বহিরা

বুহাইরা পাদ্রির সাথে নবির চাচা আবু তালিবের সাক্ষাত

বহিরা বা বুহাইরা (আরবি ভাষায়: بَحِيرَىٰ, সিরীয় ভাষায়: ܒܚܝܪܐ) হলেন একজন খ্রিস্টান পাদ্রি, যিনি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে ইসলামের শেষ নবী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, তাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের উপর ভিত্তি করে।

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

আবু তালিব ব্যবসায়ী ছিলেন এবং আরবদের নিয়ম অনুযায়ী বছরে একবার সিরিয়া সফরে যেতেন। মুহাম্মাদ এর বয়স যখন ১২ বৎসর তখন তিনি চাচার সাথে সিরিয়া যাওয়ার জন্য বায়না ধরলেন। প্রগাঢ় মমতার কারণে আবু তালিব আর নিষেধ করতে পারলেন না। যাত্রাপথে বসরা পৌঁছার পর কাফেলাসহ আবু তালিব তাবু ফেললেন। সে সময় আরব উপদ্বীপের রোম অধিকৃত রাজ্যের রাজধানী বসরা অনেক দিক দিয়ে সেরা ছিল। এই শহরটিতে জারজিস নামক এক খ্রিষ্টান পাদ্রি ছিলেন যিনি বুহাইরা বা বহিরা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি তার গির্জা হতে বাইরে এসে কাফেলার মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। তিনি বালক মুহাম্মাদকে দেখে শেষ নবি হিসেবে চিহ্নিত করেন।[] তিনি নবী (স.) এর হাত ধরে বললেন, আল্লাহ তায়ালা একে রহমাতুললিল আলামিন হিসাবে প্রেরণ করেছেন। আবু তালিব বুহাইরাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আপনারা এই এলাকায় আসার পর এই বালকের সম্মানে এখানকার সব গাছপালা এবং পাথর সেজদায় নত হয়েছে। এরা নবী ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করে না। তাছাড়া মোহরে নবুয়তের দ্বারা আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। তাঁর কাঁধের নীচে নরম হাড়ের পাশে একটি “সেব” ফুলের মতো মজুদ রয়েছে।[][] আমরা তাঁর উল্লেখ আমরা আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে দেখছি।[] ফিজারের যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন নবির বয়স ১৫ বছর। এই যুদ্ধে তিনি পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। অর্থাৎ, তিনি সরাসরি যুদ্ধ না করে, নিজ গোত্রের লোকদের অস্ত্রের যোগান দেয়া সহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন। যুদ্ধের নির্মমতায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। সে সময় থেকেই তিনি কিছু একটি করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তার উত্তম চরিত্র ও সদাচরণের কারণে পরিচিত মহলের সবাই তাকে "আল-আমিন" (আরবি :الامين; অর্থ: "বিশ্বস্ত, বিশ্বাসযোগ্য, আস্থাভাজন") "আল-সিদ্দিক" (অর্থ: "সত্যবাদী") বলে সম্বোধন করতেন।[][]

হাদিসে উল্লেখ

[সম্পাদনা]

সুনান আত-তিরমিজির একটি সহিহ হাদিসে বিস্তারিত ঘটনাটি এসেছে,

আবূ মূসা আল-আশ’আরী (রাযিঃ) বলেনঃ কিছু প্রবীণ কুরাইশসহ আবূ তালিব (ব্যবসার উদ্দেশে) সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে রওয়ানা হন। তারা (বুহাইরাহ) পাদ্রীর নিকট পৌছে তাদের নিজেদের সওয়ারী থেকে মালপত্র নামাতে থাকে, তখন উক্ত পাদ্রী (গীর্জা থেকে বেরিয়ে) তাদের নিকটে এলেন। অথচ এ কাফিলা এর আগে অনেকবার এখান দিয়ে চলাচল করেছে কিন্তু তিনি কখনও তাদের নিকট (গীর্জা) বেরিয়ে আসেননি বা তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেননি। রাবী বলেন, লোকেরা তাদের বাহন থেকে সামানপত্র নামাতে ব্যস্ত থাকাবস্থায় উক্ত পাদ্ৰী তাদের (তাঁবুর) ভেতরে ঢোকেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাত ধরে বলেন, ইনি “সাইয়্যিদুল আলামীন” (বিশ্ববাসীর নেতা), ইনি রাসূল রাব্বিল আলামীন (বিশ্ববাসীর প্রতিপালকের রাসূল) এবং আল্লাহ তা’আলা তাকে রহমাতুল্লিল আলামীন করে (বিশ্ববাসীর জন্য করুণা স্বরূপ) পাঠাবেন।

তখন কুরাইশদের বৃদ্ধ লোকেরা তাকে প্রশ্ন করে, কে আপনাকে জানিয়েছে? তিনি বলেন, যখন তোমরা এ উপত্যকা হতে নামছিলে, (তখন আমি লক্ষ্য করেছি যে,) প্রতিটি গাছ ও পাথর সিজদায় লুটিয়ে পড়ছে। এই দুটি নবী ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টিকে সিজদা করে না। এতদভিন্ন তার ঘাড়ের নিচে আপেল সদৃশ গোলাকার মোহরে নবুওয়াতের সাহায্যে আমি তাকে চিনেছি। খাদ্যদ্রব্যসহ যখন তাদের নিকটে এলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের পাল চরাতে গিয়েছিলেন। পাদ্রী বলেন, তোমরা তাকে ডেকে আনার ব্যবস্থা কর। অতএব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন, তখন একখণ্ড মেঘ তার উপর ছায়া বিস্তার করেছিল এবং কাফিলার লোকেরা যারা তার পূর্বেই এসেছিল তাদেরকে তিনি গাছের ছায়ায় বসা অবস্থায় পেলেন।

তিনি বসলে গাছের ছায়া তার দিকে ঝুকে পড়ে। পাদ্রি বলেন, তোমরা গাছের ছায়ার দিকে লক্ষ্য কর, ছায়াটি তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। রাবী বলেন, ইত্যবসরে পাদ্রী তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদেরকে শপথ দিয়ে বলেছিলেন, তোমরা তাকে নিয়ে রোম সাম্রাজ্যে যেও না। কেননা রূমীয়রা যদি তাকে দেখে তাহলে তাকে চিহ্নগুলোর দ্বারা সনাক্ত করে ফেলবে এবং তাকে মেরে ফেলবে। এমতাবস্থায় পাদ্রী লক্ষ্য করেন যে, রূমের সাতজন লোক তাদের দিকে আসছে। পাদ্রী তাদের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রশ্ন করেন, তোমরা কেন এসেছ? তারা বলে, এ মাসে আখিরী যামানার নবীর আগমন ঘটবে। তাই চলাচলের প্রতিটি রাস্তায় লোক পাঠানো হয়েছে, তাই আমাদেরকে আপনাদের পথে পাঠানো হয়েছে।

পাদ্রী রোমীয় নাগরিকদের প্রশ্ন করেন, তোমাদের পেছনে তোমাদের চেয়েও ভাল কোন ব্যক্তি আছে কি (কোন পাদ্রী তোমাদেরকে এই নবীর সংবাদ দিয়েছ কি)? তারা বলল, আপনার এ রাস্তায়ই আমাদেরকে ঐ নবীর আসার খবর দেয়া হয়েছে। পাদ্রী বলেন, তোমাদের কি মত, আল্লাহ তা’আলা যদি কোন কাজ কারার ইচ্ছা করেন তবে কোন মানুষের পক্ষে তা প্রতিহত করা কি সম্ভব? তারা বলল, না (অর্থাৎ শেষ যামানার নবীর আগমন ঘটবেই, কোন মানুষ তা ঠেকাতে পারবে না)।

রাবী বলেন, তারপর তারা তার নিকট আনুগত্যের শপথ করে এবং তার সাহচর্য অবলম্বন করে। তারপর পাদ্রী (কুরাইশ কাফিলাকে) আল্লাহর নামে শপথ করে প্রশ্ন করেন, তোমাদের মধ্যে কে তার অভিভাবক? লোকেরা বলল, আবূ তালিব। পাদ্রী আবূ তালিবকে অবিরতভাবে আল্লাহ তা’আলার নামে শপথ করে তাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আবূ তালিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে (মক্কায়) ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং আবূ বকর (রাযিঃ) বিলাল (রাযিঃ)-কে তার সাথে দেন। আর পাদ্রী তাকে পাথেয় হিসেবে কিছু রুটি ও যাইতুনের তৈল দেন।[][]

সমালোচনা

[সম্পাদনা]

ইমাম আয যাহাবি (রহ.) বহিরা সম্পর্কিত সকল ঘটনা, এমনকি বহিরার অস্তিত্বকে মিথ্যা এবং বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন,

আবু বকর (রা.) [মুহাম্মাদ (স.) এর আবু তালিবের সঙ্গে ভ্রমণের সময়] কোথায় ছিলেন? তাঁর বয়স তখন মাত্র ১০ বছর, মহানবীর চেয়ে ২.৫ বছর ছোট। আর বিলাল (রা.) সেই সময় কি করছিলেন? আবু বকর তাকে সেই সময় কিনেছিল যখন নবী ৪০ বছর বয়সী ছিলেন—বিলাল তো তখনও জন্মাননি! তাছাড়া, যদি একটা মেঘ মুহাম্মদ (স.) এর ওপর ছায়া ফেলতো, তাহলে কিভাবে গাছের ছায়া [তার নিচে] নড়ল? কারণ মেঘের ছায়া তো গাছের ছায়াকে ঢেকে রাখবে যেখানে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। আমরা দেখি না কোথাও নবী (স.), আবু তালিবকে সেই পাদ্রির কথা কখনও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এবং কুরাইশও তাকে তা মনে করিয়ে দেয় নি, এবং তাদের মধ্যে কেউ এই গল্পও উদ্ধৃতিও করেন না, যদিও তারা এর জন্য খুবই আগ্রহী ছিল। যদি ঘটনাটি সত্যিই ঘটে থাকে, তবে এটি তাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হতো। তাছাড়া, নবী তার নবুওতের ব্যাপারে সচেতন থাকতেন এবং তাই তিনি প্রথম প্রকাশিত অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্দেহ করতেন না। সে কারণে তার নিজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ থাকতো না এবং খাদিজার কাছে যাওয়ারও সুযোগ থাকতো না, আর পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়ে যাওয়ার জন্য যেতেন না। যদি আবু তালিব নবীর জীবন নিয়ে এত চিন্তিত হতেন যে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, তাহলে পরে কিভাবে তিনি খাদিজা (রা.) 'র পক্ষ থেকে বাণিজ্য করতে সিরিয়া ভ্রমণের অনুমতি দিতে রাজি হলেন?[]

বাহিরার সাথে মুহাম্মদ (স.) এর সাক্ষাতের সকল বিবরণ, আধুনিক ইতিহাসবিদরা কাল্পনিক হিসেবে বিবেচনা করেছেন।[১০][১১][১২][১৩]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Armand Abel, Bahira, Encyclopaedia of Islam
  2. "সহীহ শামায়েলে তিরমিযী | হাদিস: ১৩"www.hadithbd.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১০ 
  3. "মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) | হাদিস: ৫৭৭৯"www.hadithbd.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১০-১০ 
  4. সীরাতুন্নবী (সাঃ) – আর রাহীকুল মাখতূম 
  5. Khan, Majid Ali (১৯৯৮)। Muhammad the final messenger (ইংরেজি ভাষায়) (1998 সংস্করণ)। India: Islamic Book Service। পৃষ্ঠা 332। আইএসবিএন 81-85738-25-4 
  6. Esposito (1998), p. 6
  7. সুনান আত-তিরমিজী, হাদিস নং ৩৬২০
  8. মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ৫৯১৮
  9. Anthony 2020, পৃ. 73।
  10. Roggema 2008, পৃ. 52।
  11. Gabriel 2007, পৃ. 56।
  12. Watt 1961, পৃ. 9।
  13. Rodinson 2021, পৃ. 47।