বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানে (ইংরেজি: Dendrochronology) বা বৃক্ষ-চক্র ডেটিং হল বৃক্ষের চক্র বা বৃদ্ধিচক্রের নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বয়স নির্ধারণের (ডেটিং) বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিভিন্ন ধরনের কাঠে, অতীতে কোন সময়ে বৃক্ষের কোন চক্র গঠিত হয়েছিল তা বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানের মাধ্যমে হুবহু নির্ধারণ করা সম্ভব। এর প্রয়োগের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছেঃ প্রত্নবাস্তুবিদ্যা, যেখানে অতীতের বাস্তুবিদ্যার কিছু দিক (বিশেষত জলবায়ু) নির্ধারণের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়; প্রত্নতত্ত্ব, যেখানে পুরোনো স্থাপনার বয়স নির্ধারণে এটি ব্যবহৃত হয়; এবং রেডিওকার্বন ডেটিং, যেখানে এটি রেডিওকার্বনের বয়স নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের কিছু অঞ্চলে অল্প কয়েক হাজার থেকে শুরু করে বেশ কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত কাঠের বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব। সাম্প্রতিককালে, বর্তমান থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ ১১ হাজার বছর অতীত পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে কালক্রম পাওয়া গেছে।[১]
বিংশ শতকে প্রথমভাগে জোতির্বিদ এ. ই. ডগলাস বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞান প্রবর্তন করেন। তাঁর হাতেই অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষ-চক্র গবেষণা পরীক্ষাগার গড়ে উঠে। ডগলাস সৌরকলঙ্কের কার্যকলাপের আবর্তন ভালোভাবে বুঝার চেষ্টা করেন এবং যুক্তি দেন যে, সৌর কার্যকলাপের পরিবর্তন পৃথিবীর জলবায়ুর রীতিকে প্রভাবিত করবে যা পরবর্তীকালে বৃক্ষ-চক্রের বৃদ্ধির নমুনা দ্বারা লিপিবদ্ধ হবে।
বৃক্ষের কান্ডের অনুভূমিক প্রস্থচ্ছেদ করলে বৃদ্ধি চক্র বা বৃক্ষ চক্র বা বর্ষবলয় দেখতে পাওয়া যায়। বৃদ্ধি চক্র হল ভাস্কুলার ক্যাম্বিয়ামের (বাকলের কাছাকাছি একটি কোষের স্তর যাকে পার্শ্বীয় ভাজক কলা বলা হয়) নতুন বৃদ্ধির ফলাফল। ব্যাসের এই বৃদ্ধি, সেকেন্ডারি বৃদ্ধি বলে পরিচিত। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বৃদ্ধির গতির পরিবর্তনের পরিণাম হল এসব দৃশ্যমান চক্র। একটি চক্র দিয়ে এক বছর সময়কাল নির্দেশিত হয়। শীতপ্রধান অঞ্চলে ঋতুর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য থাকার কারণে এসব চক্র অধিকতর দৃশ্যমান।
বৃদ্ধি চক্রের ভেতরের অংশটি বৃদ্ধি ঋতুতে গঠিত হয়। এসময় বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে দ্রুত হয়, যে কারণে কাঠ হয় তুলনামূলক কম ঘন। বৃদ্ধি ঋতুতে তৈরি হওয়া ভেতরের এই কাঠকে “আর্লি উড” বা “বসন্ত কাঠ” বা “বসন্তশেষ কাঠ” বলা হয়। চক্রের বাইরের অংশটিকে বলা হয় “লেট উড”। একে মাঝে মাঝে গ্রীষ্মকালিন কাঠ বলেও ডাকা হয়। এটি হয় অধিকতর ঘন।[২] বসন্ত কাঠ বলার চেয়ে ভেতরের অংশে তৈরি হওয়া কাঠকে আর্লি উড বলাই ভালো, কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে এই কাঠ গ্রীষ্মের শুরুর দিকে (যেমন, কানাডায়) অথবা শরতে (যেমন কিন্তু ভূমধ্যসাগরীয় প্রজাতিতে) গঠিত হয়।
শীতপ্রধান দেশের অনেক বৃক্ষ প্রতি বছর বাকলের লাগোয়া সবচেয়ে নতুন একটি মাত্র চক্র তৈরী করে। বৃক্ষের পুরো জীবনকালে বছর বছর গড়ে উঠা চক্রের নমুনা, বৃক্ষ যেখানে বড় হয়েছে, সেই এলাকার জলবায়ুগত অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। পর্যাপ্ত আর্দ্রতা এবং দীর্ঘ বৃদ্ধি-ঋতু জন্ম দেয় প্রশস্ত চক্রের। যে বছর খরা হয় সে বছরের চক্র হয় অপ্রশস্ত। পর্যায়ক্রমিক খারাপ এবং উপযোগী অবস্থা, যেমন মধ্য গ্রীষ্মে খরা, একই বছরে কয়েকটি চক্রের জন্ম দিতে পারে। ওক এবং এলম বৃক্ষে উধাও চক্র খুব বিরল- ওক বৃক্ষে উধাও হয়ে যাওয়া চক্রের একমাত্র লিপিবদ্ধ ঘটনা পাওয়া যায় ১৮১৬ সালে যেটি গ্রীষ্মবিহীন বর্ষ বলে পরিচিত।[৩] একই এলাকায় বড় হওয়া বৃক্ষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে একই ধরনের প্রশস্ত চক্রের জন্ম দেয়। এই ধরনগুলো একই ভৌগোলিক অঞ্চলে এবং একই জলবায়ুগত পরিবেশে বেড়ে ওঠা বৃক্ষের চক্রের সাথে তুলনা করা যায় ও সাদৃশ্য পাওয়া যায়। জীবন্ত বৃক্ষ থেকে এসব বৃক্ষ-চক্রের ধরনগুলো অনুসরণ করে পেছনের দিকে গিয়ে পুরো অঞ্চলের অথবা পৃথিবীর উপ-অঞ্চলগুলোর কালপঞ্জি তৈরী করা সম্ভব। এভাবে প্রাচীন স্থাপনাগুলোর কাঠকে জানা কালপঞ্জির সাথে মিলানো যেতে পারে (এই কৌশলকে ক্রস-ডেটিং বলে), এবং কাঠের বয়স সঠিকভাবে নির্ণয় করা যেতে পারে। কম্পিউটারগুলো পরিসংখ্যানগত সহায়তা প্রদানের জন্য উপযোগী হয়ে উঠার আগ পর্যন্ত ক্রস-ডেটিং সাধারণত দৃষ্টিনির্ভর পরীক্ষণের উপর নির্ভর ছিল।
বৃক্ষ-চক্র বৃদ্ধির একক ভিন্নতা এড়ানোর জন্য বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা একটি চক্রের ইতিহাস তৈরীর জন্য একাধিক বৃক্ষের নমুনা থেকে বৃক্ষ-চক্রের মসৃণ গড় নিয়ে থাকেন। এই পদ্ধতিকে রেপ্লিকেশন বা পুনরাবৃত্তি বলে। যে বৃক্ষচক্র ইতিহাসের শুরুর এবং শেষের তারিখ জানা নেই তাকে ফ্লোটিং ক্রোনোলজি বা অনির্দিষ্ট কালপঞ্জি বলা হয়। এক্ষেত্রে একে বিশ্বস্ত করে তোলার জন্য আরেকটি জানা কালপঞ্জির (বৃক্ষচক্র ইতিহাস) সাপেক্ষে অজানাটি মিলিয়ে দেখা হয়। সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কালপঞ্জির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ জার্মানির রিভার ওক বৃক্ষ, এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের পাইন যাদের সঠিক চক্রের ইতিহাসের ব্যাপ্তি ১১ হাজার বছরেরও বেশি।[১][৪][৫] এছাড়াও, এই দুইটি স্বতন্ত্র বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞান-সংক্রান্ত অনুক্রমের পারস্পরিক সঙ্গতি তাদের তেজস্ক্রিয় কার্বনভিত্তিক এবং বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানে-সংক্রান্ত বয়স দ্বারাও নিশ্চিত করা হয়েছে।[৬] আরেকটি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য কালপঞ্জি হল দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিসলকোন পাইনের যা ৮৫০০ বছর অতীত পর্যন্ত ব্যাপ্ত।[৭] ২০০৪ সালে, বৃক্ষ এবং সামুদ্রিক তলানির সর্বসম্মত বিশ্বব্যাপি উপাত্ত সেটের উপর ভিত্তি করে, INTCAL04 নামে একটি নতুন ক্রমাঙ্কণ বক্ররেখাকে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যা বর্তমানকাল থেকে শুরু করে ২৬,০০০ বছর পর্যন্ত অতীতের তারিখ প্রদান করে।[৮]
কাঠের কোর’র নমুনা বার্ষিক বৃদ্ধি চক্রের প্রশস্ততা পরিমাপ করে। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান এবং বিভিন্ন স্তর থেকে নমুনা নিয়ে গবেষকরা সর্বাঙ্গীণ ঐতিহাসিক ক্রম তৈরী করতে পারেন যা বৈজ্ঞানিক নথির একটি অংশ হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন স্থাপনায় প্রাপ্ত প্রাচীণ কাঠের ক্ষেত্রে কাঠের বয়সের একটি সর্বোচ্চ সীমা ধার্য করে এর বয়স এবং এর উৎস বৃক্ষ কখন বেঁচে ছিল এবং বেড়ে উঠছিল তা নির্ধারণ করা যায়। এ ধরনের বিশ্লেষণের জন্য বৃক্ষের কয়েকটি গণ অন্যান্য গণের চাইতে সুবিধাজনক। একইভাবে, যেসব জায়গাতে বৃক্ষরা প্রান্তিক পরিবেশে, যেমন শুষ্ক বা প্রায়-শুষ্ক, বেড়ে উঠে, সেসব স্থানের বৃক্ষের ক্ষেত্রে বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানের কৌশলগুলো আর্দ্র এলাকায় বেড়ে উঠা গাছের চাইতে সঙ্গতিপূর্ণ। এই হাতিয়ারগুলো শুষ্ক দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থানীয় আমেরিকানদের দুরারোহ পর্বতগাত্রের কাঠের প্রত্নতাত্ত্বিক তারিখ প্রদানের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানীরা অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ, পিঁপড়ার কিছু প্রজাতি আছে যারা বৃক্ষে বসবাস করে এবং কাঠের মাঝে তাদের সুড়ঙ্গ তৈরী করে যা চক্রের গঠনকে ধ্বংস করে দেয়।
যেসব অঞ্চলের জলবায়ু যুক্তিসংগত কারণে আন্দাজ করা যায়, বিভিন্ন বছরে সেখানকার বৃক্ষরাজি আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, মাটির পিএইচ, গাছের পুষ্টি, কার্বনডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব, ইত্যাদির উপর নির্ভর করে নানান বৈশিষ্ট্যের বর্ষবলয়ের বিকাশ ঘটায়। এসব প্রকরণ অতীত জলবায়ুর ভিন্নতা অনুমান করতে বৃক্ষ-জলবায়ুবিজ্ঞানে (ডেনড্রোক্লাইমেটোলজি) ব্যবহার করা হয়।
একটি প্রাপ্ত কাঠের নমুনাতে বৃক্ষ চক্রের বৃদ্ধির ভিন্নতা থেকে কেবল বাৎসরিক মিলই নয়, এমনকি এর দ্বারা অবস্থানও মিলিয়ে ফেলা যায়, কারণ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশের জলবায়ু এক হয় না। এর ফলে বিভিন্ন জাহাজ ছাড়াও কাঠ থেকে তৈরী ক্ষুদ্র হস্তনির্মিত বস্তু যা অনেক দূর থেকে এসেছে, যেমন চিত্রকর্মের জন্য প্যানেল, সেসবের উৎস নির্ণয় করা সম্ভব।
প্যানেল চিত্রকর্মের উৎস ও তারিখ প্রদানের ক্ষেত্রে শিল্পকলার ইতিহাসবিদদের কাছে বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক প্রাচীন নেদারল্যান্ডের চিত্রকর্ম, হানসিয়াটিক লীগের বন্দর হয়ে ভিস্টুলা অঞ্চল থেকে জাহাজের মাধ্যমে আসা “বাল্টিক ওক” এর প্যানেলের উপর অঙ্কিত হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয়েছে ।[৯]
কাঠ থেকে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনার তারিখ প্রদানের ক্ষেত্রে বৃক্ষচক্রীয় কালনিরূপণবিজ্ঞানের ব্যবহার হয় । এর একটি উদাহরণ হল মেসাচুসেটস এর ডেডামে অবস্থিত ফেয়ারব্যাংক হাউস । বাড়িটি প্রায় ১৬৪০ সালে নির্মিত হয়েছে বলে দাবী করা হত (এটি উত্তর আমেরিকার সবচাইতে পুরোনো কাঠের ফ্রেমের বাড়ি)। গ্রীষ্মের কড়িকাঠ থেকে নেয়া কাঠের নমুনা কোর থেকে প্রাপ্ত তথ্য সুনিশ্চিত করে যে, এই কাঠ ১৬৩৭-১৬৩৮ সালে কর্তনকৃত একটি গাছের। আরেকটি কড়িকাঠের অতিরিক্ত নমুনা ১৬৪১ সালের তারিখ উৎপন্ন করে যার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেল যে বাড়িটি ১৬৩৮ সাল থেকে শুরু করে ১৬৪১ সালের কিছুকাল পরে পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়, যেহেতু নতুন ইংল্যান্ডে ঐ সময়ে স্থাপনাতে ব্যবহারের পূর্বে কাঠকে পোক্ত বা সিজন করা হয়নি।[১০]
|অধ্যায়=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)