বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট

বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট
ব্যবস্থাপকক্যারি প্যাকার
খেলার ধরনবিভিন্ন
প্রথম টুর্নামেন্ট১৯৭৭
শেষ টুর্নামেন্ট১৯৭৯ বিশ্ব সিরিজ কাপ
দলের সংখ্যাডব্লিউএসসি অস্ট্রেলিয়া একাদশ
ডব্লিউএসসি বিশ্ব একাদশ
ডব্লিউএসসি ওয়েস্ট ইন্ডিজ একাদশ
সর্বাধিক উইকেটডেনিস লিলি
প্রথম ডব্লিউএসসি খেলা নিয়ে এবিসির সংবাদ প্রতিবেদন।

বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট (ডব্লিউএসসি) ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশ খ্যাতনামা ক্রিকেটারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ভিন্ন ধাঁচের পেশাদার ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ছিল। অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন নাইন নেটওয়ার্কসের মালিক ও ধনকুবের কেরি প্যাকারের ব্যবস্থাপনায় এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। খেলাগুলো আয়োজনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিরোধিতা করা হয়েছিল। বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট ক্ষিপ্রতার সাথে আয়োজনের ফলে ক্রিকেটের ধরন পরিবর্তনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। অদ্যাবধি এর প্রভাব ক্রিকেট অঙ্গনে রয়ে গেছে।

ডব্লিউএসসি প্রবর্তনে দুইটি প্রধান উপাদান কাজ করেছে। খেলোয়াড়দের ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণে জীবন ধারণের উপযোগী পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা না পাবার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া; এবং ঐ সময়ে অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কমিশনে (এবিসি) অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সম্প্রচারসত্ত্বকে ব্যাপকভাবে কেরি প্যাকারের ইচ্ছার মাধ্যমে পরিচালনার নিশ্চয়তা আনয়ণ।

অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) ১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টেস্ট খেলাগুলোর টেলিভিশন সম্প্রচারে চ্যানেল নাইনের দরপত্র প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, কেরি প্যাকার অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়দের সাথে গোপনে চুক্তিতে আবদ্ধ হন ও নিজস্ব সিরিজ আয়োজনে অগ্রসর হন।

খেলোয়াড়দের মধ্যে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক টনি গ্রেগ, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড, অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক গ্রেগ চ্যাপেল, পাকিস্তানের ভবিষ্যতের অধিনায়ক ইমরান খান ও সাবেক অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেল অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্যাকার তাঁকে সহযোগিতার জন্যে জন কর্নেল ও অস্টিন রবার্টসন নামীয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদেরকে নিযুক্ত করেন। তাঁরা সিরিজ আয়োজনের শুরুরদিক সামাল দেন ও প্রশাসনিক কাজে অংশ নেন।

কেরি প্যাকার ও অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন শিল্প

[সম্পাদনা]

১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রেলীয় টেলিভিশন শিল্প আড়াআড়ি পথে চলছিল। ১৯৫৬ সালে এ শিল্পের প্রবর্তনের পর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় বাণিজ্যিকমূখী টেলিভিশন অনুষ্ঠান আমদানী নির্ভর ছিল। অনুষ্ঠানগুলো মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানী করা হতো। অনুষ্ঠানগুলো আমদানীতে অস্ট্রেলীয় নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অধিকতর সস্তা ছিল। ১৯৭০ সালে টিভি: মেক ইট অস্ট্রেলিয়ান শীর্ষক প্রচারণা করা হয়েছিল। এ প্রচারণার ফলে ১৯৭৩ সালে পদ্ধতিতে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল।[] ১৯৭৫ সালে রঙ্গিন আকারে সম্প্রচারের ফলে টেলিভিশনে খেলাধুলা প্রদর্শনে দর্শকদের সংখ্যা বেশ বৃদ্ধি পায় ও অস্ট্রেলীয় খেলাধুলা স্থানীয়ভাবে গণনার মধ্যে চলে আসে। তবে, ক্রীড়া প্রশাসকেরা সরাসরি খেলা সম্প্রচারের ব্যবস্থা করলেও মাঠে এর প্রভাব ফেলে। ক্রীড়া, সম্প্রচারস্বত্ত্ব ও টেলিভিশনের আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি অস্ট্রেলীয় ক্রীড়া প্রশাসকদের নজর কাড়েনি।

১৯৭৪ সালে কেরি প্যাকারের পিতা স্যার ফ্রাঙ্কের মৃত্যুর পর তিনি চ্যানেল নাইনের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। এটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান কনসোলিডেটেড প্রেস হোল্ডিংসের (সিপিএইচ) অন্যতম প্রচারমাধ্যম ছিল।[] নাইনের রেটিং বৃদ্ধিকল্পে কেরি প্যাকার এ নেটওয়ার্ককে ক্রীড়ানুষ্ঠানসহ আগ্রাসীমূলক কৌশল গ্রহণের দিকে ধাবিত হন। প্রথমেই তিনি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন গল্ফ প্রতিযোগিতার সম্প্রচারসত্ত্ব নিশ্চিত করেন। অস্ট্রেলিয়ান গল্ফ ক্লাবের উজ্জ্বীবনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেন যাতে সিডনিতে স্থায়ীভাবে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জ্যাক নিকলাসকে ভাড়াটে হিসেবে নিযুক্ত করেন ও প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নিতেন।[] কেরি প্যাকার ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে মাঝামাঝি সময়ে এর জনপ্রিয়তায় তিনিও জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালে প্রায় শেষ হতে যাওয়া চুক্তির আলোকে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত টেস্ট খেলাগুলোর সম্প্রচারসত্ত্ব লাভের বিষয়ে সোচ্চার হন। তিনি এসিবিকে তিন বছরের জন্যে A$১.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলারের বিনিময়ে চুক্তির প্রস্তাবনা দেন। এ চুক্তিটি পূর্ববর্তী চুক্তির আটগুণ বেশি ছিল। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।[] রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এবিসিরি দিকে এসিবি ঝুঁকেছিল। এবিসি বিশ বছর ধরে খেলাটি সম্প্রচার করে আসছিল। বাণিজ্যিকমূখী নেটওয়ার্কগুলো খেলাটির প্রতি খুব কমই আগ্রহ প্রকাশ করতো। প্যাকার মনে করতেন, এ সিদ্ধান্তের পিছনে প্রাচীনধর্মী নেটওয়ার্কের উপাদান নিহিত ছিল।[] তাঁর প্রস্তাবনা ঝুঁলে থাকায় তিনি বেশ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত এবিসি বাণিজ্যিকমূখী নেটওয়ার্কের দরপত্রের তোয়াক্কা না করে মাত্র $২১০০০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে তিন বছর মেয়াদের আরেকটি চুক্তি লাভ করে। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে ইংরেজ দলের অস্ট্রেলিয়া গমনে এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অবস্থায় চ্যানেল নাইনে কয়েকটি ক্রিকেট খেলা সম্প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে কেরি প্যাকার টেস্ট এন্ড কাউন্টি ক্রিকেট বোর্ডকে (টিসিসিবি) ১৯৭৭ সালের অস্ট্রেলিয়া দলের ইংল্যান্ড গমনের খেলা প্রচার লাভের অনুরোধ জানান। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ী জন কর্নেলঅস্টিন রবার্টসন তাঁর আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তোলেন। তাঁরা টেলিভিশনে প্রদর্শনী খেলা প্রচারের প্রস্তাবনা দেন।[] রবার্টসন ডেনিস লিলি’র ন্যায় শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারের সম্মতি নেন।

প্যাকার এ প্রস্তাবনাটি লুফে নেন। এরপর তিনি অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়দেরকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ আয়োজনের রূপরেখা তৈরি করেন। ক্রিকেট প্রশাসকদের প্রতি তাঁর অবিশ্বাসী মনোভাব আরও বৃদ্ধি পায় যখন এসিবি টিসিসিবিকে তাদের সম্প্রচারসত্ত্বকে প্যাকারের $২১০০০০ তুলনায় মাত্র ১৪% বেশি দরে তুলে দেয়।[] প্রথমবারের মতো খেলার আনুষ্ঠানিকতা প্যাকারের পন্থা অনুসরণে পরিচালিত হয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর প্রস্তাবনাকে দ্বিগুণ করে চুক্তিলাভ করেন।[] তবে, দরপত্র জয়ে সম্পৃক্ততায় চক্রান্তের কথা তিনি কখনো ভুলে যাননি।

গোপন চুক্তি

[সম্পাদনা]

কেরি প্যাকারের পরিকল্পনামাফিক প্রস্তাবিত প্রদর্শনী সিরিজ আয়োজন দুঃসাহসীকতাপূর্ণ ছিল। ১৯৭৭ সালের শুরুতে তিনি অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের তালিকা ধরে চুক্তি করতে অগ্রসর হন। এতে সদ্য অবসর নেয়া অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইংরেজ অধিনায়ক টনি গ্রেগের সাথে চুক্তি করে বিশাল সফলতা পান। এছাড়াও, বিশ্বের অনেক খেলোয়াড়ের সাথেও চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।[] ঐ মৌসুমের মার্চ, ১৯৭৭ সালে শতবার্ষিকী টেস্ট খেলায় অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড দল মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় দুই ডজন খেলোয়াড় প্যাকারের প্রকল্পের সাথে যুক্ত হবার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তবে, কোন মাঠে খেলা হবে, প্রশাসনিক কার্যাবলী নেই ও সকলেই ক্রিকেট বিশ্বের কাছে বিষয়টি গোপন রাখেন। এর মাধ্যমে খেলোয়াড়দের আনুষ্ঠানিক ক্রিকেট খেলার প্রতি তাদের অসন্তুষ্টির কথাই তুলে ধরে। তখনও এ অস্পষ্ট ধারণায় আচ্ছন্ন ছিল ও সবকিছুই গোপন থাকা সত্ত্বেও তারা চুক্তিবদ্ধ হয়।[]

ঐ সময়ে মে, ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া দল ইংল্যান্ড সফররত ছিল। দলের সতেরো সদস্যের মধ্যে তেরোজন খেলোয়াড় প্যাকারের সাথে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। ডব্লিউএসসির পরিকল্পনা কোনক্রমে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। এ সম্পর্ক ৯ মে তারিখে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে রক্ষণশীল ক্রিকেট বিশ্ব সমালোচনায় মুখরিত হয়। প্রত্যাশিতভাবেই ইংরেজ সমালোচকেরা দ্রুততার সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ও বিদ্রুপাত্মকভাবে বিষয়টিকে ‘প্যাকারের সার্কাস’ নামে অভিহিত করে। ইংরেজ ক্রিকেট অধিনায়ক টনি গ্রেগের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া থেকে সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলতে তৎপর হয়। তবে, তখনও টনি গ্রেগ দলে তাঁর অবস্থানে ছিলেন। তবে, তাঁকে অধিনায়কত্ব করা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় ও মাত্র কয়েক সপ্তাহ পূর্বে তাঁর আমন্ত্রণে চুক্তিবদ্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটারদেরকে একঘরে করে রাখা হয়।

বিষয়টি পরিষ্কারই ছিল যে, প্যাকারের সাথে জড়িত খেলোয়াড়দেরকে টেস্ট ও প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়েরা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্যাকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের বিষয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা তুলে ধরে।[১০] এ ঘটনায় খেলোয়াড়দের মনোবল হ্রাস পায় ও দূর্বল ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শিত হয়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ৩-০ ব্যবধানে পরাভূত হয় এবং দুই বছর পূর্বেকার অ্যাশেজ সিরিজ খোঁয়ায়। বিতর্কিত অবস্থায় সিডনি গ্যাজেটে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড এক সাক্ষাৎকারে ক্যারিবীয় দল ত্যাগ করে প্যাকারের দলে যোগদানের কথা তুলে ধরেন। লয়েড মন্তব্য করেন যে, এটি ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করা সম্ভবপর। ঐ সাক্ষাৎকারের ফলে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জসহ ক্রিকেট বিশ্বে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঢেউ তুলে। এর মাধ্যমে সবাই উপলদ্ধি করেন যে, খেলাটি একজনের ইচ্ছায় জীবন্তরূপ ধারণ করছে।

আদালতে মামলা

[সম্পাদনা]

অধিকাংশের কাছে অপরিচিত কেরি প্যাকার ১৯৭৭ সালের মে মাসের শেষদিকে লন্ডনে গমন করেন।[১১] ডেভিড ফ্রস্টের পরিচালনায় দ্য ফ্রস্ট প্রোগ্রামে অংশ নেন। তাঁর ধারণার বিষয়ে ধারাভাষ্যকার জিম লেকাররবিন মারলারের সাথে বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। মারলারের ভূমিকা ছিল বেশ আক্রমণাত্মক। প্যাকারের তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে রসাত্মক ও আত্মবিশ্বাসী ভূমিকায় স্পষ্ট জবাবে তিনি বেশ রুষ্ট হন।[১২] এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেরি প্যাকারের পরিচিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলে এবং তাঁর চিন্তাধারাকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। এ সফরে তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খেলা আয়োজকদের সাথে সাক্ষাৎ করা ও কিছু সমঝোতা আনয়ণে অগ্রসর হওয়া। তিনি ধূর্ততার সাথে রিচি বেনোকে উপদেষ্টা মনোনয়নে নিশ্চিন্ত হন। রিচি বেনো খেলায় তাঁর অবস্থান তুলে ধরেন ও তাঁর সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণের ফলে কেরি প্যাকারকে খেলার রাজনীতিতে শক্ত ভূমিকা রাখে।

ক্রিকেট বিশ্বের প্রধান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্স (আইসিসি) বিতর্কে নিজেদেরকে জড়ায়। শুরুতে তারা এ সমস্যাটিকে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া সমস্যারূপে ধারণা করেছিল। তারা প্যাকার, বেনো ও তাঁদের দুই সহযোগীকে ২৩ জুন লর্ডসে আমন্ত্রণ জানায় ও ডব্লিউএসসির পরিকল্পনার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে।[১৩] নব্বুই মিনিটব্যাপী সভায় উভয় পক্ষই সমঝোতার দিকে অগ্রসর হয়। এ পর্যায়ে কেরি প্যাকার আইসিসিকে ১৯৭৮-৭৯ মৌসুম শেষে অস্ট্রেলীয় টেলিভিশনের ব্যাপক সম্প্রচারসত্ত্ব প্রদানের দাবী উত্থাপন করেন। তবে, আইসিসি এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে না[১৪] ও প্যাকার অগ্নিশর্মা হয়ে সভা থেকে চলে আসেন। এরপর তিনি অলিখিত যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে নিম্নবর্ণিত বক্তব্য তুলে ধরেন:[১৫]

যদি আমি টিভি স্বত্ত্ব পাই তাহলে আমি এ ঘটনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেব এবং বোর্ডের হাতে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যেতে দেব। আমি কাউকে কোন সাহায্যের জন্যে কোন পদক্ষেপ নেব না। বিষয়টি প্রত্যেকের জন্যে ও প্রেতাত্মাই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

শুরুরদিকে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতিকে যেভাবে নেয়া হয়েছিল এ বক্তব্যের পর কেউ তাঁর বক্তব্যকে স্বাগতঃ জানায়নি। চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়েরা তাঁর পরিকল্পনাকে বাণিজ্যিকমূখীর চেয়ে মানবহিতৈষীতার দিকে ভেবেছিল। এরফলে তাঁর সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়েরা সতর্ক হয়ে যায়।[১৬] প্যাকারের পরিকল্পনাকে মোকাবেলা করার জন্য এক মাস পর আইসিসি তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। প্যাকারের খেলাগুলোকে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের মর্যাদা দেয়া হবে না ও অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দেরকে ভবিষ্যতে টেস্ট ও প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।

বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় চুক্তি থেকে চলে আসার কথা ভাবছিলেন।[১৭] জেফ থমসনআলভিন কালীচরণ তাঁদের চুক্তি ছিন্ন করেন। এক বেতার সংস্থার সাথে তাঁরা চুক্তিবদ্ধ ছিল ও তাঁদেরকে কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে খেলার প্রয়োজন পড়ে।[১৮] কেরি প্যাকার তাঁদের সহায়তাকল্পে দ্রুত সাড়া দেন। খেলোয়াড়দের সাথে সভা করেন ও চুক্তিভঙ্গকারী খেলোয়াড়দেরকে তৃতীয় পক্ষের সাথে অংশগ্রহণের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞাসহ আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে টিসিসিবির বক্তব্য খণ্ডনে টনি গ্রেগ, মাইক প্রোক্টরজন স্নোকে সাথে নিয়ে উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন হন।[১৯]

২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ তারিখে মামলাটি শুরু হয়। সাত সপ্তাহ পর এর রায় বের হয়। ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের কৌঁসুলী জানান, যদি শীর্ষস্থানীয় প্রচলিত ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন তাহলে তাঁরা প্রবেশদ্বারে অর্জিত অর্থ পাবেন না। কেরি প্যাকারের আইনজীবীরা মন্তব্য করেন যে, আইসিসি তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দেরকে সম্পর্ক ভাঙ্গাসহ অন্যানদেরকে যোগদানের বাঁধার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিচারপতি স্যার ক্রিস্টোফার স্লেড নিম্নবর্ণিত নয়টি বিষয়কে বিবেচনায় আনেন:[২০]

  1. ডব্লিউএসসি ও তাঁর খেলোয়াড়দের চুক্তি অকার্যকর কি-না?
  1. ৩ আগস্ট ডব্লিউএসসি প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি-না ও বিষয়টি ১৯৭৪ সালের সংবিধিবদ্ধ নিরাপত্তাবিষয়ক ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট কি-না?[২১] আইসিসিভিত্তিক প্রবর্তিত চুক্তির ধারার তুলনায় গৃহীত পদক্ষেপ উপযুক্ত ও ক্ষতির কারণ কি-না?
  1. ৩ আগস্ট ডব্লিউএসসি প্রতিষ্ঠা ও উপর্যুক্ত বিষয়াবলী টিসিসিবিভিত্তিক একই মাঠে অন্যায্যভাবে আয়োজন করা উপযুক্ত কি-না?
  1. ১৯৭৪ সালের ধারায় আইসিসির নতুন নিয়ম শ্রমিকদের দমন করছে কি-না?
  1. উপর্যুক্ত বিষয়ে টিসিসিবির প্রস্তাবিত নতুন নিয়ম শ্রমিকদেরকে দমন করছে কি-না?
  1. ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী আইসিসি শ্রমিক সংঘ কি-না?
  1. টিসিসিবি কি শ্রমিক সংঘ?
  1. যদি আইসিসি বা টিসিসিবি বা উভয়ই শ্রমিক সংঘ হয়ে থাকে তবে, কেউ চলে যেতে চাইলে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত আরোপ করে?
  1. এর স্বপক্ষে (ক) বাদী ও (খ) ডব্লিউএসসি কি ধরনের সাহায্য করতে পারে?

বিচারপতি স্লেড রায় প্রদানকালে বলেন যে, পেশাদার ক্রিকেটারদের জীবনধারণের জন্যে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। আইসিসি কেবলমাত্র নিজেদের প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করছে ও তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আইসিসি বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেছে।

খেলোয়াড়দের গোপন চুক্তির ফলে সমালোচনা করা উচিত নয়। তারা ডব্লিউএসসির কাছ থেকে অধিক উপার্জনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ও কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার ভয়ে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

এ সিদ্ধান্তের ফলে ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের আঁতে ঘা লাগে। তাদের অপমানিত হতে হয়। আদালতের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে হয়। ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটের দলগুলো তাদের চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে ও প্যাকারের সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়েরাও খেলার যোগ্যতা লাভ করে।

সুপারটেস্ট, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পিচ ব্যবহার

[সম্পাদনা]
ডব্লিউএসসিতে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটিং তারকা ভিভ রিচার্ডস দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যান হয়েছিলেন।

আনুষ্ঠানিক ক্রিকেটে কিছু ছোটধরনের বিজয়ী হয়। প্যাকার টেস্ট খেলা শব্দের প্রয়োগ ঘটাতে পারবেন না বা অস্ট্রেলীয় দলকে অস্ট্রেলিয়া বা এমসিসি প্রণীত ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক নিয়ম ব্যবহার করতে পারবেন না।[২২]

ফলশ্রুতিতে, পাঁচদিনের খেলাগুলো সুপারটেস্ট নামে পরিচিতি পাবে ও ডব্লিউএসসি অস্ট্রেলিয়া একাদশ নামে পরিচিত হবে। রিচি বেনো আইন-কানুন লিখতে বসেন ও সিরিজের খেলার অবস্থা নির্ধারণ করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডব্লিউএসসি প্রচলিত ক্রিকেট মাঠ ব্যবহার করতে পারেননি। ফলে কেরি প্যাকার মেলবোর্নের ভিএফএল পার্ক ও অ্যাডিলেডের ফুটবল পার্ক - এ দুটো অস্ট্রেলীয় রুলস ফুটবল স্টেডিয়াম এবং পার্থের গ্লুচেস্টার পার্কসিডনি শোগ্রাউন্ড ভাড়া নেন।

অবশ্যম্ভাবী সমস্যা হিসেবে ঐ মাঠগুলোয় ঘাসে আচ্ছন্ন পিচগুলো আদর্শ মানদণ্ডের উপযোগী করে তৈরী করা হয়নি। ঐ পিচগুলো পূর্বে ব্যবহার করা হতো না। সাধারণ অর্থে এতো স্বল্প সময়ে ঐ পিচগুলো খেলার উপযোগী ছিল না।[২৩] তবে, কেরি প্যাকার প্রতিভাবান কিউরেটর জন মেলেকে ব্রিসবেনের গাব্বা থেকে নিয়ে আসেন ও ড্রপ-ইন পিচের ধারণার পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।[২৪] ঐ পিচগুলো মাঠের বাইরে তৈরি করা হয় ও ক্রেনের সাহায্য নিয়ে খেলার স্থানে রাখঅ হয়। এই বৈপ্লবিক কৌশলে ডব্লিউএসসির প্রথম মৌসুমের অপ্রকাশিত গৌরবগাঁথা ছিল। এগুলো ছাড়া ডব্লিউএসসি বোকাবনে যেতো।[২৫]

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের উত্থান সিরিজটিতে অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া বনা বাদ-বাকী একাদশের খেলায় এ দলের ধারণা চলে আসে। যখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা তাদের সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে উপার্জিত অর্থের চেয়েও অধিক পরিমাণ অর্থের প্রস্তাবনা লাভ করে, তখন তারা একযোগে মহাউৎসাহে চুক্তিবদ্ধ হয়। ডব্লিউএসসি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দেরকে বিশ্ব দলের পাশাপাশি খেলতে নামায়।

প্রথম ডব্লিউএসসি খেলা সুপারটেস্ট হিসেবে খেলানো হয়। ২ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ তারিখে ভিএফএল পার্কে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। খেলার মান বেশ উন্নত ছিল। তবে, স্টেডিয়ামের আসন সংখ্যা ৭৯,০০০ হলেও দর্শক সমাগম বেশ কম হয়। একই সময়ে ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে ব্রিসবেনে সফরকারী ভারত ও তুলনামূলকভাবে দূর্বল অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক টেস্ট খেলা চলছিল। আনুষ্ঠানিক ঐ টেস্টে দর্শকদের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক।

প্রথম মৌসুম: ১৯৭৭-৭৮

[সম্পাদনা]

ব্যক্তিত্বের মানদণ্ডে বাজারজাতকরণের সাথে জড়িত কর্মীরা ডব্লিউএসসিকে দ্বৈতদানবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়। ফাস্ট বোলিংকে প্রধান মানদণ্ড করে এবং ডেনিস লিলি, ইমরান খান, মাইকেল হোল্ডিংঅ্যান্ডি রবার্টসের ন্যায় ফাস্ট বোলারদেরকে বেশ সহায়তা করে। কেরি প্যাকার স্লো বোলিংয়ের কার্যকারিতা নিয়ে বেশ সন্দিহান ছিলেন। পেস বোলারদের ক্রমাগত বোলিং পিচে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ডব্লিউএসসির ব্যাটসম্যানেরা তাদের শরীর রক্ষার্থের দিকে সচেষ্ট হন। ১৬ ডিসেম্বর তরিখে সিডনিতে অনুষ্ঠিত সুপারটেস্টে অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান ডেভিড হুকস অ্যান্ডি রবার্টসের বলে ধরাশায়ী হন।[২৬] হুকসের ভাঙ্গা চোয়ালের দৃশ্য নাইনের ক্যামেরায় স্থিরচিত্রে দেখানো হয়। ডব্লিউএসসির খেলাগুলোয় দেখানোয় ব্যবহার করা হয়।

অ্যান্ডি রবার্টসের বাউন্সারে তাঁর চোয়াল ভেঙ্গে যায়। ঐ মুহুর্তের পূর্ব-পর্যন্ত ডব্লিউএসসিকে বিনোদনধর্মীয় অনুষ্ঠানরূপে মনে করা হতো। হুকসের আঘাতপ্রাপ্তি প্রতিযোগতিতার গুরুত্বতাকে সকলের কাছে আরও বাড়িয়ে তোলে।[২৭]

এ আঘাতের ফলে আরেকটি প্রভাব পড়ে। ব্যাটসম্যানদের মাথায় প্রথমবারের মতো হেলমেট পরিধানের ধারণা আসে।[২৮] শুরুতে ইংরেজ ব্যাটসম্যান ডেনিস অ্যামিস ডব্লিউএসসিতে ব্যাটিংকালে মোটরসাইকেলের হেলমেন পরিধান করেন।[২৯] তাঁকে অনুসরণ করে অন্যরাও ব্যবহার করতে থাকেন। ডব্লিউএসসির শেষদিকে প্রতিরক্ষামূলক ক্রিকেট সরঞ্জামের ব্যবহার দ্রুত বেড়ে উঠে।[৩০] দৃশ্যতঃ ডব্লিউএসসি ও আনুষ্ঠানিক টেস্ট খেলাগুলোয় সকল ব্যাটসম্যানই প্রতিরক্ষামূলক মাথার আবরণ ব্যবহার করতে থাকেন।

ডব্লিউএসসি একদিনের ক্রিকেট খেলা আয়োজনে তৎপর হয়। অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বিশ্ব দলকে নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কাপ নামে একদিনের সিরিজ আয়োজন করে। পাশাপাশি সিডনি, মেলবোর্ন, অ্যাডিলেড ও পার্থে ছয়টি সুপারটেস্ট আয়োজন করে। প্রথম দিবা-রাত্রির খেলাটি মেলবোর্নের ভিএফএল পার্কে অনুষ্ঠিত হয়। কিছু কৌতুহলোদ্দীপক আকর্ষণ লাভে সক্ষম হলেও অর্থের বিনিময়ে খেলা দেখার জন্য দর্শকেরা সিরিজে ভিন্ন কিছু দেখতে চাইছিল। প্রতিকূল প্রচারমাধ্যমে প্রচারণা ও অস্ট্রেলিয়া-ভারতের মধ্যকার নাটকীয়ভাবে টেস্ট সিরিজ আয়োজনে আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে ক্রিকেট লাভবান হয়। এসিবি এ পর্যায়ে দশ বছর প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া ৪১ বছর বয়সী ববি সিম্পসনকে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব প্রদান করে। ডব্লিউএসসির চুক্তিতে না থাকা জেফ থমসন বাদে তুলনামূলকভাবে অপরিচিত তরুণ খেলোয়াড়কে নিয়ে দলকে পরিচালনা করেন তিনি। অ্যাডিলেডের চূড়ান্ত টেস্টের পূর্ব-পর্যন্ত সিরিজে সমতা থাকে ও পরবর্তীকালে ৩-২ ব্যবধানে জয় করে তাঁর দল। টেস্টগুলোয় ব্যাপক দর্শক সমাগম হয় ও ঐ গ্রীষ্মের পুরোটা সময় গণমাধ্যমের আশীর্বাদ পায় এসিবি কর্তৃপক্ষ।

অন্যদিকে, কেরি প্যাকারকে কার পার্কে আয়োজিত খেলাগুলোয় গাড়ীর আনাগোনা পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। তাসত্ত্বেও তিনি আশারবাণী শোনেন। কেবলমাত্র দিবা-রাত্রিতে অনুষ্ঠিত খেলাগুলোই স্বার্থকতার দাবীদার ছিল। এগুলোই দ্বিতীয় মৌসুমে সাফল্যের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। বোধোদয় হবার পর তাঁর সংগঠন স্বল্পকালীন সময়ে খেলা আয়োজনে তৎপরতা দেখায় ও কি হতে চলেছে তার ফলাফল নিয়ে আসে। ঐ সময় পর্যন্ত এসিবি গণমাধ্যমের সহযোগিতায় চলতে থাকে ও খেলার প্রকৃত ভক্তদেরকে কাছে পায়। কিন্তু, দূর্ভাগ্যবশতঃ ও দূর্বল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষিতে এসিবি প্যাকারের চেয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি।

১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে ববি সিম্পসনের নেতৃত্বে মার্চ, ১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়া দল ক্যারিবীয় অঞ্চলে আসে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট কর্মকর্তারা এসিবি-প্যাকারের যুদ্ধে অংশগ্রহণের ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। ফলে তারা প্রথম দুই টেস্টে ডব্লিউএসসি খেলোয়াড়দের মনোনীত করে। তবে, তৃতীয় টেস্টে ডব্লিউএসসির সাথে চুক্তিবদ্ধ তিনজন খেলোয়াড়কে দলের বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রধান কারণ ছিল, ঐ বছরের শেষদিকে ভারত ও শ্রীলঙ্কা সফরে অন্য খেলোয়াড়দেরকে সুযোগ দেয়া। এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছিল না। এ তিনজনের বাদ দেয়াকে ঘিরে অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ডব্লিউএসসির সাথে চুক্তিভূক্ত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়েরা সিরিজের বাদ-বাকী খেলা থেকে নিজেদেরকে দূরে থাকার কথা ঘোষণা করেন।

দূর্বল ঐকমত্য

[সম্পাদনা]

দুই ডব্লিউএসসি মৌসুমের মাঝে আইসিসি দেশগুলোর ঐক্য ক্ষয় হতে থাকে। ইংল্যান্ডে প্যাকারের আধিপত্য বিস্তার সর্বোচ্চ ছিল ও ব্যাপক ক্ষতি করে। তবে, কাউন্টি ক্লাবগুলোর অনেক কর্মকর্তা প্যাকারের সাথে জড়িত খেলোয়াড়দেরকে দলে রাখার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সর্বাপেক্ষা আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছিল। আইসিসির ঐকমত্যের স্বার্থেই কেবলমাত্র ভোট প্রদান করেছিল। আর্থিক ও রাজনৈতিক সমস্যায় অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সফরের ফলে প্যাকারের সাথে ১৯৭৯ সালের বসন্তে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ডব্লিউএসসি সিরিজ আয়োজনে আলোচনা চালায়। শুরুতে পাকিস্তান কঠোর অবস্থানে ছিল ও প্যাকারের সাথে জড়িত খেলোয়াড়দেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকার করে। তবে, মৌসুম বহির্ভূত সময়ে ডব্লিউএসসি আরও পাকিস্তানীকে চুক্তিবদ্ধ করে ও ১৯৭৮ সালের ইংরেজ গ্রীষ্মে দূর্বল দলকে আনুষ্ঠানিক খেলায় প্রেরণ করলে খুব সহজেই তারা ইংল্যান্ডের কাছে নাস্তানুবাদ হয়। এরফলে অক্টোবর, ১৯৭৮ সালে দীর্ঘ সতেরো বছর পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার প্রথম টেস্ট সিরিজের জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্রসর হয়। আপাতদৃষ্টিতে ভারত থেকে কাউকে যুক্ত করা না হলেও গুজব রয়েছে যে, অধিনায়ক বিষেন সিং বেদী ও তারকা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার ডব্লিউএসসিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন।[৩১]

নিউজিল্যান্ডের প্রধান প্রশাসক ওয়াল্টার হ্যাডলি শুরুরদিকে সমঝোতা আনয়ণে চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। এখন তিনি নভেম্বরে নিজ দেশে সংক্ষিপ্ত সফর আয়োজনে ডব্লিউএসসিকে কোন বাঁধা দেননি। এছাড়াও, স্বীয় পুত্র ও কিউইদের সেরা খেলোয়াড় রিচার্ড হ্যাডলিকে ডব্লিউএসসিতে অংশগ্রহণের উপর বাঁধা-নিষেধ আরোপ করেননি। বর্ণবৈষম্যবাদের দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কারণে দলের খেলোয়াড়ের বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের সাথে খেলবে। কেউ কেউ দাবী করেন যে, ডব্লিউএসসিতে কিছু খেলোয়াড় তুলনান্তে সেরা খেলা উপহার দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের সেরা দলে নিয়ে যেতে উদগ্রীব।

তাসত্ত্বেও, ডব্লিউএসসি এসিবির সাথে সংঘর্ষ চালিয়ে যেতে থাকে। অনেক তরুণ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারসহ আরও বিদেশী খেলোয়াড়কে চুক্তিতে আবদ্ধ করে। এখন ৫০-এরও অধিক ক্রিকেটারকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়। নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের পর ডব্লিউএসসি ইংল্যান্ড সফরের প্রস্তুতির কথা জানায় এবং ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের চুক্তির বাইরে থাকা পর্যাপ্তসংখ্যক খেলোয়াড়দেরকেও নিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুত।

১৯৭৮-৭৯ মৌসুমের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের সফরের প্রস্তুতি নেয়া হয়। এ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রাদেশিক শহরগুলোকে এর লক্ষ্যবস্তু করা হয়। বিকল্প খেলোয়াড়দেরকে নিয়মিতভাবে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। এ সফরে কুইন্সল্যান্ডের কেয়ার্নস থেকে তাসমানিয়ার ডেভনপোর্ট পর্যন্ত বিস্তৃত করে দেয়া হয়। দ্বিতীয়সারির সফরে ১৯৬০-এর দশকে ইংল্যান্ডের আদলে ক্যাভেলিয়ার্স দল গঠন করে ডব্লিউএসসি কর্তৃপক্ষ। এডি বার্লোকে দলের অধিনায়কের দায়িত্বভার প্রদান করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেট জগৎ থেকে অবসরে চলে আসা রোহন কানহাই, ডেভিড হলফোর্ডইয়ান রেডপাথসহ তুলনামূলকভাবে তরুণ অস্ট্রেলীয় ট্রেভর চ্যাপেলকে এ দলের সদস্য করা হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসের মেইটল্যান্ডে দলটি দূর্দান্ত সূচনা করে। অপরিচিত কেপলার ওয়েসেলস ক্যাভেলিয়ার্সের সদস্যরূপে অপরাজিত ৯২ রানের ইনিংস খেলেন। ঐ খেলাগুলো আয়োজনের ফলে মাঠগুলো কদাচিৎ বড় ধরনের খেলার সুযোগ থেকে পুনরায় আশার আলো জাগায়।

কেরি প্যাকার তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের মূখ্যমন্ত্রী নেভিল রেনকে দিয়ে ডব্লিউএসসিকে নিষিদ্ধতা থেকে মুক্ত করেন ও সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) সকল খেলা আয়োজনের বন্দোবস্ত করেন। এছাড়াও রেন সরকারি খরচে প্যাকারকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত আলোর যোগান দেন। এছাড়াও ডব্লিউএসসি ব্রিসবেনের টেস্ট মাঠ গাব্বা ব্যবহার করার অনুমতি পায়। এছাড়াও, অ্যাডিলেড ওভাল ব্যবহারের অনুমতি পেলেও তা নাকচ করে দেন কেরি প্যাকার। পার্থ ও অ্যাডিলেডকে ব্যবহার করেননি তিনি। ঐ কৌশল অবলম্বনের ফলে মেলবোর্ন ও সিডনি দর্শকদের বেশ মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

দ্বিতীয় মৌসুম: ১৯৭৮-৭৯

[সম্পাদনা]

২৮ নভেম্বর, ১৯৭৮ তারিখে স্নায়ুযুদ্ধ নাটকীয়ভাবে কেরি প্যাকারের অনুকূলে চলে আসে। ঐ দিন এসসিজির ন্যায় প্রচলিত ক্রিকেট মাঠে প্রথম দিবা-রাত্রির খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ডব্লিউএসসি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল মুখোমুখি হয়। প্রায় ৪৪,৩৭৭জন দর্শক সীমিত ওভারের প্রতিযোগিতাটি দেখতে আসে। এর মাধ্যমে এসিবি সতর্ক সঙ্কেত পায়। এর কয়েকদিন পর ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ইংল্যান্ডের কাছে ৫-১ ব্যবধানে অস্ট্রেলিয়া পর্যদুস্ত হবার পর ব্রিসবেনে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রেলিয়া দল ইংরেজদের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নামে। দলটিকে অপ্রস্তুত অবস্থায় গ্রাহাম ইয়ালপকে পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এমনকি গ্রাহাম ইয়ালপ স্বয়ং নিজেকে এ পদের অনুপযুক্তরূপে ঘোষণা করেন ও তাঁর দল অভিজ্ঞ, পেশাদার ইংরেজ দল মোকাবেলায় অক্ষম ছিল। নিশ্চিতভাবেই ইংরেজরা প্রতিপক্ষকে হারায়। ধীরগতিতে খেলা এসিবির আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পাশাপাশি স্বল্পসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতি ও গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে পূর্ণাঙ্গ শক্তিধর অস্ট্রেলিয়া দল নিয়ে মাঠে উপস্থিত থাকার দাবী তোলা হয়।

অন্যদিকে, ডব্লিউএসসি তাদের আগ্রাসী বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর, রাত্রিকালীন খেলা আয়োজন ও অধিকসংখ্যক একদিনের খেলা আয়োজন করতে থাকে। ফলে, দর্শকসংখ্যা ও টেলিভিশন রেটিংস - উভয়ই বৃদ্ধি পেতে থাকে। নারী ও শিশুদেরকে উপস্থিতি নিশ্চিতকরণে লক্ষ্য রাখা হয় ও খেলার মানও উচ্চ পর্যায়ের ছিল।

এসসিজিতে অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্ব দলের মধ্যে সুপারটেস্ট ফাইনাল আয়োজন করা হয়। খেলাটি ফ্লাডলাইটে অনুষ্ঠিত হয়। তিনদিনব্যাপী এ খেলায় প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের সমাগম ছিল। এক সপ্তাহ পর অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মধ্যকার ষষ্ঠ টেস্ট একই মাঠে আয়োজন করা হয়। চারদিনের খেলাটিতে মাত্র ২২,০০০ দর্শক হাজির হয়েছিলেন। ঐ মৌসুমের শেষদিকে এসিবি ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে সফরকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টের সিরিজ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরফলে অস্ট্রেলিয়া দল আটটি টেস্টে অংশ নেয়। এটি এসিবিকে আর্থিক দিক দিয়ে আরও ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে। পাকিস্তান দল তাদের ডব্লিউএসসিতে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মাঠে নামায় যা সিরিজের মানকে আরও গতিহীনতার দিকে নিয়ে যায়।[৩২]

এরপর ডব্লিউএসসি ক্যারিবীয় সফরে যায়। অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা তাদের সর্বোৎকৃষ্ট খেলা প্রদর্শনের ঘোষণা দিলে এর উত্তপ্ততা আরও বৃদ্ধি পায়। গায়ানার সুপারটেস্টে দাঙ্গার উপক্রম হয়। তবে, পাঁচটি সুপারটেস্ট ও ১২টি একদিনের খেলা আয়োজনের ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ডের কিছুটা দেনা পরিশোধের সুযোগ ঘটে। ১০ এপ্রিল, ১৯৭৯ তারিখে ডব্লিউএসসি সর্বশেষ ক্রিকেট খেলায় নামে। অ্যান্টিগুয়ায় ঐ সুপারটেস্টের চূড়ান্ত খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়েছিল। ঐ সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে ড্রয়ে পরিণত হয়।

পুণর্মিলন

[সম্পাদনা]

১৯৭৯ সালের মধ্যে এসিবি দূর্দান্তভাবে আর্থিক সঙ্কটে নিপতিত হয় ও অঢেল অর্থ সম্পদের অধিকারী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়। দুই মৌসুমে দুই বৃহৎ ক্রিকেট সংস্থা নিউ সাউথ ওয়েলসভিক্টোরিয়ার সর্বমোট অর্ধ-মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যায়। তবে, প্যাকারকেও আর্থিক দিক দিয়ে কিছুটা ভড়কে দিয়েছিল। অনেক বছর পর ডব্লিউএসসির সাথে জড়িতরা দাবী করেন যে, তিনি ঐ সময়ে যতটুকু অর্থ খরচের কথা বলেছেন তার তুলনায় এ সংখ্যাটি অনেকগুণ বেশি ছিল। ঐ বছরের মার্চে কেরি প্যাকার এসিবি সভাপতি বব পারিশের সাথে কয়েকদফা সভায় বসেন। এরফলে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যতের প্রশ্নে সমঝোতার প্রয়োজন দেখা দেয়।

৩০ মে, ১৯৭৯ তারিখে বব পারিশ বিবাদ অবসানের ঘোষণা দেন তখন ক্রিকেট অনুরাগীরা বিস্ময়াভিভূত হন। চ্যানেল নাইন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সম্প্রচারসত্ত্ব লাভ করে। শুধু তাই নয়, দশ বছরের জন্যে নতুন প্রতিষ্ঠান পিবিএল মার্কেটিংকে খেলার বিপণনে চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়। এসিবি কর্তৃপক্ষ ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ও আইসিসিকে আর্থিক দৈন্যদশার কথা তুলে ধরে এবং তারাও যথেষ্ট অর্থ ও নৈতিক সহায়তা প্রদান করে। তবে, সবকিছুই প্যাকারের কাছে তুলে দিতে বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৮০ সালের উইজডেন সংস্করণে উল্লেখ করা হয় যে,[৩৩]

অনেকদিন যাবৎ অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড কেরি প্যাকারকে তাদের গলার কাটা হিসেবে দেখে আসছিল। বাদ-বাকী ক্রিকেট বিশ্ব তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে সহায়তা করে; এমনকি আদালতের মামলা পরিচালনা করার ন্যায় ব্যয়বহুল খরচাদিও মনোঃবেদনাদায়কভাবে ক্রিকেট বিশ্ব পরিচালনা করেছে। এখন, অস্ট্রেলিয়ায় এটি উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তারা তাদের বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করে নিজেদের হাতে পরিষ্কার করে দিচ্ছে।

ডব্লিউএসসি অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়েরা তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ছিল ও আলোচনা থেকে কোন কিছু পায়নি। এরফলে তাদের মোহমুক্তি ঘটেছে ও উদ্বিগ্ন অবস্থা তৈরি করেছে। তারা হয়তোবা সামনের দিনগুলোয় এসিবিরি কাছ থেকে বিমাতাসূলভ আচরণের শিকারে পরিণত হবে। এসিবি কর্তৃপক্ষ ডব্লিউএসসির সাথে চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড়দেরকে ইংল্যান্ড সফরে অন্তর্ভুক্ত করেনি। ১৯৭৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ ও ঐ বছরের শেষদিকে ১৯৭৯-৮০ মৌসুমের ছয় টেস্টের সিরিজ থেকেও তাদেরকে বাদ রাখে। উভয় সফরেই কিম হিউজের নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া দল সাধারণমানের খেলা প্রদর্শন করে।[৩৪]

১৯৭৯-৮০ মৌসুমে গ্রেগ চ্যাপেলকে অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়করূপে পুনরায় দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ঐ দলটিতে ডব্লিউএসসি ও ডব্লিউএসসিবিহীন উভয় ধরনের খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণ ছিল। ঐ মৌসুমের খেলাগুলো ডব্লিউএসসি ধাঁচের আদলে হয়েছিল। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অস্ট্রেলিয়া সফরে আসে। উভয় দলই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজে অংশ নেয়। বিশ্ব সিরিজ কাপ নামে ত্রি-দেশীয় একদিনের প্রতিযোগিতা টেস্টের মাঝখানে অনুষ্ঠিত হয়। দলটি ইংল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে পরাজিত করে। অথচ, পূর্বেকার গ্রীষ্মে একই প্রতিপক্ষের কাছে ৫-১ ব্যবধানে নাস্তানুবাদ হয়। তবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ০-২ ব্যবধানে পরাজিত হয় ও একদিনের প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত খেলায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। ঐ মৌসুমের খেলার ধরন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।[৩৫] তাসত্ত্বেও, আর্থিক দিক দিয়ে বেশ লাভবান হয়। অধিকাংশ অর্থই পিবিএল নিয়ে যায়, এসিবি অল্প অর্থ পায়।

অর্জনসমূহ

[সম্পাদনা]

বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট চালু হবার ফলে খেলাটিতে নানাবিধ পরিবর্তন দেখা দেয়। ব্যস্ত সময়সূচীর কারণে ক্রিকেটারগণ অন্য আগের চেয়ে শারীরিকভাবে ফিট থাকার জন্য বেশি সচেষ্ট হন।

অধিকাংশ দেশেই রাতে খেলা আয়োজন করা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিনের ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয় ফরম্যাট হয়ে ওঠে। তবে, সাম্প্রতিককালে টুয়েন্টি২০ ক্রিকেট এর হুমকির কারণ হয়ে সামনে চলে এসেছে। খেলোয়াড়েরা পূর্ণাঙ্গকালীন পেশাদার খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন। বড় ধরনের ক্রিকেট দেশগুলোয় বেশ উচ্চমানের বেতন প্রদান করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টেলিভিশনের সাহায্যে আসে। খেলায় সম্প্রচারকারীরা বেশ সাড়া দিচ্ছেন।

তবে, খেলার প্রচলিত ধরনরূপে টেস্ট ক্রিকেট অদ্যাবধি বিশ্বের সর্বত্র খেলা হচ্ছে। দর্শকদের আগ্রহ ও চাহিদার কথা বিবেচনায় এনে সাম্প্রতিক মৌসুমগুলোয় একদিনের আন্তর্জাতিকে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এছাড়াও, এ স্তরের ক্রিকেটে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক প্রকৃতি ও একদিনের খেলোয়াড়দের উচ্চ পর্যায়ের বেতন দেয়া - উভয় দিক বিবেচনায় এনে টেস্ট ক্রিকেটভূক্ত দলের সদস্যরা প্রায়শঃই গুরুত্বতার সাথে দেখা হয়। বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে কেরি প্যাকার তাঁর সম্পৃক্ততার বিষয়কে অর্ধ-বিশ্বপ্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বিপণন ব্যবস্থা বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে প্রধান উপাদান হিসেবে ছিল। আকর্ষণীয় সম্পৃক্ত গান কা’মন অসি কা’মন, সাধারণ লোগো, খেলোয়াড়দের রঙিন পোশাক পরিধান ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রকে সাথে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বাজারজাতকরণে ক্রিকেট বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে। বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে এ সকল কৌশল পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ও বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় এ খেলার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে বাজারজাতকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অস্ট্রেলিয়া দলে খেলোয়াড়দের মাঝে বিভক্তি দেখা দেয়। একটি অংশ আনুষ্ঠানিক একাদশের প্রতি অনুগত ছিল ও প্যাকারের বিদ্রোহী অংশের সাবেক ডব্লিউএসসি খেলোয়াড় - ডেনিস লিলি, রড মার্শ ও কিম হিউজ আনুষ্ঠানিক দলের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। ১৯৮০-এর দশকে এ বিভাজন চলতে থাকে। ডব্লিউএসসির অনেক খেলোয়াড়ই যোগ্যতার সাথে আনুষ্ঠানিক অস্ট্রেলীয় দলে ফিরে আসেন। অ্যালান বর্ডারের ন্যায় খেলোয়াড়গণও ডব্লিউএসসির বাইরে থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেন।

প্রতি গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়াসহ অপর দুটি আন্তর্জাতিক দলকে নিয়ে একদিনের প্রতিযোগিতাকে এসিবি বিশ্ব সিরিজ কাপ নামে ব্যবহার করতে থাকে। এ প্রতিযোগিতার রূপরেখাটি ডব্লিউএসসির ইন্টারন্যাশনাল কাপ থেকে আহরিত। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ নাম ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

রঙিন পোশাক, প্রতিরক্ষার্থে হেলমেট পরিধান, ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতা, ক্রিকেটে ফ্লাডলাইটের ব্যবহার - এগুলো প্যাকার-পরবর্তী যুগে আদর্শ মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, কেরি প্যাকার নিজ দেশকে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ক্রিকেট বাণিজ্যিকমূখী খেলা যা দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।

অস্টিন রবার্টসন তাঁর গ্রন্থ ‘ক্রিকেট আউটলজের’[৩৬] মোড়ক উন্মোচনকালে[৩৭] বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী পরিচালকদের বেতনসংক্রান্ত তথ্য জানান। জন কর্নেল - $৭০,০০০; পল হোগান - $২০,০০০ ও অস্টিন রবার্টসন - $1১০,০০০।

খেলোয়াড়, ফলাফল ও পরিসংখ্যান

[সম্পাদনা]

উল্লেখযোগ্য ঘটনা

[সম্পাদনা]
  • ডব্লিউএসসি চলাকালে ৫৬,১২৬ রান ও ২,৩৬৪ উইকেটের পতন ঘটে।[৩৮] ১৯৭৭ সালে আইসিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খেলাগুলো প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের মর্যাদা পাবে না। ফলে, অংশগ্রহণকারী ডব্লিউএসসি খেলোয়াড়দের ঐ প্রতিযোগিতায় সংগৃহীত রান ও উইকেটের পরিসংখ্যানগুলো রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।[৩৯]
  • প্রকৃতপক্ষে দিবা-রাত্রিতে অনুষ্ঠিত খেলাগুলোয় সাদা বলের পরিবর্তে হলুদ রঙের বল ব্যবহৃত হয়েছিল।
  • ডব্লিউএসসির বিজ্ঞাপনচিত্র ‘কা’মন অসি কা’মন’ এককসঙ্গীত হিসেবে মুক্তি পায় ও ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলীয় চার্টে এক নম্বর স্থান দখল করেছিল।[৪০]
  • ডব্লিউএসসির অধিকাংশ খেলাগুলোয় সাদা বল ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রথম সীমিত ওভারের খেলায় রঙিন পোশাকের প্রচলন ঘটে। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭৯ তারিখে এসসিজিতে ফ্লাডলাইটে ডব্লিউএসসি অস্ট্রেলিয়া বনাম ডব্লিউএসসি ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।
  • এ প্রতিযোগিতায় ম্যাকডোনাল্ডস সকল খেলোয়াড়ের স্বাক্ষর সংবলিত রঙিন পোস্টার মুদ্রণ করে প্রতিযোগিতার প্রচারণায় অংশ নেয়।
  • সর্বশেষ খেলায় প্রতিপক্ষীয় অধিনায়ক টনি গ্রেগকে জয়সূচক রান করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে চারটি ওয়াইড বল ছুঁড়েন।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Australian Heritage Council. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ অক্টোবর ২০০৭ তারিখে Accessed 29 July 2007.
  2. "Media colossus pushed the boundaries of family empire"smh.com.au 
  3. Sydney Morning Herald. Accessed 29 July 2007.
  4. Haigh (1993), p 34.
  5. McFarline (1977), p 157.
  6. Lillee (2003), p 129.
  7. Haigh (1993), p 41.
  8. Wisden Cricketer magazine. Accessed 28 July 2007.
  9. Pollard (1982), p. 1138.
  10. The Age. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে Accessed 28 July 2007
  11. Haigh (1993), p 67.
  12. McFarline (1977), p 33.
  13. McFarline (1977), p56.
  14. McFarline (1977), pp 56–57.
  15. Haigh (1993), p 76.
  16. Haigh (1993), p 77.
  17. McFarline (1977), pp 61–62.
  18. McFarline (1977), pp 100–101.
  19. Haigh (1993), p 101. The ICC was not a defendant in the case as it had no legal "personality" at the time.
  20. Wisden 1978. Accessed on 29 July 2007.
  21. The Trade Union and Labour Relations Act 1974, repealed and replaced by the Trade Union and Labour Relations (Consolidation) Act 1992. See: The UK Statute Law database, Ministry of Justice. Accessed 30 July 2007.
  22. Marylebone Cricket Club. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ মে ২০০৮ তারিখে Accessed 29 July 2007.
  23. Lillee (2003), p 131.
  24. Cashman et al. (1996), p 327. After WSC concluded, Maley was the curator of the WACA ground in Perth from 1980–88.
  25. Lillee (2003), p 132.
  26. Cricinfo.com. Accessed 29 July 2007.
  27. Cricinfo.com: David Hookes player profile. Retrieved 27 September 2007.
  28. Haigh (1993), p 132.
  29. BBC Sport forum. Accessed 28 July 2007.
  30. Australia Innovates project. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে Accessed on 29 July 2007.
  31. Wisden 1979. Accessed 29 July 2007.
  32. Wisden 1980. Accessed 10 August 2007.
  33. Wisden 1980. Accessed 28 July 2007.
  34. Cricinfo.com. Accessed 10 August 2007.
  35. Wisden 1981. Retrieved 18 August 2007.
  36. Robertson, Austin (২০১৭)। Cricket Outlaws। Australia: Pan MacMillan। আইএসবিএন 9781760554712 
  37. "Lifting the lid on World Series Cricket" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১২-২৩ 
  38. Haigh (1993), p 326.
  39. Cricinfo.com. Accessed 30 July 2007.
  40. Australian music charts archive. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৫ জুলাই ২০০৭ তারিখে Accessed 29 July 2007.

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]