বোলিং কৌশল |
---|
ধারাবাহিকের একটি অংশ |
ক্রিকেট খেলায়, বাউন্সার (অথবা বাম্পার) হচ্ছে এক ধরনের শর্ট-পিচ্ড ডেলিভারি, যা সাধারণত কোন দ্রুতগতির বোলার কর্তৃক নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। এ ধরনের বল মাটিতে পড়ে লাফিয়ে ওঠে এবং ব্যাটসম্যানের মাথার সমান উচ্চতায় ব্যাটিং প্রান্তে পৌঁছায়।
বাউন্সার দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোন ব্যাটসম্যানকে তার পেছনের পায়ে ভর দিয়ে খেলতে বাধ্য করা, বিশেষ করে, যদি ঐ ব্যাটসম্যান সামনের পায়ে খেলে উন্মুক্তভাবে শট খেলে (যেমন- ড্রাইভ) রান নিতে থাকেন। বাউন্সার সচরাচর ব্যাটসম্যানের শরীরের রেখা লক্ষ্য করেই ছোঁড়া হয়। ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে বাউন্সার ছোঁড়া বৈধ হবে যদি তা ব্যাটসম্যানের কাছে পৌঁছানোর আগে পিচের ওপর পড়ে (বাউন্স করে), অথবা ব্যাটসম্যানের কাছে পৌঁছানোর সময় বলের উচ্চতা, ব্যাটসম্যানের কোমরের উচ্চতার চেয়ে নিচে থাকে। ব্যাটসম্যানের মাথা বরাবর লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত বল পিচে না পড়ে সরাসরি অপর প্রান্তে পৌঁছালে তাকে বিমার বলা হয়; যা অবৈধ।
কোন ব্যাটসম্যান রক্ষণাত্মক কিংবা আক্রমণাত্মকভাবে বাউন্সার মোকাবেলা করতে পারেন। যদি কোন ব্যাটসম্যান রক্ষণাত্মকভাবে খেলেন, তাহলে তিনি প্রথমত আউট হওয়া এড়ানোর চেষ্টা করেন, এবং দ্বিতীয়ত, বলের আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। মাথার সমান উচ্চতার বাউন্সার এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলা। যদি বাউন্সার বুক সমান উচ্চতার হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাটসম্যানের জন্য সেরা প্রতিরোধ হচ্ছে, নিজের ব্যাটটি লম্বালম্বিভাবে বুক সমান উচ্চতায় তুলে বলটিকে এমনভাবে ঠেকানো যেন তা ব্যাটে লেগে নিম্নমুখীভাবে পিচের ওপর পড়ে; তা না হলে বলটি ব্যাটে লেগে লাফিয়ে উঠে ফিল্ডারের জন্য ক্যাচ লুফে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। কখনো কখনো ব্যাট দিয়ে বলটি ঠেকানোর জন্য, ব্যাটসম্যানকে লাফিয়ে পর্যাপ্ত উচ্চতায় উঠতে হয়। ব্যাটসম্যান বলের রেখা থেকে সরে গিয়েও বাউন্সার এড়াতে পারেন। বাউন্সার দ্বারা কোন বোলার একজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে কিছুটা হলেও ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা করেন এবং প্রত্যাশা করেন যে, বলটি একটি অসুবিধাজনক কোণে ব্যাটে লেগে কাছাকাছি থাকা কোন ফিল্ডারের জন্য ক্যাচ এর সুযোগ করে দেবে।
অন্যদিকে, বাউন্সার একজন ব্যাটসম্যানের জন্যও ফলদায়ক হতে পারে যদি সে আক্রমণাত্মকভাবে খেলে। আক্রমণাত্মকভাবে বাউন্সার মোকাবেলা করার জন্য হুক শট খেলা হয়ে থাকে। হুক শট খেলার জন্য, বল নিক্ষেপকালে ব্যাটসম্যান তার পেছনের পা পেছনের দিকে ও অফ-সাইড অভিমুখে সরান। বলটি যখন তার দিকে আসতে থাকে, তখন তিনি দ্রুত অফ-সাইড থেকে লেগ-সাইড এর দিকে ঘুরে যান; তার ব্যাটটি তখন অনুভূমিকভাবে ধরা থাকে। তার লক্ষ্য থাকে বলটিকে সজোরে লেগ-সাইডের সীমানার অভিমুখে কিংবা ঐ অঞ্চলের ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে পাঠানো। তবে রান করার সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও, হুক শট খেলে অনেক ক্ষেত্রেই আউট হবার সম্ভাবনাও থাকে, বিশেষ করে বল যদি ব্যাটের ওপরের কোণায় লেগে উঠে যায় এবং লেগ-সাইডের কোন ফিল্ডারের হাতে জমা পড়ে। আবার, বাউন্সারের গতিরেখা যদি নির্ভুল না হয় এবং উইকেটের অফ-সাইডমুখী হয়ে ব্যাটসম্যানের নিকট পৌঁছে, তখন ব্যাটসম্যান কাট, আপার-কাট কিংবা লেট-কাট খেলতে পারেন; সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ভূমি অভিমুখী, ফিল্ডারদের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান বরাবর, কিংবা বৃত্তের ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে চার বা ছয় রানের জন্য হতে পারে।[১]
ফাস্ট বোলারদের মধ্যে একটি অলিখিত নিয়মের প্রচলন রয়েছে যে (বিশেষত যখন হেলমেট এর ব্যাপক ব্যবহার যখন প্রচলিত ছিল না), তারা একে অপরের উদ্দেশ্যে বাউন্সার ছুঁড়বেন না। কারণ, অদক্ষ ব্যাটসম্যানদের কার্যকরভাবে বাউন্সার সামলানোর দক্ষতাও কম থাকে এবং এ কারণে তাদের আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।[২] এই নিয়মের অন্যথা "বাউন্সার যুদ্ধ" সূচনা করতে পারে - মানে, পরের ইনিংসে ঐ বোলারকে লক্ষ্য করে প্রতিপক্ষের বোলারগণ আক্রমণাত্মকভাবে শর্ট-পিচ্ড বল ছুঁড়বেন।[৩]
বাউন্সার দ্বারা ব্যাটসম্যানদের গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এবং বোলারদের ক্রমাগত বাউন্সার ছোঁড়া বন্ধ করতে, ক্রিকেটের আইনে একজন বোলার কর্তৃক নিক্ষিপ্ত বাউন্সারের সংখ্যা এবং স্কয়ার লেগ এর পেছনভাগে কতজন ফিল্ডার রাখা যাবে – তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এই আইনগুলোতে ব্যাটসম্যানদের তুলনামূলক দক্ষতাও বিবেচনা করা হয়।
সত্তর থেকে আশির দশকে, প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতি সঞ্চারক কৌশল হিসেবে বাউন্সার ব্যবহৃত হত, বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল কর্তৃক। ১৯৯১ সালে, ভীতি সঞ্চারক কৌশল হিসেবে বাউন্সার দেওয়াকে নিরুৎসাহিত করতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) একটি আইন চালু করে যেখানে বলা হয়, “ওভারপ্রতি একজন ব্যাটসম্যানকে একটি বাউন্সার দেওয়া যাবে”। তবে খেলোয়াড় কিংবা আম্পায়ার, কোন পক্ষই এই আইনকে সাদরে গ্রহণ করেনি; ইংরেজ আম্পায়ার ডিকি বার্ড এই আইনকে “প্রহসনমূলক” বলে উল্লেখ করে বলেন যে, কোন কৌশল ভীতি সঞ্চারক কি–না তা আম্পায়ারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।[৪]
১৯৯৪ সালে, আইসিসি এই আইন সংশোধন করে ওভার প্রতি দুটি বাউন্সারের নিয়ম চালু করে; কোন বোলার দুটির বেশি বাউন্সার দিলে, শাস্তিস্বরূপ দুই রান জরিমানা সহ নো–বল (প্রচলিত এক রানসহ নো–বল এর পরিবর্তে) ঘোষণার বিধান করা হয়।[৫]
২০০১ সালে, একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় প্রতি ওভারে সর্বোচ্চ একটি বাউন্সার বৈধ করা হয় (এবং অতিরিক্ত বাউন্সারের জন্য নো-বল সহ এক রান জরিমানার বিধান করা হয়)।[৬]
২৯ অক্টোবর ২০১২ তারিখে, আইসিসি কর্তৃক একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় ওভার-প্রতি বাউন্সারের সংখ্যা বাড়িয়ে দুটি করা হয়। টি–২০ তে প্রতি ওভারে বাউন্সারের সংখ্যা একটিতেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
ফাস্ট লেগ তত্ত্ব, যেখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও ক্রমাগতভাবে শরীর লক্ষ্য করে বোলিং করা হয় এবং ব্যাটে লেগে লাফিয়ে ওঠা বল ধরার জন্য লেগসাইডের বেষ্টনীতে ক্যাচিং অবস্থানে একাধিক ফিল্ডার রাখা হয়, তা ১৯৩২/৩৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে ইংল্যান্ড ব্যবহার করে, যাকে অস্ট্রেলীয়রা বডিলাইন সিরিজ বলে আখ্যা দেয়। এই বিতর্কিত কৌশল ব্যবহার বন্ধে ক্রিকেটের আইন সংশোধন করা হয়।
১৯৫৪–৫৫ সালে সিডনিতে[৭], ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার ফ্র্যাঙ্ক টাইসন অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড় রে লিন্ডওয়াল-কে উদ্দেশ্য করে বাউন্সার ছোঁড়েন, যার জবাবে লিন্ডওয়ালের ছোঁড়া বাউন্সারে আঘাত পেয়ে টাইসনকে হাসপাতালে যেতে হয়। রাগান্বিত টাইসন ফুলে যাওয়া মাথা নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে, দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৫ রান দিয়ে ৬ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ৩৮ রানের জয় এনে দেন।
১৯৯৪ সালে ওভালে[৮], ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স এর করা বাউন্সার ডেভন ম্যালকম এর হেলমেটে আঘাত করে। ক্রোধান্বিত ম্যালকম দক্ষিণ আফ্রিকানদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমরা এখন ইতিহাস” এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৭ রান দিয়ে ৯ উইকেট নিয়ে তাদের ইনিংস গুঁড়িয়ে দেন।
বাউন্সার একটি আক্রমণাত্মক ডেলিভারি যা ফাস্ট বোলারদের প্রবৃত্তিগত এবং মাথা লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত, যা ব্যাটসম্যানের বুক, ঘাড় কিংবা মাথায় আঘাত করতে পারে।
১৯৬২ সালে, চার্লি গ্রিফিথ এর ছোঁড়া বাউন্সারে ভারতের অধিনায়ক নরি কনট্রাক্টর ডান কানের ঠিক ওপরে আঘাত পান। এতে তার অনেক রক্তপাত ঘটে এবং তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ছয় দিন পর তিনি সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পান এবং দশ মাস পর আবার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন।[৯]
২০০৬ সালে নিজের শততম টেস্ট খেলার সময়, অস্ট্রেলীয় উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান জাস্টিন ল্যাঙ্গার, দক্ষিণ আফ্রিকার মাখায়া এনটিনি’র ছোঁড়া বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত একটি টেস্ট ম্যাচে, অস্ট্রেলীয় বোলার ব্রেট লি’র বাউন্সারের আঘাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শিবনারায়ণ চন্দরপল বেশ কয়েক মিনিটের জন্য অজ্ঞান হয়ে যান।[১০] পাকিস্তানের শোয়েব আখতার এর বাউন্সারের আঘাতে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্যারি কারস্টেন (২০০৩) এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা (২০০৪) উভয়ই চোটপ্রাপ্ত হন; তাদের দুজনকেই মাঠ ছেড়ে যেতে হয়েছিল।[১১]
নভেম্বর ২০১৪ সালে, শেফিল্ড শিল্ড এর খেলা চলাকালে, শন অ্যাবটের ছোঁড়া বাউন্সার অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার ফিলিপ হিউজ এর হেলমেট এর গ্রিল আর খোলকের মধ্য দিয়ে মাথার পাশে আঘাত করে এবং তিনি বেহুঁশ হয়ে যান।[১২] গুরুতর অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তিনি সাবঅ্যারাকনয়েড রক্তক্ষরণ এ ভুগছিলেন। তিনি আর চেতনা ফিরে পাননি এবং দু’দিন পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[১৩]
২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালে, জফ্রা আর্চারের বাউন্সার অস্ট্রেলিয়ার অ্যালেক্স ক্যারি’র থুতনিতে লাগে ও তার হেলমেট মাথা থেকে খুলে যায়; ক্যারি অবশ্য আউট হওয়া ঠেকাতে নিজের হেলমেটটি বাতাসে ভাসমান অবস্থাতেই ধরে ফেলেন।
২০১৯ সালের অ্যাশেজ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট চলাকালে, জফ্রা আর্চারের ৯২.৪ মাইল প্রতি ঘণ্টা (১৪৮.৭ কিমি/ঘ) বেগে ছোঁড়া বাউন্সার স্টিভেন স্মিথের ঘাড়ে আঘাত করে। মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে স্মিথ আহত অবসর নিয়ে মাঠ ছাড়েন; ৪৫ মিনিট পর তিনি আবার মাঠে ফেরেন।[১৪] মস্তিষ্কে চোট বিষয়ক দাতব্য সংস্থা হেডওয়ে , অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক দল কর্তৃক স্মিথকে আবার খেলায় ফিরতে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে “অত্যন্ত ভয়ানক” বলে সমালোচনা করেন।[১৫] কোন টেস্ট খেলায় প্রথম মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে বদলি হিসেবে, মার্নাস লাবুশেন, স্মিথের স্থলে মাঠে নামেন।[১৬]