বিমারিস্তান ( ফার্সি: بيمارستان ; আরবি: بِيْمَارِسْتَان) বা মারিস্তান; যা আরবীতে দার আল–শিফা ('নিরাময়ের ঘর') নামেও পরিচিত–এটি ছিল ঐতিহাসিক ইসলামী বিশ্বের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা। মুসলিমদের পারস্য বিজয়ের পূর্বে সাসানীয় সাম্রাজ্যে এর উৎপত্তি খুঁজে পাওয়া যায়।[১][২] তবে বিমারিস্তান শব্দটি এখনও চিকিৎসালয় বোঝানোর জন্যে ইরানে উচ্চারিত ফার্সি ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
বিমারিস্তান ছিল রাষ্ট্রীয় কোষাগারের আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত সাধারণ হাসপাতাল,[১] যেখানে বিনামূল্যে অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক ও মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হতো। এতে অস্ত্রোপচার করারও ব্যবস্থা ছিল এবং এর চিকিৎসাব্যবস্থা একটি বিশেষ অভিজ্ঞ চিকিৎসাকর্মীর দল দ্বারা পরিচালিত হত। ইতিহাসে মুসলিম ডাক্তাররা সর্বপ্রথম সাধারণ হাসপাতাল, নার্সিং হোম ও মানসিক রোগীদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন, যেখানে উন্মাদ এবং কুষ্ঠরোগের মতো গুরুতর রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হয়েছিল। বিমারিস্তানকে বর্তমান হাসপাতালের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মধ্যযুগের মুসলিম চিকিৎসাবিদেরা মানসিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, সরকারী হাসপাতাল, মেডিকেল স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব পান। যতক্ষণ না এটির অবস্থার অবনতি হয় এবং অসুস্থদের প্রতি অবহেলিত এবং তাদের পরিত্যাগ করা হয়, ততক্ষণ চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতুলনীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে ছিল।[১]
বিমারস্তান একটি ফার্সি শব্দ (بیمارستان: bīmārestān ) যার অর্থ "হাসপাতাল"। শব্দটির প্রথম অংশ বিমার, যা পাহলভি ফার্সি শব্দ বেমার বা ভেমার থেকে, যার অর্থ হয় 'অসুস্থ বা 'অসুস্থ ব্যক্তি' এবং এর সাথে প্রত্যয় হিসেবে -'স্তান' শব্দটি যুক্ত হয়েছে, যার অর্থ হয় 'স্থান' বা 'অবস্থান'। এই হিসেবে শব্দটির অর্থ হয়, অসুস্থের স্থান অর্থাৎ হাসপাতাল। [১]
ইংরেজি সাহিত্যে শব্দটি প্রায় ইসলামি বিশ্বে বিদ্যমান ঐতিহাসিক বা প্রাক-আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলি চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়; তবে এটি বর্তমানও কখনও কখনও তাদের স্থানীয় ভাষায় আধুনিক হাসপাতাল বা নির্দিষ্ট ধরণের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। [৩][৪]
প্রাচীন কালের অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র মুসলিম পণ্ডিতদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যয়ন ও অগ্রগতির উপায় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ব্যবস্থা ছিল বিমারিস্তানের প্রথম সংস্করণ। [৫] এই ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালগুলি ওষুধ, খাবার ও জল বহন করত এবং রোগীকে প্রয়োজনে সাহায্য করার জন্য চিকিত্সক ও ব্যবহারবিদদের সাথে নিয়ে ভ্রমণ করত। [৫] ঐতিহ্য অনুসারে খন্দক যুদ্ধের সময় ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে রুফাইদা আল আসলমিয়াহ কর্তৃক স্থাপন করা একটি তাঁবুতে প্রথম বিমারিস্তান অবস্থিত ছিল। [৫][৬] পরবর্তীকালে এই ভ্রাম্যমাণ কেয়ার সেন্টারগুলি এক বা দুইটি তাঁবু থেকে ঔষধি ভেষজ, খাদ্য, চিকিত্সক ও ফার্মাসিস্ট দিয়ে সজ্জিত চিকিৎসা পরিচর্যার বিশাল ইউনিটে পরিণত হয়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ সালজুক বেগের সেলজুক সালতানাতের শাসনামলে, একটি একক ভ্রাম্যমাণ কেয়ার সেন্টার পরিবহনের জন্য কমপক্ষে ৪০ টি উটের প্রয়োজন পড়ত। [৭] ধারণা ছিল যে, বড় শহরগুলির উপকণ্ঠে বসবাসকারী গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা আরো ভালভাবে প্রসারিত করতে সক্ষম হওয়া; কারণ তাদের চিকিৎসা গ্রহণের অন্য কোনো মাধ্যম বা উপায় ছিল না।[৬] এই ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত পরিষেবাগুলি সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য ইসলামি হাসপাতালে স্থানান্তরিত হয়।
যদিও ইসলামি সাম্রাজ্য অনেক বড় ছিল; তবুও তখন বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোতে সবচেয়ে সুপরিচিত বিমারস্তানগুলি ছিল। [১] প্রথম ছয়টি বিমারিস্তান অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামি হাসপাতালের ইতিহাসে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখায়। [৮] উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ প্রথম দ্বারা ৭০৬ সালে দামেস্কে নির্মিত প্রথম বিমারিস্তান, যা কুষ্ঠরোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা কার্যে মনোনিবেশ করেছিল; তবে অন্য রোগের রোগীদেরও সেবা প্রদান করা হয়েছিল।[১][৮] একই সময়ে দ্বিতীয় বিমারস্তান কায়রোতে নির্মিত হয় এবং দ্রুতই বাগদাদে আরও দুটি তৈরি হয়ে যায়। [১] এরপর আরও শীঘ্রই আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ দ্বারা বিমারিস্তান নির্মিত হয়েছিল। [১][৮]
প্রাক-ইসলামি বিমারিস্তান
ইরানের সাসানীয় রাজ্যের যুগে গোন্ডি শাপুর শহরে বিশ্বের প্রথম বিমারিস্তান পাওয়া যায়, গোন্ডি শাপুর একাডেমি নামে পরিচিত। [৯]
ইসলামী সভ্যতায় হাসপাতালগুলি যেভাবে গড়ে উঠে, তেমনি এসবে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যও বজায় রাখা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, বিমারিস্তানগুলি জাতি, ধর্ম, নাগরিকত্ব বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত লোকেকে সেবা প্রদান করে। [১০] ওয়াকফ নথিতে বলা হয়েছে যে, কাউকে কখনই বিমারিস্তান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না;[১১] এর মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বা ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ার আলেপ্পোর আরঘুন হাসপাতালে মানসিক অসুস্থ ব্যক্তির যত্নের মধ্যে ছিল প্রচুর আলোর ব্যবস্থা, তাজা বাতাস, প্রবাহিত জল ও সঙ্গীত। [১২] সমস্ত চিকিত্সক ও হাসপাতাল কর্মীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল নিজেদের রোগীদের সুস্থতার জন্যে একসাথে কাজ করা। [১১]
একজন রোগী চিকিৎসার জন্য অবস্থান করতে পারে এমন কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা ছিল না। [১৩] পরিবর্তে, ওয়াকফের নথিতে বলা হয়েছে যে, হাসপাতালে সমস্ত রোগীদের সম্পূর্ণরূপে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাদের রাখতে বাধ্য থাকবে।[১০] পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা কিন্তু সমানভাবে সজ্জিত ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল। [১০][১১] মানসিক রোগ, ছোঁয়াচে রোগ, অ-সংক্রামক রোগ, সার্জারি, ওষুধ ও চোখের রোগের জন্য আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[১১][১৩] রোগীদের জন্য তাদের সমলিঙ্গের নার্স ও কর্মীরা উপস্থিত থাকতেন। [১৩] প্রতিটি হাসপাতালে ছিল বক্তৃতা উপস্থাপনের জন্য একটি বিশেষ প্রশস্ত কক্ষ, রান্নাঘর, ফার্মেসি, পাঠাগার, মসজিদ ও মাঝে মাঝে খ্রিস্টান রোগীদের জন্য একটি চ্যাপেলও ছিল। [১৩][১৪] বিনোদনমূলক উপকরণ এবং সঙ্গীতজ্ঞদেরকে রোগীদের সান্ত্বনা ও উৎসাহিত করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। [১৩]
পবিত্র কুরআন পেশাদার নৈতিকতার বিকাশের ভিত্তি প্রদান করেছে, যেখানে ওজু বিধানের উত্থান চিকিৎসা অনুশীলনে স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্বকেও প্রভাবিত করেছে। স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব স্বাস্থ্যকর জীবনধারাকে উন্নীত করে এবং স্বাস্থ্যবিধি অবকাঠামো তৈরি করতে সম্প্রদায়কে প্রলুব্ধ করে রোগ-বালা কমিয়ে দেয়। বিমারিস্তানগুলি নিয়মিত রোগী ও কর্মীদের গোসল করার অনুশীলন, পরিষ্কার বিছানা এবং চিকিৎসা সকল সামগ্রী প্রদানের পাশাপাশি নিজের স্থাপত্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি নজর রাখে। তাদের স্থাপত্য এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, তাতে সর্বদা বায়ু সঞ্চালন ও উজ্জ্বল উন্মুক্ত আলো প্রবেশ করার যথেষ্ট সুযোগ থাকে। [১৫] ফার্মেসিগুলো পর্যায়ক্রমে মুহতাসিব নামক সরকারি পরিদর্শকদের দ্বারা পরিদর্শন করা হত, যারা ওষুধগুলি সঠিকভাবে মিশ্রিত করা হয়েছে, কিনা; তা পাতলা করা হয়েছে, কি না এবং তা পরিষ্কার জারে রাখা হয়েছে কিনা, সে সব কিছুই পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখতেন। উপরন্তু, আল রাযী, যাকে বাগদাদে একটি নতুন হাসপাতালের জন্য জায়গা বেছে নিতে বলা হয়েছিল, তিনি গোটা শহরের চারপাশে বিভিন্ন স্থানে গোশতের টুকরো ঝুলিয়ে দেন এবং যেখানে গোশত সবচে কম পচনশীল হয় সেখানে তিনি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সুপারিশ করেন। [১৬]
বিভিন্ন কুরআনের আদেশ এবং হাদিস (বা মুহাম্মদের কর্ম), যা শিক্ষার মূল্যবোধের প্রচার করে এবং জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বের উপর জোর দেয়–তা তৎকালীন সে যুগের মুসলমানদের জ্ঞানের সন্ধানে এবং বিজ্ঞানের বিকাশে প্রভাবিত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমন অগণিত হাদিস পাওয়া যায়, যা জ্ঞান অর্জন এবং সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার পরামর্শ দেয়। [১৭][১৮][১৯]
বিমারিস্তান কেবল অসুস্থ ব্যক্তিদের যত্ন প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হত না। এগুলি এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল, যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাগদাদ, দামেস্ক এবং কায়রোর মতো শহরে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানকে উন্নত করার কাজ করে। [২০] এছাড়াও কিছু মাদ্রাসা বিমারিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল, যাতে এদের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিখতে পারে এবং তাদের তাত্ত্বিক জ্ঞান বিমারিস্তানে সরাসরি অনুশীলনে রাখতে পারে। [২১] ব্যক্তিগত নির্দেশক, স্ব-অধ্যয়ন ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রাথমিক বিজ্ঞানের প্রস্তুতি শেখানো হয়েছিল। এসব হাসপাতালের অনেকগুলির সাথে একটি সংযুক্ত বড় লাইব্রেরিও ছিল, যা সাধারণত অধিকাংশ বিষয়ে সম্ভাব্য লেখায় ভরা থাকে এবং হাসপাতালে অনুশীলন করা ওষুধের সাথে প্রাসঙ্গিক আলোচনাও এসব বইয়ে থাকত। [২২]
এসব প্রাথমিক মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসকরা সকলে একচেটিয়াভাবে মুসলিম ছিলেন না; ইহুদি ও খ্রিস্টান চিকিৎসকরাও এসবে অনুশীলন ও শিক্ষা দিতেন। [২৩] কায়রো, বাগদাদ ও দামেস্কের প্রধান হাসপাতালসমূহে শিক্ষার্থীরা সর্বদাই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের তত্ত্বাবধানে রোগীদের দেখতে যেত–এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যা বর্তমানকালের মেডিকেল কলেজের সাথে তুলনীয়। আজকের চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মত অনুশীলনকারী চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে বিমারস্তানে কাজ করা এবং শেখার ফলে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাড়া দেওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। [৪]
সেই যুগে আব্বাসী খিলাফতে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। [১৩] ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে, খলিফা আল-মুক্তাদির একজন চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় নিজের একজন প্রজার মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পারেন। [১৪] তিনি অবিলম্বেই নিজের মুহতাসিব সিনান ইবনে সাবিতকে বিষয়টি পরীক্ষা করার নির্দেশনা দেন এবং দেশের চিকিৎসকদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত অনুশীলন করতে বাধা দেন। [১৩][১৪] সেই সময় থেকে চিকিৎসকের জন্য লাইসেন্স পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে এবং শুধুমাত্র যোগ্য চিকিৎসকদের ওষুধ অনুশীলন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। [১৩][১৪]
প্রাথমিক ইসলামি সাম্রাজ্যে যখন বিভিন্ন জ্ঞান সন্ধান করার কাজ শুরু, তখন প্রাক-ইসলামী যুগের অসংখ্য কাজ রোম, গ্রীস, পাহলভি ও সংস্কৃতের মত সাম্রাজ্য থেকে আরবিতে অনুবাদ করেছিল এবং এই অনূদিত কাজগুলি আগে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল এবং সম্ভবত এটিও হতে পারত যে, এসব চিরতরে হারিয়ে যেত। [২৪] এই নতুন তথ্যের আবিষ্কার ইসলামি সাম্রাজ্যগুলিকে প্রচুর পরিমাণে বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আবিষ্কারের পথ উন্মোচিত করে দিয়েছিল। আরবরা চিকিৎসা ও ওষুধবিজ্ঞানে গ্রীক এবং রোমান গবেষণাসহ বিজ্ঞান জুড়ে বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করেছে। অনূদিত বহু নিদর্শন; যেমন: চিকিৎসা অভিধান এবং স্বাস্থ্যবিধি ও যৌন মিলনের তথ্য সংবলিত বইগুলি এখনও সংরক্ষিত আছে। সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনূদিত অংশের মধ্যে একটি হল মুসলিম চিকিত্সক ইবনে সিনা দ্বারা গ্রীক থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা একটি মানব শারীরস্থান বই, যে বইটি ১৭ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের স্কুলগুলিতে পঠিত হয়েছিল। [২৫]
ইসলামি যুগের হাসপাতালগুলির সবচে' উল্লেখযোগ্য অবদানগুলির মধ্যে একটি হল সাংগঠনিক কাঠামো এবং তা কীভাবে ইসলামী সংস্কৃতিতে কাজ করে সেটা প্রমাণিত করা। এই অবদানগুলি এখনও সমসাময়িক চিকিৎসা অনুশীলনকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, বিমারিস্তানগুলি রোগী এবং তাদের চিকিৎসার লিখিত নথি সংগ্রহেই রাখত–যা রোগীদের জন্য প্রথম লিখিত চিকিৎসার ইতিহাস। [১১] শিক্ষার্থীরা রোগীদের রেকর্ড সংরক্ষণ করার কাজে নিয়োজিত ছিল, যা পরবর্তীতে চিকিৎসক দ্বারা সম্পাদিত হত এবং তাতে ভবিষ্যতের চিকিৎসাও উল্লেখ করা হতো। [১৩]
খলিফা হারুন আল রশিদ এবং তার উজির ইয়াহিয়া ইবনে খালিদ আল বার্মাকি ৮০৫ সালে বাগদাদে প্রথম নথিভুক্ত জেনারেল হাসপাতালটি তৈরি করেছিলেন। [২১][২৬] যদিও দুর্বল নথিপত্রের কারণে এই হাসপাতাল সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, তবে এ সাধারণ হাসপাতালটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অনেক হাসপাতালের জন্য একটি উদাহরণ তৈরি করেছিল। ১০০০ সাল নাগাদ বাগদাদে আরও পাঁচটি হাসপাতাল ছিল। [২৭] ইসলামী বিশ্ব জুড়ে নতুন হাসপাতাল তৈরি হওয়ার সময় তারা বাগদাদের হাসপাতালটির অনুরূপ সাংগঠনিক কাঠামো অনুসরণ করে।
বাগদাদের সাধারণ সেই হাসপাতালটিকে দেহ-সংক্রান্ত রোগ, সার্জারি ও অস্থিচিকিৎসার মত বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। এছাড়াও বড় হাসপাতালগুলির আরও অনেক বৈচিত্র্যময় বিশেষত্ব ছিল। "দেহ-সংক্রান্ত রোগ" বিভাগটি ছিলো বর্তমান প্রচলিত অভ্যন্তরীণ ওষুধের মোটামুটি সমতুল্য এবং এটি জ্বর, সংক্রমণ ও হজম সংক্রান্ত সমস্যাগুলির মতো আরো কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত ছিল। [২২] প্রতিটি বিভাগের একজন পরিদর্শক অফিসার, একজন অধিষ্ঠাতা অফিসার এবং একজন তত্ত্বাবধায়ক বিশেষজ্ঞ থাকতেন। হাসপাতালগুলিতে লেকচার থিয়েটার ও লাইব্রেরিও ছিল। হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, যারা পরিচ্ছন্নতা নিয়ন্ত্রণ করেন এবং একজন হিসাবরক্ষকসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। [১২] হাসপাতালগুলি সাধারণত তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো: যাদের একজন ছিলেন অচিকিৎসক প্রশাসক, একজন প্রধান ফার্মাসিস্ট এবং শায়খ সায়দালানি নামে প্রধান চিকিত্সকের ভূমিকার সমান একজন, যিনি মুতওয়াল্লি ( ডিন) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। [২৮] হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা ঐতিহ্যগতভাবে প্রতি রাতে বন্ধ থাকতো; কিন্তু ১০শ শতকের মধ্যে আইন পাস করা হয় যে, হাসপাতাল ২৪ ঘন্টা খোলা রাখতে হবে। [২৯]
পুরুষ ও মহিলা উভয় এই হাসপাতালে কাজ করতেন এবং উভয় চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত থাকতেন; কিন্তু হাসপাতালের কর্মীরা বিভিন্ন পেশার কাজ করতেন। [৩০] অনেকটা আজকের হাসপাতালের মতো, তারাও ফার্মাসিস্ট, নার্স, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, তত্ত্বাবধায়ক বিশেষজ্ঞ, সচিব এবং সুপারিনটেন্ডেন্টসহ ইত্যাদি পদে চাকরি করত। সুপারিন্টেন্ডেন্টরা ( যারা আরবি ভাষায় শা'উর নামে পরিচিত ছিলেন ) নিশ্চিত করতেন যে, হাসপাতালগুলি একটি সম্পূর্ণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার নির্দিষ্ট মান পুঙ্খানুপুঙ্খ পূরণ করেছে। [২২] ফার্মাসিস্টরা হাসপাতালের রোগীদের চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরি করতেন এবং এক্ষেত্রে তারা রসায়ন বা আলকেমির জ্ঞানের উপর নির্ভর করতেন। [২২]
১০ম শতাব্দীর আগে, হাসপাতালগুলি সারা দিন কাজ করত এবং সারা রাত বন্ধ থাকতো। পরবর্তীতে সমস্ত হাসপাতাল ২৪ ঘণ্টার ভিত্তিতে পরিচালিত হতে থাকে। তা সত্ত্বেও, হাসপাতালে অনুশীলনকারী চিকিত্সকগণ নিজেদের নির্ধারিত বেতনই নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘন্টা কাজ করেছিলেন; তবে পরবর্তীতে তাদের উদারভাবে যথেষ্ট অর্থ প্রদান করা হয়েছিল, যাতে তাদের প্রতিভা ধরে রাখা যায়। প্রধান চিকিৎসক হিসেবে, জাবরিল ইবনে বুখতিশু বার্ষিক প্রায় ৪.৯ মিলিয়ন দিরহাম বেতন পান এবং তার তুলনায় একজন আবাসিক চিকিৎসক প্রতি মাসে ৩০০ দিরহাম বেতনে উল্লেখযোগ্যভাবে দীর্ঘ ঘন্টা কাজ করতেন। [২২]
ইসলামি হাসপাতালগুলি ওয়াকফ দান বা অসিয়তের মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক যোগান অর্জন করত এবং তা বায়তুল মালের সহায়তায় সংগ্রহ করা হত। একটি ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের আইনি নথিগুলি রোগীর সাথে হাসপাতালে কেমন আচরণ করা হয়, তাকে কিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে এবং এই নিয়মও নির্ধারণ করে যে, জাতি, লিঙ্গ ও নাগরিকত্ব নির্বিশেষে যে কেউ ভর্তি হতে পারে। [৩১] সমস্ত আর্থ-সামাজিক অবস্থার রোগী এতে সম্পূর্ণ চিকিৎসার সুযোগ পেত; কারণ সব খরচ হাসপাতাল নিজেই বহন করত। এর একটি উদাহরণ ছিল কায়রোর আল-মানসুরি হাসপাতাল, যা মিশরের মামলুক শাসক আল মনসুর কালাউনের নির্দেশক্রমে নির্মিত হয়েছিল। এর সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতা ছিল প্রায় ৮০০০ জন এবং এটির কেবল বার্ষিক দানই ছিল এক মিলিয়ন দিরহাম বলে উল্লেখ করা হয়। হাসপাতালের নকশাটি পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যে পাশাপাশি একটি ফার্মেসি, একটি লাইব্রেরি ও বক্তৃতা হলের জন্য আলাদাভাবে করা হয়। বক্তৃতা হলগুলি হাসপাতালের আসান, বক্তৃতা প্রদানকারী এবং কর্মীদের ব্যবহারের পাশাপাশি নিয়মিত বৈঠকের জন্যও ব্যবহৃত হত।
বাগদাদে হাসপাতালের অস্তিত্ব খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী থেকে নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং প্রথমটি সম্ভবত ৮০৫ সালে খলিফা হারুনুর রশিদ ও তার উজির ইয়াহিয়া ইবনে খালিদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। [২৬] খ্রিস্টীয় ১০ শতকের শেষের দিকে বাগদাদে আরও প্রায় পাঁচটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। [১]
বাগদাদের তৎকালীন শাসক আদুদ আল-দৌলা দ্বারা ৯৮১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই হাসপাতালটি বিখ্যাত চিকিৎসক আল রাজি দ্বারা পরিচালিত হতো, যিনি দজলা নদীর তীরে এর একটি সঠিক অবস্থানও বেছে নিয়েছিলেন। [৩২] তিনি "কয়েক দিনের জন্য বেশ কয়েকটি জায়গায় কিছু মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে দেন এবং যেখানে গোশত সবচেয়ে কম সংক্রামিত পাওয়া যায়, সেখানেই তিনি হাসপাতাল নির্মাণের পরামর্শ দেন এবং এভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে এর জন্যে একটি সঠিক স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। [৩২] সূচনা কালে আল-আদুদি হাসপাতালে ২৫ জন কর্মী সদস্য ছিল, যারা আলোকবিজ্ঞান থেকে শুরু করে সার্জারি পর্যন্ত প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এই সকল বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি আল-আদুদি হাসপাতাল নতুন ডাক্তারদের জন্য একটি শিক্ষামূলক হাসপাতাল হিসাবেও কাজ করে। আল-আদুদি হাসপাতালটি ১২ শতক পর্যন্ত চালু ছিল, যখন ১১৮৪ সালে এক বর্ণনায় এটিকে "...আকারে একটি বিশাল প্রাসাদের মত" বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। [১] শেষ পর্যন্ত ১২৫৮ সালের দিকে হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোল কর্তৃক বাগদাদ অবরোধ কালে তারা আল-আদুদি হাসপাতালটি ধ্বংস করে দেয়।[৩২]
প্রথম দিকের মিশরীয় হাসপাতালগুলির মধ্যে একটি ছিল আল-ফুসতাত হাসপাতাল, যা খ্রিস্টীয় ৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি সুলতান আহমদ ইবনে তুলুন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি ফুসতাতে অবস্থিত ছিল, যা বর্তমান আধুনিক কায়রোতে অবস্থিত। আল-ফুসতাত হাসপাতালটি আধুনিক হাসপাতাল ব্যবস্থার সাথে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্যে সাদৃশ্য রাখে। এর মধ্যে ছিল, লিঙ্গ হিসেবে পৃথক আসন, পৃথক ওয়ার্ড এবং রোগীর সুস্থতার সময় ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সুরক্ষা। [৮][৩২] এসব পৃথক অনুশীলন ছাড়াও আল-ফুসতাত হাসপাতালই প্রথম মানসিক রোগীদের চিকিত্সার প্রস্তাব দিয়েছিল। [১] ওষুধ অনুশীলনের বাইরে আল-ফুসতাত হাসপাতালটি একটি শিক্ষাদানের হাসপাতাল ছিল এবং এতে প্রায় ১০০,০০০ এর অধিক গ্রন্থ ছিল। এছাড়াও আল–ফুসতাত হাসপাতালের অপর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এটি বিনামূল্যে সব চিকিৎসা প্রদান করত এবং তা ওয়াকফ রাজস্ব কারণের সম্ভব হয়েছিল। এর যাবতীয় খরচ বায়তুল মাল থেকে বহন করা হত। আল-ফুসতাত হাসপাতালই সম্ভবত এভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রথম হাসপাতাল ছিল।[৮] আল–ফুসতাত হাসপাতালের কাছে ইবনে তুলুম জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার জন্য একটি ফার্মেসিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। [৮] আল-ফুসতাত হাসপাতালটি প্রায় ৬০০ বছর ধরে চালু ছিল। [৩২]
আল–মানসুরি হাসপাতাল ছিল কায়রোতে অবস্থিত আরেকটি হাসপাতাল এবং ১২৮৪ খ্রিস্টীয় সালে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা সুলতান আল-মনসুর কালাউন দামেস্কের একটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার জন্যে অনুপ্রাণিত হন। [৩২] হাসপাতালের প্রতি সুলতান কালাউনের এমন সুদৃষ্টির কারণে ধনী ও দরিদ্র উভয়ের জন্যই হাসপাতালটিকে সহজলভ্য করার লক্ষ্যে এতে চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়েছিল। উপরন্ত...'রোগীকে ছাড়ার পরে হাসপাতালে থাকার সময় নিজের যে মজুরি হারায় তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে রোগীকে খাবার এবং অর্থ দেওয়া হতো'।[৩২] আল-মানসুরি হাসপাতালটি এতটাই সহজলভ্য ছিল যে, এটি প্রতিদিন প্রায় ৪,০০০ জন রোগীর চিকিৎসা করত। আল মানসুরি হাসপাতাল একটি যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান ছিল এবং ভবিষ্যতের বিমারিস্তানগুলির জন্য একটি আদর্শ হিসেবে কাজ করেছিল।
আল-মানসুরি হাসপাতালটি আকার এবং দান উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট ছিল। এই হাসপাতালে ৮০০০ টি শয্যা রাখার সক্ষমতা ছিল এবং বার্ষিক রাজস্ব থেকে এটির অর্থায়ন করা হয়েছিল, যার মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১ মিলিয়ন দিরহাম। [৪] এর আগেকার আল-ফুসতাত হাসপাতালের মতোই আল-মানসুরি হাসপাতালটিও মানসিক রোগীদের চিকিত্সা করত এবং থেরাপির একটি রূপ হিসাবে সঙ্গীত চালু করেছিল। ১২৫৮ সালে মৃত্যুর পর আল-মানসুরি ইবনুন নাফিসের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও পেয়েছিলেন [৩৩] আল-মানসুরি হাসপাতাল খ্রিস্টীয় ১৫ শতক পর্যন্ত চালু ছিল এবং আজও এটি কায়রোতে রয়েছে; যদিও এটি এখন "মুস্তাশফা আল কালাউন " নামে পরিচিত। [১][৩২]
দামেস্ককে ৭০৬ এবং ৭০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইসলামি হাসপাতালের কেন্দ্র বলে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালটি কুষ্ঠ ও অন্ধত্বের মত দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং সেইসাথে গরিব বা দরিদ্র উভয়ের জন্য একটি চিকিত্সা কেন্দ্র হিসাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল।[৮] এটি শুরু হয়েছিল আল ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক কর্তৃক কুষ্ঠরোগীদের একত্র করা এবং তাদের অর্থ প্রদান করার মাধ্যমে রোগ ছড়ানো থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে আয়োজিত একটি জমায়েতের মাধ্যমে। কারণ, কুষ্ঠরোগীরা ভিক্ষার মাধ্যমে রোগের বিস্তার ঘটায় এমনটি ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি তাদের অর্থের জন্যে অপরিচিত মানুষদের থেকে ভিক্ষা করা থেকে বিরত রাখার জন্য করা হয়েছিল এবং এর ফলে কুষ্ঠরোগের বিস্তার কমানো সম্ভব হয়েছিল। [৩৪] এই উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য কুষ্ঠরোগের মত সংক্রামক রোগের জন্য পৃথক ওয়ার্ড বিদ্যমান ছিল এবং সেখানে রোগীদের চিকিৎসার জন্য কোনও খরচ করতে হয়নি। পরবর্তীতে আল-ওয়ালিদ হাসপাতালকে বাইজেন্টাইন নোসোকোমিয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছিল এবং সেখানে অসুস্থ, কুষ্ঠরোগী, অচল ও দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। [৮]
১১৫৬ সালে আল-ওয়ালিদ হাসপাতালের প্রায় সাড়ে চার শতাব্দী পরে দামেস্কে নূর উদ্দিন বা আল-নুরি হাসপাতাল বিমারস্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটির নামকরণ করা হয় নূর উদ্দীন জেনগির নামে। আল-নুরি হাসপাতাল হলো সেই হাসপাতাল, যেখানে আল-মনসুর কালাউনের চিকিৎসা করা হয়েছিল এবং তা দেখেই কায়রোতে তার নিজস্ব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং এটি প্রায় ৭০০ বছর যাবত পরিচালিত হয়েছিল। আল-নুরি হাসপাতালের অনুশীলনগুলি উদ্ভাবনী ছিল; কারণ এটি রোগীদের চিকিৎসা রেকর্ড বজায় রাখা প্রথম হাসপাতাল হয়ে ওঠে। [৩২] আল-নুরি হাসপাতালটি একটি মর্যাদাপূর্ণ মেডিকেল স্কুলও ছিল, যার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন ইবনুন নাফিস, যিনি পরবর্তীতে পালমোনারি সঞ্চালন তত্ত্বের পথপ্রদর্শক হন। [৩২]
উসমানী সাম্রাজ্য যুগে যুগে যে সকল দেশে নিজেদের দুর্দান্ত অবস্থান উপভোগ করেছিল; তখন এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল, বিশেষত চিকিৎসার প্রতিষ্ঠান। সেই সময় কালে বেশ কয়েকটি স্কুল, চিকিৎসা গ্রন্থাগার ও বেশ কয়েকটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল; যার মধ্যে রয়েছে, “দার আল-শিফা', 'দার আল-আফিয়া' ও 'খাস্তা খানা'। উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রথম হাসপাতালটি ছিল সুলতান বায়জিদ দ্বারা ৮০২ হি./ ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এবং দ্বিতীয়টি ইস্তাম্বুলে সুলতান মোহাম্মদ আল ফাতিহ কর্তৃক ৮৭৫ হিজরি / ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, এই হাসপাতালটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এটিও উল্লেখ্য যে "দার আল শিফা এদিরন", যা সুলতান বায়েজিদ দ্বিতীয় দ্বারা ৮৯৫ হিজরি/১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটি বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত একটি বিশিষ্ট স্থাপত্য হিসাবে অবশিষ্ট ছিল এবং এটি ইউরোপীয় হাসপাতাল নির্মাণে প্রভাবের জন্য পরিচিত ছিল। তা চোখের রোগ ও মানসিক রোগের চিকিৎসায় বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিল।
নবম শতাব্দীর শেষের দিকে আব্বাসীয় খলিফা আল মুতাদিদ একটি বিমারিস্তান নির্মাণ করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। এটি ২৭৯ হি./৮৯২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যিনি চিকিৎসক আবু বকর আল রাজিকে বাগদাদে একটি বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্যে আদেশ করেছিলেন এবং তিনি একে তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম এবং আধুনিক সমন্বিত হাসপাতাল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আল-রাজি হাসপাতালের জন্য উপযুক্ত জায়গা বেছে নেওয়ার জন্য নিজের উদ্ভাবিত প্রসিদ্ধ সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে, যা এখনও ডাক্তারদের দ্বারা প্রশংসিত। আল রাজি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন ধরণের মাংসের কিছু টুকরো বাগদাদের বিভিন্ন অংশে রাখেন এবং তারপর চব্বিশ ঘন্টা অপেক্ষা করে তিনি জায়গা বেছে নিয়েছিলেন। আল রাজি সেই সময়ের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল মুতাদিদির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আজ এর কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। [৩৫][৩৬][৩৭][৩৮]
৯১৮ সালে আব্বাসীয় খলিফা আল মুক্তাদির বাগদাদ শহরে একটি বিমারিস্তান নির্মাণ করেন এবং তিনি উম্ম আল মুক্তাদির নামে অপর একটি বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি এর জন্য সে সময়ের সবচে' বিখ্যাত চব্বিশ জন ডাক্তার নিয়োগ করেন, যার মধ্যে সার্জন, শল্যচিকিৎসক, চক্ষুচিকিৎসকও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১১৮১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল ওয়ালিদ যে বিমারস্তান নির্মাণ করেছিলেন তার পাশেই দামেস্কে আরো একটি চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এটি দামেস্কে বিদ্যমান তৎকালীন চিকিত্সা ও নিরাময় কেন্দ্রগুলির সাথে উল্লেখিত রয়েছে। ইতিহাসবিদরা বিমারিস্তানটির চিকিৎসা পরিষেবা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও এটি বিনামূল্যে কী কী পরিষেবা প্রদান করত এবং এর সাথে এতে কর্মরত ডাক্তারসহ রোগী ও বিমারিস্তানের বিভাগ ও কক্ষগুলির একটি সঠিক বিবরণ রয়েছে।
খলিফা ইয়াকুব আল-মানসুর আল-মুগদি ( মৃত্যু: ৫৯৫ হিজরি ) এর গুণাবলী সম্পর্কে নিজের বক্তৃতা প্রসঙ্গে আব্দল ওয়াহিদ মারাকেশী তার বই "আল-মুজাব ফি তাখলিস আখবার আল মাগরিবে" বলেছেন : "তিনি মারাকেশে এমন একটি জায়গা তৈরি করেছিলেন, যা আমি মনে করি না, পৃথিবীতে এমন জায়গার অস্তিত্ব রয়েছে। এর কারণ হল তিনি দেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় একটি প্রশস্ত উঠান বেছে নিয়েছিলেন এবং নির্মাতাদের এটিকে নিখুঁত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাদের যা প্রস্তাব করা হয়েছিল তা ছাড়াও তারা সূক্ষ্ম খোদাই ও বিস্তৃত অলঙ্করণগুলি নিখুঁত করেছিল এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এতে সমস্ত সুগন্ধযুক্ত ও ভোজ্য গাছ লাগানো হবে এবং তিনি এতে প্রচুর জল প্রবাহিত করেছিলেন, যা সমস্ত ঘরের উপরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মাঝখানে চারটি পুল রয়েছে, যার মধ্যে একটি সাদা মার্বেল দিয়ে নির্মিত। তারপর তিনি তাকে সমস্ত ধরণের পশম, লিনেন, সিল্ক, চামড়া ও অন্যান্য জিনিসের মূল্যবান আসবাবপত্রের আদেশ দিলেন, যা বর্ণনার চেয়েও বেশি ছিল। তিনি এতে খাবারের জন্য প্রতিদিন ত্রিশ দিনার দিতেন। তিনি সেখানে অসুস্থদের জন্য রাত দিন চিকিৎসা প্রস্তুত করেছিলেন। গ্রীষ্ম ও শীতের পোশাকসহ ঘুমানোর জন্যে আলাদা আলাদা পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। অসুস্থ ব্যক্তি যখন সুস্থ হয়ে উঠত, যদি সে দরিদ্র হয় তাহলে উপার্জনক্ষম না হওয়া পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকার মত তাকে অর্থ দেওয়া হতো এবং যদি সে ধনী হয় তবেও তাকে কিছু অর্থ দেওয়া হত। তিনি এটি কেবলমাত্র গরিবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেননি; বরং অসুস্থ ধনী গরিব সকল অসুস্থ ব্যক্তির জন্য তা উন্মুক্ত ছিল। একজন অপরিচিত ব্যক্তিকেও যদি সেখানে নিয়ে যাওয়া হত, তাহলে বিশ্রাম বা মারা না যাওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করানো হয়েছিল।
প্রতি শুক্রবার নামাযের পর তিনি সওয়ার হয়ে শহরে প্রবেশ করতেন। তখন যে সকল অসুস্থ ব্যক্তি ফিরে আসতেন, তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছেন? মানুষ কিভাবে আপনার উপর শাসন করছে? তিনি মারা না যাওয়া পর্যন্ত এই কাজ চালিয়ে যান।
সালাহুদ্দিন আইয়ুবি কায়রোতে বিমারিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ভ্রমণকারী ইবনে জুবায়ের তা বর্ণনা করেছিলেন; কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোন চিহ্ন অবশিষ্ট নেই।
প্রাথমিক ইসলামি হাসপাতালের বিকাশ ও অস্তিত্বের সাথে সাথে রোগীদের চিকিত্সার জন্য নতুন উপায়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিমারিস্তানগুলি এই সময়ে ইসলামী সংস্কৃতিতে অনেক যুগান্তকারী এবং অগ্রগামী চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে আসে, যা শেষ পর্যন্ত বাণিজ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিময়ের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই যুগের বিশিষ্ট চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার, কৌশল, আবিষ্কার ও অসুস্থতার নিরাময়সহ অগণিত চিকিৎসাযন্ত্রের উদ্ভাবনে বিপ্লবী পদ্ধতি ও অনুশীলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। ইসলামি হাসপাতাল থেকে উদ্ভূত অনেক উন্নয়নের মধ্যে ছিল অসুস্থতা বা রোগ নির্ধারণ করা এবং রোগ ও শারীরস্থানের চিকিৎসার জন্য তার নকশা তৈরি করা।
১০ শতকের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ আম্মার আল মাওসিলি ছানির জন্য একটি বৈপ্লবিক চিকিৎসা তৈরি করেন। [৩৯] তার অনুশীলনের মধ্যে একটি ফাঁপা সিরিঞ্জ (যা তিনি নিজে তৈরি করেন) ও স্তন্যপানের মাধ্যমে ছানি অপসারণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও এই পদ্ধতিটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরো বিকশিত হয়েছে; তবে তার আবিষ্কৃত সেই প্রাথমিক চিকিৎসার পদ্ধতিটি আজও একই রয়ে গেছে। [৪০]
এই যুগে আলি ইবনে ঈসা আল-কাহাল বা ইবনে ঈসা (মৃ. ১০৩৮) যিনি বাগদাদের আল-আদুদি হাসপাতালে অনুশীলন ও শিক্ষা দিতেন, তিনি চোখের রোগগুলির আরও ব্যাপক অন্বেষণ করেন। তিনি তাজকিরাতুল কাহহালি লিখেন এবং চিকিৎসার বিকাশ করেন, যা শারীরবৃত্তীয় অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ১৩০ টিরও বেশি চোখের রোগের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। [৪১] কাজটি তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল যার মধ্যে রয়েছে:
এই কাজটি ১৪৯৭ সালে লাতিন ভাষায় এবং তারপরে আরো কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়, যা এটিকে কয়েক শতাব্দী ধরে চিকিৎসক সম্প্রদায়ের উপকার করার সুযোগ করে দেয়। [৪০]
সম্ভবত ইসলামি যুগে অস্ত্রোপচারের উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অবদান আবুল কাসিম খালাফ বিন আব্বাস আল জাহরাবি থেকে এসেছে, যিনি আবুল কাসিম বা আল-জাহরাবি (৯৩৬-১০১৩) নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ২০০ টিরও বেশি চিকিৎসার যন্ত্র উদ্ভাবন ও বিকাশের মাধ্যমে অস্ত্রোপচারের অগ্রগতিতে অবদান অতুলনীয় রাখেন, যা অস্ত্রোপচারের প্রথম স্বাধীন কাজ হিসেবে স্বীকৃত হয়। [৪২] তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রের মধ্যে ফোরসেপ, পিনসার, স্ক্যাল্পেল, ক্যাথেটার, কাউটারি, ল্যানসেট ও স্পেকুলার মতো সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত ছিল, যাদের সাথে প্রতিটি যন্ত্রের বিস্তারিত অঙ্কনও যুক্ত ছিল। [৪০] আল-জাহরাবি আত-তাশরীফ লিমান' আজাজাত তালিফ, বা আত-তাশরীফ (পদ্ধতি) নামে একটি গ্রন্থও লেখেন, যা পূর্ববর্তী কাজগুলির ( যেমন: ৭ম শতাব্দীতে লিখিত বাইযেন্টাইনীয় এজিনার চিকিৎসক পলের এপিটোমা) উপর ভিত্তি করে একটি ৩০-খণ্ডবিশিষ্ট পাঠ্য ছিল এবং এ বইটি মূলত চিকিৎসা পর্যবেক্ষণের নিয়মের সমন্বয়ে গঠিত এবং এই গ্রন্থটি হিমোফিলিয়ার প্রাচীনতম বর্ণনা হিসেবে বিবেচিত হয়। [৪২] ৩০-ভলিউমের বিশ্বকোষটি অসুস্থ বা পীড়িতদের চিকিৎসা নিয়ে আল জাহরাবি ও তার সহকর্মীদের অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করেছে। বইটিতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রের নির্দেশনা ছাড়াও সেই কাজের পরিচালনা করার কৌশল, হৃদযন্ত্রের সুরক্ষার জন্যে ট্যাব্লেট ও ওষুধ প্রস্তুত করার চিকিৎসাবিদ্যা-নির্দেশিত পদ্ধতি, প্রসুতিতন্ত্রে ব্যবহৃত অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি, ক্ষত নিরাময় ও মাথাব্যথার চিকিৎসাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। [৪০]
যদিও জাহরাবিকে পূর্ব খিলাফতের হাসপাতাল এবং চিকিৎসকদের দ্বারা কিছুটা অবহেলা করা হয়;[৪২] তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, তার স্পেনীয় শিকড়ের কারণে ( কর্ডোবা, স্পেনের কাছাকাছি ) তার অগ্রগতি এবং তার কাজের মধ্যে থাকা চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং পর্যবেক্ষণের দলিলপত্রাদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিকাশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তার এই কাজগুলি খ্রিস্টান ইউরোপে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখে, যখন ১২ শতকের দিক লাতিন ভাষায় তা অনুবাদ করা হয়। [৪০]
বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফত ১০ ও ১১ শতাব্দীতে চরম বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিকিৎসা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে অতিক্রম করেছিল। [৪০] অনেক দক্ষ চিকিত্সক এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আবু বকর মুহাম্মদ বিন যাকারিয়া আল রাজি ( লাতিনে রাজেস; আনু. ৮৬৫–৯২৫ খ্রি.) উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন। বাগদাদের হাসপাতালে একটি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে ইমাম আল রাযি ইরানের রায়ের একটি হাসপাতালে প্রধান চিকিত্সক হিসাবে কাজ করেছিলেন। তিনি চিকিৎসা ও দর্শনের অগ্রগতি সম্পর্কিত দুইটি উল্লেখযোগ্য কাজ তৈরি করেছিলেন: কিতাব আল-মানসুরি এবং কিতাব আল হাবী ( "বিস্তৃত বই" ) যাতে প্রাথমিক গ্রীক, সিরীয় এবং আরবি ওষুধের জরিপ করেছেন এবং সেসব ব্যাপারে তিনি নিজস্ব রায় এবং ভাষ্য যোগ করেছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি ছোটখাটো গ্রন্থও লিখেছেন এবং এসবের মাঝে সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত হল, ক্ষুদ্র পক্স ও হাম রোগ সম্পর্কিত গ্রন্থ । এই ধরনের সংক্রামক রোগের চিকিৎসা ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে এই গ্রন্থটি বেশ কয়েকটি আধুনিক ভাষার পাশাপাশি লাতিন এবং বাইজেন্টাইন গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। [৪৩]
আবু বকর আল রাজি হাসপাতালের মধ্যে চিকিৎসা শিক্ষার উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তিনিই 'ওয়ার্ড রাউন্ড' পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন, যা হাসপাতালের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শিক্ষার পদ্ধতি হিসাবে কাজ করেছিল। [৪৪] ওয়ার্ড রাউন্ডে উত্তর দেওয়ার জন্য বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ দ্বারা শিক্ষার্থীদের জন্যে মনোনীত কয়েকটি রাউন্ডের প্রশ্ন থাকে। [৪৪] প্রথম রাউন্ডে শিক্ষার্থীরা বর্তমান সমস্যাগুলির সাথে সম্পর্কিত চিকিৎসা থেকে প্রশ্নের উত্তর দিবে বলে নির্ধারণ করা হয়েছিল। [৪৪] দ্বিতীয় রাউন্ডে আরো জটিল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আরো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের মনোনীত করা হয়েছিল। [৪৪] অবশেষে, দ্বিতীয় রাউন্ডের পরেও যদি প্রশ্ন থেকে যায় তাহলে আল রাজি উত্তর প্রদান করবেন এবং সবাই তার অনুসন্ধানগুলি নথিভুক্ত করবে। [৪৪] আবু বকর আল রাজি তার সারা জীবনে ২০০ টিরও বেশি বই ও গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব পেয়েছেন। [৪৪]
যদিও মধ্যযুগের ইসলামি সময়ে অস্ত্রোপচারের উন্নয়ন এবং অগ্রগতিগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তবে চিকিৎসা জগতের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর অবদান যা ইসলামি চিকিৎসা ও হাসপাতাল থেকে এসেছে, তা এসেছে বাগদাদের আকাশে উদিত হওয়া ইবনে সিনা বা পশ্চিমা ভাষায় "আভিসেনা" থেকে।[৪০] ইবনে সিনা হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ১৮ বছর বয়সে একজন খ্যাত ডাক্তার হয়েছিলেন এবং আল-কানুন ফি আল-তিব ("চিকিৎসার নিয়ম" ) গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। [৪০] এই কাজটি মূলত সর্বকালের অন্যতম বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীয় কাজ হিসেবে পরিচিত। যে উপায়ে ইবনে সিনার আল কানুন ফিত্তিব বিভিন্ন শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতি একত্রিত করার জন্য কাজ করেছিল, তা মূলত গ্রিক লেখক ও দার্শনিকদের পুনরুজ্জীবিত করেছিল এবং ভবিষ্যতের চিকিৎসা অনুশীলনের ব্যাপক বিকাশের জন্য নতুন চিন্তার ধরণগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে, যা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি। ইবনে সিনা গ্রীক চিকিত্সক ও দার্শনিক গ্যালেনের চিকিৎসা উন্নয়নের সাথে দার্শনিক এরিস্টটলের দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়ে এটি সম্ভব করেন। [৪০] তদ্ব্যতীত ইসলামি চিকিৎসাব্যবস্থা স্বীকৃতি দিয়েছে যে, অনেক রোগ সংক্রামক; যেমন: কুষ্ঠ, গুটি বসন্ত ও যৌনবাহিত রোগ এবং ইবনে সিনা যক্ষ্মাকেও একটি সংক্রামক রোগ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা মাটি ও পানির মাধ্যমে ছড়াতে পারে। [৪৫] ১৮ শতকের মধ্যেও ইউরোপীয় চিকিৎসা পেশাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা ইবনে সিনার কানুন ফিত্তিব গ্রন্থটি অধ্যয়ন ও পাঠদান করা অব্যাহত ছিল। ব্যবহারিক বিজ্ঞান, চিন্তাধারা ও ধর্মের এই সমন্বয় ও যৌক্তিকতা ইসলামী চিকিৎসার পাণ্ডিত্যের শিখর ও চিকিৎসাবিজ্ঞান-জগতের প্রকৃত উন্নয়নের প্রকৃতিকে তুলে ধরে। [৪০]
নিজের কাজ আল কানুন ফিত্তিবের পাশাপাশি ইবনে সিনা 'মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার' একজন প্রবর্তক হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং রোগ নির্ণয়ের সময় শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট প্রতি মনোযোগ না দিয়ে, সামগ্রিকভাবে রোগীর অবস্থার উপর জোর দিয়েছিলেন। [৪৬] ইবনে সিনা যখন একজন রোগীর উপসর্গের দিকে তাকাতেন তখন রোগ নির্ণয়ের সময় রোগীর পুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত পরিবেশের দিকেও মনোযোগ দিতেন। [৪৬] ইবনে সিনার বিশ্বাস ছিল যে, শারীরস্থান চিকিৎসা বিদ্যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। [৪৬] ইবনে সিনাই প্রথম প্রসিদ্ধ চিকিত্সক ছিলেন, যিনি মূত্রাশয় সেচের উদ্দেশ্যে একটি নমনীয় মূত্রনিষ্কাশনযন্ত্র ব্যবহার করেন এবং ইবনে সিনা মানবদেহে প্রস্রাব ধরে রাখার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করেছিলেন। [৪৬] ইবনে সিনা খাদ্যনালীর ক্যান্সার, রক্তক্ষরণ ধমনীর বন্ধন, স্নায়ু ও চুলকানির শারীরস্থান, মানুষের উপাঙ্গে আঘাতের পর সৃষ্টি হওয়া বিরল রোগ কম্পার্টমেন্ট সিনড্রোম ও ধমনি মেরামত একদিন সম্ভব হবে এই ধারণার স্বীকৃতিতে যুগান্তকারী ছিলেন। [৪৬]
যখন লোকেরা ভ্রমণ করে বা তাদের বাড়ি বা মাদ্রাসা বা হাসপাতালে পড়ালেখা করে চিকিৎসাবিদ্যা শিখত, তখন লোকেরা জেনেছিল যে, মারিস্তানগুলি মানুষের শেখার জন্য সবচেয়ে সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। তাদের কাছে সর্বদা উপলব্ধ সমস্ত সংস্থান এবং শিক্ষক ছিল, যা এটিকে শিখতে এবং শেখানোর জন্য একটি খুব সুবিধাজনক জায়গা করে তুলেছিল। বিমারিস্তানগুলি যুগের পর যুগ ধরে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করেছে। [৪৭]
আধুনিক হাসপাতাল এবং আধুনিক বিজ্ঞানের উপর ইসলামি প্রভাবশালী বিষয়াদির বেশিরভাগই দশম ও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই সব হাসপাতালে কর্মরত সেই সময়ের পণ্ডিত এবং চিকিৎসকগণ কর্তৃক প্রবর্তিত আবিষ্কার, কৌশল ও তাদের অনুশীলনসমূহে পাওয়া যায়। এ সময়টি আধুনিক ঔষধি অনুশীলনের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তা এটির বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়কাল হিসাবে পরিচিত। এই আবিষ্কারগুলির মধ্যে অনেকগুলি ইউরোপে চিকিৎসা উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং সে সকল বিষয় এখনও আধুনিক ওষুধে সাধারণভাবে অনুশীলন করা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন ও ধাতুবিদ্যায় আবিষ্কৃত অনেক জিনিসই পণ্ডিতরা শুধুমাত্র ওষুধের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছিলেন; যেমন: পাতন ও বীজাণুবারক হিসাবে অ্যালকোহল ব্যবহার, যা এখনো হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ আবিষ্কারগুলি কেবল মুসলিম বিশ্বে চিকিৎসার ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী উন্নতির দিকে পরিচালিত করেনি; বরং প্রাথমিক ইসলামি ও আরবি হাসপাতাল ও তাদের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রভাবের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন নতুন ধারণা এবং তার কাঠামোর সাথে পরিচিত হয়, যা দক্ষতা ও পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি করেছে এবং তাদের অনুশীলনের প্রভাব আজও আধুনিক দিনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাওয়া যায়।
এর মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ধারণার মধ্যে রয়েছে, রোগ ও লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে পৃথক ওয়ার্ডের বাস্তবায়ন, ফার্মেসি, মেডিকেল রেকর্ডের আবাসন এবং ওষুধের অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন শিক্ষা। ইসলামি যুগের আগে বেশিরভাগ ইউরোপীয় চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্যনিবাস ও চার্চের পুরোহিতদের সাথে সংযুক্ত করা হত। ইসলামি হাসপাতালগুলি শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষভাবে ও একটি সরকারী সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিপ্লব আনে। [৪৮] সরকার চালিত এ ধরণের হাসপাতালের প্রবর্তনের ফলে যেকোন কারণে কারো প্রতি কোনো বৈষম্য না করে হাসপাতালগুলিকে শুধুমাত্র তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে সমস্ত লোকের সেবা করা এবং সবাইকে সাহায্য করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার প্রতি মনোনিবেশ করতে দেয়।
বিমারিস্তান হল প্রথম পরিচিত হাসপাতালগুলির মধ্যে একটি, যা শুধুমাত্র চিকিৎসার স্বার্থেই নির্মিত হয়েছিল এবং সত্যিকার অর্থে তাদের আশেপাশের লোকেদের জন্য একটি মহান উদ্দেশ্য পরিবেশন করেছিল। তারা রোগীদের সেবাযত্নের জন্য প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হয়ে ওঠে; ছাত্রদের জন্য চিকিৎসা শিক্ষার একটি প্রধান উৎস হয় এবং বিমারিস্তানের মধ্যে কাজ করা সমস্ত ডাক্তার এবং চিকিৎসাকর্মীদের জন্যে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে। [৪] তারা নথিভুক্ত করেছিল যে, কীভাবে কেন্দ্রগুলি চলেছিল; কীভাবে চিকিৎসা রেকর্ডগুলি সুরক্ষিত রাখা হয়েছিল; কীভাবে ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীরা সঠিকভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং কিভাবে হাসপাতালের রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল, যাতে তারা রোগীদের পরিষেবা চালিয়ে যেতে পারে। পরবর্তী কালে হাসপাতালগুলিতে তাদের মূলভিত্তি হিসেবে বিমারিস্তানের আদর্শকে প্রয়োগ করা হয়েছিল। যার ফলে দেখা যায় যে, সে সব হাসপাতাল সুচারুরূপে পরিচালিত একটি কেন্দ্র ছিল, যা এসবের আশেপাশের এলাকার মানুষের জন্যে একটি মহান উদ্দেশ্য পরিবেশন করেছিল। বিমারিস্তানের প্রাথমিক চিকিৎসা অনুশীলনের ইতিহাস ছাড়া বর্তমান পশ্চিমা হাসপাতালগুলি আজকের মতো নাও হতে পারত। [৪]
ইসলামি হাসপাতালসমূহ হাসপাতালের পৃথক ওয়ার্ড ব্যবস্থা বা বিভাগগুলির ধারণা নিয়ে আসে, যা রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী পৃথক করা হয়েছিল। এছাড়া ইসলামি হাসপাতালগুলি যখন প্রথম এই ধারণাটি নিয়ে আসে, তখন কেবলমাত্র ওয়ার্ডগুলিকে রোগের লক্ষণ দ্বারাই আলাদা করা হয়নি; বরং যৌনতার মাধ্যমেও আলাদা আলাদা ওয়ার্ড নির্ধারণ করা হয়। [৪৯] যদিও বর্তমানে হাসপাতালগুলি ততটা কঠোর হয় না এবং যৌনতার দ্বারা আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয় না, তবুও তারা রোগ বা সমস্যা অনুযায়ী মানুষকে আলাদা করে ভিন্ন ভিন্ন ওয়ার্ডে রাখে। এটি করার মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের রোগীর জন্য নির্দিষ্ট কিছু চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া অধিকতর সহজ হতে পারে। এই অভ্যাসটি কেবলমাত্র আধুনিক হাসপাতালে আজ বিদ্যমান নয়; বরং এটি সেই সময়ে চিকিৎসার অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়, যা বর্তমান "কানুন ফিততিব" গ্রন্থে পাওয়া যায়। রোগের এই পৃথকীকরণ শুধুমাত্র রোগীদের সময় মত চিকিৎসায় সাহায্য করেনি; বরং রোগী এবং চিকিৎসক উভয়কেই তাদের আশেপাশের অন্য সংক্রামক রোগে অসুস্থ হতে বিরত রাখে। এছাড়াও রোগীদের আলাদা করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রোগী ও চিকিৎসার বিশেষীকরণ সত্যিই ওষুধকে উন্নত করেছে এবং হাসপাতালগুলির কার্যকারিতা উন্নত করেছে, যা শেষ পর্যন্ত আধুনিক ও উন্নত হাসপাতাল ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করেছে।
ইসলামি হাসপাতালসমূহ ওষুধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতির সাথে সাথে নিজেদের সমস্ত অনুসন্ধানগুলি তালিকাভুক্ত করার জন্য একটি একটি নতুন উপায়ের মুখাপেক্ষী হয়, যা শেষ পর্যন্ত তাদের প্রথম বারের মতো চিকিৎসা রেকর্ড সংরক্ষণের দিকে নিয়ে যায়। এটি হাসপাতালগুলিকে আরও দক্ষ করে তুলেছিল। কারণ তারা অন্যান্য রোগীদের জন্যে একই ধরনের উপসর্গযুক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করার রেকর্ড সংরক্ষণ করে তা পরীক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এতে নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিটির চিকিৎসা অতি সহজ হয়ে গিয়েছিল। কারণ রেকর্ডকৃত ব্যক্তিকে তারা যেভাবে চিকিৎসা করেছিল ঠিক সেভাবে একই রোগে আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসকরা কেবল চিকিৎসা রেকর্ডই রাখেননি; বরং তারা সকল রোগীর উপর নোট তৈরি করে তাও সংরক্ষণ করতেন। [৫০] এই তথ্যটি চিকিৎসকদের রোগীর মধ্যে নিদর্শন লক্ষ্য করতে আরো সক্ষম করে তোলে, যা ওষুধের অনুশীলনগুলিকে আরও নির্ভুল করে তোলে; কারণ এতে রোগীর সবকিছু অধিক স্পষ্টভাবে চিকিৎসকের সামনে উপস্থিত হয়। এসব রেকর্ড রাখা থেকে অর্জিত দক্ষতা হাসপাতালগুলিকে আরও মসৃণভাবে চলতে এবং রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা করতে সাহায্য করে। এই রেকর্ড রাখা শেষ পর্যন্ত " কানুন ফিততিব"- এর মত গ্রন্থ রচনার দিকে পরিচালিত করে, যা পারসিক দার্শনিক ইবনে সিনা (অ্যাভিসেনা) দ্বারা সংকলিত একটি ওষুধের বই, যা ১০২৫ সালে সম্পন্ন হয়েছিল।
ইসলামি চিকিৎসার অপর একটি প্রভাব, যা চিকিৎসা পদ্ধতির বিকাশের পথকে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন করে, তা হল শিক্ষার পদ্ধতি এবং চিকিৎসা জ্ঞানের স্থায়ীত্ব। ইসলামি হাসপাতালগুলি চিকিৎসকদের যোগ্যতা এবং শিক্ষার আধুনিকায়ন করেছে, যার ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা অনুশীলনের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ৯৩১ সালে খলিফা আল-মুক্তাদির সিনান ইবনে সাবিতকে শুধুমাত্র যোগ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসা লাইসেন্স দেওয়ার কথা বলে লাইসেন্স প্রদানকারী চিকিৎসক নিয়োগের আন্দোলন শুরু করেন। সিনান ইবনে সাবিত খলিফা আল-মুক্তাদির কর্তৃক এই আদেশ প্রাপ্তির কারণ হলো যে, পূর্বে একজন চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার কারণে বাগদাদে একজন রোগী মারা গিয়েছিলেন। [৪] সিনান ইবনে সাবিতকে সেই সময়ে ৮৬০ জন অনুশীলনকারী চিকিৎসকের প্রত্যেককে পরীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে ১৬০ জন ব্যর্থ হয়েছিল এবং এটি চিকিৎসা জগতে একটি নতুন নজির স্থাপন করেছিল। [৪]
সে মুহূর্ত থেকে চিকিৎসকদের ওষুধ অনুশীলন করতে সক্ষম হওয়ার আগে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। [৪] লাইসেন্স পরীক্ষা যথাযথভাবে কার্যকর করার প্রয়াসে "মুহতাসিব" পদবী প্রতিষ্ঠিত হয়। [৪] মুহতাসিব ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি নতুন তরুণ চিকিৎসকের মৌখিক ও ব্যবহারিক লাইসেন্স পরীক্ষা পরিচালনা করতেন। [৪] যদি তরুণ চিকিৎসক পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তার পেশাদার দক্ষতা প্রমাণ করতে সফল হন, তাহলে মুহতাসিব হিপোক্রেটিক শপথ এবং চিকিৎসককে আইনত ওষুধ অনুশীলন করার অনুমতি দেওয়ার লাইসেন্স প্রদান করেন। [৪] নতুন চিকিৎসক বা ছাত্রদের প্রশিক্ষণ যে ভাবে ইসলামি হাসপাতালের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঠিক সে লক্ষ্যে সিনিয়র চিকিৎসক ও অন্যান্য চিকিৎসা অফিসাররা প্রায় ক্লাসে পান্ডুলিপি থেকে রোগ, নিরাময়, চিকিৎসা ও এর কৌশলগুলির বিবরণ দিয়ে বড় বড় বক্তৃতা কক্ষে শিক্ষণীয় সেমিনার করতেন।
ইসলামি হাসপাতালগুলি এ ক্ষেত্রেও প্রথম ছিল, যারা মেডিকেল ছাত্রদের অনুশীলন অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে রোগীর যত্নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ওয়ার্ডে গ্রহণ করতেন । [৩২] হাসপাতালগুলিকে স্কুল হিসাবে দ্বিগুণ করা শুধুমাত্র হাসপাতালগুলিকে আরও নতুন কাজের অংশীদার হতে দেয় না; বরং তা ওষুধের অগ্রগতিতেও সাহায্য করে। ইসলামী যুগের হাসপাতালগুলির শিক্ষা আধুনিক হাসপাতালগুলিকে আধুনিকীকরণ করেছে; যার ফলে কেউ এখন চিকিৎসক হওয়ার আগে তাকে অবশ্যই হাসপাতালে একটি আবাসিক সময় কাল পূর্ণ অতিবাহিত করতে হয়। তাই বর্তমান শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট হাসপাতালে অধ্যয়ন করতে থাকে এবং সেখান থেকে সম্পূর্ণভাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হওয়ার আগে কয়েক বছর ধরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অধীনে রোগী দেখার অনুশীলন করে। [৩২] এটি এমন একটি সময়ে এসেছিল, যখন ইউরোপে অধিকাংশ চিকিৎসা পদ্ধতি তুলনামূলক কম উন্নত ছিল এবং অ্যাভিসেনার (ইবনে সিনা ) চিকিৎসা পাঠ্যপুস্তক "ক্যানন অফ মেডিসিন" (কানুন ফিত তিব ) সংকলনের সাথে এই যুগান্তকারী ইসলামী আবিষ্কারগুলি ইউরোপকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয় এবং আগত শতাব্দীতে বাকি বিশ্বের জন্যে একটি আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থা রেখে যায়।
ইসলামি স্বর্ণযুগে গ্রীক চিকিৎসা গ্রন্থগুলিকে আরবীতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে একটি অনুবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এ ক্ষেত্রটিকে প্রভাবিত করে এমন কিছু বই ছিল ওষুধের মিশ্রণ সম্পর্কিত; যেমন: তারকিব আল-আদবিয়া, আল আদবিয়া আল মুফরাদিয়া, যা একক ঔষুধ সম্পর্কে লেখা হয়েছিল এবং "কুওওয়াহ আল - আগজিয়াহ" নামে একটি গ্রন্থ শুধুমাত্র ঔষুধি খাদ্যের ক্ষমতা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল। আল-আদবিয়া ওয়াল দাওয়া এবং আল-ওরাম গ্রন্থদ্বয় শরীরের ফুলে যাওয়া সম্পর্কে এবং আল তিরয়াক বা দ্য বুক অফ থেরিয়াক বইটিও ঔষুধ সম্পর্কে লেখা হয়েছিল । [৫১] এসব গ্রন্থ পড়ার মাধ্যমে ইসলামি ডাক্তারগণ এমন ওষুধ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছিল, যা তারা রোগীদের চিকিত্সার কাজে ব্যবহার করতে পারে। [৫২]
ওষধ বিজ্ঞানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদানকারীদের মধ্যে একজন হলেন গ্যালেন, যিনি রোমান সাম্রাজ্যের একজন চিকিৎসক ছিলেন এবং 'ওষুধের ক্রিয়া' তত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন। গ্যালেনের এই তত্ত্বগুলি পরে আরবি পণ্ডিতদের দ্বারা লিপিবদ্ধ, সরলীকৃত ও অনুবাদ করা হয়েছিল; বিশেষ করে হুনাইন ইবনে ইসহাক দ্বারা এবং গ্রীক থেকে আরবীতে অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তার কারণে ওষুধের নামকরণের বিষয়ে প্রচুর দলিল-পত্র পাওয়া যায়। আবুল কাসিম ও মুসা বিন মৈমুনের মত লেখকরা এই দিকটির উপর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন এবং ভাষাতত্ত্বসহ ওষুধসমূহের নামকরণের পাশাপাশি ওষুধের নামের পিছনে প্রতিশব্দ এবং তার ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। [৫২] ইবনে সিনা ওষুধের নামকরণ ও শ্রেণীকরণেও অবদান রেখেছেন। নিজের কানন অব মেডিসিনে তিনি বীজবারক ওষুধ এবং মাদকদ্রব্যের মতো ওষুধের ধরন ব্যাখ্যা করেছেন এবং এসবের তিনি পাশাপাশি ট্যাবলেট, পাউডার ও সিরাপের মত জিনিসেরও ব্যাখ্যা করেছেন। [৫১]
এভাবে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত ঔষধি জ্ঞান ও তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পরে আরবি চিকিৎসরা নিজেদের অবস্থার উপর নির্ভর করে রোগী এবং অসুস্থদের জন্য ওষুধের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অসংখ্য অবদান রেখেছিলেন। বিখ্যাত আরব পণ্ডিত ও চিকিৎসক আল কিন্দি সহ একাধিক পণ্ডিত ওষধি মাত্রার জ্যামিতিক অগ্রগতি নির্ধারণ করেছেন। ডোজ বা মাত্রা বাড়ানোর সাথে তারা ওষুধ সংবেদনে একটি গাণিতিক মাত্রা বৃদ্ধিরও উপায় খুঁজে পেয়েছেন। [৫২]
ঔষধ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অধ্যয়নের কিছু প্রধান ক্ষেত্র বিষ বিজ্ঞান, যন্ত্রণাহর ও বেদনানাশক ওষুধের সাথে সম্পর্কিত। অনেক আরবি চিকিৎসক বিষবিদ্যার প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। কীভাবে সেগুলি তৈরি করা যায় এবং তাদের প্রতিকার করা যায় সে সম্পর্কে তারা জ্ঞানের সন্ধান করেছিল। একইভাবে প্রশমক এবং ব্যথানাশক ওষুধের বিজ্ঞানও আরবি চিকিৎসকদের মুগ্ধ করে। ক্যানাবিস স্যাটিভা ( হাশিশ ), হায়োসায়ামাস নাইজার (মাদক) ও পাপাভার সোমনিফেরামের (আফিম) মতো পদার্থগুলি সম্পর্কে তখন ভালোভাবে অধ্যয়ন করা হয়েছিল এবং তাদের ওষুধে ব্যবহার করা হয়েছিল। [৫১]
|pmid=
এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)।
|hdl-সংগ্রহ=
এর |hdl=
প্রয়োজন (সাহায্য)