বৈদ্যুতিক জেনারেটর এক ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্র যা যান্ত্রিক শক্তি বা ক্ষমতাকে বৈদ্যুতিক শক্তি বা ক্ষমতায় রুপান্তরিত করে। অবশ্য ডায়নামো বলতে সাধারণ্যে কেবল জেনারেটরকেই বোঝানো হয়। প্রথম নির্মিত জেনারেটরকে ডায়নামো নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এই বৈদ্যুতিক যন্ত্র গতিশীল তড়িচ্চালক শক্তি উৎপাদনের নীতি ব্যবহার করে এই রুপান্তর ঘটায়। ফ্যারাডের তড়িচ্চুম্বক আবেশের নীতি অনুসারে একটি পরিবাহী যখন চৌম্বক ফ্লাক্সের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তখন এর মধ্যে একটি গতিশীল তড়িচ্চুম্বক আবেশের সৃষ্টি হয়। পরিবাহী পদার্থ বা তারকে আবদ্ধ বর্তনীতে অন্তর্ভুক্ত করলে এর মধ্যে দিয়ে এই ফ্লাক্সের কারণে একটি তড়িৎ প্রবাহ পাওয়া যায়। এভাবেই বিদ্যুতের উৎপত্তি ঘটে। অর্থাৎ তড়িৎ শক্তি উৎপাদন করতে গেলে তিনটি জিনিস আবশ্যক: একটি চৌম্বক ক্ষেত্র, একটি তড়িৎ পরিবাহক এবং গতি। এই তিনের সম্মিলন ঘটিয়েই জেনারেটর নির্মিত হয়। তবে ব্যবহারযোগ্যতা এবং উপযোগিতার কথা চিন্তা করে এর মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন. সংযোজন এবং নকশা অন্তর্ভুক্ত করতে হয়।
যে সকল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের জন্য উচ্চ বিভবের প্রয়োজন পড়ে তাদের ক্ষেত্রে স্থির বৈদ্যুতিক জেনারেটর ব্যবহার করা হত। অন্তরক যন্ত্র অতি উচ্চ বিভব তৈরি করে বলেই সেগুলো নিয়ে সমস্যা রয়েছে। আর তাই স্থির বৈদ্যুতিক জেনারেটর খুব কম শক্তি রেটিংয়ে তৈরি করা হত এবং বাণিজ্যিক বা লাভজনক ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যেখানে অনেক শক্তির দরকার হয় সেখানে এগুলো ব্যবহার করা যেত না। তড়িৎ এবং চুম্বকত্বের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে স্থির বৈদ্যুতিক নীতির উপর ভিত্ত করেই জেনারেটর নির্মিত হত। ব্রিটিশ উদ্ভাবক জেমস উইমহার্স্ট এমন একটি স্থির বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম উইমহার্স্ট যন্ত্র। কিছু স্থির বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন, আধুনিক কালের ফান দ্য গ্রাফ জেনারেটর, নিচের যেকোন মূলনীতি অনুসারে কাজ করতে পারে:
স্থির বৈদ্যুতিক জেনারেটর বলতে তাই মূলত এমন জেনারেটরকে বুঝায় যা উচ্চ বিভব এবং খুবই নিম্ন পর্যায়ের প্রবহমান তড়িৎ উৎপন্ন করে, তথা এটি স্থির তড়িৎ তৈরি করে। সুপ্রাচীন কাল থেকেই স্থির তড়িতের সাথে মানুষ পরিচিত ছিল। কিন্তু এই মাত্র সপ্তদশ শতাব্দীতে স্থির নির্দিষ্ট যন্ত্রের মাধ্যমে এটি তৈরি করা গেছে। সে সময় মানুষ ঘর্ষণের মাধ্যমে স্থির তড়িৎ উৎপাদন করতো। অষ্টাদশ শতাব্দীতে তড়িৎ বিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এই জেনারেটর প্রধান উপকরণ হয়ে উঠে। এ ধরনের কিছু কিছু যন্ত্রকে প্রায়ই "ঘর্ষণ যন্ত্র" বলা হয়ে থাকে।
১৮৩১-১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন যে, একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সাথে লম্ব বরাবর গতিশীল তড়িৎ পরিবাহকের দুই প্রান্তে বিভব পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। এই আবিষ্কারকে ফ্যারাডের তড়িচ্চৌম্বক নীতি বলা হয়। এই নীতির উপর ভিত্ত করে ফ্যারাডেই প্রথম তড়িচ্চৌম্বক জেনারেটর তৈরি করেন যা চল তড়িৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়। তার জেনারেটর তথা ডায়নামোটিকে "ফ্যারাডে ডিস্ক" বলা হয়। অশ্বক্ষুরাকৃতির একটি চুম্বকের দুই মেরুর মাঝখানে স্থাপিত কপার চাকতির ঘূর্ণন ব্যবহার করে এই যন্ত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় যা একটি সমমেরুক জেনারেটরের উদাহরণ। এই ডিস্ক সামান্য পরিমাণ একমুখী প্রবাহ বিভব এবং অনেক বেশি তড়িৎ প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল।
ডায়নামো ছিল প্রথম বৈদ্যুতিক জেনারেটর যা শিল্প কারখানার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। ডায়নামো তড়িচ্চুম্বকত্বের নীতি ব্যবহার করে যান্ত্রিক শক্তিকে খানিকটা স্পন্দনশীল একমুখী তড়িৎ প্রবাহে রুপান্তরিত করে। কম্যুটেটর ব্যবহারের মাধ্যমে একমুখী প্রবাহ পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। ডানামোতে একটি স্থির কাঠামো সুষম চৌম্বক ক্ষেত্র সরবরাহ করে, আর স্থির কাঠামোর ভিতরে কিছু ঘূর্ণনশীল ওয়াইন্ডিং স্থাপিত হয় যারা চৌম্বক ক্ষেত্রকে আড়াআড়িভ বা লম্বভাবে অতিক্রম করে। ছোট আকারের যন্ত্রে কয়েকটি স্থায়ী চুম্বক ব্যবহার করে চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হলেও বড় আকারের যন্ত্রের জন্য সার্বক্ষণিক তড়িচ্চুম্বক সরবরাহ করতে হয় যাকে সাধারণত ক্ষেত্র কুণ্ডলী নামে উল্লেখ করা হয়।
ফ্যারাডের নীতি ব্যবহার করে প্রথম ডায়নামো নির্মিত হয় ১৮৩২ সালে। ফরাসি যন্ত্রপাতি নির্মাতা Hippolyte Pixii এটি তৈরি করেছিলেন। একটি ক্র্যাংকের মাধ্যমে স্থায়ী চুম্বককে ঘুরিয়ে এটি তৈরি করা হয়। ঘূর্ণনশীল চুম্বকটিকে এমনভাবে স্থাপিত করা হয় যাতে এর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু তার দিয়ে পেঁচানো একটি লৌহদণ্ডকে অতিক্রম করে যেতে পারে। Pixii দেখতে পান, প্রতিবার যখন একেকটি মেরু তারের কুণ্ডলীকে অতিক্রম করে তার সাথে সাথেই তারের মধ্যে একটি স্পন্দনশীল তড়িৎ প্রবাহের উৎপত্তি ঘটে। তার উপর দুই মেরুর অতিক্রমের সময় উৎপন্ন প্রবাহদ্বয়ের দিক ছিল বিপরীত। একটি কম্যুটেটর ব্যভহারের মাধ্যমে তিনি এই পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহকে একমুখী তড়িৎ প্রবাহে পরিণত করতে সমর্থ হন।
ফ্যারাডে ডিস্কের তুলনায় Pixii'র ডায়নামো বেশি কর্মক্ষম ছিল। কারণ ডায়নামোত ব্যবহৃত লৌহদণ্ডে শ্রেণী সমবায়ে যত ইচ্ছা তত তারের ওয়াইন্ডিং ব্যবহার করা যেত। আর এ কারণে বেশি পরিমাণে প্রান্তীয় বিভব উৎপন্ন হতো যা একে গ্রহণযোগ্য মাত্রার বিভবে তড়িৎ শক্তি সরবরাহ করতে সক্ষম করে তুলেছিল।
একটি ডায়নামোতে যান্ত্রিক ঘূর্ণন এবং তড়িৎ প্রবাহের মধ্যে সম্পর্কটি প্রত্যাবর্তী। এর মাধ্যমেই পরবর্তীতে বৈদ্যুতিক মোটর নির্মাণ সম্ভব হয়। মোটর এবং জেনারেটর প্রকৃতপক্ষে একটি যন্ত্রের দুটি ভিন্ন কার্যক্রিয়ার নাম। একটি ডায়নামো তার সাথে অভ্যন্তরীনভাবে সংযুক্ত আরেকটি ডায়নামোকে ঘোরাতে পারে (অর্থাৎ দ্বিতীয়টিতে তড়িৎ উৎপন্ন হওয়ার পরিবর্তে তা যান্ত্রিক শক্তি সরবরাহ করবে) যদি দ্বিতীয়টিতে তড়িৎ সরবরাহ করা যায়। যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রুপান্তরিত করে তা থেকে আবার যান্ত্রিক শক্তি লাভের এই প্রক্রিয়ার কারণেই ডায়নামোকে বিদ্যুতের ক্ষতিপূরণ এবং ভারসাম্য রক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
১৮২৭ সালে হাঙ্গেরীয় উদ্ভাবক Anyos Jedlik তড়িচ্চৌম্বক ঘূর্ণনশীল যন্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি এ ধরনের যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন তড়িচ্চৌম্বক আত্ম-ঘূর্ণনশীল যন্ত্র। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি একক-মেরুবিশিষ্ট বৈদ্যুতিক স্টার্টার তৈরি করেন। এই স্টার্টারের স্থির এবং ঘূর্ণনশীল, উভয় অংশই তড়িচ্চৌম্বক ছিল। তিনি আর্নস্ট ভের্নার ফন সিমেন্স এবং চার্লস হুইটস্টোনের ছয় বছর পূর্বেই ডায়নামো ধারণাটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তার ধারণাটি ছিল, স্থায়ী চুম্বকের পরিবর্তে দুইটি বিপরীত তড়িচ্চুম্বক ব্যবহার করে রোটরের চারদিকে চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যেতে পারে।