বিজয়নগর সাম্রাজ্যে কন্নড় সাহিত্য বলতে বোঝায় খ্রিস্টীয় চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বিজয়নগরের সম্রাটদের প্রভুত্বের যুগে দক্ষিণ ভারতের কন্নড় ভাষায় রচিত সাহিত্যসম্ভার। ১৩৩৬ সালে প্রথম হরিহর ও প্রথম বুক্ক রায় নামে দুই ভাই এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৬৫ সালে তালিকোটার যুদ্ধে শাহি সালতানাতের কাছে পরাজিত হওয়ার পর বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শক্তিক্ষয় শুরু হয়। তবে ১৬৬৪ সাল পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য টিকে ছিল। সাম্রাজ্যটির নামকরণ করা হয়েছিল এর রাজধানী বিজয়নগরের নামানুসারে। এই শহরের ধ্বংসাবশেষ অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কর্ণাটক রাজ্যের হাম্পির চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। এটি এখন ইউনেস্কো-স্বীকৃত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
এই যুগের কন্নড় সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হল বীরশৈব (লিঙ্গায়েত) ও বৈষ্ণব সমাজ ও ধর্ম-বিষয়ক রচনা এবং অল্প পরিমাণে জৈন লেখকদের অনুরূপ বিষয় নিয়ে লিখিত গ্রন্থাবলি।[১][২] ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যও এই যুগে প্রথমাবধিই জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল।[৩] শুধুমাত্র কবি বা পণ্ডিতেরই নয়, এই যুগে রাজপরিবারের সদস্যবর্গ, রাজমন্ত্রী, সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ আধিকারিক, অভিজাতবর্গ এবং বিভিন্ন সামন্ত শাসকও সাহিত্যক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।[৪][৫][৬] সেই সঙ্গে চারণকবি, মরমিয়া ও সন্ত-কবিরাও ভক্তিমূলক লোকসাহিত্যের এক বিপুল সম্ভার সৃষ্টি করেন, যা বিজয়নগরের সমাজব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করে। এই যুগের কবিরা স্থানীয় ষট্পদী (ছয়-চরণের পদ্য), সাঙ্গত্য (বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গেয়) ও ত্রিপদী (তিন-চরণের পদ্য) ছন্দগুলিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।[৭]
সঙ্গম রাজবংশের সর্বাধিক পরিচিত রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের রাজত্বকালে বীরশৈব সাহিত্যের সর্বাধিক উৎকর্ষ সাধিত হয়।[৮] অন্যদিকে তুলুব রাজবংশের রাজা কৃষ্ণদেব রায় ও পরবর্তী শাসকদের রাজত্বকালে বৈষ্ণব সাহিত্যের সর্বাধিক উন্নতি ঘটে।[৯] পূর্ববর্তী শতকগুলিতে কন্নড় ভাষায় জৈন সাহিত্য প্রভাবশালী ছিল। কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম ও বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে এই প্রভাব ক্ষীণ হতে শুরু করে। এই ভক্তি আন্দোলনে হরিদাস সম্প্রদায়ের অবদানও বিশেষভাবে স্মরণীয়।[১০] বিজয়নগর সাম্রাজ্যে কন্নড় ও তেলুগু সাহিত্যের মধ্যে যে আদানপ্রদান শুরু হয়েছিল তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এই সাম্রাজ্যের পতনের পরেও থেকে যায়।[১১]
দ্বাদশ শতকের পূর্বে জৈন সাহিত্যিকেরা কন্নড় সাহিত্যে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। এই সাহিত্যিকদের গদ্য-পদ্য মিশ্রিত চম্পূ শৈলীর রচনা রাজসভায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। মধ্যযুগের পরবর্তী পর্যায়ে জৈন সাহিত্যকারেরা বীরশৈবদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। আবার বীরশৈবরা বচন কবিতার মাধ্যমে রাজকীয় সাহিত্যের ধারণার বিপরীতে গণসাহিত্যের ধারাটিকে প্রতিষ্ঠা করেন। এই কাব্য ছিল কথ্যভাষায় রচিত এক শৈলীবদ্ধ সাহিত্য, যা লোকসাহিত্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।[১২] দ্বাদশ শতকে শিবের উপাসক বীরশৈবদের সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অন্যদিকে বিষ্ণুর উপাসক বৈষ্ণব সাহিত্যিকদের প্রভাব সূচিত হয় পঞ্চদশ শতকে। এর ফলে জৈন সাহিত্যিকেরা নিজেদের সাহিত্যধারাকে সংশোধনে বাধ্য হন। সন্ন্যাসের ন্যায় প্রথাগত বিষয়বস্তু থেকে সরে এসে জৈনরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন সমসাময়িক বিষয়ে। ত্রয়োদশ শতকে রচিত অণ্ডয়্যের কব্বিগর কব (কবিগণের রক্ষক) গ্রন্থটি ছিল সাহিত্যশৈলীর এই দিক পরিবর্তনের একটি আদি উদাহরণ। এই গ্রন্থে বীরশৈবদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে; জৈন লেখক মন্মথ কর্তৃক শিবকে অর্ধনারীতে পরিণত করার উপাখ্যানটি গ্রহণ করেছেন শৈবদের উপহাস করার জন্য।[১৩] বীরশৈবরাও নিয়মানুগ সাহিত্যের ধারাটিকে ত্যাগ করে লোকসাহিত্যের ধারায় সাহিত্যরচনা শুরু করে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সূচনা করেন। আবার বৈষ্ণব হরিদাস সম্প্রদায়ের সন্ত-কবিরা সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য গীতিকবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।[১৪] এই যুগের ধ্রুপদি সাহিত্য অতীতের রাজা ও সেনানায়কদের স্তবস্তুতিতে পরিপূর্ণ। এই যুগে কন্নড় সাহিত্য কথ্য ভাষা ও লোকসংগীতের পরম্পরার নিকটবর্তী হয়ে আসে। গীতিযোগ্যতা ও দেবভক্তি এই সাহিত্যের এক স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে।[১৫]
চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ ভারতে যে বড়োসড়ো রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলি সূচিত হয়েছিল, সাহিত্যক্ষেত্রেও তার প্রভাবে এই পরিবর্তনগুলি ঘটে। স্থানীয় হিন্দু রাজ্যগুলির পতনের পর উত্তর ভারত থেকে আগত মুসলমান আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সুরক্ষাপ্রাকার হিসেবে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। আর সেই সঙ্গে চারুকলার উৎকর্ষের অনুকূল এক পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়।[১৬][১৭] কন্নড় সাহিত্যের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়টি বৈষ্ণব ও বীরশৈব সাহিত্যিকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সাক্ষী। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাহিত্য নিয়ে বিতর্ক ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার; বিশেষত রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের রাজসভা ছিল এই তর্কবিতর্কের এক প্রধান স্থল। এই তীব্র প্রতিযোগিতার ফলশ্রুতিই হল সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের কবিদের লেখা ধ্রুপদি গ্রন্থগুলির সম্মানে বের হওয়া "সংগঠিত শোভাযাত্রা"।[৬] দুই সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ ও সুপরিচিত সাহিত্যিকেরা ছাড়াও অনেক লেখক তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের সাহিত্য রচনা করেছিলেন; এগুলির মধ্যে সাম্প্রদায়িক মতের প্রকাশ ও প্রচারমূলক বিবৃতিই ছিল প্রধান।[১৮]
বৈষ্ণব সাহিত্যকারদের দু’টি গোষ্ঠী ছিল এবং সম্ভবত এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। একটি গোষ্ঠীতে ছিলেন সাধারণাভাবে রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট ব্রাহ্মণ টীকাকারেরা; এবং অপর গোষ্ঠীতে ছিলেন রাজসভার সংসর্গ থেকে দূরে থাকা ভক্তিবাদী কবিরা। এই কবিরা লোকগীতির ধাঁচে মধুর গান রচনা করে সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরপ্রেমের বার্তা পৌঁছে দিতেন। কুমার ব্যাস ও তিম্মন্ন কবি ছিলেন সুপরিচিত ব্রাহ্মণ টীকাকার; অন্যদিকে পুরন্দর দাস ও কনক দাস ছিলেন বিখ্যাত ভক্তিবাদী কবি।[১৯] ত্রয়োদশ শতকে কন্নড়ভাষী অঞ্চলেই মধ্বাচার্য দ্বৈতবাদী দর্শন প্রচার করেছিলেন। পরবর্তী দুই শতকে এই দর্শন কন্নড়ভাষী অঞ্চলের বাইরেও প্রসার লাভ করে। হরিদাস সম্প্রদায়ের পরিব্রাজক মরমিয়া সন্ত-কবিরা মধ্বাচার্যের দর্শনকে সরল কন্নড় ভাষায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন এবং ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি, জ্ঞান ও বৈরাগ্যের আদর্শ প্রচার করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।[১২][২০]
এই যুগটি ছিল ষট্পদী ছন্দের যুগ। অবশ্য চামরস, কুমার ব্যাস, কনক দাস ও ভাস্করের ন্যায় সুদক্ষ কবিরাই কেবল এই ছন্দ যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[২১] কন্নড় সাহিত্যে এই ছন্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম নাগবর্মা কর্তৃক আনুমানিক ৯৯০ সালে লেখা ছন্দোম্বুধি গ্রন্থে। কিন্তু দ্বাদশ শতকে হৈসল কবি রাঘবাঙ্ক প্রথম এই ছন্দটি সার্থকভাবে ব্যবহার করেন।[২২] ষড়মাত্রিক এই ছন্দটি আখ্যানকাব্যের জন্য উপযুক্ত ছিল এবং সমগ্র বিজয়নগর যুগে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল।[২৩] বৈরশৈবরা শতক ছন্দের (একশো চরণের পদ্য) উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। বীরশৈব নীতিমূলক সাহিত্যের অধিকাংশ এই ছন্দে রচিত হলেও এর সর্বাপেক্ষা সুপ্রসিদ্ধ শিল্পী ছিলেন জৈন কবি রত্নাকর বর্ণি। আবার সাঙ্গত্য ছন্দে রত্নাকর বর্ণি ও কনক দাসের রচনাগুলিকেও এই যুগের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে গণ্য করা হয়।[২১]
হৈসল যুগে রাজসভায় কন্নড় ও তেলুগু সাহিত্যের মধ্যে যে আদানপ্রদানের পরম্পরার সূত্রপাত হয়েছিল তা বিজয়নগর যুগেও অব্যাহত ছিল। কন্নড় থেকে তেলুগু এবং তেলুগু থেকে কন্নড় বাষায় ধ্রুপদি সাহিত্যের অনুবাদ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই যুগের বিশিষ্ট দ্বিভাষিক কবিরা ছিলেন ভীম কবি, পিদুপর্তি সোমনাথ ও নীলকণ্ঠাচার্য। ধূর্জটি প্রমুখ কন্নড়-বিশারদ তেলুগুর কবিরা কন্নড় পরিভাষা মুক্তভাবে তেলুগু রচনায় ব্যবহার করতেন। কন্নড় ভাষার সঙ্গে এমন "ঘনিষ্ঠতা"র সুবাদে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রীনাথ নিজের তেলুগু রচনাকে "কন্নড়" বলে উল্লেখ করতেন। দ্বিভাষিক সাহিত্যিকদের হাতে অনুবাদের ধারা পরের শতকগুলিতেও অব্যাহত ছিল।[১১]
ষোড়শ শতকের শেষ ও সপ্তদশ শতকের গোড়ায় বিজয়নগর সাম্রাজ্য বহুধাবিভক্ত হয়ে পড়লে কন্নড় সাহিত্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে নবোদিত স্বাধীন মহীশূর ও কেলাডি নায়ক রাজসভা। এই সবার রাজসভার সাহিত্যিকেরা অনেকেই ছিলেন বীরশৈব ধর্মাবলম্বী। এই সাহিত্যিকেরা যে শুধু কন্নড় ভাষাতেই সুপণ্ডিত ছিলেন তা-ই নয়, বরং প্রায়শই সংস্কৃত এবং/অথবা তেলুগু ভাষাতেও সমান পারদর্শিতা অর্জন করতেন। এমনই দুই সাহিত্যিক ছিলেন কালালে নাগরাজ ও বেঙ্গালুরু শহরের প্রতিষ্ঠাতা কেম্পে গৌড়া। এই ধরনের বহুভাষিকতা সম্ভবত উদারনৈতিক বিজয়নগরের সাহিত্য-সংস্কৃতির এক উত্তরাধিকার।[২৪] এছাড়া বীরশৈব সন্ন্যাসীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মতবাদ শুধু আর কন্নড় জনসাধারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সমগ্র দক্ষিণ ভারতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য বীরশৈব প্রচারকদের উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল। সেটিও এই বহুভাষিকতার অন্যতম কারণ হতে পারে।[২৫]
মহীশূর রাজ্যে বীরশৈব সাহিত্যিকদের ওডেয়ার রাজসভার শ্রীবৈষ্ণব সাহিত্যিকদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়। কন্নড় সাহিত্যের শ্রীবৈষ্ণবপন্থী লেখকেরা তেলুগু ও সংস্কৃত সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বকালে দেশীয় রাজ্য মহীশূরের রাজসভাতেও এই সাহিত্যিকদের প্রাধান্য বজায় ছিল।[২৬] এদিকে ষোড়শ শতকের কবি রত্নাকর বর্ণির প্রগতিশীল লেখাগুলি এক নতুন ধরনের কবিতার পথ খুলে দেয়। এগুলি ঠিক প্রথাগত রাজসভার সাহিত্য নয়, বরং এই ধরনের কাব্যের রচয়িতারা ছিলেন কন্নড়ভাষী অঞ্চলে পর্যটনরত পরিব্রাজক কবি। এই কবিরা পথে রাজসভা বা মঠে অবস্থান করতেন, ত্রিপদে ছন্দে কবিতা রুচনা করতেন এবং বর্ণপ্রথা ও ধর্মের সামাজিক বন্ধন ছেদ করার জন্য নিজেদের মানবতাবাদী মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতেন সাধারণ মানুষকে। এই কবিদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞ, শিশুনল, শেরিফ, মুপিন ষড়ক্ষরী, নবলিঙ্গযোগী ও কডকোলড মডিবিলপ্প। সর্বজ্ঞকে প্রায়শই তেলুগু কবি বেমনার সঙ্গে তুলনা করা হয়। রাজসভার রীতিনীতির বাঁধনমুক্ত এই বিদ্রোহী কবিরা কন্নড় ভাষায় পৃথক এক অচিরাচরিত সাহিত্যধারার পুরোধা ব্যক্তি তথা নতুন সাহিত্যরুচির প্রতিষ্ঠাতা।[২৬]
রাজসভার বৈষ্ণব কবি-সাহিত্যিকেরা হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত এবং ভাগবত পুরাণ, বেদান্ত ও অন্যান্য হিন্দু পৌরাণিক সাহিত্য অবলম্বনে সাহিত্য রচনা করেছেন।[২৭] এই যুগটি ছিল প্রভাবশালী বৈষ্ণব কবি তথা মধ্যযুগীয় কন্নড় মহাকাব্যের পুরোধাপুরুষ কুমার ব্যাসের যুগ। ইতিহাসবিদেরা আদিকবি পম্প (আনুমানিক ৯৪১) ও কুমার ব্যাসের সাহিত্যে সাদৃশ্যগুলির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন, আবার দু’জনের রচনাশৈলীর মৌলিক পার্থক্যগুলিও চিহ্নিত করেছেন। দু’জনেই ছিলেন সমসাময়িক কালের দুই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। পম্প ছিলেন ধ্রুপদি যুগের এক শৈলীবিশারদ, অন্যদিকে কুমার ব্যাস ছিলেন মধ্যযুগের এক বহুবিদ্যাবিশারদ। পম্প ছিলেন কন্নড় সাহিত্যের মার্গ অর্থাৎ মূলধারার সংস্কৃতানুগ পর্যায়ের সাহিত্যকার; কিন্তু কুমার ব্যাস সার্থকভাবে দেশীয় ষট্পদী ছন্দে কাব্য রচনা করেছিলেন। কুমার ব্যাসের রচনায় রূপকালংকার, উপমা, হাস্যকৌতুল, এমনকি স্থূলরুচির বিষয়ও প্রযুক্ত হয়েছিল বৈচিত্র্যসাধনের উদ্দেশ্যে।[২৮]
১৪৩০ সালে ব্যাসের পরম্পরায় কুমার ব্যাস রচনা করেন গড়ুগিনা ভারত। এই গ্রন্থের শিরোনাম কবির নিবাস গাড়াগু অঞ্চলের (অধুনা গদাগ) নামটির দ্যোতক। মহাভারতের শেষ দশটি অধ্যায় অবলম্বনে গ্রন্থটি রচিত। এটি কর্ণাট ভারত কথামঞ্জরী বা কুমারব্যাস ভারত নামেও পরিচিত। গাড়াগুর গ্রামদেবতার প্রতি গ্রন্থটি উৎসর্গিত এবং এতে কৃষ্ণের মাহাত্ম্য কীর্তিত।[২৮] উল্লেখ্য, পম্প বিক্রমার্জুন বিজয় (৯৪১) গ্রন্থে মহাভারতের জৈন ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই গ্রন্থে পাণ্ডব রাজপুত্র অর্জুন ছিলেন নায়ক, দ্রৌপদী ছিলেন কেবলমাত্র অর্জুনেরই পত্নী এবং কৌরব রাজপুত্র দুর্যোধন ও তার অনুগত কর্ণ ছিল অহংকারী ব্যক্তি। অন্যদিকে কুমার ব্যাস কৃষ্ণ ছাড়া আর সব চরিত্রকেই দোষেগুণে ভরা মানুষ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। ধূর্ত কীচক ও কাপুরুষ উত্তর কুমারের মতো গৌণ চরিত্রগুলি তিনি যেভাবে এঁকেছেন তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[২৯][৩০] এই কাব্যে কৃষ্ণের সংলাপে কবি যে রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা কৌতূহলোদ্দীপক। এই গ্রন্থটির মাধ্যমেই কন্নড় সাহিত্য প্রাচীনতা থেকে আধুনিকতায় উন্নীত হয়।[৩১] পরিশীলিত রূপকালংকারের ব্যবহারের কুশলতার জন্য বিখ্যাত কুমার ব্যাস "রূপক-সাম্রাজ্য-চক্রবর্তী" উপাধি অর্জন করেছিলেন। এই মহাকাব্যের অবশিষ্ট অধ্যায়গুলি অনুবাদ করেন রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সভাকবি তিম্মন্ন কবি (১৫১০)। পৃষ্ঠপোষক রাজার নামানুসারে তিনি এই কাব্যের নামকরণ করেন কৃষ্ণরায় ভারত।[৩১][৩২][৩৩] কুমার ব্যাস রচিত ঐরাবত (১৪৩০) কাব্যে মহাভারতের একটি অধ্যায় পুনর্কথিত হয়েছে। এটি দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন হাতিটির উপাখ্যান।[৫]
কুমার ব্যাসের অনুপ্রেরণায় কুমার বাল্মীকি (নরহরির ছদ্মনাম, ১৫০০) কন্নড় ভাষায় অপর হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের প্রথম ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্করণটি রচনা করেন। এই গ্রন্থের নাম তোরাভে রামায়ণ। নামটি গ্রন্থের রচনাস্থল তোরাভে গ্রামের নামটির দ্যোতক। মহাভারতের ন্যায় রামায়ণের এই সংস্করণটিও নাগচন্দ্র রচিত জৈন সংস্করণের (১১০৫) তুলনায় লক্ষণীয়ভাবে আলাদা। নাগচন্দ্র সংস্কৃত সাহিত্যের জনপ্রিয় চম্পূ ছন্দে রামায়ণ রচনা করেছিলেন এবং রাবণকে এক ট্র্যাজিক নায়ক রূপে দেখিয়েছিলেন। মূল বাল্মীকি রামায়ণ থেকে সরে এসে তিনি জৈন মহাকাব্যের শেষে রামের সন্ন্যাসগ্রহণ ও নির্বাণলাভের বর্ণনা দিয়েছেন।[৩৪] বাল্মীকির পরম্পরায় লিখিত কুমার বাল্মীকির রামায়ণ ষট্পদী ছন্দে রচিত এবং এতে বিষ্ণুর অবতার রূপে রামের মহিমাই কীর্তিত।[৩৫] গ্রন্থটিতে শিব ও পার্বতীর কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে।[৩৫] কুমার বাল্মীকির রামায়ণে দেখা যায়, খলনায়ক রাবণ সীতার স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত হন। কিন্তু সীতাকে বিবাহ করতে সক্ষম না হয়ে তিনি রামের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এই রামায়ণে হনুমানের প্রভুভক্তির উচ্চ প্রশংসা করা হয় এবং "পরবর্তী সৃষ্টিকর্তা"র মর্যাদাও প্রদান করা হয়। কাহিনির অন্তে দেখা যায়, রামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাবণ উপলব্ধি করছেন যে রাম আর কেউ নন, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। তখন তিনি মোক্ষলাভের জন্য রামের হাতে মৃত্যুবরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। অন্যান্য অধ্যায়গুলির তুলনায় যুদ্ধ-বিষয়ক অধ্যায়টি ("যুদ্ধকাণ্ড") এই রামায়ণে অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। গ্রন্থটি বহু শতক ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। যক্ষগান প্রভৃতি লোকনাট্যও এটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। এইসব নাট্যাভিনয়ের সময় এই রামায়ণ থেকে বিভিন্ন পর্ব অভিনয়ার্থে গ্রহণ করা হয়।[৩৫] পৌরাণিক সাহিত্য ও মধ্বাচার্যের প্রভাব এই ধর্মীয় আখ্যানটিতে সুস্পষ্ট; নায়ক রামকে মহিমান্বিত করার প্রতিটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হয়েছে এতে। অবশ্য কবি এখানে বিমূর্ত ধারণা নিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আলোচনা করেছেন বলে সমালোচকেরা মনে করেন। তাছাড়া তিনি পূর্বসূরি কুমার ব্যাসের সমতুল্য কাব্যপ্রতিভার অধিকারীও ছিলেন না।[৩৬]
সংস্কৃতজ্ঞ আচার্যদের (গুরু) প্রথম যুগের ভাগবত-বিষয়ক গ্রন্থগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে স্বমতে আনা, তাদের ঈশ্বরবিশ্বাসী করে তোলা এবং কৃষ্ণে ভক্তিমান হতে উদ্বুদ্ধ করা।[৩৭] রাজা কৃষ্ণদেব রায় ও তাঁর উত্তরসূরি রাজা অচ্যুত দেব রায়ের সভাকবি চাটু বিট্ঠলনাথ প্রথম কন্নড় ভাষায় ভাগবত অনুবাদ করেন। এই প্রকাণ্ড গ্রন্থটি ২০৮টি অংশে ১২,২৪৭টি স্তবকে বিন্যস্ত। গ্রন্থে মূল গ্রন্থের সম্পূর্ণ অংশই ষট্পদী ছন্দে বিবৃত হয়েছে।[৩৮] পুথির শেষ পৃষ্ঠায় সদানন্দ যতি ও নিত্যাত্মা শুকযোগী নাম দু’টি পাওয়া যায় বলে কোনো কোনো গবেষক গ্রন্থটিকে একাধিক ব্যক্তির যৌথ রচনা বলে মনে করেন; অন্যেরা অবশ্য এগুলিকে একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন নাম বলে মত প্রকাশ করেছেন।[৩৭] এই গ্রন্থে বিষ্ণুর দশটি অবতারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; যদিও এর মূল উপজীব্য পরমেশ্বর রূপে কৃষ্ণের উপাখ্যান। এছাড়া বিষ্ণুর বিশিষ্ট ভক্ত প্রহ্লাদ ও ধ্রুব প্রমুখের কাহিনিও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। রয়েছে বিষ্ণুর হাতে নিহত হওয়ার মাধ্যমে মোক্ষলাভে উৎসুক বৃতাসুর, হিরণ্যকশিপু ও অন্যান্য দানবগণের কথাও। হরিদাস সম্প্রদায়ের রচনায় এই মহাকাব্যের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেযুগের অন্য দুই মহাকাব্যের ন্যায় ভাগবতকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা না হলেও, ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে এর গুরুত্ব ছিল প্রবল।[৩৭] চাটু বিট্ঠলনাথ মহাভারতের কিছু অংশের একটি পূর্ণতর পাঠ রচনা করেছিলেন।[৩৮] ষোড়শ শতকের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকেরা ছিলেন ত্রিপদী ছন্দে কাব্য রচনাকারী তিরুমালা ভট্ট (শিব-গীতে) ও রামেন্দ্র (সৌন্দর্য-কথারত্ন)।[২]
বীরশৈব সাহিত্যিকদের রচনার বিষয় ছিল শিব ও পঁচিশ জন শিবভক্তের জীবনী এবং শৈব ধর্ম ও দর্শনের ব্যাখ্যা।[২৭] বসব, অল্লম প্রভু প্রমুখ দ্বাদশ শতকের বীরশৈব সন্তদের জীবনী এই যুগের সাহিত্যে নতুন রূপ লাভ করে।[৩৯]
বসবপুরাণ (আনুমানিক ১৩৬৯) গ্রন্থে ভীম কবি ষট্পদী ছন্দের পথ প্রস্তুত করে যান। অবশ্য এই ছন্দ নিয়ে প্রথম পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন দ্বাদশ শতকের হৈসল কবি রাঘবাঙ্ক। ভীম কবি রচনা করেছিলেন বসবের জীবনী। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বীরশৈব পুরাণগ্রন্থ। হৈসল কবি হরিহরের লেখা বসব-জীবনী এবং ত্রয়োদশ শতকের কবি পালকুরিকি সোমনাথের তেলুগু গ্রন্থাবলি থেকে এটি অনুপ্রেরণা লাভ করে। হরিহরই প্রথম আখ্যানকাব্যের আকারে বসবের জীবনী রচনা করেছিলেন; গ্রন্থটির নাম ছিল বসবরাজ রাগালে। ভীম কবি বিশিষ্ট শিবভক্তদের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ রচনা করে বিনীতভাবে পূর্বসূরিদের ঋণ স্বীকার ও গুণগান করেন।[৪০]
ভীম কবি গ্রন্থের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন বসবের জন্ম-বিবরণ দিয়ে; তারপর অল্লম প্রভু প্রমুখ অন্যান্য বিশিষ্ট শরণদের (শিবভক্ত) কাহিনি বসবের জীবনেতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। বসবপুরাণ-এ দেখা যায়, বসব একাধারে এক সন্ত, শিবের বিশেষ ভক্ত, নন্দীর অবতার, নানাবিধ অলৌকিক কার্যের সম্পাদক, ধর্মপ্রচারক এবং বিশ্বে বীরশৈব মতের পুনঃসংস্থাপক। রচনাটি আটটি "আশ্বাস" (বিভাগ), একষট্টিটি "সন্ধি" (অধ্যায়) ও ৩,৭২১টি শ্লোকে বিন্যস্ত। আখ্যানের মধ্যে শিবের ভক্তগণ কীভাবে তাঁদের অহংকার জয় করছেন তার বিবরণও দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ভিন্নতা বাদে ভীম কবি ও পূর্বসূরিদের রচনা পরস্পর পরিপূরক। ভীম কবির দু’টি হারিয়ে যাওয়া রচনা হল ভীমকবীশ্বর-রাগালে ও ভৃঙ্গিদণ্ডক।[৪১][৪২]
চামরস, লক্খন দণ্ডেশ ও জক্কনর্য রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।[৩২][৪৩] দ্বিতীয় দেব রায়ের রাজসভায় বিশিষ্ট বীরশৈব প্রচারক চামরস ছিলেন কুমার ব্যাসের প্রতিন্দ্বন্দ্বী। প্রভুলিঙ্গ-লীলে (১৪৩০) গ্রন্থে তিনি দ্বাদশ শতকের সন্ত অল্লম প্রভুর প্রশস্তি রচনা করেন। গ্রন্থটি দ্বিতীয় দেব রায়ের নির্দেশে তেলুগু ও তামিল ভাষায় অনূদিত হয়। পরে এটি সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল।[৪৪] এই গ্রন্থে দেখানো হয়েছে, পার্বতী বনবাসীর রাজকুমারী রূপে এবং অল্লম প্রভু গণপতির অবতার রূপে সেই রাজকুমারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।[৬] কুমার ব্যাসের যুদ্ধসর্বস্ব মহাকাব্যের বিপরীতে চামরস আধ্যাত্মিক ভাবে পূর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন।[৪৫] কবি নিজের কাহিনি সম্পর্কে বলেছেন যে, এটি "সাধারণ নশ্বর মানুষের [কাহিনি] নয়"। এই কথার মাধ্যমে তিনি বৈষ্ণব মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতকে নশ্বর মানুষের কাহিনি বলে ইঙ্গিত করেছেন; যে বক্তব্যের মধ্যে বৈষ্ণব-শৈব বিবাদের প্রমাণ বিদ্যমান।[৪৪]
দ্বিতীয় দেব রায়ের প্রধানমন্ত্রী তথা এক প্রাদেশিক শাসনকর্তা লক্খন দণ্ডেশ বীরশৈবদের মতবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের এক বিশ্বকোষ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম শিবতত্ত্ব চিন্তামণি। এই গ্রন্থে বীরশৈব মতের প্রবর্তক বসব ও শতাধিক বীরশৈব অনুগামীর জীবনকথা পাওয়া যায়। এই জন্য এই ধর্মান্দোলনের শিক্ষার্থীদের কাছে এটি একটি মূল্যবান উৎসগ্রন্থ।[৪৬] এই গ্রন্থে বিজয়নগরের রাজধানী ও তার শহরতলি অঞ্চলেরও অনেক উল্লেখ পাওয়া যায়।[৫] দ্বিতীয় দেব রায়ের অপর মন্ত্রী জক্কনর্য নুরোন্দুস্থল (একশো এক আখ্যানমালা) রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন সন্ত-কবি কুমারবঙ্ক নাথ ও মহালিঙ্গ দেবের পৃষ্ঠপোষক। এই দুই কবি বচন কবিতা এবং শৈব দর্শন-বিষয়ক ষটস্থল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[৬][৯] পঞ্চদশ শতকের উল্লেখযোগ্য অন্যান্য সাহিত্যকারেরা হলেন রাজা সলুব নরসিংহ দেব রায়ের সভাকবি কবি লিঙ্গ (১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ), অদ্রিসপ্প (প্রৌদরায় চরিত্র),[৪৭] বোম্মরস (সৌন্দর্যপুরাণ), কল্লরস (জনভাষ্য), চতুর্মুখ বোম্মরস (রেবণসিদ্ধেশ্বর পুরাণ), সুরঙ্গ কবি (ত্রিষষ্ঠী পুরাতনর চরিত্রে) ও উম্মত্তুর দলপতি বীরনজ্ঞেন্দ্রের সভাকবি নীলকণ্ঠাচার্য (আরাধ্য-চরিত্র)।[৪৮]
কন্নড়-তেলুগু দ্বিভাষিক কবি পালকুরিকি সোমনাথের অনুপ্রেরণায় ১৫০০ সালে সিঙ্গিরাজ মহাবসবরাজ চরিত্র (বা সিঙ্গিরাজ পুরাণ) নামে বসবের একটি সুসংবদ্ধ জীবনী রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি বসবের বচন কবিতাগুলি ব্যবহার করেন এবং বসবের অষ্টআশিটি বিখ্যাত কাজের বিবরণ দেন; উপরন্তু এই গ্রন্থে দক্ষিণ কলচুরি রাজা দ্বিতীয় বিজ্জলের রাজসভায় বসবের প্রতিন্দ্বন্দ্বীদেরও বিবরণ পাওয়া যায়।[৪৯] এই যুগের অপর বিশিষ্ট কবি গুরু বসব সপ্তকাব্য নামে পরিচিত সাতটি মহাকাব্য রচনার জন্য বিঝ্যাত। এই সাতটি কাব্যের ছয়টি ষট্পদী ছন্দে রচিত। এগুলিতে প্রথাগত গুরুশিষ্যের মধ্যে কথোপকথনের ভঙ্গিতে ধর্মোপদেশ দেওয়া হয়েছে। আধ্যাত্মিকতা ও ইন্দ্রিয়াতীয় ধ্যানধারণা এই-সব মহাকাব্যের মূল উপজীব্য।[৯][৪৫]
গুব্বির কন্নড়-সংস্কৃত দ্বিভাষিক কবি মল্লনর্য রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। কন্নড় ভাষায় তিনি রচনা করেন ভব চিন্তারত্ন বা সত্যেন্দ্র চোলে কথে (১৫১৩) ও বীরশিবামৃত পুরাণ (১৫৩০)। ষট্পদী ছন্দে রচিত প্রথম গ্রন্থটির ভিত্তি খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের একটি তামিল রচনা এবং এটির বিষয় এক শৈব-মতাবলম্বী চোল রাজার জীবনী। দ্বিতীয় গ্রন্থটি বিশ্বকোষ-জাতীয় রচনা, যাতে দার্শনিক বিষয় ছাড়াও শিবের বিভিন্ন লীলা ও বিখ্যাত শৈব সন্তদের জীবনী বর্ণিত হয়েছে।[৫০][৫১]
১৫৮৪ সালে বিজয়নগরের বিরূপাক্ষ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিরূপাক্ষ পণ্ডিত দ্বাদশ শতকের সন্ত ও বচন কবি চন্নবসবের জীবন ও কীর্তির একটি বিবরণ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম চন্নবসবপুরাণ। এতে চন্নবসবকে শিবাবতার রূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং শিব ও বিশিষ্ট শিবভক্তদের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। এই বই থেকে আদি বীরশৈব সন্ত ও বচনকারদের (বচন কবি) সম্পর্কে তারিখ সহ অনেক মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।[৫২] ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও এই রচনায় বিজয়নগরের পূর্বতন রাজধানী, তার রাজপ্রাসাদ, বাজার ও বণিক সম্প্রদায়, সেখানকার সেনাশিবির, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বিভিন্ন পেশার কর্মীসংঘের বিশেষত্ব ও বিভাগগুলির সম্পর্কে দরকারি তথ্য পাওয়া যায়।[৫৩] ষোড়শ শতকের অন্যান্য সাহিত্যিকেরা হলেন চেরমঙ্ক (চেরমঙ্ক কাব্য), বীরভদ্ররাজ (বীরভদ্রবিজয়), চেন্নবসবঙ্ক (মহাদেবী অক্কন্ন পুরাণ), ইক্কেরির নঞ্জুন্দ (ভৈরবেশ্বর কাব্য) ও সদাশিব যোগী (রামনাথবিলাস)।[৪৮]
দ্বাদশ শতকের পর থেকে কর্ণাটক অঞ্চলে জৈনদের সাংস্কৃতিক প্রাধান্য হ্রাস পেতে শুরু করে। তারও আগে দশম শতকে পশ্চিম চালুক্য সম্রাটদের হাতে প্রধানত জৈন রাষ্ট্রকূটদের এবং তাঞ্জাবুরের চোল সম্রাটদের হাতে গঙ্গ রাজাদের পরাজয় ঘটলে জৈন সংস্কৃতির অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটেছিল। উত্তর কর্ণাটক অঞ্চলে বসবের সময়কালে বীরশৈব মতবাদ প্রাধান্য লাভ করে; অন্যদিকে দক্ষিণ কর্ণাটকে রামানুজের প্রভাবে বৈষ্ণবধর্মের শাখা শ্রীবৈষ্ণববাদের বিকাশ ঘটে।[৫৪] হৈসল রাজা বিষ্ণুবর্ধন ও তাঁর উত্তরসূরিরা বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন।[৫৫] বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতারা সকল ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু হলেও পরবর্তীকালের সঙ্গম রাজবংশের রাজারা শৈব এবং তারও পরবর্তীকালে তুলুব রাজবংশের রাজারা শ্রীবৈষ্ণব মতে দীক্ষিত হয়েছিলেন।[৫৬] এই যুগে জৈন জনসংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করে। অবশ্য রাজা প্রথম বুক্ক রায় জৈন-নিপীড়নের অভিযোগ পেয়ে জৈনদের উপাসনার স্বাধীনতা প্রদান করে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন।[১০] আধুনিক কর্ণাটকের উপকূলীয় অঞ্চলে জৈনদের প্রধান স্মারকস্থল ও প্রকাণ্ড একশিলা মূর্তিগুলি নির্মিত হয়েছিল। তাই বিজয়নগর যুগে সাধারণভাবে জৈনধর্ম ও জৈন সাহিত্যের প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু হলেও ওই-সব অঞ্চলে জৈন সংস্কৃতি শক্তিশালীই ছিল।[৫৭] পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলিতে জৈন সাহিত্যিকেরা তীর্থংকর, জৈন রাজপুত্র ও জৈনধর্মের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষকদের জীবনী রচনা করেছিলেন।[২৭] উপকূলীয় কর্ণাটকের বিশিষ্ট জৈন কবিদের মধ্যে ছিলেন রত্নাকর বর্ণি, অভিনব বাদী বিদ্যানন্দ, সল্ব ও নেমন্ন।[৫৭]
করকলের সভাকবি মুদাবিদ্রির রত্নাকর বর্ণি (১৫৫৭) ভৈরস ওডেয়ারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তিনি জাগতিক সুখের উপাদানকে সন্ন্যাসবাদের ধারণার সঙ্গে সফলভাবে গ্রন্থন করে সতর্কভাবে আদিরসাত্মক বিষয়কে একটি ধর্মীয় মহাকাব্যে ব্যবহার করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম ভারতদেশ বৈভব। এটি রত্নাকর বর্ণির শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কন্নড় সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিদের অন্যতম রত্নাকর বর্ণির রচনাবলি সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। রাজসভা ও ধর্মীয় মঠ উভয়ের সঙ্গেই তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন বলে অনুমান করা হয়। তবে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক কাব্যের পরিবর্তে আদিরসাত্মক ও জাগতিক সুখ-বিষয়ক সাহিত্যেই তিনি বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।[৫৮] প্রগতিপন্থী ও সুবেদী কবি রত্নাকর বর্ণি একদা ধ্যানকে "একঘেয়ে" বলে দাবি করেছিলেন।[৫৯] কথিত আছে, প্রথম দিকে ভারতদেশ বৈভব (নামান্তরে ভারতেশ্বর চরিত্রে) গ্রন্থটি নিন্দিত হলে রত্নাকর বর্ণি বীরশৈবধর্মে দীক্ষিত হন; পরবর্তীকালে আবার জৈনধর্মে ফিরে এসে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলি রচনা করেন।[৬০] ভারতদেশ বৈভব গ্রন্থটি আশিটি স্কন্ধ ও ১০,০০০ শ্লোকে বিন্যস্ত। রত্নাকর বর্ণির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনার মধ্যে রয়েছে অন্নগলপদ ("ভ্রাতৃবৃন্দের সংগীত") নামে পরিচিত ২,০০০ আধ্যাত্মিক গান এবং তিনটি শতক: রত্নাকরশতক, অপরাজিতেশ্বর শতক (জৈন নীতিশাস্ত্র, সন্ন্যাস ও দর্শন সংক্রান্ত কথোপকথন) ও তিলোক্যশতক (স্বর্গ, নরক ও মধ্যবর্তী জগৎগুলি নিয়ে গঠিত জৈন মহাবিশ্ব ধারণার এক বিবরণ)।[৬১][৬২][৬৩][৬৪]
জিনসেন রচিত পূর্বপুরাণ গ্রন্থ অবলম্বনে ভারতদেশ বৈভব গ্রন্থটি রচিত হয়। এতে ৯৪১ সালে আদিকবি পম্প রচিত আদিপুরাণ গ্রন্থ অপেক্ষা এক ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গিতে কাহিনি উপস্থাপনা করা হয়েছে। প্রথম তীর্থংকর ঋষভনাথের পুত্র ভরতের মহিমাকীর্তন এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য। তবে পম্প ভরতের জীবনের যে দিকগুলি উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন, রত্নাকর বর্ণি সেগুলির উপর সুদক্ষ ভাবে আলোকপাত করেন।[৬৫] ভারতদেশ বৈভব গ্রন্থে রাজপুত্র ভরতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কবির মতে, ভরত যোগ ও ভোগ অর্থাৎ ত্যাগ ও আসক্তির মধ্যে এক আদর্শ সামঞ্জস্য বিধান করেছিলেন। এই গ্রন্থে "৯৬,০০০ নারী"র সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েও ভরতকে জাগতিক সুখ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম এক ব্যক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। পম্প ভরত ও বাহুবলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সংঘাত এবং অন্তে বাহুবলীর সন্ন্যাসগ্রহণ ও ভরতের অবমাননা দেখিয়েছেন। কিন্তু রত্নাকর বর্ণি লিখেছেন যে, সন্ত হওয়ার পথে বাহুবলীর জন্য ভরত পথ ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং সেই কারণেই তিনি মহৎ; ক্রমে ত্যাগের বহ্নিতে দগ্ধ হয়ে ভরতও মোক্ষলাভ করেন।[৬৫] রাজা, স্বামী, পুত্র, বন্ধু ও ভক্ত হিসেবে ভরতের আদর্শ চরিত্রের কথা উল্লেখ করেও কবি ভরতের স্তুতিবাদ করেছেন। জৈন সাহিত্যে ভরতের এই বিবরণ "এক নিখুঁত মানবসত্তা"র দুর্লভ বিবরণ। জৈন পরম্পরায় অথবা পূর্ববর্তী রচনায় তরুণ শাসক হিসেবে ভরতের প্রথম জীবনের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তাই রত্নাকর বর্ণির এই সুস্পষ্ট বিবরণের অধিকাংশই কবির নিজস্ব কল্পনাপ্রসূত বলে ধরে নেওয়া হয়। কন্নড় মহাকাব্যের ক্কেহত্রে এই গ্রন্থটি লৌকিক সাঙ্গত্য ছন্দে রচিত দীর্ঘতম কাব্য।[৬২]
সল্ব (১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন কোঙ্কন প্রাদেশিক শাসনকর্তা সল্বমল্লের সভাকবি। তিনি সল্ব ভারত নামে একটি প্রচারমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।[৩২] এটি মহাভারতের জৈন পাঠান্তর। ষোলোটি পর্বে বিভক্ত এই গ্রন্থটি পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে কুমার ব্যাস রচিত মহাভারতের বৈষ্ণব সংস্করণের প্রতিক্রিয়ায় রচিত হয়।[৫৭][৬৬] গেরসোপ্পার অভিনব বাদী বিদ্যানন্দ (১৫৫৩) কাব্যসার রচনা করেন। এটি ছিল ৯০০ থেকে ১৪৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত পূর্ববর্তী কবিদের রচনার অংশবিশেষ নিয়ে ১,১৪৩ শ্লোকের একটি সংকলন গ্রন্থ। গ্রন্থটি হৈসল কবি মল্লিকার্জুন (১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ) রচিত একটি সংকলন গ্রন্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যপূর্ণ; শুধু মল্লিকার্জুনের পরবর্তীকালের কিছু রচনা এতে যুক্ত হয়েছে।[৬৭] রক্ষণশীল জৈন ও তার্কিক বিদ্যানন্দ বিজয়নগর ও অন্যান্য প্রাদেশিক রাজসভায় নিজ ধর্মবিশ্বাসের সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। নেমন্ন (১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দ) জ্ঞানভাস্কর-চরিত্রে রচনা করেন। এই গ্রন্থে মোক্ষলাভের সঠিক পথ হিসেবে অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ধ্যানমগ্নতার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[৬৪]
বিজয়নগরে রাজা দ্বিতীয় হরিহর ও প্রথম দেব রায়ের সভাকবি মধুর এই দুই রাজার প্রধানমন্ত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।[৩২] তিনি পঞ্চদশ তীর্থংকরের বিবরণ নিয়ে ধর্মনাথ-পুরাণ (১৩৮৫ খ্রিস্টাব্দ) গ্রন্থটি রচনার জন্য বিখ্যাত। গ্রন্থটি পূর্ববর্তী শতকগুলির জৈন কবিদের শৈলীতেই রচিত হয়। শ্রবণবেলগোলার গোমতেশ্বরকে নিয়ে লেখা একটি কবিতার রচয়িতাও মধুরকেই মনে করা হয়।[৬৮][৬৯] অযাতবর্মা (সম্ভবত পঞ্চদশ শতক) সংস্কৃত থেকে একটি চম্পূ (গদ্য-পদ্য মিশ্রিত রচনা) অনুবাদ করেন। এটির নাম রত্ন করণ্ডক । এটির উপজীব্য জৈন আদর্শবাদ।[৭০] কল্লহল্লির এক সামন্ত রাজা এবং বিজয়নগরের সেনানায়ক মঞ্জরস দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন: তার মধ্যে ১৫০৮ সালে সম্পূর্ণ হওয়া নেমিজিনেশন-সঙ্গত গ্রন্থটি বাইশতম তীর্থংকরের জীবনের কাহিনি এবং ১৫০৯ সালে লিখিত সংযুক্ত-কৌমুদী গ্রন্থটি ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিকথামূলক ১৮টি ছোটোগল্পের সংকলন।[৫][৬৮]
এই যুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ ষট্পদী রচনা হল ভাস্কর রচিত জীবন্ধর-চরিত্রে (১৪২৪ খ্রিস্টাব্দ)। রাজপুত্র জীবন্ধর পিতা কর্তৃক অন্যায়ভাবে অধিকৃত সিংহাসন কীভাবে পুনরুদ্ধার করেন, তা-ই এই কাব্যের বিষয়বস্তু।[২১] অন্যান্য বিশিষ্ট জৈন সাহিত্যকারেরা ছিলেন কল্যানকীর্তি (জ্ঞানচন্দ্রাভ্যুদয়, ১৪৩৯), শান্তিকীর্তিমুনি (শান্তিনাথচরিতে, ১৪৪০), বিজয়ন্ন (দ্বাদশানুপ্রেক্ষে, ১৪৪৮), তেরাকনম্বির বোম্মরস (সনৎকুমার-চরিতে, ১৪৮৫), কোটেশ্বর (১৫০),[৬৮][৭১][৭২] তৃতীয় মঙ্গরস (জয়নৃপ কাব্য), সন্তরস (যোগরত্নাকর), শান্তিকীর্তি (শান্তিনাথ পুরাণ, ১৫১৯), ডোড্ডয় (চন্দ্রপ্রভ পুরাণ, ১৫৫০), ডোড্ডনঙ্ক (চন্দ্রপ্রভ-পুরাণ,) ও শৃঙ্গেরীর বাহুবলী পণ্ডিত (ধর্মনাথপুরাণম্, ১৩৫২)।[৬৮][৭২][৭৩]
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যুগে রচিত অধিকাংশ সাহিত্যকীর্তিই ধর্ম-বিষয়ক। তবে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যও যে এই যুগে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তারও পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। এই রচনাগুলির কয়েকটি থেকে নগরজীবন, সাম্রাজ্য ও প্রাদেশিক রাজসভাগুলির বৈভব, রাজকীয় বিবাহ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে দরকারি তথ্য পাওয়া যায়। অন্যান্য রচনায় সাধারণ বিজয়নগর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরের নগর-পরিকল্পনা, দুর্গনির্মাণ ও অস্ত্রাগার সম্পর্কে এবং সেচ জলাধার, বণিক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী ক্রয়বিক্রয়ের কেন্দ্র হিসেবে দোকানবাজারগুলির বিষয়ে নানা তথ্য পাওয়া যায়। কখনও কখনও সাহিত্যিকেরা পৌরাণিক নগরের জীবনযাত্রার আদলে সমসাময়িক জীবন সম্পর্কে নিজেদের আদর্শায়িত ধারণা ব্যক্ত করতেন।[৭৪] সাধারণভাবে এই সব রচনায় কবি, চারণকবি, গীতিকার, চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, নট, মল্লযোদ্ধা প্রভৃতি শিল্পী ও পেশাদারদের বর্ণনা ও তাদের সঙ্গে রাজসভার সম্পর্ক বর্ণিত হত। এছাড়া এগুলি থেকে রাষ্ট্রনায়ক, রাষ্ট্রদূত, রক্ষিতা, কোষাধ্যক্ষ, স্বর্ণকার, কুসীদজীবী, এমনকি ভৃত্য ও দ্বাররক্ষকদের কথাও জানা যায়।[৭৫]
প্রণয়গাথা, আখ্যানকাব্য, আদিরসাত্মক রচনা, লোকসংগীত ও সংগীত-বিষয়ক সন্দর্ভ এই যুগে জনপ্রিয়তা লাভ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান, আবহাওয়াবিজ্ঞান, পশুচিকিৎসাবিজ্ঞান ও ঔষধিবিজ্ঞান, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ, দর্শন, কাব্য, ছন্দশাস্ত্র, জীবনী, ইতিহাস ও শব্দকোষ, সেই সঙ্গে অভিধান ও বিশ্বকোষও এই যুগে রচিত হয়েছিল।[৭৬]
১৩৬০ প্রথম মঞ্জরাজ খগেন্দ্র-মণি-দর্পণ নামে ঔষধিবিজ্ঞানের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটির ভিত্তি ছিল খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে পূজ্যপাদের রচনা।[৭৭] পদ্মনঙ্ক (১৩৮৫) স্বীয় পূর্বপুরুষ তথা হৈসল মন্ত্রী ও কবি কেরেয় পদ্মরসের জীবনী পদ্মরাজ-পুরাণ রচনা করেছিলেন। এই রচনা থেকে হৈসল সাম্রাজ্য ও কবি হরিহর ও রাঘবাঙ্ক প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়।[৫][৪৫] দ্বিতীয় দেব রায়ের সভাকবি চন্দ্রশেখর (বা চ্রকবি) ১৪৩০ সালে বিরূপাক্ষ মন্দির, সেটির চত্বর ও পম্পপুরার (অধুনা হাম্পি) জনবসতির একটি বিবরণ রচনা করেন পম্পস্থান-বর্ণনম্ গ্রন্থে।[৫] দ্বিতীয় মঙ্গরাজ ১৩৯৮ সালে মঙ্গরাজ-নিঘণ্টু নামে একটি শব্দকোষ রচনা করেন, অন্যদিকে অভিনব চন্দ্র চতুর্দশ শতকে অশ্ববিদ্যা নামে একটি পশুচিকিৎসা-বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। কবি মল্ল চতুর্দশ শতকে মন্মথবিজয় নামে একটি আদিরসাত্মক গ্রন্থ রচনা করেন। পঞ্চদশ শতকে মাধব দণ্ডী রচিত একটি সংস্কৃত কাব্য অনুবাদ করেন এবং সেটির নাম দেন মাধবালংকার । ঈশ্বর কবি (নামান্তরে বন কবি) কবিজিহ্ব-বন্ধন নামে একটি ছন্দশাস্ত্র রচনা করেন।[২][৭৮]
রাজপরিবারের সদস্য দেপরাজ অমরুক ও প্রেমকাহিনির সংকলন সোবজিন-সোনে (১৪১০) রচনা করেছিলেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটি লেখকের পত্নীর উদ্দেশ্যে কথিত আখ্যানের আদলে রচিত।[৬][৪৫] কোটরাইয়াহ্-র মতে অবশ্য সোবজিন-সোনে আসলে রাজা দ্বিতীয় দেব রায়ের রচনা। এই রচনায় পেশাদার শিকারীদের সঙ্গে নিয়ে রাজার মৃগয়াযাত্রার কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ পাওয়া যায়।[৪] ১৫২৫ সালে নঞ্জুন্দ কবি নামে এক সামন্ত শাসক স্থানীয় ইতিহাস সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং রামনাথ-চরিতে (বা কুমার রাম সাঙ্গত্য) নামে সাঙ্গত্য ছন্দে রাজপুত্র রামনাথের একটি স্তুতিবাদ রচনা করেন। কাব্যটি দক্ষিণ ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশের আদি যুগে কাম্পিলির রাজপুত্রের বীরত্বব্যঞ্জক কীর্তি-বিষয়ক।[৫] এই রচনায় লৌকিক ও মহাকাব্য সাহিত্যের উপাদানের সমন্বয় ঘটেছে। কাহিনির প্রধান চরিত্র নিজের বিমাতার প্রণয়প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এক মন্ত্রী তাকে উদ্ধার করেন। ঘটনাচক্রে মুসলমানেরা রাজধানী আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে সে শহিদ হয়।[৭৯]
১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে মহীশূরের জৈন সাধু শ্রুতকীর্তি সংস্কৃত ভাষা থেকে হৈসল অভিজাত নারী বিজয়কুমারীর জীবনীমূলক কাব্য বিজয়কুমারী-চরিতে গ্রন্থে অনুবাদ করেন।[৫] এই রচনায় এক শহরের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়, যেটিকে রাজধানী বিজয়নগর বলেই মনে করা হয়। এতে সেখানকার দোকানবাজার, বণিকসংঘ ও ব্যবসাবাণিজ্যের কথাও আলোচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে কঠোর বর্ণ-ভিত্তিক জনবসতির বিবরণ পাওয়া যায় এবং দেখানো হয় কীভাবে জনসাধারণ ধোপা, নাপিত, কুমোর ও ছুতোরের বৃত্তি অবলম্বন করে দুর্গপ্রাচীরের বাইরে তাদের জন্য নির্দিষ্টভাবে নির্মিত পথে দৈনন্দিন সাধারণ কর্তব্য পালন করছে।[৮০] সল্ব (১৫৫০) রস-রত্নাকর ও শারদা-বিলাস নামে দু’টি কাব্য রচনা করেছিলেন। প্রথমটি রস (কাব্যের ভাব) বিষয়ক এবং দ্বিতীয়টি (যার অংশমাত্রই আবিষ্কৃত হয়েছে) কাব্যের ধ্বনি বিষয়ক।[৫৭][৬৬] ষোড়শ শতকে রচিত তিম্মের নবরসালঙ্কার গ্রন্থটিও রস-বিষয়ক।[৮১] ষোড়শ শতকে দু’টি শব্দকোষ রচনা করেন লিঙ্গমন্ত্রী (কব্বিগরকৈপিডি) ও দেবোত্তম (নানারথ-রত্নাকর)।[৪৮][৭৩] সপ্তদশ শতকের গোড়ায় ভট্টকলঙ্ক দেব কর্ণাটক-শব্দানুশাসনম্ গ্রন্থে কন্নড় ব্যাকরণের দীর্ঘ আলোচনা করেন। এটি সংস্কৃত ব্যাকরণের আদর্শে রচিত এবং একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা হিসেবে পরিগণিত।[৮২]
বীরশৈব সন্তেরা শিবভক্তির উপদেশ প্রদান করতেন এবং এক শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষজন ছিলেন এই আন্দোলনের উৎস। কিন্তু হরিদাস আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে সামাজিক ক্ষমতার উচ্চতর স্তর থেকে। হরিদাস সন্তেরা বিষ্ণুভক্তির উপদেশ দেন এবং এক নমনীয় বর্ণভিত্তিক সমাজের কথা প্রচার করেন। কালক্রমে এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[৮৩] হরিদাস পরম্পরার সূচনা অনুসন্ধান করা হয় মধ্বাচার্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব দ্বৈতবাদী দর্শনের মধ্যে।[৮৪] চতুর্দশ শতকের গোড়ায় কন্নড় সাহিত্যে এর প্রভাব দেখা যায় মধ্বাচার্যের বিশিষ্ট শিষ্য নরহরিতীর্থের আদিতম জ্ঞাত রচনাগুলির মধ্যে।[৮৫]
চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত হরিদাস সম্প্রদায়ের ভক্ত-সন্তদের দ্বারা চালিত বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন কন্নড় সাহিত্যে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ভুক্ত কবিদের হাতে যে সাহিত্যধারার জন্ম হয় তা হরিদাস সাহিত্য নামে পরিচিত। দ্বাদশ শতকে বীরশৈব আন্দোলন যেমন সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনই হরিদাসদের ভক্তিবাদী দর্শনের দ্বারাও লক্ষাধিক মানুষ আকৃষ্ট হয়। হরিদাস সম্প্রদায় মধ্বাচার্যের বার্তা ছড়িয়ে দিত গুহ্য সংস্কৃত রচনা (ব্যাস-কূট বা ব্যাস পরম্পরাভুক্ত কবিদের রচনা) এবং সরল কন্নড় ভাষায় জনসাধারণের উদ্দেশ্যে রচিত ভক্তিসংগীতের (দাস-কূট বা দাস পরম্পরার কবিদের রচনা) মাধ্যমে।[৩৮][৮৫][৮৬] মধ্বাচার্যের বিশিষ্ট শিষ্য নরহরিতীর্থ, জয়তীর্থ, ব্যাসতীর্থ, শ্রীপদরায়, বাদীরাজতীর্থ, পুরন্দর দাস, কনক দাস ও অন্যান্যরা দ্বৈতবাদী দর্শন প্রচারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[৮৭]
হরিদাস সাহিত্যের অন্তর্গত রচনাগুলি চার প্রকারের: "কীর্তনে", "সুলডি", "উপভোগ" ও "মুন্ডিগে"। "কীর্তনে" হল রাগ ও তালে নিবদ্ধ ঈশ্বরের মাহাত্ম্যজ্ঞাপক গীতিকবিতা; "সুলডি" তাল-ভিত্তিক, "উপভোগ" স্বরমাধুর্য-ভিত্তিক এবং "মুণ্ডিগে" ধাঁধার আকারে রচিত কাব্য। এছাড়াও "জোগুলা" (ঘুমপাড়ানি গান) ও "সোবানে"-র (বিবাহসংগীত) আদলেও গান বাঁধা হত। হরিদাস সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল এগুলি রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবত পুরাণ থেকে অনুপ্রাণিত রচনা।[৮৫]
নরহরিতীর্থের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যেই হরিদাস কাব্যসাহিত্যের অবক্ষয় শুরু হয়। এরপর শ্রীপদরায় আবার এই কাব্যের পুনর্জাগরণ ঘটান। তিনি কিছুকাল মুলুবাগিলুর (অধুনা কোলার জেলায় অবস্থিত) মধ্ব মঠের প্রধান ছিলেন। নরহরিতীর্থের রচনা বলে পরিচিত প্রায় একশোটি "কীর্তনে" পাওয়া যায়। এগুলি তিনি শ্রীরঙ্গ বিঠল ছদ্মনামে রচনা করেছিলেন। শ্রীপদরায়কে এই ধারার ভক্তিগীতিতে এক অগ্রণী ব্যক্তি মনে করা হয়।[৮৫] শ্রীপদরায়ের শিষ্য ব্যাসতীর্থ বা ব্যাসরাজ ছিলেন পরবর্তীকালের মধ্বপন্থী সন্তদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত। তিনিই মধ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাস-কূট ও দাস-কূট পরম্পরার স্রষ্টা। ব্যাসতীর্থ রাজা কৃষ্ণদেব রায়কে সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেন; পরিবর্তে রাজাও ব্যাসতীর্থকে কুলদেবতার সম্মানে ভূষিত করেন। কন্নড় ভাষায় অভিজ্ঞ এবং সংস্কৃত ভাষায় প্রভাবশালী গ্রন্থের রচয়িতা ব্যাসতীর্থ কন্নড় ভাষার দুই শ্রেষ্ঠ সন্ত-কবি পুরন্দর দাস ও কনক দাসের কর্মজীবনের দিকনির্দেশ করে দিয়েছিলেন।[৮৮][৮৯] দাস সাহিত্য যুগের আরেক বিশিষ্ট সাহিত্যিক বাদীরাজতীর্থ ছিলেন পুরন্দর দাসের সমসাময়িক এবং কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় বহু গ্রন্থের রচয়িতা।[৯০]
পরিব্রাজক চারণকবি পুরন্দর দাস (১৪৮৪-১৫৬৪) রাজা অচ্যুত দেব রায়ের রাজত্বকালে বিজয়নগরে আসেন। কথিত আছে, তিনি কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় ৪৭৫,০০০টি গান রচনা করেছিলেন।[৯১] অবশ্য এর মধ্যে প্রায় ১,০০০টি গানই পাওয়া যায় এখন। এই গানগুল বিভিন্ন রাগে নিবদ্ধ এবং বেশিরভাগই শেষ হয়েছে হিন্দু দেবতা বিট্ঠলের বন্দনার মাধ্যমে। এই রচনাগুলিতে উপনিষদ্ ও পুরাণ সাহিত্যের সারবস্তু সরল অথচ ভাবপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। পুরন্দর দাস এমন এক প্রণালী প্রবর্তন করেন যার মাধ্যমে সাহদারণ মানুষ কর্ণাটকী সংগীত শিক্ষা করতে পারবে। তিনিই সংগীতের রূপগুলিকে "স্বরাবলি", "অলংকার" ও " গীতম"-এ বিভক্ত করেন। সংগীতে এই অবদানের জন্য পুরন্দর দাসকে "কর্ণাটক-সংগীত-পিতামহ" উপাধিতে ভূষিত করা হয়।[৯১][৯২][৯৩]
কাগিনেলের (অধুনা (হাবেরি জেলা|হাবেরি জেলায়]] অবস্থিত) কনক দাস (জন্মগত নাম তিম্মপ্প নায়ক, ১৫০৯-১৬০৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন সন্ন্যাসী ও আধ্যাত্মিক গুরু। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায় যে তিনি কুরুব (রাখাল) বা বেদ (শিকারী) পরিবারের সন্তান ছিলেন। বিজয়নগরের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায়[৫] তিনি মোহনতরঙ্গিনী (১৫৫০) প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের প্রতি উৎসর্গিত উক্ত গ্রন্থটি সাঙ্গত্য ছন্দে রচিত কৃষ্ণের আখ্যান। কনক দাসের অন্যান্য বিখ্যাত রচনাগুলি হল নরসিংহস্তব (বিষ্ণুর নরসিংহ অবতারের মাহাত্ম্যব্যঞ্জক রচনা), নলচরিত (নলের কাহিনি, যেটি তার আখ্যানভাগের জন্য উল্লেখযোগ্য) ও হরিভক্তিসার (ষট্পদী ছন্দে রচিত একটি ভক্তিমূলক রচনা)। শেষোক্ত রচনাটি নীতি, ভক্তি ও বৈরাগ্য-বিষয়ক। এটি পরবর্তীকালেও শিশুশিক্ষার জন্য একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখে।[৯৪] কনক দাসের অপর রচনা রামধান্য-চরিত্রে একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক রূপক কবিতা; এতে ভাতের পরিবর্তে রাগির মাহাত্ম্য কীর্তিত হয়েছে।[৩৮] এই কবিতায় দরিদ্রের খাদ্য রাগির সঙ্গে ধনীর খাদ্য ভাতের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হয়েছে। রাম এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, রাগিই শ্রেষ্ঠ, কারণ সংরক্ষণের সময় রাগি পচে যায় না। কাব্যটি কন্নড় ভাষায় শ্রেণিসংগ্রামের আদিতম কাব্যিক উপস্থাপনার অন্যতম। এই সকল ধ্রুপদি গ্রন্থ ছাড়াও কনক দাসের লেখা প্রায় ২৪০টি গানও পাওয়া যায়।[৯৫]
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর কিছুকালের জন্য ভক্তি আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে সপ্তদশ শতকে তার পুনর্জাগরণ ঘটে। এই সময় প্রায় ৩০০ জন ভক্তিবাদী কবির আবির্ভাব ঘটে। এই কবিদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন বিজয় দাস (১৬৮২-১৭৫৫), গোপাল দাস (১৭২১-১৭৬৯), জগন্নাথ দাস (১৭২৮-১৮০৯), মহীপতি দাস (১৭৫০), হেলবনকট্টে গিরিম্ম ও অন্যান্যেরা।[৯৬] কালে এই ভক্ত-কবিদের রচিত গান "হরিকথা" নামে পরিচিত বৈষ্ণব ধর্মীয় ও উপদেশাত্মক অভিনয়শিল্পের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে বীরশৈবদের মধ্যে "শিবকথা" শৈলীর উদ্ভব হয়।[৯৭]
হিন্দুসমাজের কঠোর বর্ণবাদের প্রতিক্রিয়ায় বীরশৈব বচন কাব্যসাহিত্যের উদ্ভব ঘটেছিল। দ্বাদশ শতকে সামাজের নিম্নস্তরের মানুষজনের কাছে তা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই কাব্যসাহিত্যের রচয়িতা বীরশৈব কবিরা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের যুগেও প্রভাব বজায় রেখেছিলেন।[৯৮] চতুর্দশ শতকের গোড়াদ দিকে উত্তর ভারত থেকে মুসলমানদের আক্রমণের পর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা প্রণালীবদ্ধভাবে হিন্দু লোককথা-বিষয়ক রচনাগুলিকে একত্র করেন। এই ঘটনা পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বিভিন্ন বীরশৈব সংকলকদের অনুপ্রাণিত করে আদিতে তালপাতার পুথিতে লেখা শৈব সাহিত্য ও বচন কবিতা সংকরলের কাজে।[৯৮] কবিতাগুলি দুর্বোধ্য ছিল বলে সংকলকেরা এগুলির সঙ্গে টীকা যুক্ত করে দেন; তার ফলে এগুলির গুহ্য অর্থ ও গোপন গুরুত্ব সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়।[৯৯] এই-জাতীয় সংকলন সাহিত্যের আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক দিক হল সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রামাণ্য শৈবশাস্ত্রের অনুবাদ। এর সাহায্যে বচন সাহিত্যকেও সংস্কৃতানুগ সাংস্কৃতিক বৃত্তের মধ্যে আনা গিয়েছিল।[১৯]
এই সকল সংকলন গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি সুপরিচিত গ্রন্থ হল কল্লুমতদ প্রভুদেবের গণভাষিত রত্নমালে (১৪৩০), চন্নবীরাচার্যের বিশেষানুভব ষটস্থল (ষোড়শ শতক) ও সিদ্ধ বসবরাজের বেদজিন বচনগলু (১৬০০)। স্বাতন্ত্র্যসূচক গ্রন্থ শূন্যসম্পদনে চারটি সংস্করণে সংকলিত হয়েছিল।[১০০] প্রথম সংস্করণের সংকলক ছিলেন শিবগণপ্রসাদী মহাদেবাইয়াহ্ (১৪০০)। তিনিই অন্যান্য তিনটি সংকলনের আদর্শ স্থির করে দিয়েছিলেন। এই প্রথম সংকলনের কবিতাগুলি মূলগতভাবে পৃষ্ঠপোষক সন্ত অল্লম প্রভু ও বিশিষ্ট শরণদের (শিবভক্ত) মধ্যে কথোপকথনের আকারে রচিত। এগুলির উদ্দেশ্য ছিল দ্বাদশ শতকের সমাজ-বিপ্লবের উচ্ছ্বাসকে পুনর্জাগরিত করা। হলগে আর্য (১৫০০-১৫৩০), গুম্মলপুরা সিদ্ধলিঙ্গ যতি (১৫৬০) ও গুলুর সিদ্ধবীরানোদয় (১৫৭০) পরবর্তীকালের সংস্করণগুলির সংকলক।[১০১]
দ্বাদশ শতকের শেষের দিকে বসবের যুগ যখন শেষ হচ্ছে, তখন বচন কবিতার ধারাতেও অবক্ষয় দেখা যায়। পরবর্তীকালের বচন কবি তথা বিশিষ্ট শৈব সন্ত এবং রাজা দ্বিতীয় বিরূপাক্ষ রায়ের গুরু তোন্তদ সিদ্ধেশ্বর (বা সিদ্ধলিঙ্গ যতি) এই ধারার পুনর্জাগরণ ঘটান। তিনি ষটস্থল-জ্ঞানামৃত (১৫৪০) নামে ৭০০টি কবিতার একটি সংকলন সম্পাদনা করেন।[১০২] ১৫৬০ সালে বিরক্ত তোন্তদর্য তোন্তদ সিদ্ধেশ্বরের জীবনকথাকে তাঁর সিদ্ধেশ্বর-পুরাণ গ্রন্থের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বেছে নেন।[১০৩] বিরক্ত তোন্তদর্য, গুম্মলপুরা সিদ্ধলিঙ্গ, স্বতন্ত্র সিদ্ধলিঙ্গেশ্বর (১৫৬০) ও ঘনলিঙ্গিদেব (১৫৬০) প্রমুখ সুপরিচিত বচন কবিরা আদিযুগের কবিদের গৌরবময় দিনগুলির পুনঃসৃজনের চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তার আর সামাজিক বা রাজনৈতিক সুযোগ ছিল না।[১০১]
পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে বীরশৈব ও অদ্বৈত দর্শনের সমন্বয়-প্রয়াসের ফলে মরমিয়া সাহিত্যেরও পুনরুত্থান ঘটেছিল। এই ধারাটি চলেছিল উনবিংশ শতক অবধি।[৮৬] এই মরমিয়াপন্থীদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন নিজাগুন শিবযোগী। প্রথাগত বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি পেশায় ছিলেন কোল্লেগল অঞ্চলের (অধুনা মহীশূর জেলা) কাছে এক সাধারণ গোষ্ঠীপতি; পরে তিনি এক শৈব সন্তে পরিণত হন। তিনি যে ভক্তিগীতিগুলির রচনা করেছিলেন, সেগুলি একত্রে কৈবল্যসাহিত্য (বা তত্ত্ব-পদগলু অর্থাৎ বৈরাগ্যপথের গান) নামে পরিচিত।[৮৬] শিবযোগীর গানগুলি ছিল চিন্তামূলক, দার্শনিক এবং যোগ-বিষয়ক। ষট্পদী ছাড়া কন্নড় ভাষায় ব্যবহৃত সকল স্থানীয় ছন্দই এই কবিতাগুলিতে ব্যবহৃত হয়েছে।
শিবযোগীর অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে বিবেকচিন্তামণি নামে একটি বিজ্ঞানসম্মত বিশ্বকোষ। বইটি এতটাই মান্যতা অর্জন করে যে ১৬০৪,সালে এটি মারাঠি ভাষায়, এরপর ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত ভাষায় এবং অষ্টাদশ শতকে আবার সংস্কৃত ভাষায় অনূদিত হয়। এই গ্রন্থে বিষয়ের ভিত্তিতে ১,৫০০টি প্রসঙ্গ আলোচিত হয়; তার মধ্যে ছিল কাব্যতত্ত্ব, নৃত্য ও নাট্যকলা, সংগীততত্ত্ব ও কামশাস্ত্রের মতো বৈচিত্র্যময় বিষয়।[১০৪] শৈব দর্শন ব্যাখ্যা ও সংস্কৃত ভাষায় অজ্ঞ সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য সংস্কৃত ভাষা থেকে তিনি শিবযোগপ্রদীপিকা গ্রন্থটি অনুবাদ করেছিলেন।[৫১]
বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতনের পর কৈবল্য পরম্পরা তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। প্রথম শাখাটি ছিল নিজগুণ শিবযোগী পরম্পরার অনুগামীদের ধারা। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল অধিকতর অভিজাতপন্থী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রকৃতির ধারা, যা মহালিঙ্গরঙ্গের (১৬৭৫) রচনাবলি অনুসরণ করত। তৃতীশ শাখাটি বচন পরম্পরাকে জীবিত রেখেছিল।[১০৫] বচন পরম্পরার সুপরিচিত সন্ত-কবিদের অন্যতম তথা শিবযোগীর সমসাময়িক মুপ্পিন ষড়ক্ষরীর সংগীত সংগ্রহটি সুবোধসার নামে পরিচিত। এছাড়া ছিলেন সপ্তদশ শতকের চিদানন্দ অবধূত এবং অষ্টাদশ শতকের সর্পভূষণ শিবযোগী। এই সাহিত্যসম্ভার এতটাই সুবিপুল যে এর অনেকটাই এখনও পর্যালোচনা সম্ভব হয়নি।[৮৬]