बर'/बड़ो [১] | |
---|---|
![]() ঐতিহ্যবাহী পোশাকে বড়ো বিসগু নাচ | |
মোট জনসংখ্যা | |
১৪.৫ লাখ [২] (২০১১) | |
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল | |
আসাম | ১৪.১ লাখ [৩] (২০১১) |
ভাষা | |
বড়ো এবং অসমীয়া | |
ধর্ম | |
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুধর্ম সংখ্যালঘু বাথৌ ধৰ্ম, খ্রিস্টধর্ম |
বড়ো জনগোষ্ঠী (बर'/बड़ो [bɔɽo]) হচ্ছে আসাম-এর ভৈয়ামের জনগোষ্ঠী। আসামের ভৈয়ামে বাস করা জনগোষ্ঠীদের মধ্যে এরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।[৪] বড়োদের মাতৃভাষা বড়ো ভাষা। বড়োরা বৃহৎ মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
প্রাচীন কালের হিমালয়ের উত্তরে এবং চিনের পশ্চিমে অবস্থিত "বড" দেশের নাগরিকদের এই জনগোষ্ঠীটি খ্রীঃপূঃ প্রায় ১৫ শ শতকে মানতেই সমগ্র পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। মহাভারতে উল্লেখ করা কিরাতরাই পূর্ব ভারতের বড়োরা। প্রাচীনকালে এই মূল "বড" দেশের নাগরিকদের "বডো-ফিচা" বা "বডোচা" ("বডো" মানে ভূমি এবং "ফিচা" বা "চা" মানে সন্তান অর্থাৎ বড দেশের সন্তান) বলে পরিচিত ছিল এবং সময়ের স্রোতে বড বা বড়ো হিসাবে পরিচিত হয়।
আসামের কোকরাঝার, চিরাং, বাক্সা এবং ওদালগুড়ি জেলায় বড়োদের মূল বসতি। তদুপরি কার্বি আংলং গোয়ালপাড়া জেলায়ও কিছু সংখ্যক বড়ো লোকেরা বাস করেন। তদুপরি পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল এমনকি ভুটান-নেপালেও বড়ো জনগোষ্ঠী পাওয়া যায়।
লোক ঐতিহ্য থেকে বোরো মানুষের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা যায়। পদ্মভূষণ বিজয়ী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে , পৌরাণিকভাবে, বড়োরা হলেন "বিষ্ণু ( বরাহ ) এবং মা-পৃথিবীর ( বসুমতী ) পুত্রের সন্তান " যাদের মহাকাব্য যুগে "কিরাতস" বলা হত।[৫]
বড়ো ভাষা চীন-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য । এটি চীন-তিব্বতি পরিবারের তিব্বত-বর্মন ভাষা শাখার বোরো-গারো গোষ্ঠীর অন্তর্গত। এটি আসাম রাজ্য এবং ভারতের বোডোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অঞ্চলের একটি সরকারী ভাষা ।[৬] এটি ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে তালিকাভুক্ত বাইশটি ভাষার মধ্যে একটি ।[৭]
বড়োরা মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর তিব্বত-বর্মীয় ভাষা-ভাষী লোক। এরা বিশেষভাবে শৈব পন্থার সাথে জড়িত বাথৌ পন্থীয় লোক যদিও তাঁদের মধ্যে কিছুসংখ্যক সনাতন, বৈষ্ণব ইত্যাদি বিভিন্ন ধারা এবং খ্রিস্টধর্মীয় লোকও আছে। তাঁদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক যদিও মাতৃতান্ত্রিক (মাসারী) সমাজ ব্যবস্থাও কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিলক্ষিত হয়। বিয়ের পর কনেই বরের ঘরে বাস করেন এবং সন্তান সন্ততি বাবার উপাধি গ্রহণ করেন। অবশ্য অন্য জনজাতীয় সমাজে প্রচলিত না থাকা সগোত্রীয় বিবাহ বড়োদের মধ্যে প্রচলন আছে।
বড়োরা সমাজ করে বাস করেন। তাঁরা পরম্পরাগতভাবে পাঁচটা সমাজ বন্ধনে, অর্থাৎ অগরবাদ, ফংছথবাদ, দাউঁচুিবাদ, খাওঁয়ালিবাদ এবং খৌলৌবৌদবাদ এই 'আচারবা'য় সমাজ পরিচালনা করেন। [৮]
বড়োদের মধ্যে চাংঘর, ঝুমচাষ ইত্যাদির প্রচলন নেই। তাঁরা ঘর-বাড়ি উন্মুক্ত করে মাঝে একটি চোতাল রেখে চারিদিক তৈরি করে। চোতালটির উত্তর-পূর্ব দিকে সিজু গাছ পুঁতে সেখানে পাঁচটা বাঁশের টাটী-চকোয়ার ঘিরে 'বাথৌশালী' প্রতিষ্ঠা করা থাকে। আদর্শ বড়ো বরঘরের (নেমানো) কুঠরি তিনটি: ইসিং, উঁচুং এবং খফ্রা।
বড়ো তিরোতাদের প্রত্যেকেই এক পাকৈত দাবনী, রোবনী, মাছুবয়ে এবং রান্ধনী। এড়ী পালন এবং এড়ী সূতা কাটা বড়ো নারী অতিশয় সুদক্ষ। কাপড়বোনা না জানা 'আলুরি' মেয়ে বিয়ের বাজারে মূল্যহীন। তাঁরা ভাল শিপিণী এবং নাচনীও।
বড়োরা প্রধানত কৃষিজীবী। বড়োদের দোং খনন করিয়ে মাঠে আল বেঁধে করা শালিচাষের প্রবর্তক বলা হয়। কৃষির সাথে জড়িত নানান ধরনের লোকাচার, যেমন: ন-আগ আনা, ন-গাছা দেয়া, ন-ভাত খাওয়া, কাতি গাছআ ছাওনায় (রঙালী বিহুতে ঔখোলে মাঠে বাতি জ্বালানো), শইচ চপওয়া এবং মাঘবিহুতে বেলাগুর (মেজি) খোয়া, ব'হাগ বিহুতে গরুকে গা ধোওয়ানো ইত্যাদির উদ্ভাবক এরাই বলে পণ্ডিতদের ধারণা।[৮]
রন্ধন কলাতেও বড়োরা অতি নিপুণ। এদের প্রধান খাদ্য হল ভাত। পচলা, ঢেঁকীয়া, কচুথোর, লফা, বাঁশগাজ, খরিচা ইত্যাদি ব্যঞ্জন মঙ্গোলীয় সংস্কৃতির দান। শুকান মাছ (নাফাম), শুকান মাংস, শুক্তা ইত্যাদি তাঁদের উদ্ভাবন। জুমায়, জৌফিথিখা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের লাওপানী, কোমল চাউল, ভাপপিঠা, চোঙাপিঠা, টোপোলা পিঠা, খারলি-কাঁহুদি ইত্যাদি রুচিকর খাদ্য প্রস্তুত করায় তাঁরা সিদ্ধহস্ত। [৮]
বড়ো তিরোতা বুকে দখনা (মেঠনি) মারে বা মেখেলা-চাদর পরে, গায়ে ফাছ্রা নিয়ে ঘিলাখোপা খোপায় একটাকরে কাকৈ গুজে নিয়ে সাজি-কাচি ভাল করে। তাঁদের মধ্যে প্রিয়জনের সাথে ঘর সংসার করতে না পারার দুঃখে দেওয়া 'হাংমা-হাংছানি ফালি' নামের রুমালের ব্যবহার অতিশয় চিত্তাকর্ষক। অন্যদিকে বড়ো পুরুষের বেশভূষা অতি সাধারণ ধরনের। কঁকালে আঁঠুূুমূরীয়া বা আঁঠুচেরা ফখরা-চিতরা গাম্চা (চুরিয়া), গায়ে গাছ্লা (চোলা) আরি ডিঙিতে ফুলাম ফালি (আর'নাই)-এই তিনটিই বড়ো পুরুষের সমস্ত বেশভূষা। [৮]
বড়োদের জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যুর সাথে জড়িত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান আছে। তার মধ্যে সন্তানর নাভি এঁয়াসূতায় বেঁধে বাঁশের চেঁচুতে কাটা, নাভি কাটারপর শান্তি জল ছিটিয়ে প্রায়শ্চিত করা (জাতে তোলা), একবছরের মধ্যে ধাইকে মান ধরা, পাঁচ বছরে মামা দ্বারা চূড়াকরণ করা পর্ব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আদিম ধর্মী বড়োরা 'হাথাছুনি' প্রথায় এবং ব্রহ্ম ধর্মীয় বড়োরা হিন্দুর বৈদিক প্রথায় (বড়ো ভাষার মন্ত্রে) বিয়ে বারু করেন।
বড়ো সমাজে প্রচলিত বিয়ে ছয় প্রকারের:
বড়োর হাথাছুনি প্রথা নাগরিকদের স্বামী-স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া পর্ববিশেষ। সমস্ত প্রকারের বিয়েতে ভোজন পর্বের সময় এই নিয়ম পালন করতে হয়। বড়োর বিয়ের জন্য দুইজন বৈরাথী (ব্রতী) এবং দুইজন আয়থা (এয়োতী) এবং একজন বা দুজন বার-লাম্ফা (ভারী) অতি আবশ্যক। বিয়ের জোরণ দেয়া, অভ্যাগতকে মান ধরা, নানা ধরনের মাঙ্গলিক কার্যে সহায়তা করা এবং নৃত্য-গানের মধ্য দিয়ে গোটা অনুষ্ঠানটিকে সতেজ করে রাখায় এদের ভূমিকা আছে। বার-লাম্ফাই বোকোচাতে মাটির চপরা বেঁধে নেচে নেচে বরকে আগবাড়িয়ে নেয়ার দৃশ্য অতি অপূর্ব এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বড়োদের মধ্যে মৃত্যুর সাথে জড়িত বিভিন্ন লোকাচার এবং লোকবিশ্বাস আছে। মরা সৎকার করার পর শবযাত্রীকে গোবর-জলে শুচি করা এবং শোকোতা চিবিয়ে মৃতের সাথে সমস্ত পার্থিব সম্বন্ধ ছেদ করার বিধান আছে। মৃত্যুর দশ দিনে 'দহা গার্নায়' (দশা ফেলানো) পর্ব এবং বারো দিনে শ্রাদ্ধ করে। [৮]
বড়োদের মধ্যে তন্ত্র-মন্ত্র, ভেল্কি বাজি, ডাকিনী-যোগিনী (ডায়না), বীরা-ভূত-প্রেতের বিশ্বাস অতি প্রবল। এমনকি মন্ত্রের দ্বারা ভালুকের সাথে সখী সম্পন্ন, বীরা পোহা এবং মেলি দেওয়া ইত্যাদি কার্যও করতে পারে বলে এদের মধ্যে বিশ্বাস প্রচলিত; কিন্তু আজকাল এমন অন্ধবিশ্বাস নেই বলা যায়। বড়োদের মধ্যে প্রচলিত ছুথি দায়নায় (নজর কাটা), খুগা দায়নায় (মুখ ভাঙা), সময় (শপথ খাওয়া), শপথ মোচন, বধ শপথ দেয়া, দরা নেওয়া প্রথায় কিছু স্বকীয়তা থাকলেও অন্যান্য সমাজের সাথে প্রায় একই। [৮]
খাম-ছিফুং-জথা-ছেরাজা এই চারধরনের লোকবাদ্য বিভিন্ন উৎসবে অপরিহার্য। বাগুরুম্বা, বৈছাগু মৈছানায় ইত্যাদি বসন্তকালীন মন উরিঙা করা নৃত্য-গানের সাথে জারআফাগ্লা, থেন্থামালি, খফ্রিমৌছানায় (ঝাঁপি নৃত্য), রৌনচণ্ডী ইত্যাদি ধর্মীয় নৃত্য-গীত এবং দাওহা (যুদ্ধ), না (মাছমারা) ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রমবিষয়ক নৃত্য-গীত বড়ো সমাজে বিদ্যমান। রাওনা-রাওনী, ছন্দ্রমালি-খৌথিয়া বুদাং, আছাগি বৈছাগি, জারা ফাগ্লা ইত্যাদি সাধুকথা; কছিরাম-জৌহৌলাও, জাওলিয়াছৌন দেওয়ান ইত্যাদি কাহিনী গান এবং হওয়া মেথায় (বিহু গান) ইত্যাদি নানা প্রকারের লোকগীত, মন্ত্র-স্তোত্র, ফঁকরা-যোজনা, প্রবচন ইত্যাদি এদের লোকসাহিত্যে ফিরে আসে। [৮]
আসাম-এর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো বড়োরাও প্রজনন এবং উর্বরার প্রতীকরূপে খেরাই উৎসব পালন করেন। এই খেরাই উৎসব বহাগ বিহুর মতো বসন্তকালীন উৎসব৷ এই উৎসবের সাথে জড়িত খেরাই নৃত্য এক ঋতুধর্মী নৃত্য৷ সিজু গাছকে বাথৌ দেবতা হিসাবে গণ্য করে বড়োরা পরম্পরাগতভাবে এই পূজা করে। খেরাই-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এচাম পণ্ডিত এইমত দিয়েছেন, খেরাই হল খার+আই, অর্থাৎ খার মানে হল দৌড়ানো বা গতি এবং আই মানে গোঁসানী। আইমাতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা নৃত্যই হল খেরাই নৃত্য। কোনো কোনো জনের মতে খ-র অর্থ হল আঠু কঢ়া , রা-মানে সম্বোধন করা এবং ই-র অর্থ হল ঈশ্বর-এর উদ্দেশ্যে করা নৃত্য। বাথৌ দেবতার সমুখে বিভিন্ন উপাচার, বলির জীব-জন্তু, পশু-পক্ষী রেখে দেওধনী পূর্বদিকে মুখ করে গমারি কাঠের পীরাতে বসেন। ওজা পরে বসে আঠুতে মন্ত্র বলেন৷ ওজার পরে বুঢ়া-মেথারা বসেন। দেউরী দেওধনীর বাঁদিকে কিছু দূরে বসেন। সেইসময়ে খেরাই নৃত্য চলতে থাকে। পূজা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও নৃত্য চলতে থাকে৷ খাম, চিফুং, রিঙি, রামতাল, ওবা, খোয়াং, বঙ্গনা ইত্যাদি এই নৃত্যে ব্যবহার হওয়া বাদ্যযন্ত্র৷[৯]
বড়োরা বছরে সমজুবা করে একবার গার্জা, একবার খেরাই (বাথৌ) এবং সময়সুবিধা অনুযায়ী ব্যক্তিগত্ভাবে মায়নাওব্রী (লক্ষ্মী), বুর্ল্লিব্রী (কামাখ্যা), মারাই (মনসা)র উদ্দেশ্যে বিশেষ রীতি-নীতি এবং বলি-বাহনে পূজা দেন। খেরাই উৎসব অতি জাক-জমকে উদ্যাপন করেন। আমথিচুবা (অম্বুবাচী), কাতিগাছা (কাতিবিহু), দোমাছি (ভোগালী বিহু), ফুছ্লহাবা (পুতলী বিয়ে), বৈছাগু বা বাইছাগু (ব'হাগ বিহু) ইত্যাদিরও বড়ো সমাজে প্রচলন আছে।
উৎসব-পার্বণে পুরুষের সাথে বড়ো চিখ্লা (কুমারী), আয়থা (এয়োতী), বৈরাথী (নামতী) এবং বয়োবৃদ্ধা লোকের বিশেষ ভূমিকা আছে। খেরাই পূজার দৈদিনী (দেওধানী) এবং বাগরুম্বা ইত্যাদি নৃত্য-গীত নারীকেন্দ্রিক। [৮]