মিয়ানমারের ইতিহাস |
---|
![]() |
|
|
|
|
![]() |
বার্মায় জাপানি দখলদারিত্ব ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ১৯৪২ এবং ১৯৪৫ সালের মধ্যে, যখন জাপান বার্মা দখল করেছিল। জাপানিরা বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্স সেনা (বিআইএ) গঠনে সহায়তা করেছিল, এবং তিরিশ কমরেড (৩০ জন বার্মিজ যুবককে নিয়ে গড়া বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্স সেনা)কে প্রশিক্ষিত করেছিল, যাঁরা আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর (তৎমাত্ব) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ব্রিটিশদের বহিষ্কার করে যাতে বার্মা স্বাধীন হতে পারে, তার জন্য বার্মিজরা জাপানিদের সমর্থন পাওয়ার আশা করেছিল।[১][২] ১৯৪২ সালে জাপান বার্মা আক্রমণ করেছিল এবং ১৯৪৩ সালের ১লা আগস্ট জাপান এই উপনিবেশকে স্বাধীন বার্মা রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করে। বাও মাও এর নেতৃত্বে একটি পুতুল সরকার গঠিত হয়। তবে, অনেক বার্মিজ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে জাপানিরা তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা দেওয়ার কোনও ইচ্ছা পোষণ করে না।[১][২]
ভবিষ্যতের বিরোধী নেতার পিতা অং সান, ও রাজ্য কাউন্সিলর অং সান সু চি এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতারা ১৯৪৪ সালের আগস্টে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সংস্থা গঠন করেছিলেন, এই সংস্থা যুক্তরাজ্য কে জাপানের বিরুদ্ধে অন্যান্য মিত্রশক্তির সাথে জোট গঠনের জন্য বলেছিল। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে মিত্রশক্তি জাপানিদের তাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে, বার্মিজ এবং ব্রিটিশদের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল। জাপানিদের দখলে থাকার সময়ে, ১,৭০,০০০ থেকে ২,৫০,০০০ বেসামরিক লোক মারা গিয়েছিল।[১][২]
কিছু বার্মিজ জাতীয়তাবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার বিষয়টি দেখেছিলেন যুদ্ধের চেষ্টায় সহায়তার বিনিময়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ছাড় পাওয়ার সুযোগ হিসাবে। অন্যান্য বার্মিজ, যেমন থাকিন আন্দোলনকারীরা, যে কোনও পরিস্থিতিতে যুদ্ধে বার্মার অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যান্য থাকিনদের সাথে অং সান ১৯৩৯ সালের আগস্টে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৩] অং সান পিপলস রেভোলিউশনারি পার্টির (পিআরপি) সহ-প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দলের নামকরণ হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক পার্টি। স্বাধীনতা ব্লক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি ডোবামা এশিয়াইয়োন, এবিএসইউ, রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় সন্ন্যাসী এবং বা ম'য়ের দরিদ্র মানুষদের পার্টির সঙ্গে জোট গঠন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।[৩]
ডোবামা আসিয়ায়োন জাতীয় অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়ার পরে, অং সান সহ সংস্থার অনেক নেতা, যাঁরা চীনে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। অং সানের উদ্দেশ্য ছিল চীনা কমিউনিস্ট দের সাথে যোগাযোগ করা কিন্তু তাঁকে জাপানি কর্তৃপক্ষ চিনতে পেরে যায়। তারা তাঁকে মিনামি কিকান নামে পরিচিত একটি গোপন গোয়েন্দা বিভাগ গঠনের মাধ্যমে সমর্থন দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। এর প্রধান ছিলেন কর্নেল সুজুকি এবং এই বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল বার্মা রোড বন্ধ করে দেওয়া এবং একটি জাতীয় বিদ্রোহকে সমর্থন করা।[৩]
অং সান অল্প দিনের জন্য বার্মায় প্রত্যাবর্তন করে উনত্রিশজন যুবককে তালিকাভুক্ত করেছিলেন, যারা তাঁর সঙ্গে চীনের হাইনান প্রদেশে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল। তাঁরা একত্রে "তিরিশ কমরেড" নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপানিরা ব্যাংকক দখল করার পর, অং সান ১৯৪২ সালে জাপানের বার্মায় আগ্রাসনের অনুমান করে বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (বিআইএ) গঠনের ঘোষণা করেছিলেন।[৩]
জাপানের সামরিক নেতৃত্বের জন্য, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শত্রুতা শুরুর প্রারম্ভিক পর্যায়ে বার্মা বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্য ছিল। বার্মা দখল করলে চীনের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহের যোগাযোগ বাধাপ্রাপ্ত হত। এছাড়াও, জাপানিরা এটাও জানত যে, গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পদ রাবার উৎপাদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ভাবা কঠিন ছিল যে মিত্রশক্তি যদি জাপানের পক্ষে অনুকূল শর্তাদি গ্রহণ করে, তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয়র রাবার সরবরাহের যোগান থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে।
বিআইএ ১৯৪২ সালের বসন্তে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে, তবে বার্মার ভবিষ্যত নিয়ে জাপানি নেতৃত্বের মধ্যেই মত পার্থক্য ছিল। যখন কর্নেল সুজুকি তিরিশ কমরেডকে অস্থায়ী সরকার গঠনে উৎসাহিত করেছিলেন, জাপানী সামরিক নেতৃত্ব কখনও এ জাতীয় পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি। অবশেষে, জাপানী সেনাবাহিনী সরকার গঠনের জন্য বা ম'য়ের দিকে ঝুঁকলো।[৩]
১৯৪২ সালে যুদ্ধের সময়, বিআইএ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে গিয়েছিল॥ অনেক জেলা কর্মকর্তা এবং এমনকি অপরাধীরা বিআইএতে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এটি জাপানিদের অধীনে বার্মা প্রতিরক্ষা সেনা (বিডিএ) হিসাবে পুনর্গঠিত হলেও অং সানই এর নেতৃত্বে ছিলেন। যদিও বিআইএ একটি অনিয়মিত বাহিনী ছিল, বিডিএ তে নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ হত এবং জাপানি প্রশিক্ষকগণ একটি প্রচলিত সেনাবাহিনীর মতই প্রশিক্ষণ দিতেন।[৩]
পরে বা ম'কে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল, এবং তাঁর মন্ত্রিসভায় অং সানকে যুদ্ধমন্ত্রী হিসাবে, কমিউনিস্ট নেতা থাকিন থান তুনকে ভূমি ও কৃষিমন্ত্রী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এছাড়াও সমাজতান্ত্রিক নেতা থাকিনস নু এবং মিয়া উভয়েই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। জাপানিরা ১৯৪৩ সালে খাতায় কলমে বার্মাকে স্বাধীন ঘোষণা করার পর, বার্মা ডিফেন্স আর্মির (বিডিএ) নাম পরিবর্তন করে বার্মা ন্যাশনাল আর্মি (বিএনএ) করা হয়েছিল।[৩]
শীঘ্রই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠল যে জাপানের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিগুলি সমস্তই মিথ্যা ছিল এবং যে বা ম' প্রতারিত হয়েছিলেন। যুদ্ধের ফল জাপানিদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাথে সাথে, ১৯৪৩ সালের ১লা আগস্ট তারা বার্মাকে সম্পূর্ণ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করল, তবে এটিও ছিল আর একটি মিথ্যা। হতাশায় অং সান কমিউনিস্ট নেতা থাকিন থান তুন ও থাকিন সোয়ে এবং সমাজতান্ত্রিক নেতা ব্য সুউ এবং কিউ নাইয়েনের সাথে আলোচনা শুরু করেছিলেন, এবং এর ফলে ১৯৪৪ সালের আগস্টে পেগুতে সিপিবি, পিআরপি এবং বিএনএ এর গোপন বৈঠকে তৈরি হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংস্থা (এএফও)। পরে এএফওর নামকরণ করা হয় ফ্যাসিবাদ বিরোধী পিপলস ফ্রিডম লীগ (এএফপিএফএল),[৩] তারা জাপানি ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত বিরোধিতা করে এবং সুন্দর ও সকলের জন্য সমান সমাজের প্রস্তাব দেয়।[৪]
১৯৪১ সালের জুলাই মাসে ইনসেইন কারাগারে থাকাকালীন থানকিনস থান টুন ও সো, ইনসেইন ম্যানিফেস্টো সহ-রচনা করেছিলেন। এটি ডোবামা আন্দোলনে বিরাজমান মতামতের বিরুদ্ধে, বিশ্ব ফ্যাসিবাদকে আসন্ন যুদ্ধের প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করেছিল এবং একটি বৃহত্তর মিত্র জোটে ব্রিটিশদের সাথে অস্থায়ীভাবে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছিল, যেই জোটে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সোয়ে ইতোমধ্যে জাপানিদের দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে গা ঢাকা দিয়েছিলেন, এবং থান টুন জাপানের গোয়েন্দা তথ্য সোয়ের কাছে সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্য কম্যুনিস্ট নেতা থাকিনস থেইন পে এবং টিন শ্বে ভারতের শিমলায় নির্বাসিত ঔপনিবেশিক সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।[৩]