বিষ্ণুবর্ধন | |
---|---|
হোয়সল রাজা | |
রাজত্ব | আনু. ১১০৮ – আনু. ১১৫২ খ্রিস্টাব্দ |
পূর্বসূরি | প্রথম বীর বল্লাল |
হোয়সল রাজন্যবর্গ (১০২৬-১৩৪৩) | |
দ্বিতীয় নৃপ কাম | (১০২৬-১০৪৭) |
হৈসল বিনয়াদিত্য | (১০৪৭-১০৯৮) |
এরিয়াঙ্গা | (১০৯৮-১১০২) |
প্রথম বীর বল্লাল | (১১০২-১১০৮) |
বিষ্ণুবর্ধন | (১১০৮-১১৫২) |
প্রথম নরসিংহ | (১১৫২-১১৭৩) |
দ্বিতীয় বীর বল্লাল | (১১৭৩-১২২০) |
দ্বিতীয় বীর নরসিংহ | (১২২০-১২৩৫) |
বীর সোমেশ্বর | (১২৩৫-১২৬৩) |
তৃতীয় নরসিংহ | (১২৬৩-১২৯২) |
তৃতীয় বীর বল্লাল | (১২৯২-১৩৪৩) |
হরিহর রায় (বিজয়নগর সাম্রাজ্য) |
(১৩৪২-১৩৫৫) |
বিষ্ণুবর্ধন (কন্নড়: ವಿಷ್ಣುವರ್ಧನ) (১১০৮-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন হোয়সল সাম্রাজ্যের (অধুনা ভারতের কর্ণাটক রাজ্য) সম্রাট। ১১০৮ খ্রিষ্টাব্দে তার দাদা বীর বল্লালের মৃত্যুর পর তিনি হোয়সল সিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রথম জীবনে বিষ্ণুবর্ধন ছিলেন জৈনধর্মের অনুগামী এবং তার নাম ছিল বিট্টিদেব। পরে হিন্দু দার্শনিক রামানুজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন এবং ‘বিষ্ণুবর্ধন’ নাম গ্রহণ করেন।[১] বিষ্ণুবর্ধন তার ঊর্ধ্বতন শাসক পশ্চিম চালুক্য রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ও দক্ষিণের চোল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ করে দক্ষিণ ভারতে স্বাধীন হোয়সল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। টালাকাডের যুদ্ধে জয় লাভ করে তিনি চোলেদের অধীনে থাকা গঙ্গাবাডি প্রদেশের (অধুনা দক্ষিণ কর্ণাটক) কিয়দংশ পুনরুদ্ধার করেন।[২] নোলামবাবডির কিয়দংশও তিনি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।[৩] ইতিহাসবিদ কোলহোর মতে, বিষ্ণুবর্ধনের প্রচেষ্টার ফলেই হোয়সলরা একটি রাজ্যের সম্মান লাভ করেছিল। বিষ্ণুবর্ধনের শাসনকাল একাধিক “গৌরবময়” সামরিক অভিযানে পূর্ণ ছিল।[৪] ইতিহাসবিদ সেন, চোপরা ও শাস্ত্রীর মতে, বিষ্ণুবর্ধন ছিলেন একজন “মহান সৈনিক” ও “উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজা”।[৫][৬][৭]
বিষ্ণুবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় কন্নড় ভাষায় হোয়সল সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি শুরু হয়। গণিতজ্ঞ রাজাদিত্য গণিত বিষয়ে ব্যবহারগণিত ও লীলাবতী রচনা করেন। ইতিহাসবিদ ই. পি. রাইসের মতে, মহাকাব্যের কবি নাগচন্দ্র বিষ্ণুবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম কন্নড় রামায়ণ (একটি জৈন পাঠান্তর) রচনা করেন। এই গ্রন্থটির নাম ছিল রামচন্দ্র চরিত পুরাণ। এছাড়া তিনি নবম জৈন তীর্থঙ্কর মাল্লীনাথের জীবন অবলম্বনে মাল্লীনাথপুরাণ নামে একটি মহাকাব্যও রচনা করেন।[৮][৯][১০][১১]
বিষ্ণুবর্ধন তার দাদা প্রথম বীর বল্লালের শাসনকালে গঙ্গাবাডি অঞ্চলের প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। হোয়সল রাজসিংহাসনে আরোহণের পর ১১১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চোল নিয়ন্ত্রণাধীন গঙ্গাবাডি অঞ্চলে সামরিক অভিযানে যান। এটিই তার প্রথম উল্লেখযোগ্য সামরিক সাফল্য। ইতিহাসবিদ কামাথের মতে, বিক্ষুব্ধ চোল প্রাদেশিক শাসক আদিগৈমন সম্ভবত এই অভিযানে বিষ্ণুবর্ধনকে সাহায্য করেছিলেন। আদিগৈমন বৈষ্ণব হিন্দু হওয়ায় রাজা প্রথম কুলোতুঙ্গ চোল সম্ভবত তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না।[১২][১৩] তবে শাস্ত্রী দাবি করেন যে, আদিগৈমনের সাহায্য পাওয়ার আগে বিষ্ণুবর্ধন তাকে পরাজিত করেছিলেন।[৫] ১১১৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই বিষ্ণুবর্ধন নীলগিরি অঞ্চলের অন্যান্য শাসকদের পরাজিত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন চেঙ্গলব, কোঙ্গলব (ইতিহাসবিদ ডেরেটের মতে, এই যুদ্ধের পরিণতিতেই কোঙ্গলব রাজকুমারী চণ্ডালদেবীর সঙ্গে বিষ্ণুবর্ধনের বিবাহ হয়) ও নিডুগল চোল শাসক ইরুক্কবেল। কামাথের মতে, বিষ্ণুবর্ধনের বাহিনী কাঞ্চী পর্যন্ত সামরিক অভিযানে গিয়েছিল। নোলাম্ববাডির নোলাম্ব, বনবাসীর কদম্ব ও গোয়া (দ্বিতীয় জয়কেশীর শাসনাধীনে), উচ্চাঙ্গীর পাণ্ড্য (তুঙ্গভদ্রার কাছে একটি ছোটো রাজবংশের শাসকবর্গ), তুলুনাডুর আলুপা এবং হোসাগুন্ডার সান্তারা রাজবংশ বিষ্ণুবর্ধনের অধীনতা স্বীকার করে তাকে কর দিতেন।[৫][১৪][১৫] সেই যুগের হোয়সল উৎকীর্ণ লিপিগুলি থেকে বিষ্ণুবর্ধনের নীলগিরি অভিযানের কথা জানা যায়। চমরাজনগর লিপি থেকে জানা যায় যে, তার সেনাবাহিনী নীলগিরি পর্বতমালা অতিক্রম করেছিল। এই লিপিতে তাকে ‘কেরলের প্রভু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ চোপরা, রবীন্দ্রন ও সুব্রহ্ম্যণমের মতে, অন্যান্য নথি থেকে জানা যায় যে, চোল বিজয়ের পর তিনি সাময়িকভাবে কাঞ্চীতে অবস্থান করেছিলেন। চোল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণও ছিলেন বিষ্ণুবর্ধন।[৬] এই সব সামরিক অভিযানে সাফল্য অর্জনের পর বিষ্ণুবর্ধন ‘টালাকাডুগোন্ডা’ (‘টালাকাডের প্রভু’) ও ‘নোলাম্বাবাডি গোন্ডা’ (‘নোলাম্বাদের প্রভু’) উপাধি গ্রহণ করেন।[১৬]
দক্ষিণে সামরিক অভিযানগুলিতে সাফল্য অর্জনের পর বিষ্ণুবর্জন তার নিজের ঊর্ধ্বতন শাসক পশ্চিম চালুক্য রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের কর্তৃত্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন। ১১১৭ থেকে ১১২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বিষ্ণুবর্ধন কেন্নাগলে (১১১৮ খ্রিষ্টাব্দ) চালুক্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করলেন। এরপর তিনি হাঙ্গলের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ একটি দুর্গ অধিকার করেন এবং হাল্লুরে চালুক্য সেনাপতি বোপ্পান্নাকে পরাজিত করেন (১১২০ খ্রিষ্টাব্দ)। এরপর তিনি বনবাসী ও হুমচ অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করলেন। ১১২২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি কৃষ্ণা নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। সেখানে শক্তিশালী সিন্ড দলপতি আচুগি তাকে পরাজিত করেন। আচুগি ছিলেন চালুক্য সম্রাটের অনুগত এক সেনাপতি। এই জন্য বিষ্ণুবর্ধনকে কিছুকালের জন্য চালুক্য সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করতে হয়েছিল।[৭][১৪][১৭] কিন্তু বেশিদিন তাকে চালুক্য সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতে হয়নি। ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর ১১৪০ সালের মধ্যে তিনি হাঙ্গল, উচ্চাঙ্গী ও কাঙ্কাপুরা পুনর্দখল করেন এবং তুঙ্গভদ্রা নদীর উত্তরে লাককুন্ডি পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।[১৪][১৮] ইতিহাসবিদ মজুমদার দাবি করেন যে, ১১৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই বিষ্ণুবর্ধন কৃষ্ণা নদী অববাহিকা অধিকার করেছিলেন এবং চালুক্যদের অধীনে নামমাত্র শাসক হওয়া সত্ত্বেও সার্বভৌমিকতার প্রতীক স্বরূপ ‘তুলাপুরুষ’ যজ্ঞ করেছিলেন।[১৯] বিষ্ণুবর্ধন কোন সালে মারা গিয়েছিলেন, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। শাস্ত্রী, এস. কে. আয়াঙ্গার ও দেসাই মনে করেন, তিনি ১১৫২ সালে মারা যান। তবে কামাথ দাবি করেছেন যে, বিষ্ণুবর্ধন যে তার কিছুকাল আগেই মারা গিয়েছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ, ১১৪৫ খ্রিষ্টাব্দের যল্লদহল্লির নথি থেকে জানা যায়, বিষ্ণুবর্ধনের পুত্র প্রথম নরসিংহ তখন হোয়সল রাজা ছিলেন।[১৪]
বিষ্ণুবর্ধন ছিলেন একজম মহান স্থপতি। চোলদের বিরুদ্ধের তার বিজয় উদ্যাপন করার জন্য তিনি টাকাকাডে কীর্তিনারায়ণ মন্দির ও বেলুরে বীরনারায়ণ মন্দির নামে দুটি সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেন। বীরনারায়ণ মন্দিরটি চেন্নাকেশব মন্দির নামেও পরিচিত। এই দুটি মন্দিরই ছিল হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর মন্দির।[১২] একই সময়ে তিনি হালেবিডুতে হোয়েসলেশ্বর মন্দির নামে শিবের একটি মন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরটি ছিল আরও সুন্দর।[২০][২১] বেলুর ও হালেবিডুর মন্দিরগুলি প্রস্তাবিত ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। [২২] চেন্নাকেশব মন্দিরের থেকে তুলনায় ছোটো হলেও কাপ্পে চেন্নিগরায় মন্দির নামে সুন্দর একটি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন বিষ্ণুবর্ধনের রানি শান্তলাদেবী। [২৩]
পূর্বসূরী প্রথম বীর বল্লাল |
হোয়সল ১১০৮–১১৫২ |
উত্তরসূরী প্রথম নরসিংহ |