তাঞ্জোর বালাসরস্বতী | |
---|---|
প্রাথমিক তথ্য | |
জন্ম | ১৩ই মে ১৯১৮ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত |
উদ্ভব | তাঞ্জোর |
মৃত্যু | ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪ (৬৫ বছর বয়সী) মাদ্রাজ, ভারত |
ধরন | কর্ণাটকী ধ্রুপদী সংগীত |
পেশা | ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী |
তাঞ্জোর বালাসরস্বতী,[১] অথবা শুধু বালাসরস্বতী, (১৩ই মে, ১৯১৮ – ৯ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৪), একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে উৎপন্ন একটি শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী ভরতনাট্যম, তাঁর উপস্থাপনায় এই নৃত্য শৈলী, ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সুপরিচিতি পেয়েছে।
১৯৫৭ সালে তাঁকে ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল [২] এবং ১৯৭৭ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ দেওয়া হয়েছিল।[১] ১৯৮১ সালে তিনি চেন্নাইয়ের ইন্ডিয়ান ফাইন আর্টস সোসাইটির সংগীত কলাশিখামণি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বালাসরস্বতী মন্দিরের সংগীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের (যাদের দেবদাসী বলা হয়, যাঁরা উচ্চ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করতেন) ঐতিহ্যবাহী প্রথা মাতৃকুলভিত্তিক পরিবারের সপ্তম প্রজন্মের প্রতিনিধি ছিলেন।[৩] বালাসরস্বতীর শিল্পী বংশের সন্ধান করলে পাপাম্মল পর্যন্ত পৌঁছোনো যায়, যিনি ছিলেন তাঞ্জোর শাসকদের দরবারে অষ্টাদশ শতাব্দীর এক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। এই থেকেই তাঁর নামে 'তাঞ্জোর' নামটি এসেছে। অনেকে মনে করেন তাঁর মাতামহ বীণা ধনম্মল (১৮৬৭–১৯৩৮) বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর মা, জয়ম্মল (১৮৯০-১৯৬৭) একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন, যিনি বালাসরস্বতীর প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করেছিলেন।[৪]
সাত বছর বয়সে তিনি কাঞ্চিপুরম শহরের দেবী মন্দিরে তাঁর আরঙ্গেত্রম (প্রথম জনসমক্ষে মঞ্চে ওঠা) করেছিলেন এবং তাঁর ছন্দবদ্ধভাবে সম্পাদিত গতিবিধি দর্শকদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।[৫]
বড় হওয়ার সাথে সাথে বালাসরস্বতী ভরতনাট্যমকে তাঁর পেশা হিসেবে নেয়ার প্রতিজ্ঞ আরো দৃঢ় হয়। তবে, তাঁর এই সিদ্ধান্তে পরিবার এবং সমাজ উভয় দিক থেকেই প্রচুর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। পূর্ণকালীন পেশা হিসাবে নৃত্যকে তুচ্ছ করে দেখা হত। যেহেতু তাঁর পরিবার দেবদাসী সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত ছিল তাই তারাও তাঁর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে চায়নি। কিন্তু তাঁর মাতামহ বীণা তাঁর সম্ভাবনা বুঝতে পেরে তাঁকে গুরু কান্দাপ্পা পিল্লাইয়ের অধীনে নৃত্য প্রশিক্ষণে ভর্তি করেছিলেন। একই সঙ্গে, তিনি চিন্নায়া নাইডু এবং গৌরী আম্মলের কাছেও অনুশীলন করতেন। গৌরী তাঁকে স্ত্রোত্রপাঠ এবং নৃত্যাভিনয় (অভিব্যক্তি) শিখিয়েছিলেন। তিনি এই মহিমান্বিতদের তত্ত্বাবধানে বিকশিত হয়ে উঠেছিলেন এবং নৃত্যশিল্পী হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে দিনরাত অনুশীলন করেছিলেন।[৪]
তিনি শৈশবকাল থেকেই পরিবারের মধ্যে সংগীত শিখেছিলেন এবং বিখ্যাত থানজাবর নট্টুভানর পরিবারের সদস্য বিশিষ্ট নৃত্যশিক্ষক কে কান্দ্প্পান পিল্লাইয়ের অধীনে তিনি চার বছর বয়সে নৃত্যের কঠোর প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন। তার ছোট ভাইরা ছিলেন সংগীতশিল্পী টি রঙ্গনাথন এবং টি বিশ্বনাথন যারা উভয়ই ভারত এবং আমেরিকার বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী এবং শিক্ষক হয়ে উঠেন। তাঁর কন্যা লক্ষ্মী নাইট (১৯৪৩-২০০১) তাঁর মায়ের ধরনের এক বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী হয়েছিলেন। তার নাতি অনিরুদ্ধ নাইট আজও পারিবারিক রীতিতে অভিনয় করে চলেছেন, এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বালা সংগীত ও নৃত্য সমিতি এবং ভারতের বালাসরস্বতী স্কুল অব ডান্সের শৈল্পিক পরিচালক। তার জামাতা ডগলাস এম নাইট জুনিয়র একটি গুগেনহেম ফেলোশিপ (২০০৩) এর সহায়তায় তাঁর জীবনী লিখেছেন। বিখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তার কাজের একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন।
১৯২৫ সালে, সাত বছর বয়সে, নর্তকী হিসেবে বালাসরস্বতীর আত্মপ্রকাশ হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতের বাইরে এই ঐতিহ্যবাহী রীতির নৃত্য প্রদর্শনে তিনিই ছিলেন প্রথম, ১৯৩৪ সালে কলকাতায় তিনি প্রথম নৃত্য প্রদর্শন করেছিলেন।[৪] কৈশোর বয়সে তিনি নৃত্য পরিকল্পক উদয় শঙ্করের চোখে পড়েছিলেন। উদয় শঙ্কর তাঁর প্রদর্শনের উৎসাহী প্রচারক ছিলেন, এই সময়ে তিনি বিদেশেও নৃত্য প্রদর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর প্রদর্শন বিখ্যাত মাপের মানুষদের সমালোচনা ও সম্মান পেয়েছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন শম্ভু মহারাজ, মার্গোট ফন্টেইন, মার্থা গ্রাহাম এবং মেরেস কানিংহাম। মাদ্রাজের সংগীত একাডেমির প্রশাসকদের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে বালাসরস্বতী প্রতিষ্ঠানের সাথে মিলিতভাবে একটি নৃত্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে নতুন নৃত্যশিল্পীদের ভরতনাট্যম প্রশিক্ষণ দিতেন। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা সহ অনেক দেশে পারফর্ম করে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করেছিলেন। সেই দশকের পরে, ১৯৭০-এর দশক এবং ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে, তিনি বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন ও থেকেছেন। কারণ তিনি ছিলেন ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটি (মিডলেটাউন, কানেকটিকাট), ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব আর্টস (ভ্যালেন্সিয়া), মিলস কলেজ (ওকল্যাণ্ড, ক্যালিফোর্নিয়া), ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় (সিয়াটল) এবং জ্যাকবসের বালিশ নৃত্য উৎসব (বেকেট, ম্যাসাচুসেটস) সহ আরো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং অভিনয়শিল্পী। তাঁর আন্তর্জাতিক ব্যস্ততার পাশাপাশি ভারতে তাঁর কার্যক্রমের মাধ্যমে, বিশেষত মাদ্রাজে, বালাসারস্বতী শুধুমাত্র ভারত নাট্যমের ঐতিহ্যগত স্টাইলে অগণিত শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন নি, বরং এই শিল্পের অনেক নতুন অনুশীলনকারীকেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
তিনি ভারতে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছিলেন, এর মধ্যে ছিল সংগীত নাটক আকাদেমি থেকে রাষ্ট্রপতির পুরস্কার (১৯৫৫), ভারত সরকারের কাছ থেকে বিশিষ্ট জাতীয় সেবার জন্য পদ্মবিভূষণ (১৯৭৭) এবং মাদ্রাজ সংগীত একাডেমি থেকে সংগীত শিল্পীদের জন্য দক্ষিণ ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার সংগীত কলানিধি (১৯৭৩)।