বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ | |
---|---|
প্রাক্তন প্রাদেশিক রাজনৈতিক দল | |
প্রতিষ্ঠা | ১৯১২ |
ভাঙ্গন | ১৯৪৭ |
ভাবাদর্শ | নিয়মতন্ত্র, দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ, বাঙালি মুসলমানদের জন্য নাগরিক অধিকার |
রাজনৈতিক অবস্থান | মধ্য-ডানপন্থী |
ধর্ম | ইসলাম |
জাতীয় অধিভুক্তি | নিখিল ভারত মুসলিম লীগ |
পাকিস্তানের রাজনীতি |
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ (বিপিএমএল) ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের একটি শাখা। এটি ১৯২১ সালের ২ মার্চ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দলটির প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা ছিল বাংলা।[১] বঙ্গীয় আইন পরিষদ এবং বঙ্গীয় আইনসভায় দলটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলার প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে দুই জন উক্ত দল থেকেই নির্বাচিত হন। বিশেষত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের জয় লাভ করার পর দলটি পরে পাকিস্তান অধিরাজ্য সৃষ্টির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
১৯২৯ সালে দলটির একাংশ ভেঙে গিয়ে প্রজা পার্টি গঠন করে। পরবর্তীতে, বিএমপিএল-এর সদস্যরা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিলেন। যেমন: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং নুরুল আমিন); পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল (স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন); পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন, এ কে ফজলুল হক এবং আতাউর রহমান খান); বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি (শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ এবং খন্দকার মোশতাক আহমেদ), বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম) এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী (শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মুহাম্মদ মনসুর আলী এবং আতাউর রহমান খান)।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় ভারত জুড়ে, বিশেষত বাংলায় হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯০৬ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসামে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি অল ইন্ডিয়া মুহাম্মাদান এডুকেশনাল কনফারেন্সে গঠিত হয়েছিল, যার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে উদার শিক্ষার প্রচার করা। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দেয়। এ সিদ্ধান্ত অধিকাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠীই ভালভাবে গ্রহণ করেনি।
১৯১২ সালের ২ মার্চ ঢাকায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, স্যার আবদুল হালিম গজনবী, বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল কাশেম, ওয়াহিদ হোসেন ও আবদুর রসুল। এদের মধ্যে নওয়াব স্যার খাজা সলিমুল্লাহকে সভাপতি এবং সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও জাহিদ সোহরাওয়ার্দীকে সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করা হয়। আবুল কাসেম, ওয়াহিদ হোসেন ও আবদুর রসুল সহ অনেক সদস্য একই সাথে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন।[১] এ কে ফজলুল হক ১৯১৫ সালে দলটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিপিএমএল বাংলাকে তার প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। দলটির সকল ঘোষণাপত্র বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল।[১] অন্যদিকে, মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই ছিলেন উর্দু-ভাষী।
১৯১৯-১৯৩৫ এর দ্বৈত শাসনকালে বিপিএমএল-এ বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য একটি দল স্ব-শাসন অর্জনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে অপর একটি দল অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল।[১]
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিপিএমএল বাংলার আইনসভার ৪০টি আসনে জয়লাভ করে। আইনসভায় দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা একে ফজলুল হকের সরকারকে সমর্থন জানায়। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ২২টি আসনের মধ্যে বিপিএমএল ১৮টি আসনে জয়ী হয়।[১] সে বছরই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পক্ষে এ.কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করে যাতে পূর্ব ভারতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৪১ সালে বিপিএমএল হক সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৩৭-১৯৪৬ সালের মধ্যে দলটির প্রধান ছিলেন স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, যিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিশ্বস্ত কর্মী। ১৯৪৩ সালে নাজিমুদ্দিন হক-শ্যামা জোটকে সরিয়ে দিয়ে সরকার গঠন করেন এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। রক্ষণশীল নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ সহ বিভিন্ন বিপর্যয় দেখা দেয়। এতে বিপিএমএল-এর মধ্যে কোন্দল বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৫ সালে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে এবং গভর্নরের শাসন জারি করা হয়। এরপর, দলের নিয়ন্ত্রণ হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মতো উদার ও কেন্দ্রবাদী নেতৃত্বের হাতে চলে যায়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বিপিএমএল বঙ্গীয় আইন সভায় ২৫০ আসনের মধ্যে ১১৪টিতে জয়লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অন্যান্য প্রদেশ মুসলিম লীগের অবস্থান ছিল: সিন্ধু প্রদেশ: ২৮/৬০, পাঞ্জাব: ৭৫/১৭৫, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ: ১৭/১৫০, যুক্তপ্রদেশ: ৫৪/২২৮, বিহার প্রদেশ: ৩৪/১৫২, আসাম: ৩১/১০৮, বোম্বে প্রেসিডেন্সি: ৩০/১৭৫, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি: ২৯/২১৫ এবং ওড়িশা প্রদেশ: ৪/৬০।[২] অর্থাৎ, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে বিপিএমএল-এর ৪৫% আসন লাভ করাই ছিল এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে সবচেয়ে বড় সাফল্য। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভাই ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।[৩] সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা গঠনের একটি প্রস্তাব দিলেও মাউন্টব্যাটেন প্ল্যান তা বিবেচনায় নেয়নি। নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর পরিকল্পনার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এবং নাজিমউদ্দিনের সহযোগী- জিন্নাহর কাছ থেকেও সোহরাওয়ার্দী এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা পাননি।[৪]