বৃহৎ জারণ ঘটনা বা Great Oxidation Event (GOE) হল ২.৪ গিগাবর্ষ থেকে ২.১-২.০ গিগাবর্ষ আগে ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের প্যালিওপ্রোটেরোজেয়িক যুগের একটি ঘটনা, যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে এবং অগভীর সমুদ্রে অক্সিজেনের পরিমাণ অভুতপূর্ব হারে বৃদ্ধি পায়।[২] এটি বৃহৎ অক্সিজেনযোজন ঘটনা, অক্সিজেন বিপর্যয়, অক্সিজেন সংকট, অক্সিজেন হলোকস্ট[৩] বা অক্সিজেন বিপ্লব ইত্যাদি নামেও পরিচিত। ভূতাত্ত্বিক, আইসোটপিক এবং রাসায়নিক লক্ষণ থেকে অনুমান করা হয় জৈব-উৎসগত আণবিক অক্সিজেন (ডাইঅক্সিজেন, O2) বায়ুমণ্ডলে সঞ্চিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলকে বিজারক থেকে জারক অবস্থায় নিয়ে আসে।[৪] বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে বিভিন্ন অনুমান করা হলেও এ ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও অস্পষ্ট।[৫]
অক্সিজেন সঞ্চয়ের সময়রেখা থেকে জানা যায় যে, সর্বপর্থম মুক্ত O2 উৎপাদন করেছিল প্রথমে প্রোক্যারিওট এবং এরপর ইউক্যারিওট অণুজীব, যারা সালোকসংশ্লেষণে উচ্চদক্ষতা অর্জন করেছিল এবং এই ক্রিয়ার বর্জ্য হিসাবে অক্সিজেন নির্গত করত।[৬][৭] একটি ধারণামতে O2 তৈরিকারী প্রথম সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলো বৃহৎ জারণ ঘটনাকালের আগেই O2 উৎপাদনকারী প্রথম সায়ানোব্যাকটেরিয়াগুলোর উত্থান ঘটে[৬][৮] (এখন থেকে ২.৭–২.৪ গিগাবর্ষ বা তারও আগে[২][৯][১০])। কিন্তু সালোকসংশ্লেষণে O2 এর পাশাপাশি জৈব কার্বনও উৎপন্ন হয়, যা অক্সিজেন থেকে পৃথক না হলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন সঞ্চিত হতে পারত না। তাই অক্সিজেন সঞ্চয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে জৈব কার্বন, সালফাইড, এবং ফেরাস (Fe2+যুক্ত) খনিজ দ্রব্য মাটিতে শোষিত হওয়া।[১১] জৈব কার্বন এবং পাইরাইট জারণের আগেই মাটিতে শোষিত হওয়ার ফলে সব মিলিয়ে প্রতি বছর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ১৫.৮±৩.৩ টেরামোল (Tmol) (১ টেরামোল = ১০১২ মোল) O2 যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ অক্সিজেন উৎস হতে যোগাত্মক অক্সিজেন প্রবাহ বিদ্যমান রয়েছে।
অক্সিজেনের বৈশ্বিক উৎস এবং শোষকের পার্থক্য থেকে O2 মাত্রা পরিবর্তনের হার গণনা করা যায়।[১২] শোষকের মধ্যে রয়েছে বিজারক গ্যাস এবং আগ্নেয়গিরিজাত খনিজ দ্রব্য, রাসায়নিক রূপান্তর এবং ক্ষয়।[১২] অক্সিজেনের শোষকের পরিমাণের তুলনায় O2 উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির আগে অক্সিজেন বিপর্যয় শুরু হয় নি।[১৩]
ক্ষয়জনিত কারণে, এবং আগ্নেয়গিরি, রূপান্তর এবং সামুদ্রিক পরিস্রাবণ ও তাপ নির্গমনে উৎপন্ন বিজারক গ্যাস ও খনিজ দ্বারা বর্তমানকালে প্রতিবছর প্রায় ১২.০ ± ৩.৩ T mol O2 বায়ুমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।[১২] অন্যদিকে, আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রায় ৫.৭ ± ১.২ T mol O2 বিজারক গ্যাসের সাথে যুক্ত হয়ে থাকে।[১২]
তবে প্রারম্ভিক পৃথিবীতে মহাদেশীয় ভূখণ্ডে জারক উপাদানের পরিমাণ খুবই কম ছিল, এবং এভাবে শোষিত অক্সিজেনের পরিমাণ, বিজারক গ্যাস ও সামুদ্রিক জলে দ্রবীভূত লোহায় শোষিত অক্সিজেনের পরিমাণের তুলনায় নগন্য ছিল। ওই সময় উৎপন্ন মুক্ত অক্সিজেন দ্রবীভূত লোহার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় Fe এবং Fe2+ থেকে অদ্রব্য ম্যাগনেটাইট () তৈরি করত, যা সমুদ্র তলে সঞ্চিত হয়ে পরবর্তীতে স্তরীভূত লোহাগঠিত শিলায় পরিণত হয়।[১৩] অক্সিজেন শোষক নি:শেষ হতে প্রায় ৫ কোটি বছর বা আরও বেশি সময় লেগেছিল।[১৪]
সালোক সংশ্লেষ এবং সংশ্লিষ্ট জৈবদ্রব্যের সমাধির হারও অক্সিজেন সঞ্চয়ের মাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। ডেভোনিয়ান যুগে স্থলজ উদ্ভিদ ভূ-খণ্ডে বিস্তৃত হলে কার্বন সমাধির মাত্রা বাড়তে থাকে এবং তার ফলে মুক্ত অক্সিজেনের মাত্রায় ক্রমবৃদ্ধি ঘটতে থাকে।[১৫] বর্তমানকালে, বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত একটি O2 অণু, স্থলজ শোষকে শোষিত হবার আগে গড়ে প্রায় ২০ লাখ বছর মুক্তভাবে বিচরণ করতে পারে।[১৬] অবশ্য ভূ-তাত্ত্বিক সময়ের সাপেক্ষে এই সময়কাল নগন্য, অতএব ফ্যানেরোজোয়িক যুগে অবশ্যই এমন কোন প্রক্রিয়া চলমান ছিল যা অক্সিজেনের মাত্রাকে জীবনের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখত।
সময় পরিক্রমায়, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়, যার দুটি প্রধান ফলাফল দেখা যায়।
প্রথমত, একটি প্রস্তাব করা হয়েছে যে, অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলীয় মিথেনকে জারিত করে CO2 এবং পানি গঠন করেছে। এর ফলে পৃথিবীর গ্রিনহাউজ প্রভাব প্রশমিত হয়, এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাস পায়, এবং এসময় হিউরোনিয়ান হিমায়ন শুরু হয় যা ২.৪৫–২.২ গিগাবর্ষ সময়কালে চলমান ছিল।[১৭][১৮][১৯] দক্ষিণ আফ্রিকায় চতুর্থ একটি হিমপর্যায়ের লক্ষণ পাওয়া গেছে, যার বয়স ~২.২২ গিগাবর্ষ। তবে এই হিমায়ন নিম্ন উচ্চতায় ঘটেছিল এবং এর প্রভাব সমুদ্রপৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছেছিল বলে একে স্নোবল পৃথিবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করা হয়।[২০]
দ্বিতীয়ত, O2 এর মাত্রাবৃদ্ধি জৈব বৈচিত্র্যকে ত্বরান্বিত করে, এবং শিলা, বালু, মাটি ও অন্যান্য ভূ-স্তরীয় উপাদানের সঙ্গে বায়ু, সমুদ্র ও অন্যান্য পৃষ্ঠতলীয় জলের মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। জৈব উপাদানের প্রাকৃতিক পুনর্ব্যবহার সত্ত্বেও অক্সিজেন সহজলভ্য হবার আগে প্রাণধারণের জন্য শক্তির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিপাকীয় বিবর্তনের মাধ্যমে জীবের উপলদ্ধ মুক্ত শক্তির কার্যকারিতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, যা বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, বৃহৎ জারণ ঘটনার পরেই মাইটোকন্ড্রিয়ার উদ্ভব ঘটে, যার সহায়তায় ক্রমাগত জটিলতর পরিবেশের উপযুক্ত শারীরবৃত্তিক প্রক্রিয়ার সামর্থ্য জীবদেহে তৈরি হয়। (যদিও এদের কার্যকর বিবর্তন সম্পন্ন হতে প্রোটেরোজোয়িকের অবসান এবং ক্যামব্রিয়ান যুগ পর্যন্ত সময় লেগেছে)।[২১]
প্যালিওসল (ফসিল মাটি), শিলাবর্জ্য কণা, এবং রেড বেড হল স্বল্প-মাত্রার অক্সিজেনের উপস্থিতির স্থলজ কিছু চিহ্ন।[১২] ২.৪ গিগাবর্ষের চেয়ে পুরোনো প্যালিওসলে লোহার উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অল্প, যা অক্সিজেন পরিস্থিতি নির্দেশ করে।[২২] ২.৪ গিগাবর্ষের চেয়ে পুরোনো শিলার বর্জ্য কণাতে যেসব উপাদান পাওয়া গেছে, তা-ও কেবল অক্সিজেনবিহীন বা স্বল্প-অক্সিজেনধারী পরিবেশে বিদ্যমান থাকতে পারে।[২৩] রেড বেড হল হেমাটাইট আস্তরণযুক্ত লালচে বেলেপাথর, যা লোহার জারণের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্তিতিকে নির্দেশ করে।[২৪]
স্তরীভূত লোহা (banded iron) হল এক ধরনের পাললিক শিলা, যাতে লৌহ অক্সাইড (ম্যাগনেটাইট, Fe3O4 অথবা হেমাটাইট, Fe2O3) এবং লৌহমুক্ত শিলার ধারাবাহিক স্তর দেখা যায়[২৫]। বৃহৎ জারণ ঘটনার শুরুর দিকে এধরনের শিলার প্রাচুর্য পাওয়া যায়,[২৬], এবং ১.৮ গিগাবর্ষ পূর্বের সময় হতে ক্রমে হ্রাস পায়। প্রচলিত ধারণামতে, সায়ানো্ব্যা্ক্টেরিয়ার বিমুক্ত অক্সিজেন সমুদ্রের পানিতে উপস্থিত লোহার সাথে অদ্রবণীয় আয়রন অক্সাইড গঠন করে এবং স্তর আকারে সমুদ্রতলে অক্সিজেনবিহীন কাদামাটির মধ্যে সঞ্চিত হতে থাকে।[২৭] ধরে নেয়া হয় যে শুরুতে পৃথিবীর সমুদ্রে লোহা ও নিকেলের প্রাচুর্য ছিল। সালোকসংশ্লেষী প্রাণের বিবর্তনের ফলে অক্সিজেন মুক্ত হতে শুরু করে, যা সমুদ্র থেকে আয়রন অক্সইড রূপে বিমুক্ত হয়। যখন সমদ্রভাগ সম্পূর্ণভাবে অক্সিজেনপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেসময় O2 উৎপাদন মাত্রার ক্ষুদ্র বিচ্যূতির ফলে ধারাবাহিকভাবে যথাক্রমে মুক্ত অক্সিজেন এবং স্তরীভূত লোহার অক্সাইড সঞ্চিত হয়।
ভূত্বকের লৌহসঞ্চয়ের লোহাবিজড়িত (ferruginous) এবং ইউক্সিনিক (অক্সিজেনবিহীন এবং সালফাইডের অধিক্য) অবস্থা, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা নির্দেশ করতে সাহায্য করে।[২৮] অক্সিজেনশূন্য বায়ুমণ্ডলে মোট লৌহউপাদানের মধ্যে ফেরুজিনাস এবং ইউনিক্সিক লোহার অনুপাত, অক্সিজেনশূন্য গভীর সাগরে অনুরূপ অনুপাত থেকে কম দেখা গেছে।[২৯] এর একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, বৃহৎ জারণের আগেই, ২.৬-২.৫ গিগাবর্ষ পূর্বে, অগভীর সাগরের পরিবেশ তার অন্তস্থিত অণুজীবমণ্ডল দ্বারা জাড়িত হয়ে গিয়েছিল।[১২][২৯] গভীর সাগরে ফেরুজিনাস এবং ইউক্সিনিক পললের মাত্রা এবং স্তরীভূত লৌহ সংগঠনের লক্ষণ পারস্পরিক সামঞ্জস্য প্রদর্শন করে।[১২]
দুই ধরনের আইসোটোপ ফ্র্যাকশনায়ন বিবেচনা করা যায়: ভরভিত্তিক ফ্র্যাকশনায়ন (MDF) এবং ভরমুক্ত ফ্র্যাকশনায়ন (MIF)। সামুদ্রিক পললে অক্সিজেন-ভিত্তিক আইসোটোপে সঞ্চয়, যেমন কার্বন, সালফার, নাইট্রোজেন, এবং অবস্থান্তর ধাতু (ক্রোমিয়াম, মলিবডেনাম, লোহা), এবং অন্যান্য অধাতব মৌল (যেমন সেলেনিয়াম), প্রভৃতির উপস্থিতি MDF এর প্রমাণ।[১২]
উদাহরণস্বরূপ, সমুদ্রতলে গঠিত প্রাচীন শিলায় ক্রোমিয়ামের মাত্রায় আকস্মিক স্ফীতি ইঙ্গিত করে যে মহীসোপান থেকে ক্রোমিয়াম সংগ্রহ জলে মিশে গিয়েছিল।[৩০] কিন্তু ক্রোমিয়াম যেহেতু সহজে দ্রবীভূত হয় না, সেহেতু এর অবমুক্তির জন্য সালফিউরিক এসিডের মত শক্তিশালী এসিডের উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল, যা পাইরাইটের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়ে থাকতে পারে।[৩১]
বৃহৎ জারণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল যে, MIF সালফার আইসোটোপ, যা কেবল অক্সিজেনশূন্য বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত থাকতে পারে, তা পাললিক শিলা থেকে ২.৪-২.৩ গিগাবর্ষ আগে হারিয়ে যেতে শুরু করে, যা বৃহৎ জারণ সময়কালের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[৩২] MIF আইসোটোপ অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে থাকতে পারে না, কারণ অক্সিজেন (এবং এর আলোকরাসায়নিক ফলাফল, ওজোন স্তর) সালফার ডাইঅক্সাইডের আলোক-বিশ্লেষণ ব্যহত করে। MIF পলল সঞ্চয়ের কার্যকারণ বর্তমানে অনিশ্চিত।[১২]
স্ট্রোমাটোলাইট অক্সিজেনের একটি ফসিল নির্দেশক, এবং সালোকসংশ্লেষণ থেকে অক্সিজেন উৎপত্তির ধারণার সমর্থন প্রদায়ক। এছাড়া পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পিলবারায় সায়ানোব্যাক্টেরিয়ার 2α-মিথাইলহোপেন জৈবনির্দেশক আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এর জৈবনির্দেশক উপাত্ত দূষিত হয়ে গেছে বলে এ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল এখন আর নির্ভরযোগ্য নয় এবং প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত হয় না।[৩৩]
সামুদ্রিক পললস্তরে কিছু মৌল অক্সিজেনের বিভিন্ন মাত্রার জন্য সংবেদনশীলতা দেখায়, যেমন মলিবডেনাম এবং রেনিয়াম ইত্যাদি অবস্থান্তর মৌল ।[৩৪] অ-ধাতব মৌল যেমন সেলেনিয়াম এবং আয়োডিনও অক্সিজেন মাত্রা নির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে।[৩৫]
সালোকসংশ্লেষণ দ্বারা অক্সিজেন উৎপাদন শুরু এবং ভূতাত্ত্বিকভাবে অক্সিজেনের মাত্রাবৃদ্ধি শুরুর মধ্যে প্রায় ৯০ কোটি বছরের পার্থক্য দেখা যায়। এটি ব্যাখ্যার জন্য বিভিন্ন তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে।
কারও কারও মতে অক্সিজেন বিপর্যয়ের একটি কারণ ছিল অক্সিজেনের উৎস বৃদ্ধি। একটি তত্ত্বমতে বৃহৎ জারণ ছিল সালোকসংশ্লেষণের সরাসরি ফল, তবে বেশিরভাগ বিজ্ঞানীর ধারণামতে দীর্ঘকালীন মাত্রাবৃদ্ধিই অক্সিজেন বিপর্যয়ের মূল কারণ।[৩৬] কিছু কিছু মডেলের ফলাফলে কার্বন সমাধির দীর্ঘকালীন বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখা যায়,[৩৭] তবে উপসংহার হিসাবে তা অনিশ্চিত।[৩৮]
অনেকে অক্সিজেন প্রশমক বা শোষকের পরিমাণ কমে যাওয়াকেও বৃহৎ জারণের কারণ হিসেবে দেখেন। একটি তত্ত্ব বলে যে, আগ্নেয়গিরির গ্যাসের উৎপাদিত যৌগসমূহ অতিরিক্ত জারিত ছিল।[১১] আবার অন্য একটি তত্ত্ব অনুসারে এর প্রধান কারণ হল রূপান্তরক গ্যাসের পরিমাণ হ্রাস এবং সার্পেনটাইনাইটায়ন। রূপান্তরক প্রক্রিয়ায় নি:সৃত হাইড্রোজেন এবং মিথেন বাযুমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এবং ধীরে ধীরে অক্সিজেনের তুলনামূলক মাত্রা বৃদ্ধি পায়।[৩৯] বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেন যে বায়ুমণ্ডলের উচ্চস্তরে অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে মিথেন বিভাজিত হয়ে হাইড্রোজেন মহাশূন্যে হারিয়ে যাওয়ার কথা। এই কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল জাড়িত হয়ে অক্সিজেন বৃদ্ধি পেতে পারে, কেননা হাইড্রোজেন বিয়োজনের প্রক্রিয়াই রাসায়নিক হল জারণ।[৩৯]
একটি তত্ত্ব প্রস্তাব করে যে, অক্সিজেন মাত্রাস্ফীতির জন্য ভূ-ত্বকের টেকটোনিক পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়েছিল, যেমন সোপান সমুদ্রের উদ্ভব, যার মাধ্যমে জৈব কার্বনের পললে মিশে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।[৪০] নতুন উৎপন্ন অক্সিজেন প্রথম দিকে সমুদ্রে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ক্ষয় হয়েছিল, বিশেষত লোহার সঙ্গে বিক্রিয়ায়। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে শিলাস্তরে স্তরীভূত লোহা সম্পন্ন সুবিশাল প্রস্তর ভাণ্ডারে, যা দৃশ্যত অক্সিজেন এবং লোহার বিক্রিয়াকালে সঞ্চিত হয়েছিল। বর্তমানে প্রাপ্য অধিকাংশ খনিজ লোহা এসব ভাণ্ডার থেকেই আহরিত। প্রথমদিকে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার অবদান অনুমান করা হলেও, লক্ষণ পর্যালোচনা করে ধারণা করা হয় যে লোহার সঞ্চয়ের কারণ ছিল লৌহ-জারণে সক্ষম অক্সিজেন-অনির্ভর আলোগ্রাহী ব্যাকটেরিয়া।[৪১] ভূ-তাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা গেছে যে ভূ-খণ্ডের সংঘর্ষ দ্বারা মহাদেশীয় ভু-খণ্ড গঠনের সময় প্রতিবারই অক্সিজেনের মাত্রায় লক্ষণীয় স্ফীতি ঘটেছিল। টেকটোনিক চাপে পর্বতমালার উত্থান ঘটে, যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সাগরে সায়ানোব্যাকটেরিয়ার পুষ্টি উপাদানের যোগান দিয়েছিল।[৪২]
প্রারম্ভিক জৈব-বিশ্লেষী জীব সম্ভবত মিথেন উৎপাদন করত, যা আণবিক অক্সিজেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারক, কেননা মিথেন সহজেই অতিবেগুনী বিকিরণ দ্বারা পানি ও কার্বন ডাই অক্সাইডে জাড়িত হয়ে যায়। আধুনিক মিথেন-উৎপাদক অণুজীবের এনজাইম সহউপাদান হিসেবে নিকেলের প্রযোজন পড়ে। ভূ-ত্বক শীতল হতে থাকায় এবং আগ্নেগয়িরি-উদগিরিত নিকেলের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার ফলে O2-উৎপাদক শৈবাল মিথেন-উৎপাদকের চেয়ে অধিক কার্ষক্ষমতা অর্জন করেছিল, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমবৃদ্ধি শুরু হয়।[৪৩] ২.৭ থেকে ২.৪ গিগাবর্ষ পুর্বে নিকেল অবক্ষেপনের হার বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বেশি ছিল।[৪৪]
আরও একটি তত্ত্বীয় কাঠামো রয়েছে, যা বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণের দ্বি-সাম্যাবস্থা (bistability) প্রস্তাব করে: অর্থাৎ O2 মাত্রার দুটি স্থিতিশীল পরিমাণ। এ তত্ত্ব মতে অক্সিজেনের স্থিতিশীল নিম্নমাত্রা হল ০.০২%, যা মিথেন জারণের উচ্চ হার ইঙ্গিত করে। কোন কারণে অক্সিজেনের মাত্রা একটি সীমারেখা অতিক্রম করলে ওজোন স্তরের উদ্ভব ঘটে, যা অতিবেগুনী রশ্মিকে বাধা দেয়। এর ফলস্বরূপ মিথেন জারণ ব্যহত হয় এবং অক্সিজেনের মাত্রা ২১% বা তারও বেশি হয়ে স্থিতিশীলতায় পৌঁছায়। এভাবে অক্সিজেন বিপর্যয় ঘটনাটিকে একটি পর্যায় রূপান্তর প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা যায়, যা ক্রমান্বয়ে স্থিতিশীল নিম্ন- এবং উচ্চ মাত্রায় ভ্রমণশীল।[৪৫][৪৬]
বৃহৎ জারণ ঘটনার ফলে খনিজ বৈচিত্র্যে বিস্ফোরক সমৃদ্ধি ঘটে। বিভিন্ন মৌলের এক বা একাধিক জারিত রূপ ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি পৌঁছে যায়।[৪৭] ধারণা করা হয়, অক্সিজেন বিপ্লবই পৃথিবীতে বর্তমানে বিদ্যমান আনুমানিক ৪,৫০০ খনিজের ভিতর প্রায় ২,৫০০ এরও বেশি রূপের সরাসরি উদ্দীপক। ম্যান্টল এবং ক্রাস্টের পরিবর্তনকারী প্রক্রিয়ার কারণে এই খনিজগুলোর অধিকাংশই হাইড্রেট এবং জারণ হিসেবে উপলদ্ধ।[৪৮]
অ্যান্টার্কটিকার ফ্রাইক্সেল হ্রদে গবেষণাকালে গবেষকরা আবিষ্কার করেন যে স্থূল বরফস্তরের নিচে অতি অক্সিজেনবিরূপ পরিবেশেও অক্সিজেন-উৎপাদক সায়ানোব্যাকটেরিয়াসমূহ O2-যুক্ত পানির পাতলা স্তর (১–২ মিলিমিটার প্রস্থ) তৈরি করতে পারে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে বায়ুমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অক্সিজেন প্রবেশ করার আগেই এধরনের অনুজীবগুলো অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশের জন্য অভিযোজিত হয়ে থাকতে পারে।[৪৯][৫০] কালক্রমে, অক্সিজেনগ্রাহী বায়ুজীবি প্রাণের বিবর্তনের ফলে অক্সিজেনের উপস্থিতির মাত্রায় ভারসাম্য আসে। এ সময় থেকে মুক্ত অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে।
ইউক্যারিওটার উৎপত্তি বিষয়ে একটি প্রস্তাবনা হল, সায়ানোব্যাকটেরিয়ার সালোসংশ্লেষণের ফলে প্রাচীন অণুপরিবেশে অক্সিজেনের মাত্রার বৃদ্ধি পারিপার্শ্বিক জৈবমণ্ডলের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত হয়ে ওঠে, এবং এই পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর সময় আর্কিয়ার একটি শাখা থেকে প্রারম্ভিক ইউক্যারিওটার উত্থান ঘটে।[৫১] প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন যৌগ (বা আরওএস, Reactive oxygen species) উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট জারণ চাপ এবং অন্যান্য পরিবেশমণ্ডলীয় চাপ (যেমন অতিবেগুনী বিকিরণ, বিশুষ্কীকরণ) এর সমন্বিত প্রভাব আর্কিয়ার একাংশের বিবর্তনকে ইউক্যারিওসিসের দিকে ধাবিত করে। এই আর্কিয়া পূর্বসুরী হয়ত ইতোমধ্যেই ডিএনএ যুগল এবং পুনর্মিলনের ভিত্তিতে ডিএনএ মেরামত এবং কোষীয় ফিউশন পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছিল।[৫২][৫৩] অন্তমিথোজীবি প্রাক-মাইটোকন্ড্রিয়া দ্বারা আর্কিয়ার জিনোমে আভ্যন্তরীণ আরওএস এর ফলে মিয়োসিস-ভিত্তিক প্রজননের উদ্ভব ঘটে থাকতে পারে।[৫২] ধারণা করা যায় যে সম্ভবত অক্সিজেনজনিত ডিএনএ ত্রুটির মেরামতের প্রেক্ষিতে ইউক্যারিওটিক প্রজননের বিভিন্ন গুরুত্ববাহী বৈশিষ্ট্য বিকাশ ঘটেছে, যেমন কোষীয় ফিউশন, সাইটোস্কেলেটন-নির্বাহিত ক্রোমোজোম প্রবাহ, নিউক্লীয় মেমব্রেনের উদ্ভব, প্রভৃতি।[৫১]
অর্থাৎ ইউক্যারিওজেনেসিস এবং ইউক্যারিওটিক প্রজননের বিবর্তন ঘটে মূলত ডিএনএ মেরামতের প্রয়োজনীয়তার মধ্য দিয়ে[৫১][৫৪], এবং এর পেছনে বৃহৎ জারণ ঘটনার অতিরিক্ত অক্সিজেনের মাত্রার প্রভাব অনুমান করা যায়।