একটি জীব থেকেই কেবল আরেকটি জীবের সৃষ্টি সম্ভব। এই তত্ত্বকেই বায়োজেনেসিস বলা হয়। এ ব্যাপারে ল্যাটিন ভাষায় একটি প্রবাদ আছে “জীবন থেকেই জীবনের উদ্ভব” লুইস পাস্তুরের পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে বায়োজেনেসিস মতবাদটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে অ্যাবায়োজেনেসিস বায়োজেনেসিসের সম্পূর্ণ বিপরীত। অর্থাৎ অ্যাবায়োজেনেসিস অনুসারে জড় থেকে জীবের সৃষ্টি সম্ভব।
বায়োজেনেসিস শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন হেনরি চার্লটন বাস্তিয়ান। কিন্তু তিনি বায়োজেনেসিস বলতে জড় থেকে জীব সৃষ্টির পদ্ধতিকে বুঝিয়েছিলেন। পরে থমাস হাক্সলি জড় থেকে জীব সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে অ্যাবায়োজেনেসিস বলে অবিহিত করেন। তিনি বায়োজেনেসিসের সংজ্ঞা পুনর্গঠন করেন। তিনি একটি জীব থেকে নতুন জীব সৃষ্টির পদ্ধতিকে বায়োজেনেসিস বলেন।[১] মহাবিশ্বের ইতিহাসে,[২] এক বার অ্যাবায়োজেনেসিস হয়েছে এবং সেটি ছিল প্রথম প্রাণ সৃষ্টির সময়।[৩][৪][৫]
প্রাচীন গ্রীকরা বিশ্বাস করত জড় বস্তু থেকে জীবের সৃষ্টি সম্ভব। তারা বিশ্বাস করত গায়া দেবী পাথর থেকে জীবন সৃষ্টি করতে পারেন, এই পদ্ধতিটি ‘জেনেরিও স্পন্টানায়ি’ নামে পরিচিত ছিল। এরিস্টটল এটি না মানলেও তিনি বিশ্বাস করতেন অন্য ধরনের জীব কিংবা মাটি থেকে নতুন জীবের সৃষ্টি সম্ভব। এই স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি বা অ্যাবায়োজেনেসিস তত্ত্ব সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত টিকে ছিল। কিন্তু ১৭দশ শতাব্দীর শেষ দিকে এ মতবাদের বিরুদ্ধে নানা পর্যবেক্ষণ ও বিতর্কের শুরু হয়। বৈজ্ঞানিক উন্নতির সাথে সাথে নানা মত, ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সংস্কারের কারণে ব্যাপারটি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠে।
১৬৬৮ সালে ফ্রান্সেস্কো রেডি নামের একজন ইতালীয় চিকিৎসক প্রমাণ করেন উঁচু স্তরের জীব জড় বস্তু থেকে সৃষ্টি হয় নি। কিন্তু অ্যাবায়োজেনেসিস মতবাদের অনুসারীরা দাবি করে এই মতবাদটি অণুজীবের ক্ষেত্রে খাটে না। তাই তারা বলে অণুজীব জড় বস্তু থেকে সৃষ্টি হতে পারে। ১৭৬৫ সালে জন নিধাম ফ্লাস্কে মুরগির মাংসের জুস নেন এবং তা সিদ্ধ করেন। তারপর তিনি তা ঠাণ্ডা করে অপেক্ষা করেন। এতে অণুজীব জন্ম নেয় এবং তিনি দাবী করেন এই পরীক্ষা স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি তথা অ্যাবায়োজেনেসিসের স্বপক্ষে। অর্থাৎ মাংসের জুস থেকে অণুজীব সৃষ্টি হয়েছে। ১৭৬৮ সালে লাজ্জারো স্পালানজানি পুনরায় নিধামের পরীক্ষাটি করেন কিন্তু ফ্লাস্ক থেকে বাতাস সরিয়ে নেন। ফলস্বরূপ কোন অণুজীব জন্ম নেয় নি। যা অ্যাবায়োজেনেসিসের বিপক্ষে। কিন্তু নিধাম দাবী করেন স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির জন্য বায়ু আবশ্যক ফলে স্পালানজানির ফ্লাস্ক থেকে বায়ু অপসারণ করায় অণুজীব জন্ম নেয় নি। নিধামের প্রথম পরীক্ষার প্রায় ১০০ বছর পর দুজন বিজ্ঞানী বায়ু নিয়ে বিতর্কের সমাধানের চেষ্টা করেন। ১৮৩৬ সালে ফ্রেঞ্জ স্কালজ বায়ু নিরুদ্ধ ফ্লাস্কে সেদ্ধ মাংসের জুস নেন এবং তাতে অ্যাসিড দ্রবনের মধ্য দিয়ে বায়ু প্রবেশ করান। একি ভাবে থিওডোর স্চোয়ান উত্তপ্ত নলের মধ্য দিয়ে বায়ু প্রবেশ করান। দেখা যায় দুই ক্ষেত্রেই কোন অণুজীব জন্ম নেয় নি। এই পরীক্ষাদ্বয় অ্যাবায়োজেনেসিসের বিপক্ষে। কিন্তু অ্যাবায়োজেনেসিস মতবাদের অনুসারীরা দাবী করে অ্যাসিড ও তাপ বায়ুর গুণ পরিবর্তন করে যার ফলে অণুজীব জন্ম নেয় না। এই বিতর্কের অবসান হয় যখন বিজ্ঞানীরা বায়ুকে তুলা পূর্ণ নলের প্রবেশ করান। তুলায় বাতাসের মধ্যকার অণুজীব আটকা পড়ে ফলে মাংসে অণুজীব জন্ম নেয় না।অবশেষে লুইস পাস্তুর একটি লম্বা ও বাঁকা হাসের ঘাড়ের মত ফ্লাস্ক ব্যবহার করেন। বাতাস তাতে সহজেই প্রবেশ করতে পারে কিন্তু তাতে কোন অণুজীব জন্ম নেয় না কারণ অণুজীবরা ‘U’ আকারের বাঁকা নলে আটকা পড়ে এবং মাংস পর্যন্ত পৌছাতে পারে না। তিনি প্রমাণ করেন যে পূর্বে কোন জীব দ্বারা সংক্রমিত হওয়া ছাড়া নতুন জীবের সৃষ্টি সম্ভব নয়। পাস্তুর তার পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর বলেন “ স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি একটি স্বপ্ন মাত্র”