বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিক বা নৈতিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি বা নির্দিষ্ট বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে যে সমস্ত মতবাদ রয়েছে তাদের একত্রে বিবাহের সমালোচনামূলক মতবাদ বলে গণ্য করা যায়। বিবাহের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বিভিন্ন যৌন অভিমুখীতার মধ্যে সমতা ইত্যাদি বিষয়ে কতটুকু প্রভাব পড়তে পারে; বিবাহ এবং সহিংসতার মধ্যে সম্পর্ক; বিবাহ অন্যান্য দার্শনিক প্রশ্নের উপর কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কাজের জন্য বিবাহের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ কতটা হতে পারে, একজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ অন্যের উপর কতটা হতে পারে ইত্যাদি এই সমস্ত মতবাদের আলোচ্য বিষয়। এছাড়া বিবাহবিচ্ছেদের হারের সঙ্গে অর্থনৈতিক ঝুঁকির সম্পর্ক, এবং প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা ও সরকার বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা এর অনুমোদনের মূল্যায়ন করাও বিবাহের সমালোচনার উদ্দেশ্য।[১][২]
৩৮০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার নিজের রিপাবলিক (প্লেটো'স রিপাবলিক) এ বিয়ের সমালোচনা করেন, তিনি এ সম্বন্ধে বলেন যে, বিয়ে হচ্ছে প্রকৃতি এবং মানুষের শত্রু যা ধ্বংস করে মানুষকে।[১]
উনিশ শতকে শিল্পযুগে বেশ কিছু নারী যেমন সারাহ ফিল্ডিং, ম্যারি হায়েস, এবং ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট বিয়ের তীব্র সমালোচনা করেন এটাকে এক প্রকারের পতিতাবৃত্তি বলে, তারা বলেন বিয়ে নারীদের সত্ত্বা নষ্ট করে, বিয়ের মাধ্যমে একজন নারী একজন পুরুষের ভোগ্যবস্তু হয়ে যায়।[৩] নওমী গার্সটেল এবং নাটালিয়া সারকিসিয়ান লিখেন যে বিয়ে একটি নারীকে (বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকেও) ব্যাপক লজ্জায় ফেলে দেয় যে স্বামী বা স্ত্রীর সামনে উলঙ্গ হওয়া লাগবে যার সাথে তার আগে বন্ধুত্ব ছিলোনা।[২] লেখক ড্যান মলার তার 'ব্যাচেলর্স আর্গুমেন্ট' বইতে বিয়েকে একটি মানব সভ্যতার জন্য 'বড় একটি সমস্যা' বলে দাবী করেন, তিনি বলেন যে, যদিও বিয়ে সন্তান লালন-পালনে একটি ভূমিকা রাখে কিন্তু ঐ ভূমিকা শুধুই একটি ভূমিকা, মানব জাতির বিকাশে একটি পরিবার-প্রথা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে আর বিয়েই এর জন্য দায়ী।[৪]
যে কোনো ধর্মবাদী বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ তো বিধি-বিধানের খড়গের মধ্যে পড়ে যায়ই, নারীরাও পড়ে যায়, বরঞ্চ নারীরা আরো বেশি পড়ে। যেমন খ্রিস্টান ধর্মের আইন অনুযায়ী একজন নারীকে তার স্বামীর সব কথা শুনতে হবে[৫] এবং মুসলমানদের কোরানে আছে (৪ঃ৩৪), 'পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের ওপর বিশিষ্টতা দান করেছেন আর এটি এজন্যে যে নারী পুরুষের ধন-সম্পদ হতে ব্যয় করে'। তাছাড়া এ ধর্মে নারীদের সবসময় বোরকা পরে এবং স্বামীর অনুমতি নিয়ে বাইরে বেরোতে হয়।[৬]
ডেনমার্কের দার্শনিক সরেন কিয়ের্কেগার্ড (১৮১৩-১৮৫৫) বিয়েকে যৌনতার ক্ষেত্রে এক প্রকারের দেয়াল বলেন। তিনি বলেন বিয়ে নারী-পুরুষের যৌনতাকে একটি শক্ত দেয়াল দ্বারা ঢেকে দেয়। তিনি প্রেম করে বিয়ে করাকে ধনাত্মক বলেন আর অভিভাবকদের দ্বারা অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বিয়ে করাটাকে ঋণাত্মক এবং ক্ষতিকর বলেন নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যেই। অস্ট্রিয়ার দার্শনিক ফ্র্যাঞ্জ কাফকাও একই ধরনের কথা বলে বলেন, 'বিয়ে মানুষের যৌন বিকাশ রুদ্ধ করে দেয় এবং সমাজে অনেক অহংকার এবং হিংসার সৃষ্টি করে।'[৭]
ফরাসী দার্শনিক জ্যা পল সার্ত্রে তার প্রেমিকা সিমোন দ্যা বোভোয়ারকে কোনোদিনও বিয়ে করেননি। ব্রায়ান সয়ার বলেন, 'বিয়ে করার মাধ্যমে মানুষের জৈব সত্ত্বা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় পরাধীনতার কারণে।[৮]
ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল বিয়ের বিরোধিতা না করলেও ধর্মবাদী বিয়ের সমালোচনা করেছিলেন এবং প্রেম করে বিয়ে করার ওপর বেশি জোর দিতেন।[৯]