বক্রকৃমি বা হুকওয়ার্ম হল অন্ত্রে বসবাসকারী, রক্ত-ভোজী একধরনের গোলাকার কৃমি যা হেলমিনথিয়াস নামক বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের সৃষ্টি করে থাকে। শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যায় এদেরকে নেমাটোডা পর্বের অন্তর্গত Strongiloidea বর্গের অধীনে রাখা হয়েছে।[১] পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয় না- এমন দেশগুলোতে এটি প্রায়ই রোগ সৃষ্টি করে। মানুষের মধ্যে বক্রকৃমির সংক্রমণ মূলত দুটি প্রজাতির গোলকৃমি দ্বারা ঘটে থাকে; যার একটি Ancylostoma এবং অপরটি Necator গণের অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সংক্রমণকারী প্রধান পরজীবী হল Ancylostoma প্রজাতি।
মানবদেহে সাধারণত দুটি প্রজাতির বক্রকৃমির সংক্রমণ ঘটে থাকে। এগুলো হল Ancylostoma duodenale ও Necator americanus।[১] তবে, Necator americanusই অধিকাংশ (৯০%) সংক্রমণের জন্য দায়ী। এদের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। তবে, উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোতে এরা বেশি সহজলভ্য।[২]
বক্রকৃমির যেসব প্রজাতি গৃহপালিত বিড়ালকে সংক্রামিত করে সেগুলো হলো Ancylostoma braziliense এবং Ancylostoma tubaeforme। আর, বন্য বিড়াল Ancylostoma pluridentatum দ্বারা সংক্রামিত হয়।
Ancylostoma caninum সাধারণত কুকুরকে সংক্রামিত করে। তবে, এদেরকে বিড়াল এবং শিয়ালের দেহেও পাওয়া যায়। আর, গবাদি পশুর সংক্রমণের জন্য মূলত Bunostomum bovis প্রজাতির বক্রকৃমিই দায়ি।[১]
প্রজাতিভেদে বক্রকৃমির বৈশিষ্ট্যে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তবে, যে দুটি প্রজাতি মানুষকে সংক্রামিত করে তাদের অঙ্গসংস্থানও প্রায় একই রকম। A. duodenale প্রজাতির কৃমিগুলো ফ্যাকাশে ধূসর বা কিছুটা গোলাপী। শরীরের অন্যান্য অংশের চেয়ে মাথাটি কিছুটা বাঁকানো, যা অনেকটা হুকের আকৃতি গঠন করে। এ কারণেই এর নাম রাখা হয়েছে হুকওয়ার্ম। A. duodenale-এর হুক শরীরের সম্মুখ প্রান্তে থাকে। এছাড়া, তাদের দুই জোড়া দাঁত সমৃদ্ধ সুগঠিত মুখ রয়েছে। পুরুষ কৃমি প্রায় ১ সেন্টিমিটার (± ০.৫ মিমি) লম্বা হয় এবং এদের কপুলেটরি বার্সা থাকে। আর স্ত্রী কৃমি অপেক্ষাকৃত বেশি লম্বা এবং মোটা হয়।[৩]
অন্যদিকে, N. americanus সাধারণত A. duodenale-এর চেয়ে খাটো হয়। এ প্রজাতির পুরুষ কৃমি সাধারণত ৫ থেকে ৯ মিমি লম্বা হয়। আর স্ত্রী কৃমি প্রায় ১ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে থাকে। দুই জোড়া দাঁতের পরিবর্তে N. americanus-এর মুখ বিহ্বরে থাকে একজোড়া কাটিং প্লেট।[২][৩]
পোষক (হোস্ট) সবসময় লার্ভা দ্বারাই সংক্রামিত হয়, ডিম দ্বারা নয়। আর, লার্ভা পোষকের দেহে প্রবেশ করে মূলত ত্বকের মাধ্যমে। বক্রকৃমির লার্ভাগুলো ডিম পাড়ার জন্য ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি উষ্ণ ও আর্দ্র মাটির প্রয়োজন। সরাসরি সূর্যের আলোতে থাকলে বা শুকিয়ে গেলে তারা মারা যায়। Ancylostoma-এর লার্ভার চেয়ে Necator-এর লার্ভা বেশি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে।
প্রথম পর্যায়ের লার্ভা (এল-১) সংক্রামণের অনুপযোগী থাকে। এরা একবার জমা হওয়া মাটিতে ডিম পাড়ে এবং তারপরে মাটির অণুজীবগুলো খাওয়ায় যতক্ষণ না তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের লার্ভা (এল-২) তে পরিণত হয়।[৪] প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের লার্ভা র্যাবডিটিফর্ম পর্যায়ে (Rhabditiform stage) থাকে। প্রায় সাত দিন ধরে খাওয়ানোর পরে তারা তৃতীয় পর্যায়ের লার্ভা (এল-৩) তে পরিণত হয়; যা ফিলারিফর্ম পর্যায় (Filariform stage) হিসেবে পরিচিত। এটি হল ভক্ষণহীন ও সংক্রমণযোগ্য পর্যায়ে। ফিলারিফর্ম লার্ভা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এগুলো গতিশীল হয়ে থাকে; এমন কি, অনেক সময় হোস্টের সন্ধানে তারা উঁচু স্থানেও চলে যায়। N. americanus লার্ভা কেবল ত্বকের মাধ্যমেই সংক্রামিত হতে পারে। তবে, A. duodenale খাবারের মাধ্যমেও সংক্রামিত হয়। লার্ভার সংক্রমণের একটি সাধারণ পথ হল খালি পায়ে চলাচলকারীদের পায়ের ত্বক। লার্ভা একবার হোস্টের দেহে প্রবেশ করতে পারলে এরপর তারা রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থার মাধ্যমে ফুসফুসে গমন করে। সেখানে তারা কৈশিক জালিকা ছেড়ে বায়ুথলিতে (অ্যালভিওলাস) প্রবেশ করে। তারপরে সেখান থেকে তারা শ্বাসনালীতে (ট্রাকিয়া) যায় এবং সেখানে গলাধঃকরণকৃত হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রবেশ করে। ক্ষুদ্রান্ত্রে লার্ভা মোল্ট প্রাপ্ত হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিতে পরিণত হয়; অর্থাৎ, চতুর্থ পর্যায়ে (এল-৪) প্রবেশ করে। এটি পরিপক্ব হওয়ার জন্য অন্ত্রে প্রবেশের পর পাঁচ থেকে নয় সপ্তাহ সময় নেয়।[৫][৬]
Necator americanus-এর কারণে এক থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে, প্রথম দুই-এক বছরে অনেক কৃমি মারা যায়। আবার, কিছু কিছু কৃমির পনেরো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। অন্যদিকে, Ancyclostoma duodenale স্বল্পস্থায়ী। এরা প্রায় ছয় মাস যাবত স্থায়ী হয়। তবে, এদের লার্ভা সুপ্ত অবস্থায় টিস্যুর মাঝে সংরক্ষিত থাকতে পারে। ফলে, মারা যাওয়া কৃমিগুলোকে প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে ঐ পোষক দেহে কৃমিগুলো অনেক বছর ধরে টিকে থাকতে পারে।
পোষক দেহের অভ্যন্তরে কৃমিরা সঙ্গমে মিলিত হয়। এরপর স্ত্রী কৃমিগুলো ডিম পাড়ে। এই ডিম পোষকের মলের মাধ্যমে পরিবেশে ছড়িয়ে যায় এবং চক্রটি আবার শুরু হয়। N. americanus প্রতিদিন নয় থেকে দশ হাজার ডিম পাড়ে।[২] আর, A. duodenale প্রতিদিন পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজারের মতো ডিম দিতে পারে। এদের ডিম অবিচ্ছিন্ন হয়।[৭]
পরিপক্ব হওয়ার জন্য বক্রকৃমির পাঁচ থেকে সাত সপ্তাহ সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু সঙ্গম শুরু হতে আরো কিছু সময় লাগতে পারে। এক্ষেত্রে, মলের মধ্যে ডিম পাওয়া যাওয়ার আগেই সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে। এটি ঘটলে, বক্রকৃমি সংক্রমণের রোগ নির্ণয় জটিল হয়ে পড়ে (কারণ, সাধারণত মলে ডিমের উপস্থিতি যাচাই করেই এ রোগ নির্ণয় করা হয়।)[৮]