বাধ্যতামূলক অবায়বীয় (ইংরেজি: Obligate anaerobes) বলতে ঐসব অণুজীবকে বোঝায় যেগুলো স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় ঘনমাত্রার অক্সিজেনের উপস্থিতিতে (২০.৯৫% ) বেঁচে থাকতে পারে না।[১][২] প্রজাতিভেদে এদের অক্সিজেন-সহতায় পার্থক্য দেখা যায়; কোন কোন প্রজাতি প্রায় ৮% অক্সিজেন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যেখানে অন্যান্যরা অক্সিজেনের ঘনমাত্রা ০.৫% এর কম না হলে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।[৩] উল্লেখ্য যে, বাধ্যতামূলক আবায়বীয় অণুজীব আর মাইক্রোঅ্যারোফাইল (microaerophile[৪])এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে - উভয়ই স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডলীয় ঘনমাত্রার অক্সিজেন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, মাইক্রোঅ্যারোফাইল এর শক্তির বিপাক ঘটে সবাত প্রক্রিয়ায়, এবং বাধ্যতামূলক অবায়বীয়দের বিপাক ঘটে অবাত প্রক্রিয়ায়। সুতরাং, মাইক্রোঅ্যারোফাইল এর বৃদ্ধির জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন (সচরাচর ২-১০% ); কিন্তু বাধ্যতামূলক অবায়বীয়দের তার দরকার পড়ে না।[১][৩][৫]
টেস্টটিউবে থায়োগ্লাইকোলেট মাধ্যমে কালচার করে সবাত এবং অবাত ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা যায়:
(১) বাধ্যতামূলক বায়ুজীবীদের অক্সিজেন প্রয়োজন কেননা তারা গাঁজন কিংবা অবাত শ্বসনে অক্ষম। এগুলো টেস্টটিউবের একদম ওপরের অংশে সঞ্চিত হয়, যেখানে অক্সিজেনের ঘনমাত্রা সবচেয়ে বেশি।
(২) বাধ্যতামূলক অবায়বীয় অণুজীবসমূহ অক্সিজেন দ্বারা বিষাক্রান্ত হয়; এজন্য এরা নলের একদম তলায় জমা হয়, যেখানে অক্সিজেনের ঘনমাত্রা সবচেয়ে কম।
(৩) ঐচ্ছিক অবায়বীয়রা বায়ুর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি - উভয় পরিস্থিতিতেই বৃদ্ধি লাভ করতে পারে, কেননা এরা সবাত ও অবাত উভয় প্রক্রিয়াতেই শ্বসনে সক্ষম। এরা ওপরের দিকেই বেশি জমা হয়, কারণ অবাত শ্বসন কিংবা গাঁজনের তুলনায় সবাত শ্বসন থেকেই অধিক হারে এটিপি উৎপন্ন হয়।
(৪) মাইক্রোঅ্যারোফাইল এর অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে কেননা এরা গাঁজন কিংবা অবাত শ্বসনে সক্ষম নয়। তবে, এরা উচ্চ ঘনমাত্রার অক্সিজেনে বাঁচতে পারে না। এরা একদম শীর্ষে না হলেও নলের ওপরের অংশেই জমা হয়ে থাকে।
(৫) বায়ুসহ জীব এর অক্সিজেনের কোন প্রয়োজন পড়ে না এবং অক্সিজেন উপস্থিত থাকলেও এরা তা ব্যবহার করতে পারে না; এরা অবাত উপায়েই শ্বসন ঘটিয়ে থাকে। বাধ্যতামূলক অবায়বীয়দের মত অবশ্য এরা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বিষাক্রান্ত হয় না। এদেরকে টেস্টটিউবে সুষমভাবে বিন্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঐচ্ছিক অবায়বীয় এবং বায়ুসহ জীবসমূহে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে গাঁজন সম্পন্ন হয়, তবে ঐচ্ছিক অবায়বীয়রা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সবাত শ্বসন বেছে নেয় (এই ঘটনা পাস্তুর প্রভাব নামে পরিচিত)। গবেষণাগারে কখনো কখনো পাস্তুর প্রভাব প্রয়োগ করে ঐচ্ছিক অবায়বীয় এবং বায়ুসহ প্রজাতির মধ্যে প্রভেদ নিরূপণ করা হয়ে থাকে।
বাধ্যতামূলক অবায়বীয়সমূহের অক্সিজেন সংবেদনশীলতার পেছনে বেশ কয়েকটি নিয়ামকের সমন্বিত ভূমিকা রয়েছে:
(i) আণবিক অক্সিজেনের সর্ববহিঃস্থ অরবিটালে দুটি মুক্তজোড় ইলেকট্রন থাকে বলে, কোষের অভ্যন্তরে তা সহজেই বিজারিত হয়ে সুপারঅক্সাইড () এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড () এ পরিণত হয়। এসব পদার্থকে বিষমুক্ত করার জন্য বায়ুজীবী জীবসমূহ (aerobic organisms) সুপারঅক্সাইড ডিসমিউটেজ এবং ক্যাটালেজ নামক উৎসেচক তৈরি করে। কিন্তু বাধ্যতামূলক অবায়বীয়রা হয় অতি নগণ্য হারে এসব উৎসেচক উৎপাদন করে, নয়তো একেবারেই করে না।[১][২][৩][৬] বাধ্যতামূলক অবায়বীয়দের অক্সিজেন-সহতার পরিবর্তনশীলতা (০.৫% থেকে ৮.০% ) দ্বারা এদের মধ্যে উৎপন্ন সুপারঅক্সাইড ডিসমিউটেজ এবং ক্যাটালেজ এর পরিমাণের প্রতিফলন ঘটে বলে মনে করা হয়।[২][৩]
(ii) দ্রবীভূত অক্সিজেন কোন দ্রবণের রিডক্স (বিজারণ-জারণ) বিভব বৃদ্ধি করে, এবং উচ্চ রিডক্স বিভব কিছু কিছু বাধ্যতামূলক অবায়বীয়'র বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।[৩][৬][৭] উদাহরণস্বরূপ, রিডক্স বিভব -০.৩ ভোল্ট এর চেয়ে কম হলে মিথেনোজেন অণুজীব বৃদ্ধি লাভ করে।[৭]
(iii) কোন কোন উৎসেচকের ক্ষেত্রে সালফাইড একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, এবং আণবিক অক্সিজেন কর্তৃক তা জারিত হয়ে ডাইসালফাইড গঠন করে। ফলে কিছু কিছু উৎসেচক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় (যেমন- নাইট্রোজেনেজ)। এসব অত্যাবশ্যকীয় উৎসেচক নিষ্ক্রিয় থাকলে জীবের পরিবর্ধন ব্যাহত হতে পারে।[১][৬][৭]
(iv) জৈবসংশ্লেষণের জন্য সমতুল্য বিজারকের অভাবেও বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে, কেননা অক্সিজেনের বিজারণে ইলেকট্রন নিঃশেষিত হয়।[৭]
বাধ্যতামূলক অবায়বীয়রা অবাত শ্বসন অথবা গাঁজন প্রক্রিয়ায় শক্তির বিপাক ঘটায়। সবাত শ্বসনে, গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়া হতে উৎপন্ন পাইরুভেট অ্যাসিটাইল কো-এ তে রূপান্তরিত হয়। এটা আবার টিসিএ চক্র (ট্রাই-কার্বক্সিলিক অ্যাসিড চক্র; ক্রেবস চক্র নামেও পরিচিত) এবং ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খল (electron transport chain) দ্বারা আরও বিশ্লেষিত হয়। সবাত শ্বসনের সাথে অবাত শ্বসনের তফাৎ এখানে যে, অবাত শ্বসনে ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলে অক্সিজেন ব্যতিরেকে অন্য একটি ইলেকট্রন গ্রাহক ব্যবহার করে। বিকল্প ইলেকট্রন গ্রাহকের মধ্যে সালফেট, নাইট্রেট, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, পারদ, এবং কার্বন মনোঅক্সাইড উল্লেখযোগ্য।[৫]
অবাত শ্বসনের সাথে গাঁজনের পার্থক্য হচ্ছে, গাঁজনে গ্লাইকোলাইসিস প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পাইরুভেট কোন ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খল ছাড়াই (অর্থাৎ অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন ঘটে না) বিশ্লিষ্ট হয়। গাঁজনের বেশ কয়েকটি পথ বিদ্যমান যেমন- ল্যাকটিক অ্যাসিড গাঁজন, মিশ্র অ্যাসিড গাঁজন, ২,৩-বিউটেন-ডাইঅল গাঁজন।[৫]
অবাত শ্বসন এবং গাঁজন হতে লব্ধ শক্তি (তথা উৎপন্ন এটিপি এর সংখ্যা) সবাত শ্বসনের তুলনায় কম হয়।[৫] এ কারণেই, ঐচ্ছিক অবায়বীয়রা, যারা সবাত ও অবাত- উভয় উপায়েই শ্বসনে সক্ষম, তারা সবাত শ্বসনকেই অগ্রাধিকার দেয়। থায়োগ্লাইকোলেট মাধ্যমে ঐচ্ছিক অবায়বীয়দের কালচার করার সময় এটা লক্ষ্য করা যায়।[১]
বাধ্যতামূলক অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার গণসমূহের মধ্যে রয়েছে অ্যাক্টিনোমাইসিস (Actinomyces), ব্যাক্টেরয়েডস (Bacteroides), ক্লস্ট্রিডিয়াম (Clostridium), ফিউসোব্যাকটেরিয়াম (Fusobacterium), পেপ্টোস্ট্রেপ্টোকক্কাস (Peptostreptococcus), পর্ফিরোমোনাস (Porphyromonus), প্রেভোটেলা (Prevotella), প্রোপিওনিব্যাক্টেরিয়াম (Propionibacterium), এবং ভেইলোনেলা (Veilonella)।[৬]
বাধ্যতামূলক অবায়বীয় ছত্রাক গণসমূহের মধ্যে রুমেন ছত্রাক নিওক্যালিমাস্টিক্স (Neocallimastix), পিরোমোনাস (Piromonas), এবং স্ফায়রোমোনাস (Sphaeromonas) অন্তর্ভুক্ত।[৮]
জুলাই ২০১৯ এ, কানাডা'র কিড খনিতে (Kidd mine) বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে সালফার-গ্রাহী জীবের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২,৪০০ মিটার (৭,৯০০ ফুট) নিচে বাস করে। এসব জীব আরও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এজন্য যে, এরা খাদ্যের নিয়মিত উৎস হিসেবে পাথর (যেমন- পাইরাইট) খেয়ে থাকে।[৯][১০][১১]
টেস্টটিউবে থায়োগ্লাইকোলেট মাধ্যমে কালচার করে সবাত এবং অবাত ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করা যায়:
(i) বাধ্যতামূলক বায়ুজীবীদের অক্সিজেন প্রয়োজন কেননা তারা গাঁজন কিংবা অবাত শ্বসনে অক্ষম। এগুলো টেস্টটিউবের একদম ওপরের অংশে সঞ্চিত হয়, যেখানে অক্সিজেনের ঘনমাত্রা সবচেয়ে বেশি।
(ii) বাধ্যতামূলক অবায়বীয় অণুজীবসমূহ অক্সিজেন দ্বারা বিষাক্রান্ত হয়; এজন্য এরা নলের একদম তলায় জমা হয়, যেখানে অক্সিজেনের ঘনমাত্রা সবচেয়ে কম।
(iii) ঐচ্ছিক অবায়বীয়রা বায়ুর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি - উভয় পরিস্থিতিতেই বৃদ্ধি লাভ করতে পারে, কেননা এরা সবাত ও অবাত উভয় প্রক্রিয়াতেই শ্বসনে সক্ষম। এরা ওপরের দিকেই বেশি জমা হয়, কারণ অবাত শ্বসন কিংবা গাঁজনের তুলনায় সবাত শ্বসন থেকেই অধিক হারে এটিপি উৎপন্ন হয়।
(iv) মাইক্রোঅ্যারোফাইল এর অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে কেননা এরা গাঁজন কিংবা অবাত শ্বসনে সক্ষম নয়। তবে, এরা উচ্চ ঘনমাত্রার অক্সিজেনে বাঁচতে পারে না। এরা একদম শীর্ষে না হলেও নলের ওপরের অংশেই জমা হয়ে থাকে।
(v) বায়ুসহ জীব এর অক্সিজেনের কোন প্রয়োজন পড়ে না এবং অক্সিজেন উপস্থিত থাকলেও এরা তা ব্যবহার করতে পারে না; এরা অবাত উপায়েই শ্বসন ঘটিয়ে থাকে। বাধ্যতামূলক অবায়বীয়দের মত অবশ্য এরা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বিষাক্রান্ত হয় না। এদেরকে টেস্টটিউবে সুষমভাবে বিন্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঐচ্ছিক অবায়বীয় এবং বায়ুসহ জীবসমূহে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে গাঁজন সম্পন্ন হয়, তবে ঐচ্ছিক অবায়বীয়রা অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সবাত শ্বসন বেছে নেয় (এই ঘটনা পাস্তুর প্রভাব নামে পরিচিত)। গবেষণাগারে কখনো কখনো পাস্তুর প্রভাব প্রয়োগ করে ঐচ্ছিক অবায়বীয় এবং বায়ুসহ প্রজাতির মধ্যে প্রভেদ নিরূপণ করা হয়ে থাকে।