বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ হল ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে নর্মদা নদী উপত্যকায় নদীগর্ভের এক ধরনের পাথর। এই জাতীয় পাথর হিন্দু শৈব ও স্মার্ত সম্প্রদায় শিবলিঙ্গ হিসেবে পূজা করে। এই পাথরগুলি মসৃণ উপবৃত্তাকার। বাণলিঙ্গকে "স্বয়ম্ভু লিঙ্গ" বা ঈশ্বরের সাক্ষাৎ চিহ্ন মনে করা হয়। কারণ, এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়।[১][২]
হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, প্রাচীনকালে বাণ নামে এক অসুর প্রতিদিন শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে পূজা করতেন। এইভাবে দীর্ঘদিন শিবপূজার ফলে শিব তাকে দর্শন দিয়ে একটি বর দিতে চান। বাণ বলেন, প্রতিদিন তাকে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করতে বেশ কষ্ট পেতে হয়। তাই বর হিসেবে তিনি উত্তম লক্ষণযুক্ত শিবলিঙ্গ চান। শিব চোদ্দো কোটি শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে বাণকে দেন। বাণ সেগুলি পেয়ে মনে ভাবেন, এগুলি পূজায় যখন বিশেষ ফল পাওয়া যায়, তখন এগুলি সর্বসাধারণের কল্যাণের কাজেই ব্যবহার করা উচিত। এই ভেবে তিনি তিন কোটি লিঙ্গ কালিকাগর্তে, তিন কোটি লিঙ্গ শ্রীশৈলে, এক কোটি কন্যাশ্রমে, এক কোটি মহেশ্বর ক্ষেত্রে এবং অবশিষ্ট লিঙ্গগুলি বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে স্থাপন করেন। বাণ নামক অসুরের দ্বারা পূজিত বলে (মতান্তরে শিবের অপর নাম বাণ বলে) এই লিঙ্গগুলি বাণলিঙ্গ বা বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত হল।[৩]
নর্মদা নদীর অপর নাম "রেবা" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত "রেব" শব্দ থেকে, যার অর্থ পাথুরে নদীগর্ভ। এই নদীর গর্ভে যে বাণলিঙ্গ পাওয়া যায় তার উল্লেখ আছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, টলেমির রচনা ও পেরিপ্লাস গ্রন্থে।[৪] বায়ু পুরাণ ও স্কন্দ পুরাণ-এর রেবা খণ্ড অধ্যায়ে নর্মদা নদীর জন্ম ও গুরুত্বের বর্ণনা পাওয়া যায়। কথিত আছে, নর্মদা নদী শিবের অঙ্গ থেকে উৎসারিত। "নর্মদা" শব্দের অর্থ আলোকদাত্রী। তাকে "শঙ্করী"ও (শিবের কন্যা অর্থে) বলা হয়।
উত্তর ভারতের একটি প্রচলিত প্রবাদ হল "নর্মদা কে কঙ্কর সে উঠা শঙ্কর" (নর্মদার পাথর শিবের মূর্ত রূপ)। বাণলিঙ্গ তাই হিন্দুরা দৈনিক উপাসনার পর পূজা করেন। বৈষ্ণবদের কাছে শালগ্রাম শিলা যেমন বিষ্ণুর প্রতীক রূপে পূজিত হয়, শৈব ও স্মার্ত মতাবলম্বীরা তেমনি শিবের প্রতীক রূপে বাণলিঙ্গ পূজা করেন।
নর্মদা নদী দর্শনকে হিন্দুরা গঙ্গা স্নানের সমতুল্য মনে করেন। বৃহৎ বৈবর্ত পুরাণ নামে এক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে তিন প্রকার লিঙ্গের উল্লেখ করা হয়েছে - স্বয়ম্ভুব (স্বপ্রতিষ্ঠিত), বাণলিঙ্গ ও শৈললিঙ্গ (পাথরের লিঙ্গ)। এগুলিকে যথাক্রমে ব্যক্ত, অব্যক্ত ও ব্যক্ত্যাব্যক্ত বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মতত্ত্বে বলা হয়, ব্যক্ত লিঙ্গ মোক্ষদায়ী, অব্যক্ত লিঙ্গ আনন্দবর্ধনকারী এবং ব্যক্তাব্যক্ত লিঙ্গ মোক্ষ ও আনন্দ দুইই দেন।
শৈব সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোষ্ঠী পার্থিব শিবলিঙ্গ, কণ্ঠস্থললিঙ্গ, স্ফটিকলিঙ্গ, বাণলিঙ্গ, পঞ্চসূত্রী লিঙ্গ, পাষাণলিঙ্গ ইত্যাদি নানা ধরনের লিঙ্গ পূজা করেন।[৫]
বাণলিঙ্গ হিন্দুধর্মের পঞ্চায়তন পূজা বা পঞ্চদেবতা পূজার একটি অঙ্গ। অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু দার্শনিক আদি শঙ্কর হিন্দুধর্মের সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য পাঁচটি প্রধান হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতার পূজাকে ব্যক্তির ইষ্টদেবতা পূজার অঙ্গ হিসেবে প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে শিবের পূজা প্রবর্তিত হয়েছিল নর্মদা নদীতে প্রাপ্ত বাণলিঙ্গের উপর।[৬][৭]
হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, বাণলিঙ্গ ক্ষত্রিয়দের বিরাট রাজ্য এবং অন্য সকলের সব ধরনের ইচ্ছা পূর্ণ করে। [৮]
শৈবধর্ম |
---|
সংক্রান্ত একটি ধারাবাহিকের অংশ |