাণ সংবলিত সভ্যতার আয়ুষ্কাল, যেগুলো পুরোপুরি অজানা। এমন গ্রহের কেবল একটি উদাহরণই মানুষের জানা রয়েছে, যা হলো পৃথিবী, যার ফলে পরিসাংখ্যিক ধারণা করা অসম্ভব, এবং যে উদাহরণটি জানা আছে তাও নৃতাত্ত্বিভাবে গভীরভাবে পক্ষপাতদুষ্ট।
ফার্মির কূটাভাস সমাধান করার একটি সহজ উপায় হলো বর্হির্জাগতিক প্রাণের নিশ্চিত প্রমাণ খুঁজে পাওয়া। ১৯৬০ সালে থেকেই এর প্রমাণ অনুসন্ধানে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এখনো এ নিয়ে নানা চেষ্টা চলছে। যেহেতু মানুষ এখনও আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণে সক্ষম নয়, তাই এ অনুসন্ধান অতি দূর হতে নানা সূক্ষ্ম তথ্য বিশ্লেষণ করে হিসেব করা হয়। এর ফলে এই অনুসন্ধান কেবল সে সব গ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে যারা তাদের গ্রহের পরিবেশকে যথেষ্ট পরিমাণ পরিবর্তিত করেছে, অথবা দূর হতে পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন কিছু তৈরি করে, যেমন রেডিও নিঃসরণ। অনগ্রসর প্রযুক্তি সভ্যতাকে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে বসে আবিষ্কার সম্ভাবনা অত্যন্ত অল্প।
এ অনুসন্ধানে আরেকটি অসুবিধা হলো মানুষের নৃতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা। মানুষ ধারণা করে অন্যান্য পৃথিবীর বুদ্ধিমান প্রাণীদের সভ্যতা মানব সভ্যতার মতোই হবে এবং সে ধারনানুযায়ীই মানুষ অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণীসত্ত্বা মানুষের মতো নাও হতে পারে; এমনও হতে পারে তাদের সভ্যতা এমন যা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
মহাবিশ্বে প্রাণ খুঁজে পাবার জন্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুটি উপায় আছে। একটা হচ্ছে প্রথাগত জ্যোতির্বিদ, যারা তারকা, গ্রহ, গ্যালাক্সি ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেন তারা হয়তো এমন কোন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন যা বুদ্ধিমান সভ্যতার উপস্থিতি ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না। এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে, যখন প্রথম পালসার আবিষ্কৃত হয়, তখন তাদের ছোট্ট সাদা মানব ডাকা হত, যার কারণ ছিল তাদের স্পন্দনের নিঁখুত পুনরাবৃত্তি (পালসারের স্পন্দন সেরা আণবিক ঘড়ির সাথে পাল্লা দেবার মতো সঠিক)। আব্র সেফার্ট গ্যালাক্সিতে শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল[৮] যার কারণ ছিল তাদের বিপুল পরিমাণ শক্তি উদ্গিরণ, যার কোন ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে এমন সব পর্যবেক্ষণের জন্যেই সত্যিকার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়েছে, পালসার হলো নিউট্রন তারা, আর সেফার্ট ছায়াপথে কৃষ্ণ গহ্বর সংযোজিত চিত্রের কারণে এমন শক্তির উদগিরণ ঘটে - তবে নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনা সবসময়ই আছে।[৯]
জ্যোতির্বিজ্ঞানের মাধ্যমে ফার্মির কূটাভাস সমাধান করার আরেকটি দিক হলো এমন একটি বিশেষায়িত অনুসন্ধান, যা কেবল মহাবিশ্বে প্রাণের খোঁজে নিয়োজিত। এ সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হল।
বেতার প্রযুক্তি এবং বেতার টেলস্কোপ নির্মাণের সক্ষমতা একটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অগ্রসর সভ্যতার জন্যে স্বাভাবিক দক্ষতা মনে করা হয়[১০], তত্ত্বীয়ভাবে যা এমন প্রভাব তৈরি করতে সক্ষম যা আন্তঃ নাক্ষত্রিক দূরত্বেও অবলোকন করা সম্ভব।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সৌরজগতকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে লক্ষ্য করা যাবে পৃথিবীর টেলিভিশন ও টেলিকমিউনিকেশান সম্প্রচারের কারণে জি২ তারা|সূর্য থেকে অস্বাভাবিক রকম তীব্র বেতার তরঙ্গ নির্গত হচ্ছে। এর কোন প্রাকৃতিক কারণ নেই বলে অন্য কোন গ্রহের প্রাণীরা ঐ অঞ্চলে বুদ্ধিমান প্রাণের বিকাশ ঘটেছে ধরে নেবে।
তাই মহাকাশের বিভিন্ন অংশ থেকে প্রাপ্ত বেতার তরঙ্গ ও অস্বাভাবিক সংকেত ঠিকমতো ধরতে পারলে তা ভিন্ন সভ্যতার অস্তিত্ত্বের সরাসরি প্রমাণ দিতে পারে। এমন সংকেত কোন সভ্যতার অনিচ্ছাকৃত উপজাত হতে পারে, আবার তা যোগাযোগের চেষ্টাও হতে পারে।
|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
|dateformat=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
|dateformat=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); |প্রকাশক=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
|dateformat=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); |প্রকাশক=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)