ফ্রান্সেস ম্যারিয়ন (ইংরেজি: Frances Marion; জন্ম: ম্যারিয়ন বেনসন ওয়েন্স, ১৮ নভেম্বর ১৮৮৮ - ১২ মে ১৯৭৩)[১] ছিলেন একজন মার্কিন চিত্রনাট্যকার, সাংবাদিক, লেখিকা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ম্যারিয়নকে জুন ম্যাথিস ও আনিতা লুসের সাথে যৌথভাবে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রসিদ্ধ নারী চিত্রনাট্যকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি প্রথম লেখিকা হিসেবে দুটি একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। ম্যারিয়ন চলচ্চিত্র নির্মাতা লোইস ওয়েবারের সাথে কাজের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি অভিনেত্রী ম্যারি পিকফোর্ড অভিনীত অসংখ্য নির্বাক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন এবং পরবর্তী কালে সবাক চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। তিনি দ্য বিগ হাউজ (১৯৩০) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করে শ্রেষ্ঠ উপযোগকৃত চিত্রনাট্য বিভাগে একাডেমি পুরস্কার এবং দ্য চ্যাম্প (১৯৩১) চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনা করে শ্রেষ্ঠ কাহিনি বিভাগে একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।
ফ্রান্সেস ম্যারিয়ন ১৮৮৮ সালের ১৮ই নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিস্কো শহরে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তার প্রকৃত নাম ম্যারিয়ন বেনসন ওয়েন্স। তার পিতা লেন ডি. ওয়েন্স এবং মাতা মিনি বেনসন। তিনি তার পিতামাতার তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। তার বড় বোন মড এবং ছোট ভাই লেন। তার যখন ১০ বছর বয়স, তখন তার পিতামাতার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং তিনি তার মায়ের সাথেই বসবাস করতেন। ১২ বছর বয়সে তার শিক্ষকের ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে গিয়ে ধরা পড়ার পর তিনি বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। তিনি পরবর্তী কালে সান মাতেও'র একটি বিদ্যালয়ে বদলি হন এবং ১৬ বছর বয়সে সান ফ্রান্সিস্কোর মার্ক হপকিন্স আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। তিনি ১৯০৪ সাল থেকে ১৯০৬ সালে সান ফ্রান্সিস্কোতে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে বিদ্যালয়টি ধংস হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।[৩]
ম্যারিয়ন সান ফ্রান্সিস্কোতে আর্নল্ড গেনথের অধীনে সহকারী আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতেন এবং আলোকচিত্রের বিভিন্ন ধরন ও রঙ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। পরবর্তী কালে তিনি ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক রেলপথের জন্য বাণিজ্যিক চিত্রশিল্পী হিসেবে এবং পরে সান ফ্রান্সিস্কো এক্জামিনার-এর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করতেন। লস অ্যাঞ্জেলেসে আসার পর তিনি মরস্কো থিয়েটারে পোস্টার চিত্রশিল্পী হিসেবে এবং একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার বাণিজ্যিক ধারার কাজ করতেন।[৪]
১৯১৩ সালে তিনি হলিউডে আগমন করেন। ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক লোইস ওয়েবারের চিত্রনাট্য সহকারী, অভিনেত্রী ও তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লোইস ওয়েবার প্রডাকশন্সের সার্বিক সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। তিনি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কাজ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন এবং ১৯১৫ সালে তিনি চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।[১] এই সময়ে ওয়েবার ইউনিভার্সাল পিকচার্সে যোগ দিলে তিনি ম্যারিয়নকে তার সাথে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ম্যারিয়ন তার প্রস্তাব গ্রহণ করেননি, এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যারি পিকফোর্ডের প্রস্তাব অনুসারে তিনি ফেমাস প্লেয়ার্স-লাস্কিতে যোগ দেন। তিনি ১৯১৫ সালে ফ্রানচোন দ্য ক্রিকেট, লিটল পাল, ও র্যাগস চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। একই বছর তিনি পিকফোর্ডের সাথে আ গার্ল অব ইস্টারডে ছবিতে অভিনয় করেন। এই সময়ে তিনি পিকফোর্ডের জন্য মৌলিক চিত্রনাট্য সংবলিত দ্য ফাউন্ডিং রচনা করেন। ম্যারিয়ন এই পাণ্ডুলিপিটি ১২৫ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে আডলফ জুকরের কাছে বিক্রি করেন। ছবিটি নিউ ইয়র্কে চিত্রায়িত হয় এবং মুভিং পিকচার ওয়ার্ল্ড ছবিটিকে মুক্তি-পূর্ব ইতিবাচক পর্যালোচনা প্রদান করে। কিন্তু মুদ্রিত হওয়ার আগে ল্যাবরটরিতে অগ্নিকাণ্ডে চলচ্চিত্রটির নেগেটিভ নষ্ট হয়ে যায়।[৫]
১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালে ফ্রান্সে যুদ্ধ প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার পর তিনি পুনরায় চিত্রনাট্য রচনায় ফিরে আসেন এবং কয়েকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন, তন্মদ্ধ্যে দুটি চলচ্চিত্রে তার তৃতীয় স্বামী ফ্রেড টমসন অভিনয় করেন। ১৯২০-এর দশকে তিনি পিকফোর্ড, ম্যারিয়ন ডেভিস, রোনাল্ড কলম্যান ও রুডলফ ভ্যালেন্টিনোর মত তারকাদের জন্য চিত্রনাট্য রচনা করেন।[১] এই সময়ে তিনি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের অধীনে চিত্রনাট্য রচনার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩,০০০ মার্কিন ডলার পারিশ্রমিক পেতেন।[৬] তিনি সে সময়ে সর্বোচ পারিশ্রমিক গ্রহীতা চিত্রনাট্যকার ছিলেন।[১]
১৯৩০ সালে তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারি ড্রেসলার ও ওয়ালেস বিরি অভিনীত মিন অ্যান্ড বিল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেন। এটি ড্রেসলার অভিনীত প্রথম সবাক চলচ্চিত্র এবং এই ছবিতে অভিনয় করে ড্রেসলার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর ম্যারিয়ন দ্য বিগ হাউজ (১৯৩০) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনার জন্য শ্রেষ্ঠ উপযোগকৃত চিত্রনাট্য বিভাগে একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর দ্য চ্যাম্প (১৯৩১) চলচ্চিত্রের কাহিনি রচনা করে শ্রেষ্ঠ কাহিনি বিভাগে একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। দুটি চলচ্চিত্রেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন [[ওয়ালেস বিরি।[৭]
ম্যারিয়ন চারবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ১৯০৭ সালে ওয়েসলি দে লাপ্পেকে বিয়ে করেন এবং ১৯০৯ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরে তিনি ১৯১০ সালে রবার্ট পাইকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[৮] এই দুটি বিবাহই তিনি তার নাম পরিবর্তনের পূর্বে সম্পন্ন করেন। ১৯১৯ সালে তিনি ফ্রেড টমসনকে বিয়ে করেন। ফ্রেড ১৯২১ সালে দ্য লাভ লাইট চলচ্চিত্রে ম্যারি পিকফোর্ডের সাথে অভিনয় করেছিলেন। তিনি পিকফোর্ডের সাথে এতই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে তিনি ফ্রেডকে বিয়ে করলে ও পিকফোর্ড ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কসকে বিয়ে করলে তারা একত্রে মধুচন্দ্রিমায় যান।[৯] ১৯২৮ সালে টমসনের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর তিনি ১৯৩০ সালে পরিচালক জর্জ ডব্লিউ. হিলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩৩ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তার দুই সন্তান - ফ্রেডরিক সি. টমসন ও দত্তক নেওয়া পুত্র রিচার্ড টমসন। ফ্রেডরিক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন এবং সেখানে পাঠদান করতেন এবং পরে নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি জর্জ ইলিয়টের লেখনীর সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৮০ সালে ও পরবর্তী সময়ে ফেলিক্স হল্ট, দ্য র্যাডিক্যাল বইটির সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন।
ম্যারিয়ন ১৯৭২ সালে তার স্মৃতিকথা অফ উইথ দেয়ার হেডস: আ সিরিও-কমিক টেল অব হলিউড প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৭৩ সালের ১২ই মে ৮৬ বছর বয়সে লস অ্যাঞ্জেলেসে মৃত্যুবরণ করেন।[৭]