বাহুবলী ছিলেন প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভের পুত্র। তিনি জৈন কালচক্রের ‘অবসরপনি’ যুগে বর্তমান ছিলেন।[১][note ১][৩] জৈনদের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হলেন বাহুবলী। তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ভরতের সঙ্গে একটি অহিংস দ্বন্দ্বযুদ্ধ জয়ের পর তার মনে সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা জেগেছিল। তিনি তার রাজ্য ভরতকে দান করে দিয়ে এক দিগম্বর সন্ন্যাসী হয়ে যান। এক বছর কায়োৎসর্গ ভঙ্গিমায় স্থাণু হয়ে থাকে তিনি ধ্যান করেন। এর ফলে তার পা ঘিরে লতাপাতা গজিয়ে ওঠে।[৪] এক বছর ধ্যানের পর তিনি কেবল জ্ঞান (সর্বজ্ঞতা) প্রাপ্ত হন এবং একজন অরিহন্তে পরিণত হন। যে মানুষ ক্রোধ, আসক্তি, লোভ ও গর্ব প্রভৃতি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করতে পারেন, তাকেই ‘অরিহন্ত’ বলা হয়। জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, বাহুবলী কৈলাস পর্বতে মোক্ষ লাভ করে একজন সিদ্ধে (অর্থাৎ, পূণ্যাত্মা বা পবিত্রাত্মা ব্যক্তি) পরিণত হন।[৫]
বাহুবলীর অপর নাম গোমতেশ্বর। কারণ, এই নামে তার একটি বিগ্রহ নির্মিত হয়েছে। গোমতেশ্বর মূর্তিটি তৈরি করান গঙ্গ রাজবংশের মন্ত্রী ও সেনাপতি চামুণ্ডারায়। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের হাসান জেলার শ্রবণবেলগোলায় অবস্থিত এই একশিলা[note ২] মূর্তিটির উচ্চতা ৫৭-ফুট (১৭ মি)। মূর্তিটি ৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম বিনা-সহায়তায় দণ্ডায়মান মূর্তিগুলির অন্যতম।[১][৬] ২০০৭ সালের ৫ অগস্ট, মূর্তিটি ভারতের সাত আশ্চর্যের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে ৪৯% ভোট পেয়ে।[৭] প্রতি বারো বছরে এক বার আয়োজিত মহামস্তকাভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এখানে প্রচুর তীর্থযাত্রী, ভক্ত ও পর্যটক সমাগম হয়।
খ্রিস্টীয় ১০ম শতাব্দীতে আদিকবি পম্পা কন্নড় ভাষায় ১৬টি স্কন্ধে গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পু আকারে রচনা করেন আদিপুরাণ (৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ)। এই গ্রন্থে প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভের ও তার দুই পুত্র ভরত ও বাহুবলীর দশটি জীবনের কথা আছে।[৮][৯]
জৈন ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, ঋষভদেব যখন সন্ন্যাস গ্রহণের কথা ভাবলেন, তখন তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্র ভরতকে রাজ্য দান করেন এবং কনিষ্ঠ পুত্র বাহুবলীকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্বাচিত করেন।[১০]
ভরত ও বাহুবলীর মন্ত্রীরা দুই ভাইকে যুদ্ধ থেকে নিরত করার জন্য বলেন,
দুই ভাই নিজেদের কোনো উপায়ে বধ করতে পারেন না। তাঁরা তাঁর উপক্রমণের সর্বশেষ অবতার। তাঁদের শরীর যুদ্ধে নষ্ট করতে পারে এমন কোনো অস্ত্র নেই! তাই তাঁদের যুদ্ধ করতে হবে অন্য উপায়ে।
তখন তিন ধরনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের বিবাদ নিরসনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। এগুলি হল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে (চক্ষুযুদ্ধ), জলযুদ্ধ ও মল্লযুদ্ধ। বাহুবলী সব কটি যুদ্ধে জয় লাভ করলেন।[১১]
ভাই ভরতের সঙ্গে যুদ্ধের পর বাহুবলী মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। তিনি রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন তিনি কেবল জ্ঞান অর্জনের জন্য ধ্যান শুরু করেন। কিন্তু ভরতের দেশে দাঁড়িয়ে তিনি মনের দ্বিধা সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেননি বলে, ধ্যানেও সাফল্য অর্জন করতে পারেন না।[১২]
কিন্তু বাহুবলী দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলেন। ধ্যান করতে করতে লতাপাতা, কীটপতঙ্গ ও ধূলায় তার দেহ ঢেকে যায়। কিন্তু তার দিকে নজর দেন না। তার দুই বোন ব্রাহ্মী ও সুন্দরী একথা জানতে পেরে তীর্থঙ্করকে তাদের পার্থিব ভ্রাতা বাহুবলীর কথা জানান। তীর্থঙ্কর আদিনাথ বলেন, বাহুবলী জ্ঞানের খুব কাছে দাঁড়িয়েও জ্ঞান অর্জন করতে পারছেন না একটিই কারণে। তিনি ‘হস্তী’ অর্থাৎ আত্মম্ভরিতা ত্যাগ করতে পারছেন না। বোনেদের কাছে একথা শুনে বাহুবলী প্রশ্ন করেন, “আমি কি সত্যিই কোনো হস্তীর উপর দাঁড়িয়ে আছি?” এই প্রশ্ন করা মাত্র তিনি হস্তীটি সম্পর্কে অবহিত হন। তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি গর্ব ও অহংকারের উপর দণ্ডায়মান। বাহুবলী তখন গর্ব ও অহমিকা ত্যাগ অরেন। তিনি যাবার জন্য পা বাড়িয়ে যেই প্রণত হলেন অমনি সত্য ও জ্ঞান তার উপর বর্ষিত হল। সত্যজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে বাহুবলী তার পিতার কাছে গেলেন। ঋষভ তাকে গ্রহণ করলেন। বাহুবলী তখন মানুষকে শিক্ষা দিতে ও সঠিক পথ দেখাতে শুরু করলেন।
ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে বাহুবলীর পাঁচটি একশিলা মূর্তি আছে যেগুলির উচ্চতা ২০ ফুটের বেশি।
মহারাষ্ট্র রাজ্যের কোলাপুরের কুম্ভোজের বাহুবলী অতিশয়ক্ষেত্রে দণ্ডায়মান অবস্থায় একটি ২৮ ফুট উঁচু মূর্তি আছে।
ধর্মস্থলে সম্প্রতি বাহুবলীর একটি নতুন মূর্তি নির্মিত হয়েছে। গুজরাত রাজ্যেও বাহুবলীর একটি মূর্তি নির্মিত হচ্ছে।
মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ইন্দোর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে গোমাতাগিরিতে শ্রবণবেলগোলার মূর্তিটির অনুরূপ একটি গোমতেশ্বর মূর্তি রয়েছে।
কর্ণাটকের রাজধানী বেঙ্গালুরু থেকে ১৫৮ কিলোমিটার দূরে শ্রবণবেলগোলায় ‘গোমতেশ্বর’ নামে পরিচিত বাহুবলীর বিশাল একশিলা মূর্তিটি অবস্থিত। পর্বতের উপর অবস্থিত এই মূর্তিটি একটি মাত্র গ্র্যানাইট পাথর কেটে নির্মিত। মূর্তিটির উচ্চতা ১৭ মিটার (৫৫ ফুট)। ৩০ কিলোমিটার দূর থেকে মূর্তিটি দেখা যায়। বহু শতাব্দী ধরে শ্রবণবেলগোলা জৈনদের কাছে একটি তীর্থক্ষেত্র।
এই মূর্তিটি বিশ্বের বৃহত্তম একশিলা মূর্তিগুলির অন্যতম। গঙ্গ রাজা চতুর্থ রাচমল্ল সত্যবাকের (৯৭৫-৯৮৬) মন্ত্রী চামুণ্ডারায় কর্তৃক এই মূর্তিটি নির্মিত হয়। মূর্তিটির আশেপাশের অঞ্চলে বাসাদি নামে পরিচিত জৈন মন্দির ও তীর্থঙ্করদের অনেক মূর্তি আছে। মহামস্তকাভিষেকের সময় প্রচুর তীর্থযাত্রী ও পর্যটক এখানে আসেন। ১২ বছরে একবার মহামস্তকাভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। এই সময় গোমতেশ্বর মূর্তিটিকে দুধ, মধু, ঘি ইত্যাদি দিয়ে স্নান করানো হয়।[১] ভারত সরকার এই মূর্তিটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।[১৩]
কর্ণাটকের উডুপি জেলায় কারকল তালুকের সদর শহর কারকল উডুপি থেকে ৩৮ কিলোমিটার ও বেঙ্গালুরু থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ম্যাঙ্গালোর শহরের ৫২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই শহরটি বাহুবলীর একটি বিশাল মূর্তির জন্য বিখ্যাত।
কারকলের গোমতেশ্বর বাহুবলীর মূর্তিটি ৪২ ফুট উঁচু। এটিও একটি একশিলা মূর্তি। সম্ভবত ১৪৩২ সালে এটি নির্মিত হয়। এই মূর্তিতে তিনটি পাথরের খোদিত ধাপের উপর কায়োৎসর্গ ভঙ্গিমায় বাহুবলীকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। বীরপাণ্ড্য ভৈরব রাজা বাহুবলীর সম্মানে এই মূর্তিটি নির্মাণ করান। এখানে প্রতি ১২ বছর অন্তর মহামস্তকাভিষেক অনুষ্ঠান হয়। এই সময় বহু জৈন তীর্থযাত্রী এখানে আসেন। এই মূর্তিটি কর্ণাটকের দ্বিতীয় বৃহত্তম মূর্তি।