বউবাজার | |
---|---|
কলকাতার অঞ্চল | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
শহর | কলকাতা |
মেট্রো স্টেশন | সেন্ট্রাল |
উচ্চতা | ৩৬ ফুট (১১ মিটার) |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় প্রমাণ সময় (ইউটিসি+৫:৩০) |
পিন | ৭০০ ০১২ |
এলাকা কোড | +৯১ ৩৩ |
বউবাজার হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতা শহরের একটি অঞ্চল ও থানা। [১]
১৭৮৪ সালের লেফট্যানেন্ট কর্নেল মার্ক উডের মানচিত্রে লালবাজার থেকে পূর্বদিকে তৎকালীন মারাঠা খাত (পরে সার্কুলার রোড এবং বর্তমানে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) পর্যন্ত এলাকার নাম ছিল "বয়টাকোন্না স্ট্রিট" (Boytaconnah Street)। নামটির উৎপত্তি "বৈঠকখানা" নামটি থেকে। সেকালে এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে ব্যবসায়ীরা তাদের মালপত্র নিয়ে বিশ্রাম করতে বসতেন। শোনা যায়, জব চার্নক যখন কলকাতাকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত করেন, তখন তিনিও এখানে আসতেন। সেই থেকেই জায়গাটির নাম হয় বৈঠকখানা। উডের মানচিত্রে বৈঠকখানা বটগাছটির উল্লেখও আছে। এর পূর্বদিকের এলাকাটি ছিল জলাভূমি। ১৭৯৪ সালে অ্যারোন আপজনের মানচিত্রেও বৈঠকখানার উল্লেখ আছে। তবে উক্ত মানচিত্রে যে স্থানটি দেখানো হয়েছে সেটি বর্তমান শিয়ালদহ স্টেশনের জায়গাটি। উডের মানচিত্রে কোনো বৈঠকখানা গাছের উল্লেখ না থেকলেও আপজনের মানচিত্রে আছে।[২][৩]
পরবর্তীকালে লালবাজার ও বৈঠকখানা স্ট্রিটকে বলা হত "পূর্ব দিকের অ্যাভিনিউ" (avenue to the eastward)। পূর্বতন ডালহৌসী স্কোয়ার (অধুনা বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ) থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এই রাস্তাটি প্রসারিত ছিল। পরে এই রাস্তার নাম হয় বউবাজার স্ট্রিট। 'বউবাজার' শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে দুটি মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলাল তার বাঙালি পুত্রবধূকে একটি বাজার লিখে দেন, সেই বাজারটিই 'বহুবাজার' (হিন্দিতে 'বহু' শব্দের অর্থ 'পুত্রবধূ') এবং পরে তা বিকৃত হয়ে 'বউবাজার' নাম নেয়।[২] তবে ঐতিহাসিকেরা এই ব্যবসায়ীর পরিচয় নির্ধারণে অসমর্থ হয়েছেন। তাই দ্বিতীয় মতে, এই অঞ্চলে বহু বাজার ছিল এবং সেই সব বাজারে বহু জিনিসপত্র বিক্রি হত। সেই থেকেই এই বাজারটি প্রথমে 'বহুবাজার' ও পরে তা বিকৃত হয়ে 'বউবাজার' নাম নেয়। প্রথম মত অনুসারে, উক্ত বাজারটি ছিল ৮৪ এ এলাকায় অধুনা নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে। দ্বিতীয় মতে যে বাজারগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলির অবস্থান ছিল ১৫৫-৫৮ এলাকায়।[৪]
পরে বউবাজার স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট (স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির (১৮৮৭-১৯৫৪) নামানুসারে। ইনি ২৪ বছর ব্রিটিশ জেলে অতিবাহিত করেন। পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন)।[৫] যদিও এলাকার নামটি বউবাজারই থেকে যায়। বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত এলাকার নাম এখনও বৈঠকখানা রোড।[৬] এই রাস্তার দক্ষিণ প্রান্তের বাজারটির নামও বৈঠকখানা বাজার।
লালবাজার, বউবাজার, রবীন্দ্র সরণী (তৎকালীন চিৎপুর রোড) ও বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান। এখানে একটি ফাঁসিকাঠ ছিল এক সময়।[২]
মহম্মদ রাশিদ খান নামে এক সাট্টা ডন ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ বউবাজারে একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণে ৬৯ জন মারা যায়। এই ঘটনায় মহম্মদ রাশিদ খান সহ পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।[৭][৮]
পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করে। গোবিন্দপুর অঞ্চলের অধিকাংশ বাসিন্দাকে এই কারণে সুতানুটি এলাকায় সরিয়ে দেওয়া হয়। ডিহি কলকাতার ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী এই সময় ময়দান এলাকায় সরে আসে।[৯] সাধারণ মানুষদের নবগঠিত দুর্গের মধ্যে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি। আস্তে আস্তে লালদিঘি বা গ্রেট ট্যাঙ্কের দক্ষিণে এবং পূর্ব দিকে চৌরঙ্গি রোডের দুধারের এলাকা ইংরেজ বসতিতে পরিণত হয়। সুতানুটি ‘ব্ল্যাক টাউন’ বা ভারতীয় পল্লি এবং এসপ্ল্যানেড ও চৌরঙ্গি ‘হোয়াইট টাউন’ বা শ্বেতাঙ্গ পল্লিতে পরিণত হয়।
মহাকরণ, বৈঠকখানা (বউবাজার), ধর্মতলা, এন্টালি, তালতলা ও জানবাজার এলাকাগুলি পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, মুসলমান ও অন্যান্য জাতির আবাসস্থল হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলগুলি পুরনো কলকাতার ব্ল্যাক ও হোয়াইট টাউনের মাঝামাঝি এলাকায় পরিণত হয়।[১০]
১৮৭৬ সালের জনগণনায় দেখা যায় প্রতিদিন ১০,০০০ লোক হুগলি নদী পেরিয়ে কলকাতায় প্রবেশ করে। এরা মেছুয়াবাজার (অধুনা জোড়াসাঁকো) ও বউবাজার এলাকায় জনবহুল বস্তিতে বসবাস শুরু করে। এই সব লোকেরা ছিল হতদরিদ্র। এরা মাটির বাড়িতে বসবাস করত এবং উৎসবে অনুষ্ঠানে ধনী বাঙালিদের ঘরে ঘরে কিছু উপহার পাবার আশায় ঘুরত।[১১]
১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করলে বহু সংখ্যক চীনা কলকাতায় এসে বউবাজারের টেরিটিবাজার এলাকায় বসবাস শুরু করে। পরবর্তীকালে এই জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ পূর্ব কলকাতায় ট্যাংরা অঞ্চলে গিয়ে সেখানে চামড়ার ব্যবসা শুরু করে। এরপর যদিও কিছু চীনা বউবাজারে রয়ে যায়, ট্যাংরাই কলকাতার চায়নাটাউন হয়ে ওঠে।[১২]
বউবাজারের চীনারা মূলত ক্যান্টনিজ। স্বাধীনতার পর নতুন রাস্তা ও বড় বড় বাড়ি তৈরি হওয়ার ফলে এই অঞ্চলের চীনাদের উপর তার খারাপ প্রভাব পড়ে।[১৩]
বউবাজারের গলিগুলিতে অনেক ‘কোঠা’ আছে। এই কোঠায় বাইজিরা থাকে। কলকাতার বাইজিরা নাচ ও গানের জন্য বিখ্যাত। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, লখনউ ঘরানার কথক গুরু রামনারায়ণ মিশ্র তার ছাত্র চিত্রেশ দাসকে নিয়ে রিকশায় চড়ে বউবাজারের বাইজি কোঠায় আসতেন। তিনি প্রতিটি কোঠায় যেতেন। বাইজিরা ও তাদের মায়েরা জারি অর্থাৎ সোনার কাজ করা শাড়ি পরে তার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেন ও তাকে পান দিতেন। বউবাজারের বাইজি কোঠায় অনেক নিয়মকানুন ছিল। এখানে শিক্ষিত ধনীরা নাচগান দেখতে আসতেন। সেকালে বলা হত, “মতলব সে আয়ে, জাইয়ে সোনাগাছি।” (কুমতলব নিয়ে এলে, সোনাগাছি যান।) যদিও বর্তমানে বউবাজারের বাইজি প্রথার অনেক অবনতি ঘটেছে।[১৪]
বউবাজারে একটি লালবাতি এলাকা আছে। এখানে ১,৫০০-২,০০০ যৌনকর্মী বাস করে। এই এলাকার আশেপাশে বস্তি, ট্রাকচালক ও প্রবাসী মজুরদের বসতি। পাশে টেরিটি বাজারে অনেকগুলি পরিবহন কোম্পানির অফিস ও গুদাম আছে। এলাকাটি খুবই অস্বাস্থ্যকর।[১৫][১৬]
১৯শ শতাব্দীতে কলকাতা ছিল পালকি আর ঘোড়ায় টানা যানবাহনের শহর। ট্রাম কলকাতার প্রথম গণপরিবহন ব্যবস্থা। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়। প্রথম ট্রামের পথটি ছিল আর্মেনিয়ান ঘাট থেকে বউবাজার ও ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত।[১৭] ১৮৯৯ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি চালু হয়। এরপরই পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলতে শুরু করে।[১৮] পরে কলকাতা মেট্রো বউবাজারে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন চালু করে।
বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বউবাজার মার্কেট গয়নার দোকানের জন্য বিখ্যাত। এটি কলকাতার প্রধান গয়নার বাজার। এখানে সোনা, রুপো সহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ও রত্নের গয়না পাওয়া যায়।[১৯] অধিকাংশ পরিবারই বিবাহ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে বউবাজার থেকে গয়না কেনে।
এছাড়া বউবাজারে কাঠের আসবাব, বাদ্যযন্ত্র, জুতো, মরসুমি ফল, তাজা সবজি ও মাংসের বাজার রয়েছে।[২০]
বউবাজারে কলকাতার বহু বিখ্যাত স্কুল ও কলেজ রয়েছে। কলকাতার শিক্ষার ইতিহাসে এই এলাকার বিশেষ একটি পরিচিতি আছে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম থেকে ১৮২৯ সালে যখন প্রথম কলকাতায় আসেন, তখন তিনি বউবাজারের পঞ্চাননতলায় থাকতেন। বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর খরচ বহন করতে না পারায়, বিদ্যাসাগর রাস্তার বাতিস্তম্ভের আলোয় লেখাপড়া করতেন।[২১]
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা ড. মহেন্দ্রলাল সরকার ১৮৭৬ সালের জুলাই মাসে ২১০ বউবাজার স্ট্রিটেই এই বিজ্ঞান গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। পরে এটি যাদবপুর অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়। চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন এই সংস্থার ল্যাবরেটরিতেই রামন এফেক্ট সংক্রান্ত তার ঐতিহাসিক গবেষণার কাজটি করেছিলেন। এই গবেষণার স্বীকৃতিতেই তিনি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান।[২২]
১৯০৬ সালের ১৫ অগস্ট ১৯/১ বউবাজার স্ট্রিটে বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ অ্যান্ড স্কুল স্থাপিত হয়। অরবিন্দ ঘোষ ও সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই সংস্থার প্রথম সাম্মানিক সুপারইনটেন্ডেন্ট। পরে এই সংস্থাটিই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়।[২৩]
পাথুরিয়াঘাটার কাছে স্থাপিত বঙ্গ নাট্যালয় প্রথম থিয়েটার যারা বাংলায় অ্যাডমিশন কার্ড ছেপেছিল।[২৪]
সেকালে সাধারণত ধনী বাড়িগুলিতেই জলসার আসর বসত। তবে কিছু কিছু সাধারণ বাড়িতেও এই আসর বসত। তার মধ্যে একটি ছিল বউবাজারের বড়াল বাড়ি।[২৫] বউবাজারের ঝুলনবাড়ি উৎসবে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর বসে।[২৬]
উইকিভ্রমণ থেকে বউবাজার ভ্রমণ নির্দেশিকা পড়ুন।