মনোবিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের একটি শাখা। এটি মূলত মস্তিষ্কের গঠন, এর তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া এবং এসব প্রক্রিয়া থেকে আচরণের উদ্ভব নিয়ে কাজ করে। এটা যেহেতু জীববিজ্ঞানের একটি শাখায় সেহেতু জীববিজ্ঞানের তত্ত্বগুলোই এখানে কাজ করে। ঠিক তেমনি বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং উপাত্তের সাহায্য যদি মনোবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা হয় তবেই তাকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান (ইংরেজি ভাষায়: Evolutionary psychology) বলা যায়।[২][৩] আরও নির্দিষ্ট করে বললে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে মানব মনের গঠন ও কার্যক্রিয়া নিয়ে গবেষণার জন্য বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব-উপাত্ত প্রয়োগ করা হয়। তার মানে এটা মনোবিজ্ঞানের কোন শাখা নয় বরং একটি অ্যাপ্রোচ। দৃষ্টিশক্তি, সামাজিক আচরণ ইত্যাদি মনোবিজ্ঞানের পৃথক শাখা; কারণ তারা নির্দিষ্ট কোন দিক নিয়ে কাজ করে। কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান কোন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা না করে বরং, মনোবিজ্ঞানের সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্যই বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের আশ্রয় নেয়। এজন্যই এটা মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি বিশেষ পদ্ধতি।[৪]
আরেকটু নৈর্বক্তিক সংজ্ঞা এরকম হতে পারে: বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান এবং জ্ঞানীয় (cognitive) মনোবিজ্ঞান- এই দুটি বিজ্ঞানের সমন্বয়ই বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান। জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞান দুটি মৌলিক ধারণার উপর ভিত্তি করে কাজ করে: (১) মানুষের আচরণ মনের কিছু প্রক্রিয়ার ফসল (২) মন একটি তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র বা পদ্ধতি। একসময় মন বলতে আমরা ব্যাখ্যাতীত কোন কিছুকে বুঝতাম। কিন্তু যখনই মনকে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক একটি পদ্ধতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হল এবং মানুষের সব আচরণের নিয়ন্ত্রক হিসেবে এই মনকে মেনে নেয়া হল তখনই জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হল। ১৯৬০-এর দশককেই এই যাত্রার সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ এই সময়ই অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছে আচরণবাদ (Behaviourism) প্রত্যাখ্যাত হয় এবং বিজ্ঞানীরা আবার মন নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করেন। বর্তমানে মন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের যে ধারণা তাকে পূর্বতন লৌকিক মনোবিজ্ঞানের ধারণার সাথে তুলনা করা যায়। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, বর্তমানে মনকে কেবলই এক গণনাযন্ত্র হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছে। কম্পিউটার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্তরণই মূলত জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞানের পথ সুগম করেছে। আর এতেও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, জ্ঞানী মনোবিজ্ঞান এতোটা বিকশিত না হলে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের উত্তরণ সম্ভব ছিল না।[৫]
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মুলতঃ বিজ্ঞানের দুটো চিরায়ত শাখাকে একীভুত করেছে; একটি হচ্ছে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান (evolutionary biology) এবং অন্যটি বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান (Cognitive Psychology) [৬]। বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞান থেকে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের মানসপট নির্মাণে দীর্ঘদিনের এক জটিল পরিকল্পনার ছাপ আছে। আবার বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান বলে যে, জীবদেহের এই ‘জটিল পরিকল্পনা’ বলে যেটাকে মনে হয় সেটা আসলে ডারউইন বর্ণিত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর ফলাফল। বিবর্তনীয় পদ্ধতিতে গবেষণা করার সময়ও মানব মস্তিষ্ককে একটি তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র হিসেবে ধরে নেয়া হয়, আর মানব মন হচ্ছে তার প্রক্রিয়াজাত অভিব্যক্তি। এই বৈশিষ্ট্যটি জ্ঞানীয় মনোবিজ্ঞান থেকে এসেছে। আমাদের শিকারী-সংগ্রাহক পূর্বপুরুষদেরকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো সেগুলো সমাধানের জন্যই মনের বিবর্তন ঘটেছে বলে মনে করা হয়। তাই উল্লেখিত বিবর্তন ব্যাখ্যার মাধ্যমেই আমাদের মনের উদ্ভব ও তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মস্তিষ্কের সাথে তার সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ঠিক এ কাজটিই করে।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মনে করে প্রায় ৬ মিলিয়ন বছর আগে শিম্পাঞ্জী থেকে আলাদা হওয়ার পর সেখান থেকে শুরু করে আজ থেকে এক লক্ষ বছর আগ পর্যন্ত মানুষেরা মূলতঃ বনে জঙ্গলেই কাটিয়েছি। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে মানুষ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসে। সে সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময়কাল বিবর্তনের পঞ্জিকায় হিসেব করলে খুবই ক্ষুদ্র একটা সময়। আর দশ হাজার বছর আগে কৃষি কাজের উদ্ভব কিংবা তারো পরে শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি তো আরো তুচ্ছ। সঠিকভাবে বলতে গেলে, মানুষ শিকারী-সংগ্রাহক ছিল প্লাইস্টোসিন যুগের পুরো সময়টাতে: ২৫ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত। “হোমো” গণ এর উদ্ভবের সময়কালটাও ২৫ লক্ষ বছর পূর্বের দিকে। তার মানে মানুষের ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে ৯৯% সময়ই তারা ছিল শিকারী-সংগ্রাহক। অর্থাৎ, ইভল্যুশনারী স্কেলে মানুষেরা “মানব সভ্যতার” শতকরা নিরানব্বই ভাগ সময়টাই বনে জঙ্গলে আর ফলমূল শিকার করে কাটিয়েছে। কাজেই আমাদের মস্তিষ্কের মূল নিয়ামকগুলো হয়তো তৈরি হয়ে গিয়েছিলো তখনই, সে সময়কার বিশেষ কিছু সমস্যা মোকাবেলার জন্য - আজকের দিনের অত্যাধুনিক সমস্যাগুলোর জন্য নয়। এখনো অনেকেই মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠে, কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পায় না। কিন্তু প্রতি বছর তেলাপোকার আক্রমণে যত মানুষ না মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারা যায় ট্রাকের তলায় পড়ে। অথচ ট্রাককে ভয় না পেয়ে মানুষেরা ভয় পায় নিরীহ তেলাপোকাকে। এটা বিবর্তনের কারণেই ঘটে বলে মনে করা হয়। বনে –জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতংগকে ভয় পাবার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই বহন করি। সে হিসেবে, বাস ট্রাকের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই এগুলোকে ভয় পাবার কোন স্মৃতি আমরা এখনো (আমাদের জিনে ?) তৈরি করতে পারিনি। সেজন্যই লিডা কসমিডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন [৭] –
“ | আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক (Our modern skull house a stone age of mind)। | ” |
তবে এই অনুসিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্ক আছে। ডেভিড বুলার বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অনুমানটির সাথে একমত পোষণ করেন না [৮],[৯]। তবে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা ডেভিড বুলারের সমালোচনাকে প্রত্যাখান করেছেন [১০]।
মানব সভ্যতার শতকরা নিরানব্বই ভাগ সময়টাই বনে জঙ্গলে আর ফলমূল শিকার করে কাটিয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এর মধ্যে পুরুষেরা ছিলো হান্টার বা শিকারী, আর মেয়েরা ফলমূল সংগ্রাহক। প্রয়োজনের তাগিদেই একটা সময় পুরুষদের একে অন্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে; অন্য গোত্রের সাথে মারামারি হানাহানি করতে হয়েছে; নিজের সাম্রাজ্য বাড়াতে হয়েছে; অস্ত্র চালাতে হয়েছে। তাদেরকে কারিগরী বিষয়ে বেশি জড়িত হতে হয়েছে। আদিম সমাজে অস্ত্র চালনা করা, শিকারে পারদর্শী হওয়াকে বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হত। যারা এগুলোতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে তারাই অধিক হারে সন্তান সন্ততি এ পৃথিবীতে রেখে যেতে পেরেছে, যারা এগুলো পারেনি তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যাবে পুরুষেরা শুধু আত্মরক্ষা করতেই যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্য বাড়াতে, আর সম্পত্তি এবং নারীর দখল নিতে। আর অন্য দিকে, মেয়েরা সংসার দেখা, সন্তানের লালন পালন এবং গৃহস্থালীর পরিচর্যা মেয়েরা বেশি অংশগ্রহণ করায় তাদের বাচনিক এবং অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ধিত হয়েছে। একটি ছেলের আর মেয়েদের মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে গঠনগত যে বিভিন্ন পার্থক্য পাওয়া গেছে, তাতে বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক প্রমাণিত হয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান থেকে আরো ধারণা পাওয়া যায় যে, ছেলেরা গড়পরতা বিশেষ এবং নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে (সাধারণতঃ) বেশি দক্ষ হয়, আর মেয়েরা সামগ্রিকভাবে বহুমাত্রিক কাজে (multitasking)।
নারীপুরুষের মস্তিষ্কের গঠনগত পার্থক্যের ছাপ আছে তাদের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদায়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড বাস ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জন লোকের উপর সমীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, সঙ্গী নির্বাচনের সময় ছেলেরা গড়পরতা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে তারুন্য এবং সৌন্দর্য। অন্যদিকে মেয়েরাও গড়পরতা ছেলেদের কাছ থেকে দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর সামাজিক মর্যাদা[১১]। এ ছাড়া নারী-পুরুষের যৌনতার কল্পনাতেও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে [১২]।
কয়েকজন বিখ্যাত বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী হচ্ছেন:
|month=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)