বালুচরী শাড়ি | |
---|---|
উৎপত্তিকাল | অষ্টাদশ শতাব্দী |
উৎপত্তিস্থল | বিষ্ণুপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
উপাদান | রেশম |
দৈর্ঘ্য | ১৫ ফুট লম্বা ও ৪২ ইঞ্চি চওড়া, আঁচলের দৈর্ঘ্য ২৪ থেকে ৩২ ইঞ্চি |
শৈলী | বালুচরী শাড়ি এক প্রকারের রেশমজাত হাতে বোনা শাড়ি যার আঁচলের উপর বিবিধ পৌরাণিক ও অন্যান্য নকশা কাজ করা থাকে |
প্রকারভেদ | চিত্র, কল্কা, পাড় ও বুটি |
বিপণনকারী | বিশ্ব বাংলা[১] |
ভৌগোলিক নির্দেশক মর্যাদা | অনুমোদিত |
ফাইল নং | ১৭৩ |
ওয়েবসাইট | http://ipindia.nic.in/girindia/ |
বালুচরী পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ শাড়ি, ভারতের ভৌগোলিক স্বীকৃতি এবং বয়নশৈলীতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পকর্ম৷ আঁচলে বিবিধ পৌরাণিক ও অন্যান্য নকশা-বোনা এই শাড়ি আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে গণ্য৷ বালুচরী শাড়ি তৈরিতে মোটামুটি ১ সপ্তাহ ও তার বেশি সময় লাগে ।[২] [৩] এই শাড়ি ভারতের ভৌগোলিক অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। [৪]
বালুচরীর জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের নিকটবর্তী অধুনালুপ্ত বালুচর নামক স্থানে। বালুচরের সঠিক অবস্থান নিয়ে নানান মত আছে। ভারত পথিক যদুনাথ সর্বাধিকারী তার ১৮৫৭ সালে রচিত ভ্রমণ বৃত্তান্তে জিয়াগঞ্জ শহরে বালুচর বলে একটি অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেছেন যা চেলি ও গরদের আড়ত।[৫] মুর্শিদাবাদ জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও রেশমশিল্প গবেষক নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতে বহরমপুরের কয়েক মাইল উত্তরে ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত ছিল বালুচর।[৬] ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষের মতে জিয়াগঞ্জের বালুচর ছিল রেশমশিল্পজাত নানা প্রকার বস্ত্রাদির বড় আড়ত ও ব্যবসা কেন্দ্র। তাঁতশিল্পীদের বসতি ছিল জিয়াগঞ্জের নিকটবর্তী বাহাদুরপুর, বেলিয়াপুকুর, রামডহর, রমনাপাড়া, রণসাগর, আমডহর, বাগডহর, আমাইপাড়া প্রভৃতি গ্রামসমূহ।[৭] তারা তাদের রেশমের শাড়ি জিয়াগঞ্জের বালুচরে বিক্রি করতেন। বিক্রয় কেন্দ্রের নামেই শাড়ীর নাম হয় বালুচরী।[৭] লোকসংস্কৃতি গবেষক ডঃ সোমনাথ ভট্টাচার্যের মতে বালুচরীর উদ্ভব বালুচর অঞ্চলের নিকটবর্তী মীরপুর-বাহাদুরপুর গ্রামে।[৮]
বালুচরীর জন্মকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। বালুচরীর জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে নানান মত আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ অঞ্চলে গড়ে ওঠে বাণিজ্যকেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে মারোয়ারী, গুজরাতী, পঞ্জাবী, আর্মানী, ইহুদী, ইংরাজ, ফরাসী ও ওলন্দাজ বণিকরা বাণিজ্যের জন্য আসতে থাকেন এই অঞ্চলে। একটি মত অনুসারে সেই সময় গুজরাতী তাঁতীদেরও আগমন হয়, এবং তার ফলেই ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে বালুচরে গড়ে ওঠে বয়নশিল্প।[৬] অন্য মতে মুর্শিদ কুলি খাঁ ১৭০৪ সালে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করার পর তার বেগমদের জন্য নতুন শাড়ি তৈরীর হুকুম দেন বালুচরের তাঁতশিল্পীদের। তারা যে নতুন শাড়ি সৃষ্টি করেন তাই বালুচরী নামে খ্যাত হয়।[৯]
নবাব মুর্শিদকুলি খানের উদ্যোগে সেখানে এই শিল্পের রমরমা দেখা দেয়৷[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] সেখানে এই শিল্পের শেষ বিখ্যাত কারিগর দুবরাজ দাস মারা যান ১৯০৩ সালে, তিনি চিত্রশিল্পীদের মত শাড়িতে নিজের নাম সই করতেন৷[১০] গঙ্গার বন্যায় এই গ্রাম বিধ্বস্ত হলে শিল্পীরা আশ্রয় নেন বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে৷ সেখানে মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষণে এই শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটে৷ মল্ল রাজাদের সময়ে নির্মিত টেরাকোটার মন্দির ও অন্যান্য শিল্পের প্রভাব পড়ে এই শাড়ির নকশায়৷ পরে ব্রিটিশ জমানায় অন্যান্য দেশীয় বয়নশিল্পের মত বালুচরীও দুর্দশাগ্রস্ত হয়৷ ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সুভো ঠাকুর বা সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এই শাড়ির বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটে৷ তিনি তখনকার বিখ্যাত কারিগর অক্ষয়কুমার দাসকে রিজিওনাল ডিজাইন সেন্টারে (সুভো ঠাকুর এর ডিরেক্টর ছিলেন) সাবেক জালা তাঁতের পরিবর্তে জ্যাকার্ড তাঁতের ব্যবহার শেখান৷ পরের বছর অক্ষয় দাস অজন্তা-ইলোরার মোটিফ লাগিয়ে নতুন বালুচরী বাজারে আনলে এই শিল্পের উত্থান ঘটে৷
বালুচরী দৈর্ঘ্যে ১৫ ফুট লম্বা ও ৪২ ইঞ্চি চওড়া। আঁচলের দৈর্ঘ্য ২৪ থেকে ৩২ ইঞ্চি।[৮] গবেষিকা চিত্রা দেব বালুচরীর অলংকরণকে চার ভাগে ভাগ করেছেন, যথা চিত্র, কল্কা, পাড় ও বুটি। তার মতে চিত্র অংশের নকশা অন্যান্য শাড়ীতে দেখা যায় না।[৫]
রেশম বালুচরীতে নিত্য নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে তৈরি হয়েছে অনেক ধরনের শাড়ি৷ এক বা দুই রঙের সাধারণ বালুচরী, রঙে ঝলমল মীনাকরী বালুচরী, গুরুদাস লক্ষ্মণ আবিষ্কৃত স্বর্ণচরী, অমিতাভ পালের সৃষ্টি রূপশালি ও মধুমালতী, অমিত লক্ষ্মণের সৃষ্টি দ্রৌপদী বালুচরী (মহাভারত টিভি সিরিয়ালের দ্রৌপদীর সাজসজ্জার অনুকরণে) ইত্যাদি এর নানা প্রকার৷[১১]
এই শাড়ি মূলতঃ রেশম শাড়ি, যদিও পরে তুলো থেকে তাঁতের বালুচরী ও আজকাল বাঁশ, কলা ইত্যাদি গাছ থেকে পাওয়া সুতো থেকে জৈব বালুচরীও বানানো হয়েছে৷ একটা শাড়ি বানাতে দুজন কারিগরের এক সপ্তাহ বা বেশি সময় লাগে৷ প্রথমে গুটিপোকা থেকে রেশম সংগৃহীত হয়, পরে তা সোডা ও গরম জলে সেদ্ধ করা হয় ও অ্যাসিড রঙে চোবানো হয়৷ তারপর দুদিক দিয়ে টেনে টানটান করা হয়, যাতে সুতো দিয়ে কাপড় বোনা যায়৷ শাড়ির নকশাগুলি কাগজে এঁকে পাঞ্চিং কার্ডের সাহায্যে শাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়৷ আজকাল পরিবেশ বাঁচাতে নানা জৈব রঙও ব্যবহৃত হচ্ছে৷
বাঁকুড়া জেলা ও রেশম, এর ওপর সরকারি ভৌগোলিক তকমা পরায় অন্যত্র ও অন্য জিনিসে তৈরি হলে বালুচরী নাম দেওয়া যাবে না৷ জাতীয় পুরস্কার, শিল্পমেলা ইত্যাদির কারণে বাংলা ও ভারতের বাইরেও এখন এই শাড়ির খ্যাতি ব্যাপ্ত৷ ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লন্ডন সফরের সময় বিশ্ব বাংলা সংস্থার সহায়তায় ব্রিটেন ও জাপানের বাজারে লরা অ্যাশলির দোকানে বালুচরী, শীতলপাটি ও অন্যান্য বঙ্গজ সামগ্রী বিক্রির জন্য রফতানি সংস্থা ওবিটি ও লরা অ্যাশলি কোম্পানির চুক্তি হয়।[১] এসবের ফলে বালুচরীর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল৷