সাধু বার্ণবা লিখিত সুসমাচার (গ্রিক: Ευαγγέλιο του Βαρνάβα; ইতালীয়: Vangelo di Barnaba; স্পেনীয়: Evangelio de Bernabé) হল একটি পুস্তক যা নাসরতীয় যীশুর জীবনকে চিত্রিত করে। ধারণা করা হয় যে এটি বাইবেলীয় সাধু বার্ণবা কর্তৃক লিখিত, যিনি এই পুস্তক অনুসারে ছিলেন বারোজন প্রেরিতের একজন। এর দুটি পাণ্ডুলিপির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়, উভয়ই ১৬শ বা ১৭শ শতকের। একটি ইতালীয় ভাষায় লিখিত এবং অপরটি স্পেনীয় ভাষায়। স্পেনীয় পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে হারিয়ে গেছে, এটির ১৮শ শতকের পাঠ্য শুধুমাত্র আংশিকভাবে সংরক্ষিত আছে। [১] সাধু বার্ণবা চারটি ধর্মসম্মত সুসমাচারের মতো এটির একই দৈর্ঘ্য রেখেছেন। এটিতে উল্লেখিত অনেক ঘটনা ধর্মসম্মত সুসমাচারসমূহে খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এটি খ্রিস্টীয় উৎসের ইসলামি ব্যাখ্যার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং খ্রিস্টানদের নূতন নিয়মের শিক্ষাগুলির বিপরীত।[২] কিছু শিক্ষাবিদ পরামর্শ দেন যে, এটি পূর্বাবস্থায় অবশিষ্ট থাকতে পারে অথবা এটি অপ্রামাণিক কাজ হতে পারে (সম্ভবত গ্নোসটিক,[৩] এবাইওনিট[৪] বা ডায়াটিসারোনিক[৫] অথবা ইসলামি মতবাদের সাথে সমন্বয়ের জন্য এটি সম্পাদনা করা হয়েছে। কিছু মুসলিম এটিকে প্রেরিতদের লেখা মূল জীবন্ত সংস্করণ হিসাবে বিবেচনা করে। এছাড়াও কিছু ইসলামি সংগঠন ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে যীশুর উদ্ধৃতি সমর্থন করে।
বার্নাবাসের সুসমাচারে, যতক্ষণ পর্যন্ত চারটি কেনানীয় গসপেল ( ম্যাথিউ, মার্ক, লুক এবং জন ) একত্রিত হয়, তাতে ২২২টি অধ্যায় এবং প্রায় ৭৫,০০০ শব্দ রয়েছে। [৬] :৩৬[৭] এর মূল শিরোনাম, ইতালীয় পাণ্ডুলিপির প্রচ্ছদে প্রদর্শিত হচ্ছে, দ্য ট্রু গসপেল অফ যিশু, বলা হয় খ্রিস্ট, বিশ্বে ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত একজন নতুন নবী: বার্নাবাস তাঁর প্রেরিতের বর্ণনা অনুসারে ; [৬] :৩৬[৮] :২১৫এটি লেখকের একটি সমালোচনা অনুসরণ করে, যিনি নিজেকে বাইবেলের বার্নাবাস বলে দাবি করেন, "পৃথিবীতে বসবাসকারী সকলেই শান্তি ও সান্ত্বনা কামনা করে" ( পল দ্য অ্যাপোস্টেল সহ) যারা "একটি 'সবচেয়ে খারাপ মতবাদ' প্রচার করার জন্য শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে" 'যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র বলে, সুন্নত প্রত্যাখ্যান করে [...] এবং প্রত্যেকটি নাপাক মাংসকে হালাল করা।" [৬] :৩৬
এটিকে সুসমাচার সম্প্রীতি বলে মনে হয়, যা যিশুর পরিচর্যা এবং আবেগকে কেন্দ্র করে। [৬] :৩৬গসপেলটি ম্যাথিউ এবং লুকের সম্মিলিত উপাদান দিয়ে শুরু হয়, যেমন প্রধান দূত গ্যাব্রিয়েলের দ্বারা মেরিকে ঘোষণা করা, ম্যাগিদের আরাধনা, নিরপরাধদের গণহত্যা, যীশুর খৎনা এবং মন্দিরে তার সন্ধান । [৬] :৩৬এটিতে তারপর ৩০ বছর বয়সে যীশুর জীবনী বর্ণনা শুরু করে, যখন তিনি জলপাই সংগ্রহ করতে তার মায়ের সাথে জলপাই পাহাড়ে যান; সেখানে প্রার্থনা করার সময়, তিনি গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে সুসমাচার পান। [৬] :৩৭এই প্রকাশের পরে, সে তার মাকে বলে যে সে আর তার সাথে থাকবে না। যিশু পরে জেরুজালেমে যান এবং সেখানে প্রচার শুরু করেন। তিনি তার পরিচর্যার সময় তার সাথে যাওয়ার জন্য বারোজন প্রেরিত নিয়োগ করেন; গসপেল বার্নাবাস সহ মাত্র দশজনের কথা উল্লেখ করেছে। [৬] :৩৭ :৩৪সুসমাচারটি খৎনার উৎস, খৎনা না করাদের নিন্দা এবং আব্রাহামের জীবন ( তার মূর্তি ধ্বংস এবং তার পুত্র ইসমাইলের বলিদান সহ) সম্পর্কে যীশুর জন্য দায়ী শিক্ষাগুলি অনুসরণ করে। [৬] :৩৭–৩৮
৩৯ অধ্যায়ে যীশু কর্তৃক মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ রয়েছে। [৬] :৩৮গসপেলটি যীশুর রূপান্তর এবং তার মশীহ মুহাম্মদের ঘোষণার কথা বর্ণনা করে, যিনি তাঁর পরে আসবেন। [৬] :৩৮–৩৯তার বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্ত এবং শিক্ষার পরে এটি তার আবেগকে বর্ণনা করে, ব্যভিচারে গৃহীত মহিলা সম্পর্কে লেখক এবং ফরীশীদের সাথে তার দ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে। [৬] :৪৩মেরিকে গ্যাব্রিয়েল তার ছেলের আসন্ন ক্রুশবিদ্ধকরণ এবং এর থেকে তার সুরক্ষা সম্পর্কে বলেছিল; [৬] :৪৫মহাযাজক, হেরোড অ্যান্টিপাস এবং পন্টিয়াস পিলাট তার সম্পর্কে কী করবেন তা আলোচনা করেন। [৬] :৪৩যীশু এবং তাঁর শিষ্যরা নিকোদেমাসের বাড়িতে লুকিয়েছিলেন, যেখানে তাদের শেষ নৈশভোজ ছিল। [৬] :৪৪জুডাস ইসক্যারিওট ত্রিশটি রূপার জন্য তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে; [৬] :৪৪ঈশ্বর তখন গ্যাব্রিয়েল, মাইকেল, রাফায়েল এবং ইউরিয়েলকে আদেশ দেন যীশুকে "দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে থাকা জানালার পাশে" তৃতীয় স্বর্গে নিয়ে গিয়ে বাঁচাতে। [৬] :৪৪ :১১
জুডাস, যার মুখ ও বক্তৃতা যীশুর অনুরূপ পরিবর্তিত হয়েছে, অন্য শিষ্যরা যখন ঘুমাচ্ছে তখন ঘরে ফিরে আসে। [৬] :৪৪তিনি এটা জেনে আশ্চর্য হয়েছেন যে তারা মনে করেন তিনিই ঈসা [৬] :৪৪এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। [৬] :৪৫পিলেট তার ক্রুশবিদ্ধ করার আদেশ দেন, এবং তাকে আরিমাথিয়ার সমাধির জোসেফের মধ্যে রাখা হয়। [৬] :৪৫–৪৬যীশু তাঁর মা এবং শিষ্যদের দেখতে এবং আসলে কী ঘটেছে তা বলার ক্ষমতার জন্য প্রার্থনা করেন। [৬] :৪৬তিনি বার্নাবাসের দিকে ফিরে যান, যাকে তিনি কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে লেখার জন্য আদেশ করেন। [৬] :৪৭সুসমাচারটি শিষ্যদের ছড়িয়ে পড়া এবং পলের আরেকটি সমালোচনার সাথে শেষ হয়। [৬] :৪৭–৪৮
বার্নাবাসের সুসমাচারে উল্লেখিত কাজ সমূহ স্পষ্টভাবে বাইবেলের নতুন নিয়মের যীশু এবং তার পরিষদের শিক্ষার বিপরীত, কিন্তু ইসলামিক বিশ্বাসের সাথে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। এখানে শুধুমাত্র মুহাম্মাদের নামই উল্লেখ করা হয় নি, বরং কালিমা শাহাদাতও উল্লেখ করা হয়েছে (অধ্যায় ৩৯)। এটিতে কঠোরভাবে পল এবং ত্রি-তত্ত্বের বিরোধীতা করা হয়েছে। এছাড়াও যীশুকে একজন নবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ঈশ্বরের পুত্র বলা হয় নি, যেখানে পল-কে "প্রতারিত" বলা হয়েছে। উপরন্তু, বার্নাবাসের সুসমাচারটি বলে যে, যীশু ক্রুশবিদ্ধ না হয়ে বরং জীবিত আকাশে উত্থিত হয়েছেন, যেখানে যিহূদা ঈষ্করিয়র-কে তার জায়গায় ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে। এই বিশ্বাস---বিশেষভাবে, যীশু একজন ঈশ্বরের নবী এবং ক্রুশবিদ্ধ না হয়ে জীবিত অবস্থায় উত্থিত হয়েছিলেন---এটি ইসলামী শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অথবা যেখানে ইসলামের শিক্ষায় বলা হয়েছে যে, যীশু একজন প্রধান নবী; তিনি ক্রুশে মারা যান নি, বরং ঈশ্বরের দূত কর্তৃক তাকে জীবিত উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য অনুচ্ছেদ, যা কুরআনের শিক্ষার সাথে বিপরীত। উদাহরণস্বরূপ, জন্মের সময়, যেখানে মেরী কোনো রকম ব্যাথা ছাড়াই যীশুর জন্ম দিয়েছেন অথবা যীশুর পরিষদের ক্ষেত্রে, যেখানে তিনি মদ পানের অনুমতি দেন এবং একবিবাহের নির্দেশ প্রদান করেন। অন্যান্য উদাহরণগুলির মধ্যে, নরক কেবলমাত্র সাতটি মারাত্মক পাপের জন্য হবে (বার্নাবাস: ৪--৪৪/১৩৫), যে কেউ খাৎনা করা অস্বীকার করে সে কখনো স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না (বার্নাবাস: ১৭/২৩), সেখানে ৯টি স্বর্গ আছে (বার্নাবাস: ৩/১০৫)। যদিও বার্নাবাসের সুসমাচারে খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম উভয় উপাদানসমূহের সমন্বয়ের প্রচেষ্টা দেখা যায়।
যীশুর ধারণা সম্পর্কে অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিতর্কের জন্য কিছু সংখ্যক মুসলিম এটি প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত বার্নাবাসের সুসমাচার একাডেমিক পরিধির বাইরে সামান্য পরিচিতি ছিল। খ্রিস্টধর্মের তুলনায় এতে সাধারণত ভালোভাবেই মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। এ বিষয়ে কুরআনের ৪র্থ সূরার ১৫৭-১৫৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে :
"আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি। বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।"
যিশুর ক্রুশবিদ্ধ অবস্থা বর্ণনা করার পরিবর্তে বার্নাবাসের সুসমাচার বর্ণনা করে যে, তাকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটিকে বাইবেলের ২য় রাজাবলির ২য় অধ্যায়ে বর্ণিত এলিয়ের বিবরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এটিতে মুহাম্মাদের নাম উল্লেখ করে আগমনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে এবং যীশু-কে "নবী" বলা হয়েছে, তার প্রচারকার্য শুধুমাত্র ইসরাঈলীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের বিরুদ্ধে এটিতে বর্ধিত আকারে বিতর্ক রয়েছে (অধ্যায় ১৬৪), এবং বিশ্বাস দ্বারা বিচার সমর্থনের পক্ষে স্বর্গ বা নরকে আত্মার চিরস্থায়ী গন্তব্যের বিতর্কটি ঈশ্বরের অনুগ্রহ দ্বারা পূর্বনির্ধারিত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে (পূর্ববিধানবাদের আলোকে), এটিতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যারা মুহাম্মাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে, তারা সকলেই অবশ্যই স্বর্গে প্রবেশ করবে এবং যারা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পরেও পাপী হিসেবে নরকে যাবে তারা নরকে শাস্তি ভোগের পর অবশ্যই স্বর্গে প্রবেশ করবে (অধ্যায় ১৩৭)। কেবলমাত্র যাদের অন্তরে অহংকার অব্যাহত থাকবে এবং অনুতাপ থেকে বিরত থাকবে তারাই চিরকাল নরকে থাকবে। ১৬শ শতকে ত্রিতত্ত্ববাদ বিরোধী প্রোটেস্ট্যান্ট ঐতিহ্যের মধ্যে এরকম বিশ্বাস পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে একেশ্বরবাদ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল। ১৬শ শতকে কিছু ত্রিতত্ত্ববাদ বিরোধী সংঘ খ্রিষ্টান, ইসলাম এবং ইহুদী ধর্মের মধ্যে সমন্বয় করতে চেয়েছিল। এই সুসমাচারটিতে কঠোরভাবে পলের মতবাদের বিরোধিতা করা হয়েছে। ইতালিয়ান সংস্করণের শুরুতে বলা হয়েছে :
"অনেকেই শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হয়ে বর্তমানে ধার্মিকতার নামে অত্যন্ত অধার্মিক মতবাদসমূহ প্রচার করছেন। যথা--- যীশু ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বর নির্দেশিত চিরস্থায়ী বিধান খাৎনা বাতিল করে দিচ্ছেন এবং প্রত্যেক অপবিত্র বস্তু খাওয়ার অনুমোদন দিচ্ছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সাথে উল্লেখ করছি যে, স্বয়ং পলও এমনি একজন প্রতারিত ব্যক্তি।"
বার্নাবাসের সুসমাচার দাবী করে যে, যীশু মুহাম্মাদের আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছেন। এতে কুরআনের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায়, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে :
"স্মরণ কর, যখন মরিয়ম-তনয় ঈসা বললঃ হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল, আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি এমন একজন রসূলের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন। তাঁর নাম আহমাদ। অতঃপর যখন সে স্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আগমন করল, তখন তারা বললঃ এ তো এক প্রকাশ্য যাদু।"---- সূরা ৬১ : ৬
(আহমাদ আরবী নাম, যা মুহাম্মাদ নামের মতো একই মূল: হ-ম-দ = [ ﺡ - ﻡ - ﺩ]. হতে উদ্ভূত)।
মুসলিম পণ্ডিতগণ ঐতিহ্যগতভাবে কুরআনের উক্ত অংশের সাথে তথ্যসূত্র হিসাবে নতুন নিয়মের প্রামাণিক যোহনের সুসমাচারের (১৪:১৬, ১৪:২৬, ১৫:২৬, ১৬:৭) "পারাক্লীত" শব্দটির উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। গ্রীক "পারাক্লীত" শব্দটি "সাহায্যকারী" হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে এবং খ্রিস্টানদের মতে এটি পবিত্র আত্মাকে নির্দেশ করে। কিছু মুসলিম পণ্ডিত অনুরূপ গ্রীক "পেরিক্লীতস" শব্দ উল্লেখ করেছেন, যেটির অনুবাদ করা যেতে পারে "প্রশংসাকারী" হিসাবে, অথবা আরবীতে "আহমাদ"। বার্নাবাসের সুসমাচারে "মুহাম্মাদ" নামটি বারংবার আক্ষরিকভাবে উল্লেখিত হয়েছে, নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হিসাবে :
"যীশু বললেন, "শান্তি-দূতের নাম হবে প্রশংসিত। কেননা, স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর আত্মার এই নামকরণ সৃষ্টির আদি লগ্নেই করেছেন, আর তাঁকে স্বর্গীয় মর্যাদায় সংরক্ষণ করেছেন। ঈশ্বর তাঁর উদ্দেশ্যে বলেছেন, অপেক্ষা করো মুহাম্মাদ। কেননা, আমি তোমার জন্যই সৃষ্টি করেছি স্বর্গরাজ্য, পৃথিবী এবং অসংখ্য সৃষ্টি; যাদের প্রতি তুমি হবে উপহারসরূপ। ফলে যে তোমাকে অভিনন্দন দেবে, সে হবে আনন্দিত; আর যে তোমায় অভিশাপ দেবে, সে হবে অভিশপ্ত। যখন আমি তোমাকে পৃথিবীতে পাঠাবো, তখন তোমাকে আমার রহমতের রাসূল রূপেই প্রেরণ করবো এবং তোমার বাক্য হবে সত্যপূর্ণ। এমন কি আকাশ-পৃথিবী ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু তোমার ঈমান (বিশ্বাস) হবে অব্যর্থ। "মুহাম্মাদ" --- এই হলো তাঁর রহমত পরিপূর্ণ নাম।" জনতা তখন উচ্চস্বরে বলতে থাকলেন, "হে ঈশ্বর! পাঠাও তোমার রাসূলকে। হে মুহাম্মাদ! জগতের মুক্তির জন্য এসো।"---- বার্নাবাস ৯৭।[৯]
বার্নাবাসের সুসমাচারের একটি সংস্করণ অনুসারে :
অতঃপর পুরোহিত বললেন: "মসীহাকে কি নামে ডাকা হবে?" [যীশু উত্তরে বললেন] "মুহাম্মাদ তার রহমতপূর্ণ নাম"।
— অধ্যায় ৯৭[১০]
এবং
যীশু স্বীকার করলেন এবং সত্য জ্ঞাপন করে বললেন: "আমি মসীহা নই।"
— ৪২:২[১১]
উপরে উল্লেখিত হিসেবে এই ঘোষণাগুলি ইসলামী বিশ্বাসের বিপরীত। কেননা কুরআনে যীশুকে শুধু একজন নবী হিসেবেই উল্লেখ করা হয় নি; বরং "আল-মাসীহ" উপাধি দ্বারা উল্লেখিত হয়েছে, যা "মসীহা" শব্দের আরবি অনুবাদ। এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, কুরআন কখনো উক্ত শব্দটি মুহাম্মাদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে নি এবং কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী এটির ধারক একমাত্র যীশু (আরবীতে ঈসা)। কিছু মুসলিম পণ্ডিত যুক্তি দেয় যে, বার্নাবাসের সুসমাচারটি পরিবর্তন করা হয়েছে এবং তারা এভাবে অসঙ্গতি তুলে ধরেন। এছাড়াও কেউ কেউ যুক্তি দেয় যে, "মসীহা" শব্দটি যীশু খ্রিস্টের আনুষ্ঠানিক উপাধি হতে পারে, কিন্তু "অভিষিক্ত" অর্থটি অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হতে পারে। যেমন, রাজা ডেভিড (দাঊদ এবং তার পুত্র সলোমন (সুলায়মান রাজত্বে অভিষিক্ত হয়েছেন। কিছু মুসলিম পণ্ডিত এই সূত্রে মাহদী কে বুঝিয়ে থাকেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সহীহ (বিশুদ্ধ) হাদীসে উল্লেখিত ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, যিনি মাসীহ আদ-দাজ্জাল, ("ভণ্ড মসীহা", খ্রিষ্ট বিরোধী) কে পরাজিত করতে সাহায্য করবেন। কুরআনে এটি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মসীহা "ঈসা" এর নাম (উল্লেখ্য যে, খ্রিস্টানরা আরবিতে উচ্চারণে 'ইয়াসু'আ= يَسُوعَ নামটি ব্যবহার করেন, যা যীশু খ্রিস্টকে উল্লেখ করার জন্য হিব্রু এবং অ্যারামাইক ইয়েশুয়া নামের সমজাতীয়, "ঈসা" নামটি বর্তমানে শুধুমাত্র পুরাতন আরবিতে পাওয়া যায়):
“ | "যখন ফেরেশতাগণ বললো, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বাণীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ---মারইয়াম--তনয় ঈসা; দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভূক্ত।"---সূরা ৩:৪৫, | ” |
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান কর্তৃক অনুবাদকৃত।
বার্নাবাসের সুসমাচারের একটি সংস্করণ অনুযায়ী, যীশু মসীহা হওয়া প্রত্যাখ্যান করেছেন। বরং তিনি দাবি করেছেন যে, মসীহা ইসমাঈলীয়দের (আরব) মধ্য থেকে হবে:
অতঃপর যীশু বললেন: "তোমরা আত্মপ্রবঞ্চনা করছো; কেননা আত্মিক পর্যায়ে ডেভিড (দাঊদ) তাকে প্রভু সম্বোধন করেছেন। তিনি বলেছেন: 'ঈশ্বর আমার প্রভুকে বললেন, তুমি আমার দক্ষিণ বাহুতে লগ্ন হয়ে থাকো, যে পর্যন্ত না তোমার শত্রুদের আমি পদধূলিতে পরিণত করছি। ঈশ্বর তোমার জন্য যে মানদণ্ড প্রেরণ করেছেন তা শত্রুদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করবে।' যদি ঈশ্বরের বার্তাবাহক যাকে তোমরা মসীহা বলছো দাঊদের সন্তানই হতেন, তবে কি করে দাঊদ তাকে প্রভু বলে বর্ণনা করলেন? বিশ্বাস করো, কেননা অবশ্যই আমি তোমাদের বলছি যে, উক্ত প্রতিশ্রুতি ইসমাঈলের জন্যেই নির্দিষ্ট, ইসহাকের জন্যে নয়।"
হাজ্জ সায়েদ (জ্যেষ্ঠ সদস্য CIMS), মিশরে তার নতুন বইয়ে প্রামাণিক বাইবেল হতে নিচের বর্ণনাটি এটির সাথে তুলনা করেছেন:
"খ্রীষ্টের বিষয়ে তোমাদের কেমন বোধ হয়, তিনি কাহার সন্তান? তাহারা বলিল, দায়ূদের। তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, তবে দায়ূদ কি প্রকারে আত্মার আবেশে তাঁহাকে প্রভু বলেন? তিনি বলেন-- "প্রভু আমার প্রভুকে কহিলেন, তুমি আমার দক্ষিণে বস, যাবৎ আমি তোমার শত্রুগণকে তোমার পদতলে না রাখি।"(গীত সংহিতা ১১০:১)
প্রামাণিক সুসমাচার অনুযায়ী, যীশু ডেভিডের (দাঊদ) "সন্তান" (বংশধর) ছিলেন; এভাবে হাজ্জ সায়েদ যুক্তি দেন যে, এই বিবৃতিটি বার্নাবাসের সুসমাচারের উদ্ধৃতিকে নিশ্চিত করে। এছাড়াও বার্নাবাসের সুসমাচারের আরেকটি অধ্যায়ে মসীহা হিসেবে একজন আরবের ধারণাটি পাওয়া যায়:
যদি আমি অন্যায় কাজ করে থাকি, আমাকে তিরস্কার করুন, ঈশ্বর আপনাকে ভালোবাসবেন, কারণ আপনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করছেন। কিন্তু যদি কেউ আমাকে তিরস্কার না করেন আমার পাপের জন্য, তবে বোঝা গেল আপনারা কেউই ইবরাহীমের সন্তান নন, যদিও তা দাবি করছেন; আর ইবরাহীম যে-মাথার সঙ্গে প্রতঙ্গরূপে নিজেকে যুক্ত মনে করতেন আপনারা তাতে যুক্ত নন। ঈশ্বরের শপথ, এমনই মহান ভালোবাসা ছিল তার প্রভুর প্রতি যে, তিনি মিথ্যা দেব-দেবী গুঁড়া করে পিতা-মাতাকেই কেবল ত্যাগ করলেন না বরং উদ্যত হলেন নিজ পুত্রকে হত্যা করতে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য।"--- প্রধান যাজক বললেন, "এটাই আপনাকে আমি প্রশ্ন করছি, আর আপনাকে আমি হত্যা করতে চাই না। অতএব আমাদের বলুন, ইবরাহীমের এ পুত্রটি কে ছিলেন?" যীশু উত্তর দিতে গিয়ে বললেন, "হে ঈশ্বর, আপনার সম্মান আমাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। অবশ্যই আমি বলছি, ইবরাহীমের সে-পুত্র ছিলেন ইসমাঈল, তাঁরই অধস্তন পুরুষে আবির্ভূত হবেন মসীহা, যার প্রতিশ্রুতি ইবরাহীমকে দেওয়া হয়েছে, আর তাঁরই মাধ্যমে জগতের সকল জাতি লাভ করবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ।" উত্তর শুনে প্রধান যাজক রাগে ফেটে পড়লেন এবং বিকট চিৎকার করে বললেন, "পাথর মারো এই ধর্মহীন লোকটিকে, সে প্রকৃতপক্ষে একটা ইসমাঈলী, আর সে মূসার নিন্দা করছে এবং ঈশ্বরের বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করছে।"
এখানে বার্নাবাসের সুসমাচারের একটি সংস্করণে যীশুর উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে যে, ইবরাহীমের উৎসর্গকৃত পুত্রটি ছিল ইসমাঈল; ইসহাক নয়।(বার্নাবাস অধ্যায় ৪৪ এবং ২০৮) এটি ইসলামি বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের বিশ্বাসের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে। শেষ অনুচ্ছেদের বিবৃতির মধ্যে একটি সম্পর্ক টানা যেতে পারে যে, "তার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল জাতি অনুগ্রহ প্রাপ্ত হবে", এবং "মুহাম্মাদ" নামটির অর্থ প্রশংসিত। আর কুরআনেও মুহাম্মাদ কে বিশ্ববাসীর জন্য অনুগ্রহ বলা হয়েছে। তাই উক্ত উদ্ধৃতির শেষ অংশের সাথে কুরআনের ২১তম সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ---
“ | "আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।" | ” |
বার্নাবাসের সুসমাচার অনুযায়ী, যীশু তার উপর আরোপিত ঈশ্বরত্ব প্রত্যাখ্যান করেন:
এইরূপ বলে, যীশু উভয় হাতের তালু নিজের মুখমণ্ডলে বুলালেন এবং পরে মাটিতে মাথা ঠুকলেন। আর মাথা তুলে বলতে লাগলেন: "অভিশপ্ত সেই লোক যে আমার বচনে এইরূপ প্রক্ষেপ করবে যে আমি ঈশ্বরের পুত্র।"
— ৫৩:৬ [৩]
এটি সম্পূর্ণভাবে মুসলিম বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, উক্ত বিশ্বাস অনুযায়ী যীশু শুধু একজন মানুষ এবং নবী। কিছু হাদীস অনুযায়ী, তিনি ভবিষ্যতে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন এবং বিশ্বে ঘোষণা করবেন যে তিনি "ঈশ্বরের দাস"।
হাজ্জ সায়েদ যুক্তি দেন যে, গালাতীয়তে পল ও বার্নাবাসের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিবরণটি এই ধারণাটিকে সমর্থন করে যে পলের সময়ে বার্নাবাসের সুসমাচারের অস্তিত্ব ছিল। যেমন—পল লিখেছেন (Galatians Chapter 2):
কিন্তু কৈফা যখন আন্তিয়খিয়ায় আসিলেন, তখন আমি মুখের উপরেই তাঁহার প্রতিরোধ করিলাম, কারণ তিনি দোষী হইয়াছিলেন। ফলতঃ যাকোবের নিকট হইতে কয়েক জনের আসিবার পূর্বে তিনি পরজাতীয়দের সহিত আহার ব্যবহার করিতেন, কিন্তু উহারা আসিলে পর তিনি ছিন্নত্বকদের ভয়ে পিছাইয়া পড়িতে ও আপনাকে পৃথক রাখিতে লাগিলেন। আর তাঁহার সহিত অন্য সকল যিহূদীও কপট ব্যবহার করিল; এমন কি, বার্ণবাও তাঁহাদের কাপট্যের টানে আকর্ষিত হইলেন।
পল পিতরকে আক্রমণ করেছিলেন তাদের আইনের মাধ্যমে, "ইহুদীদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা"র জন্য, যেমন খৎনার বিষয়টি। এই বিষয়ের তর্কে বার্নাবাস পিতরকে অনুসরণ করেছিলেন এবং পলের সাথে অসম্মতি জানিয়েছেন। এছাড়াও কেউ কেউ ধারণা করেন যে, তার সময়ে গালাতীয়ের অধিবাসীগণ একটি সুসমাচার ব্যবহার করেছিল অথবা সুসমাচারটি পলের বিশ্বাসের সাথে অসম্মতি জানাচ্ছিল, যার মধ্যে বার্নাবাসের সুসমাচারটিও হতে পারে (যদিও দ্বিতীয় পত্রের আলোকে পিতরের সুসমাচারটিকে আরো নিকটতর মনে হবে)। গালাতীয়ের বর্ণনার সাথে আমরা বার্নাবাসের সুসমাচারের সূচনা অধ্যায়ের তুলনা করতে পারি, যেখানে বলা হয়েছে:
মহান ও কুদরতময় ঈশ্বর নিকট অতীতের দিনগুলিতে তাঁর নবী যিশুকে আমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলেন এবং তখন অলৌকিক ঘটনাবলী ও শিক্ষা উপস্থাপিত হচ্ছিলো; কিন্তু আজ তার প্রতিক্রিয়াতেই অনেকেই শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হয়ে বর্তমানে ধার্মিকতার নামে অত্যন্ত অধার্মিক মতবাদসমূহ প্রচার করছেন, যথা--- যিশু ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বরের নির্দেশিত চিরস্থায়ী বিধান খৎনা (ত্বকচ্ছেদ) রদ করে দিয়ে অপবিত্র খ্যাদ্যভক্ষণের অনুমতি দিচ্ছেন। আমি অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করছি যে স্বয়ং পলও এমনি একজন প্রতারিত ব্যক্তি, যে কারণে আমাকে সেই সমস্ত সত্যবাণী লিপিবদ্ধ করতে হচ্ছে যা আমি স্বকর্ণে শুনেছি এবং সেই সকল ঘটনা যা যিশুর সঙ্গে থেকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি শুধু এই জন্যই যে অন্যেরা মিথ্যাচার থেকে রক্ষা পাবে, শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হবে না এবং ঈশ্বরের বিচারাদালতে অপরাধী হয়ে নিশ্চিহ্নও হবে না। সাবধান, সেই সমস্ত প্রচারক থেকে, যারা এই গ্রন্থের বিপরীত ও বাড়তি নতুন কথা শোনাতে আসে-- অনন্তকালে যারা আত্মরক্ষা করতে চান, তাদের প্রতি এই হচ্ছে আমার সাবধান-বাণী।
পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদ থেকে এটির যুক্তি পাওয়া যায় যে, শুরুতে পল এবং বার্নাবাস একে অপরের সঙ্গ পেয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত, তারা ইহুদি আইনের গুরুত্বের জন্য তাদের বিশ্বাসে প্রস্থান করতে শুরু করে।
নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যিশু বার্নাবাসের সাথে কথা বলেছিলেন এবং তার নিকট গুপ্তরহস্য ব্যক্ত করেছেন :
যিশু কাঁদতে কাঁদতে বললেন, "হে বার্নাবাস, এ বড়ই জরুরী যে তোমার কাছে কিছু মহা গুপ্তরহস্য ব্যক্ত করি, যা এই দুনিয়া হতে আমার প্রস্থানের পর তুমিই পুনর্ব্যক্ত করবে।"
এই বিবরণী-লেখক তখন বললেন, "আমাকেই কাঁদতে দিন হে গুরু এবং অন্য লোকজনও কাঁদুক, কেননা আমরা সবাই পাপী। কিন্তু আপনি, আপনি একজন পবিত্র পুরুষ ও আল্লাহর নবী, এত রোদন যে আপনার পক্ষে মানায় না।" যিশু বললেন, "আমাকে বিশ্বাস করো বার্নাবাস, যতটুকু উচিত ছিল ততটুকু কাঁদতে পারছি না এখনও। কারণ যদি আমাকে লোকেরা ঈশ্বর না বলতো, তবে আমি ঈশ্বরকে দিব্যচোখে ঠিক সেইরূপ দেখতে পেতাম যেরূপ দর্শন স্বর্গে সম্ভব হবে এবং বিচার দিবস সম্পর্কে আমি নির্ভয় হতে পারতাম। অবশ্য ঈশ্বর জানেন যে আমি নির্দোষ, কেননা আমি ভুলেও তুচ্ছ দাসের চেয়ে অতিরিক্ত মর্যাদা পাওয়ার প্রত্যাশা করিনি কখনও। না হে, বরং বলছি তোমাকে, যদি আমাকে ঈশ্বর রূপে অভিহিত করা না হতো তবে দুনিয়া হতে প্রস্থানের পর সোজা স্বর্গে ঠাই লাভ করতাম। অথচ এখন আমাকে প্রতীক্ষায় থাকতে হবে বিচার দিবস পর্যন্ত। এখন দেখ তাহলে আমার কান্নাকাটি করার কারণ আছে কি-না।
"জেনে নাও হে বার্নাবাস, এ কারণেই আমাকে মহা নির্যাতন সইতে হবে এবং আমারই এক শিষ্য আমাকে মাত্র তিরিশ মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে ফেলবে। যদিও আমি নিশ্চিত যে, যে ব্যক্তি আমাকে বিক্রি করবে আমার নামেই তার মৃত্যু ঘটবে। কেননা ঈশ্বর আমাকে এই পৃথিবী হতে উত্তলোন করে নেবেন, আর সেই বিশ্বাসঘাতকের চেহারা অবিকল আমার মত করবেন যাতে লোকদের প্রত্যয় হয়, সে-ই আমি। অবশ্য যদিও তার এইরূপ খারাপ মৃত্যু হবে তবুও দীর্ঘকাল এই গ্লানিময় পরিণতির কথা আমার নামের সংগেই যুক্ত থাকবে। কিন্তু যখন আবির্ভাব হবে মুহাম্মাদের, যিনি হবেন ঈশ্বরের পবিত্র বার্তাবাহক, এই দুর্নাম আমার ঘুচবে। এরূপ করবেন ঈশ্বর এই জন্য যে, আমি মসীহা সম্পর্কিত সঠিক তথ্য প্রচার করেছি, তিনি আমাকে এ পুরস্কার দেবেন। আমিও জীবিত আছি বলে বিজ্ঞাপিত হবো এবং ঐ ন্যক্কারজনক মৃত্যুর সঙ্গে আমি যে সম্পর্কশূন্য তাও জানিয়ে দেয়া হবে।"
এছাড়াও বার্নাবাসের সুসমমাচার অনুযায়ী, যিশু বার্নাবাসকে সুসমাচার লিখতে আদেশ করেছেন :
আর তখন যিশু এই লেখকের দিকে ফিরলেন এবং বললেন, "দেখ বার্নাবাস, যে ভাবেই হোক, যা-যা ঘটে গেলো সে-সম্পর্কে আমার বাণী তুমি লিপিবদ্ধ করে রাখবে। আর জুদাসের ক্ষেত্রে যা ঘটলো তাও সঠিকভাবে লিখবে যাতে বিশ্বাসীরা প্রতারণার শিকার না হয়, আর যেন প্রত্যেকেই যা সত্য তা বিশ্বাস করতে পারে।"
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক টোলান্ড (Toland) বার্নাবাসের গসপেলের এ পাণ্ডুলিপিটি পাঠ করেছিলেন এবং গসপেল সম্পর্কে তিনি তার Miscellaneous Works-এ এর উল্লেখ করেছেন-'এটি আগাগোড়া যথার্থই এক ধর্মগ্রন্থ' (This is in Scripture Style to a hair)। তিনি আরও বলেছিলেন: 'এ পর্যন্ত প্রাপ্ত গসপেল সমূহে যীশুর কাহিনি বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ করে এ গসপেলটিতে এই ভিন্নতা আরো বেশি লক্ষণীয়। মূল থেকে নিকটতর ছিল বিধায় কেউ কেউ এর প্রতি অধিকতর অনুকূল ধারণা পোষণ করবে। কারণ কোন একটি ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরই শুধু সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। তাই মূল ঘটনা থেকে যতই দূরে সরে যাওয়া হয় ততই তার আবেদন হ্রাস পায়।'
উল্লেখ্য, স্প্যানিশ ভাষায় আরেকটি গসপেল এক সময় ছিল। গসপেলের ইতালীয় পাণ্ডুলিপিটি যে সময় হফবিবলিও থেকে দেওয়া হয় সেই একই সময়ে স্প্যানিশ গসপেলটিও ইংল্যান্ডের একটি কলেজ লাইব্রেরিকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। রহস্যজনকভাবে সে পাণ্ডুলিপিটি অন্তর্হিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই সেটিকে ইংল্যান্ডে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ক্যানন (Canon) ও মিসেস রযাগ (Mrs Ragg) ইতালীয় পাণ্ডুলিপিটি ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। ১৯০৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক তা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। রহস্যজনক ভাবে এর প্রায় সকল কপিই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। মাত্র ২টি কপি এখন টিকে আছে। একটি রয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এবং অন্যটি ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস-এ। লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের কপিটির একটি মাইক্রো ফিল্ম কপি সংগ্রহ করা হয় এবং তা পাকিস্তানে মুদ্রিত হয়। বার্নাবাসের গসপেলের সংশোধিত সংস্করণ পুনর্মুদ্রণের লক্ষ্যে এই সংস্করণেরই কপি ব্যবহার করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংরেজি, আরবী এবং উর্দু অনুবাদ প্রকাশের পর থেকে, যিশুর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে এটির উদ্ধৃতি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। এটির উদ্ধৃতি উল্লেখকারী ইসলামী লেখকগণের মধ্যে রাহমাতুল্লাহ কিরানবি, রশিদ রিদা, সাইয়্যিদ আবুল আলা মওদুদী, মুহাম্মদ আতা-উর-রহমান এবং মির্জা গোলাম আহমাদ অন্তর্ভুক্ত। প্রধান মুসলিম গবেষকগণ দাবী করেন যে, ইভাঞ্জিলের আরবী নাম ইঞ্জিল অথবা নবী ঈসা (নাজারাথ/নাসারাতের যীশু) এর মাধ্যমে প্রচারকৃত ভাববাদীয় সুসমাচার, যেটির ব্যাপকভাবে বিকৃতি ঘটেছে এবং খ্রিস্টান বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে বিকৃত করা হয়েছে। ফলস্বরূপ, খ্রিস্টান ঐতিহ্যের কোনো পাঠের উপর আস্থা রাখা যায় না (খ্রিস্টানদের নতুন নিয়মের চারটি আইনসম্মত সুসমাচারও অন্তর্ভুক্ত) যা যীশুর শিক্ষা সঠিকভাবে উপস্থাপন করে। অর্থোডক্স ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বার্নাবাসের সুসমাচারকে খ্রিস্টীয় কাজ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এটির অনেক বিষয় কুরআনে উল্লেখিত ঘটনার বিপরীত, সুতরাং এটা খুব প্রত্যাশিত হতে পারে যে, এটিতে বিকৃতি ঘটেছে। এছাড়াও সাধারণ মুসলিম লেখকগণ বার্নাবাসের সুসমাচারকে প্রকৃত ইঞ্জিলের ভাষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কিছু অস্বীকার করেন, যেখানে পরিচিত ইতালিয়ান পাঠ্যে পরবর্তীতে সংযোজিত মিথ্যা গল্পের বাস্তবিক উপাদান রয়েছে। তা সত্ত্বেও, মুসলিম লেখকগণ বার্নাবাসের সুসমাচারের সেসব বিষয় উল্লেখ করেন যা কুরআনের শিক্ষার মানদণ্ডের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন, যীশুর ঈশ্বরের পুত্র হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা এবং যীশু কর্তৃক ঈশ্বরের সংবাদবাহক/ আল্লাহর রাসূল (মুহাম্মাদের আগমন সম্পর্কে ভাববাদীয় ভবিষ্যদ্বাণী। ফলস্বরূপ, কিছু মুসলমান এই নির্দিষ্ট উপাদান সম্পর্কে আগ্রহী এবং পাপ হতে বেঁচে থাকার জন্য যিশুর প্রারম্ভিক সংগ্রামের ঐতিহ্য ইসলামের সাথে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে এটি সংক্ষেপে দাবী করা হয়েছিল যে, পূর্ব তুরস্কের হাক্কারির কাছে এই সুসমাচারের প্রথম দিকের সিরিয় কপি খুঁজে পাওয়া গেছে।[২১] যদিও, এই পাণ্ডুলিপি প্রকৃতপক্ষে আইনসম্মত বাইবেলে আগে থেকেই প্রকাশিত আছে।[২২] ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে এটি তুরস্কের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়েছিল যে, ৫২ পৃষ্ঠার সিরিয় লিপির বাইবেলের একটি পাণ্ডুলিপি আঙ্কারার নৃকুলবিদ্যা জাদুঘরে জমা হয়েছে।[২৩] তুরস্কের সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দাবী করা হয়েছে, উক্ত পাণ্ডুলিপিটি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে চোরাচালান/পাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে সাইপ্রাসে পাওয়া গেছে, তারপর থেকে এটি পুলিশের সংগ্রহে রাখা হয়েছে।[২৪] আরো ধারণা করা হয় যে, উক্ত পাণ্ডুলিপিটির পাঠ্য বার্নাবাসের সুসমাচারের হতে পারে। উক্ত পাণ্ডুলিপির বাইরের পৃষ্ঠার আলোকচিত্র ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যা পড়ে মনে হতে পারে এটির লিপি সাম্প্রতিক নব্য-অ্যারামাইক হাতের লেখা। কেননা এটি শুরু করা হয়েছে : "আমাদের প্রভুর নামে, এই বইটি নিনেভের উচ্চ মঠের সন্ন্যাসীর হাতে লেখা, আমাদের প্রভুর ১,৫০০তম বছরে"।[২৫][২৬] আঙ্কারা পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু হিসেবে পরবর্তীতে এটির কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় নি। এছাড়াও এটির বয়স এবং সত্যতার জন্য কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফলও খুঁজে পাওয়া যায় না।[২৩]
|তারিখ=
(সাহায্য)