জীবাশ্ম জ্বালানির সাথে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা শক্তির মূল পার্থক্য হল শক্তির উৎসটির নবায়নযোগ্যতা, তথা যে উৎসটি ব্যবহার করা হবে সেটি যাতে সহজে নিঃশেষ না হয়ে যায়। জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদির ব্যবহারের সাথে সাথে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায়। অপরদিকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ ইত্যাদি ব্যবহারের সাথে সাথে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায় না। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার ও এর উন্নয়ন নিশ্চিত জন্য করতে ২০০৮ সালের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি কার্যকর হয়।[১][২] টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ - স্রেডা এক্ট-২০১২ প্রনয়ন করে বাংলাদেশ সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসাবে সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়ো ফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ ইত্যাদিকে শনাক্ত করেছে।[৩] এই কার্যক্রমের আওতায় বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত জ্বালানির ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।[৪]
বাংলাদেশে প্রথম বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার শুরু হয় বিংশ শতকের শুরু দিক থেকে। তৎকালীন ঢাকার নবাব অর্থায়নে ঢাকার রাস্তায় বিদ্যুতের বাতি জ্বলতে শুরু করে ১৯০১ সাল থেকে।[৫] বিদ্যুৎ ব্যবহারের ইতিহাস পুরানো হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানী নীতিমালা কার্যকর করা হয় বিদ্যুৎ ব্যবহার শুরুর ১০০ বছর পরে একবিংশ শতকে।[১] যদিও বা বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনক্ষম নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয় বিংশ শতকের ষাঠের দশকে।[৬] যা পূর্ণ কর্মক্ষমতা অর্জন করে বিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে।
বিংশ শতকের শেষের দিক থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর অন্যান্য উৎস যেমন সৌরশক্তি বাংলাদেশে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বেসরকারী উদ্দ্যোগে ১৯৯৬ সাল থেকে গ্রামীণ শক্তি নামে একটি প্রতিষ্ঠান নবায়নযোগ্য জ্বালানির সুবিধা দিতে কাজ শুরু করে।[৭] তবে সৌরশক্তির অধিকাংশ ব্যবহারই শুরু হয় ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহার, যা জাতীয় গ্রীডের বাইরে।[৮]
জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রধানত পানির মধ্যে জমা হওয়া বিভব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেনারেটরের সাথে যুক্ত থাকা টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কোন বস্তুর মধ্যে জমা হওয়া বিভব শক্তির পরিমাণ ভূপৃষ্ঠ থেকে বস্তুর উচ্চতার উপর নির্ভর করে। বস্তুর উচ্চতা যত বেশি, বিভব শক্তির পরিমাণ তত বেশি। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে সাধারণ পানি আটকানোর বাঁধ প্রধান করা হয় পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করতে। পরবর্তীতে উঁচু স্থান থেকে ছেড়ে দেয়ায় পানির মধ্যে থাকা বিভব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একমাত্র কেন্দ্রটি হল কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
চট্রগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয়। পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। কাপ্তাই বাঁধের কারণে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায় যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ, এর ফলে সৃষ্টি হয় কাপ্তাই হ্রদ। ১৯৬২ সালে এটির নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পর এতে দুটি ৪০ মেগাওয়াটের জেনারেটর স্থাপন করা হয়। ১৯৬৯ সালের ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ শুরু হয়। ৩ নম্বর ইউনিটের কাজ ১৯৮২ সালে শেষ হয়। ৪র্থ ও ৫ম ইউনিটের কাজ শেষ হয় ১৯৮৮ সালে। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট।[৬][৯]
পানির প্রবাহ ছাড়া আর কোনো জ্বালানি না লাগায় কাপ্তাই কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের একমাত্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ২৫ পয়সারও কম। কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেটিকে ২০১৫ সালের জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যা ছিল সর্বোচ্চ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বীকৃতি।[১০]
বায়ুর গতিশক্তি কে কাজে লাগিয়ে জেনারেটরের টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে বায়ু যখন টারবাইনের ব্লেডের মধ্যে দিয়ে যায় তখন বায়ুর গতিশক্তি ঐ ব্লেডগুলোকে ঘুরায়। আর ঐ ব্লেডগুলোর সাথে রোটর সংযুক্ত থাকে যা ব্লেডগুলোর ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়। এই রোটর জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে যার ঘূর্ণনের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় সোনাগাজীতে অবস্থিত মুহুরী প্রজেক্টে। মুহুরী প্রজেক্ট হল বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। ফেনীর মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ছয় একর জমির উপর স্থাপিত এটি। মুহুরী প্রজেক্ট বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অবস্থিত ৪টি ২২৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন টারবাইন দিয়ে প্রায় এক মেগাওয়াট (০.৯) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।[১১][১২]
২০১৭ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় চালু হয় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বায়ু চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।[১৩] বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশে পাশের প্রায় ৫৫০ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।[১৪][১৫] সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণে আলী আকবরের ডেল এলাকায় বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশে এখন ছয়টি প্রতিষ্ঠান সোলার প্যানেল তৈরি করছে। তাই এ প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য। তাই গ্রামের অনেকে নিজেদের চাহিদা মেটাতে সৌর বিদ্যুত্ ব্যবহার করে।বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অধিকাংশ জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া ২১১.৪৬ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুতের মধ্যে ২০১.৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতই জাতীয় গ্রীডের বাইরে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লক্ষ সোলার হোম সিস্টেম যার পরিমাণ প্রায় ১৭৮.৮৬ মেগাওয়াট। আরো রয়েছে প্রায় ৫০০টি সোলার পাম্প যাতে ব্যবহৃত হচ্ছে ৬.৪৩ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ।[১৬] বাংলাদেশে ২০১৭ সালের মধ্যে ১৫৫০টি সোলার ইরিগেশন পাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিঃ।[১৭]
২০১৭ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎস থেকে রূপান্তরিত বিদ্যুৎ এর পরিমাণ
ব্যবহ্রত নবায়নযোগ্য জ্বালানি | জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত বিদ্যুতের পরিমাণ
মেগাওয়াট |
জাতীয় গ্রীডের সাথে সংযুক্ত নয় বিদ্যুতের পরিমাণ
মেগাওয়াট |
মোট পরিমাণ
মেগাওয়াট |
---|---|---|---|
সৌরশক্তি | ১০.৫৬ | ২০১.৪০ | ২১১.৯৬ |
বায়ুশক্তি | ০.৯০ | ০২ | ২.৯০ |
জলবিদ্যুৎ | ২৩০ | - | ২৩০ |
বায়োগ্যাস থেকে বিদ্যুৎ | - | ০.৬৮ | ০.৬৮ |
বায়োমাস থেকে বিদ্যুৎ | - | ০.৪০ | ০.৪৮ |
মোট পরিমাণ | ২৪১.৪৬ | ২০৪.৪৮ | ৪৪৫.৯৪ |
|তারিখ=
(সাহায্য)
|প্রথমাংশ1=
এর |শেষাংশ1=
নেই (সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|ওয়েবসাইট=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)