ফিলিস্তিনি সঙ্গীত হলো আরব সঙ্গীতের অনেকগুলো উপশাখার মধ্যে একটি। আরব সঙ্গীতের সাথে অনেক মিল থাকলেও, সঙ্গীতের ধারায় এবং বাদ্যযন্ত্রগত দিক থেকে কিছু আলাদা দিক রয়েছে, যেগুলো ফিলিস্তিনিয় সঙ্গীতকে একটি স্বতন্ত্ররূপ এনে দিয়েছে।
বর্তমান ফিলিস্তিনের যে অংশগুলো উভয় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সে ভূখন্ডে বহুবিধ জাতিগত গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অনেক প্রাচীনকাল থেকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা অব্যাহত ছিল। মেন্ডেটরি আরব ফিলিস্তিনি (তথা আরব মুসলিম, আরব খৃষ্টান, দ্রুজ সম্প্রদায় এবং বেদুঈন), ইহুদি, সামারিতান, সিরকাসিয়ান, আর্মেনিয়ান, ডোম এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী মিলে ছিল প্রাচীন ফিলিস্তিনের জনবসতি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আউদ বাদক ওয়াসিফ জাওহারিয়েহ যিনি আউদ বাজানোর পাশাপাশি কবিতা রচনায়ও সুখ্যাতি পেয়েছিলেন।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি আরবরা শহর এবং গ্রামীণ এলাকাগুলোতে কৃষক আর নয়তো যাযাবর হিসেবে জীবনযাপন করতো। ফিলিস্তিনি লোক সঙ্গীতের বেশিরভাগ অবদানই কৃষকদের তাদের কর্মব্যস্ততার মাঝে বিনোদন হিসেবে তাদের কাজের বর্ণনা নিয়ে বৈচিত্রময় গান গাইতো। ভ্রমণ গল্পকথক এবং সঙ্গীতশিল্পী "জাজালিন" নানা ধরনের মহাকাব্য ও উপখ্যানের জন্য সমধিক পরিচিত ছিল। এছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠানের অন্যতম কেন্দ্রস্থল, যেখানে মহিলারা গানের তালে দলবদ্ধ হয়ে দাবকে নামক এক ধরনের জটিল নাচের আয়োজন করতো।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর বহু আরব-ফিলিস্তিনিরা তাদের ভিটে-মাটি হারিয়ে গাজা ভূখন্ডের পশ্চিম তীরে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। ১৯৪৮ পরবর্তী সময়ে আরব্য লোক সঙ্গীতে সবচেয়ে বেশি যারা জনপ্রিয় ছিল, তাদের মধ্যে উম্মে কুলসুম এবং সৈয়দ দারবিশ ছিল অন্যতম। নাজারেত আর হাইফা ছিল ফিলিস্তিনি লোক-সঙ্গীতের পূণ্যভূমি যেখানে কায়রো আর দামেস্ক ঘরানার লোক-সঙ্গীতগুলো বেশি রচিত হয়েছে। তবে ১৯৪৮ পরবর্তী ফিলিস্তিনিয় লোক-সঙ্গীতগুলোর একটু আলাদা ধাঁচে রচিত হতো যেখানে তাদের হৃত রাষ্ট্র ফিরে পাওয়ার এবং জাতীয়তাবোধ বেশি প্রাধান্য পেতো।
১৯৭০ এর দশকে "সাবরিন" এবং "আল আশেকিন" নামের এই দুজন সঙ্গীতশিল্পী বেশ আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। এছাড়াও ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময়ে "আল-ফুনাউন", "সুহাইল খাউরি" ও "জামিল আল-সায়িহ", "সুহাইল খাউরি" ও "থায়ের বারঘাউতির" অনেক প্রতিভাবান গীতিকার নিজেদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।
১৯৯০-এর দশকে ফিলিস্তিনিয় জাতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি স্থিতিশীল হতে শুরু করে। বিবাহ উৎসবে যেসব সঙ্গীতদলগুলো যুদ্ধের কারণে হারিয়ে গিয়েছিলো, তারাও ৯০-এর দশকের পরে আবার পুনর্গঠিত হতে শুরু করে। ৯০-এর দশকের পরেই 'ইয়ুয়াদ ওয়াশেম', মোহসেন সুভি, 'আদেল সালামেহ', ঈসা বোউলোস, উইসাম জোবরান, 'সামির জোবরান' এবং 'বাসেল জায়েদ' এর মতো ফিলিস্তিনি গায়কেরা তাদের প্রতিভা প্রকাশ করার সুযোগ পায়।
ফিলিস্তিনি গানগুলোর একটা বড় অংশই বিয়ে এবং নৃত্য সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে। বিবাহ উৎসব ফিলিস্তিনি সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করায় বেশিরভাগ গানগুলোই বিয়ের উৎসবে গাওয়ার মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে আজও সাধারণ ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে স্থান করে আছে। আর বিয়ের মেহেদী অনুষ্ঠানেই মূলত এই ধরনের সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে।
২০০৫ সালে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে হামাসের জয়লাভের পর থেকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের রোষানলে ফিলিস্তিনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গতিরোধ হয়।[২]
২০০৫ সালে পশ্চিম তীরের শহর কালকিলিয়াতে হামাস নেতৃত্বাধীন পৌরসভা হারাম হওয়ার কারণ দেখিয়ে বহিরঙ্গন গান-বাজনা নিষিদ্ধ করে। উক্ত পৌরসভা এমনকি চিড়িয়াখানার বাইরেও গান-বাজনা নিষিদ্ধ করে এবং মুফতি আক্রামেহ সাবরি এই ফতোয়ার অনুমোদন দেয়।[২][৩] ফিলিস্তিনে জাতীয় কবি মাহমুদ দারউইশ এই ফতোয়ার বিরোধীতা করে করে বলেন -
এসব আমাদের সমাজে তালেবানী-জাতীয় আচরণ যাতে বিপদের আশঙ্কা দেখছি।
রামাল্লাহর ফিলিস্তিনি কলামিস্ট আব্দ আল-হামিদ তার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন যে, এই ধরনের ধর্মীয় বলপ্রয়োগ ফিলিস্তিনি সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্পীদের দেশত্যাগে বাধ্য করবে এবং আরো উল্লেখ করে বলেন -
আলজেরিয়ার ধর্মীয় মৌলবাদিরা তাদের দেশের প্রতিটি সাংস্কৃতিক প্রতীক, ভাষ্কর্য এবং বিরল শিল্পকলাসমূহ ধ্বংস করেছে, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, রিপোর্টার, ব্যালে নৃত্যশিল্পী এবং গায়কদের হত্যা করেছে - আমরা ফিলিস্তিনিরা কি আলজেরিয়ান এবং আফগানীদের ফেলে যাওয়া উদাহরণ অনুসণ করতে চলেছি?