বৈশালী वैशाली | |
---|---|
প্রাচীন শহর | |
![]() বৈশালীতে অশোকস্তম্বের সিংহমূর্তি | |
বিহারের মানচিত্রে বৈশালীর অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ২৫°৫৯′ উত্তর ৮৫°০৮′ পূর্ব / ২৫.৯৯° উত্তর ৮৫.১৩° পূর্ব | |
দেশ | ![]() |
রাজ্য | বিহার |
জেলা | বৈশালী |
ভাষা | |
• সরকারি | ভোজপুরি, হিন্দি |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় প্রমাণ সময় (ইউটিসি+০৫:৩০) |
বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের একটি শহর। এটি বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিহার রাজ্যের তিরহুত বিভাগের অন্তর্গত একটি প্রত্নক্ষেত্র।[১] বৈশালী ছিল লিচ্ছবির রাজধানী। উল্লেখ্য, খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে লিচ্ছবি ছিল বজ্জি রাষ্ট্রসংঘের (মহাজনপদ) অন্তর্গত প্রথম প্রজাতন্ত্রগুলির অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে বৈশালী প্রজাতন্ত্রের কুণ্ডলগ্রামে ২৪তম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই অঞ্চলটি তাই জৈনদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে এখানেই গৌতম বুদ্ধ মৃত্যুর আগে তার শেষ উপদেশ দিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৩ অব্দে রাজা কালাশোক এখানেই দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির আয়োজন করেছিলেন। তাই বৌদ্ধদের কাছেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান।[২][৩][৪] বৈশালীতে একটি সুসংরক্ষিত অশোকস্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভের শীর্যে একটি মাত্র এশীয় সিংহের মূর্তি দেখা যায়।
গৌতম বুদ্ধ একাধিকবার বৈশালীতে এসেছিলেন। তার সমসাময়িক কালে বৈশালী ছিল একটি সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু শহর। এই জনবহুল শহরে খাদ্যদ্রব্যের প্রাচুর্য দেখা যেত। এই শহরে ৭,৭০৭টি প্রমোদ উদ্যান এবং সমসংখ্যক পদ্ম পুকুর ছিল। এই শহরের রাজনর্তকী আম্রপালি তার সৌন্দর্যের জন্য খ্যাত ছিলেন। এই শহরের সমৃদ্ধির পিছনে তার যথেষ্ট অবদান ছিল।[৫] শহরে তিনটি প্রাচীর ছিল। প্রাচীরগুলির তিন স্থানে নজরদারির জন্য স্তম্ভসহ দরজা ছিল। শহরের বাইরে থেকে হিমালয় পর্বতমালা পর্যন্ত মহাবন নামে একটি বিশাল প্রাকৃতিক বন পরিব্যাপ্ত ছিল। [৬] শহরের কাছে গোসিঙ্গলশাল নামে আরও একটি বন ছিল।[৭]
চীনা পর্যটক ফাহিয়েন (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী) ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণবিবরণীতে বৈশালী শহরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এই বিবরণ অনুসারে ১৮৬১ সালে পুরাতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম অধুনা বিহারের বৈশালী জেলার বাসরাহ গ্রামটিকে প্রাচীন বৈশালী নগর হিসেবে চিহ্নিত করেন।[৮][৯]
বৈশালী নামটি এসেছে মহাভারতের রাজা বিশালের নাম থেকে। এই শহরের অপর নাম ‘বিশালা’।[১০] খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীর থেরবাদী বৌদ্ধ টীকাকার ও পণ্ডিত বুদ্ধঘোষের মতে, এই শহরটি বিশাল হওয়ার জন্য এই শহরের নামকরণ হয়েছিল ‘বৈশালী’।[১১][১২]
বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উত্থানের আগে থেকেই বৈশালী বর্ধিষ্ণু প্রজাতান্ত্রিক লিচ্ছবি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল।[১৩][১৪] সেই যুগে বৈশালী ছিল একটি প্রাচীন মহানগরী এবং প্রজাতান্ত্রিক বৈশালী রাজ্যের রাজধানী। উল্লেখ্য, বৈশালী রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল হিমালয় পর্বতমালা থেকে আধুনিক বিহার রাজ্যের সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকা। যদিও বৈশালীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে খুব অল্পই জানা গিয়েছে। বিষ্ণুপুরাণে বৈশালীর ৩৪ জন রাজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রথম রাজার নাম নভগ। মনে করা হয়, মানবাধিকার সংক্রান্ত কোনো কারণে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং ঘোষণা করেন: “আমি এখন মাটির এক স্বাধীন চাকা, আমার জমির অধিপতি।” তালিকার সর্বশেষ রাজার নাম সুমতি। মনে করা হয়, তিনি হিন্দু দেবতা রামের পিতা দশরথের সমসাময়িক ছিলেন।
বৈশালী প্রজাতন্ত্রেই মহাবীরের জন্ম হয়েছিল। কথিত আছে, বৈশালীতেই গৌতম বুদ্ধ তার সর্বশেষ উপদেশ প্রদান করেছিলেন এবং নিজের পরিনির্বাণের কথা ঘোষণা করেছিলেন। প্রাচীন ভারতের বিশিষ্ট রাজনর্তকী আম্রপালি বৈশালীর অধিবাসী ছিলেন। বিভিন্ন লোককথা ও বৌদ্ধ সাহিত্যে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। আম্রাপালি গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। লিচ্ছবি গোষ্ঠীর বিশিষ্ট রাজা মনুদেব বৈশালীতে আম্রপালির নৃত্য দেখে তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন।[১৫]
বৌদ্ধ তীর্থস্থান |
---|
![]() |
চারটি প্রধান তীর্থ |
চারটি অতিরিক্ত তীর্থ |
অন্যান্য তীর্থস্থান |
পরবর্তীকালের তীর্থস্থান |
বৈশালী শহরের সঙ্গে বুদ্ধের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। সন্ন্যাস গ্রহণের মানসে কপিলাবস্তু ত্যাগ করার পর তিনি প্রথমে বৈশালীতে এসেছিলেন এবং রামপুত্র উদ্রক ও অলার কালামের কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বোধিলাভের পর বুদ্ধ প্রায়ই বৈশালীতে আসতেন। বৈশালী প্রজাতন্ত্রের আদলেই তিনি ভিক্ষু সংঘ গঠন করেন। মাসি মহাপ্রজাপতি গৌতমীকে সংঘে গ্রহণ করে এখানেই তিনি ভিক্ষুণী সংঘ স্থাপন করেন। এখানেই তিনি শেষ বর্ষাবাস (বর্ষাকালীন অবস্থান) করেছিলেন এবং নিজের মহাপরিনির্বাণের (শেষবারের মতো জগত পরিত্যাগ) কথা ঘোষণা করেছিলেন। বুদ্ধ কুশীনগরে দেহত্যাগ করেছিলেন। কুশীনগরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে বৈশালীতে জনসাধারণের কাছে তিনি নিজের ভিক্ষাপাত্র রেখে যান।
বোধিলাভের পাঁচ বছর পর বুদ্ধ বৈশালীতে এসে বর্ষাবাস করেছিলেন। [১৬] বৌদ্ধ থেরবাদী টীকাগুলিতে বুদ্ধের এই আগমনের প্রেক্ষাপটের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।[১৭] বৈশালীতে সাত হাজার সাত জন রাজা বাস করতেন। প্রত্যেকেরই প্রচুর অনুগামী, অনেক প্রাসাদ ও প্রমোদ উদ্যান ছিল। খরার সময় একবার খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ কমে যায়। প্রচুর সংখ্যায় লোক প্রাণ হারান। পচনশীল মৃতদেহের গন্ধে ভূতপ্রেত আকৃষ্ট হতে থাকে এবং অনেকেই আন্ত্রিক রোগে আক্রান্ত হন। জনসাধারণ শাসক রাজকুমারের কাছে অভিযোগ জানান। তিনি সাধারণ সভা ডাকেন। সেখানে স্থির হয় বুদ্ধকে তাদের শহরে আমন্ত্রণ জানানো হবে। বুদ্ধ সেই সময় রাজগৃহের বেলুবনে অবস্থান করছিলেন। তাই রাজগিরের রাজা বিম্বিসারের বন্ধু তথা বেশালির যাজকের পুত্র লিচ্ছবি মহালিকে বিম্বিসারের কাছে পাঠানো হয়। তিনি বিম্বিসারকে অনুরোধ করেন বুদ্ধকে বৈশালীতে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে।
বিম্বিসার তাকেই বুদ্ধের কাছে প্রেরণ করেন। মহালির কথা শুনে বুদ্ধ বৈশালীতে যেতে রাজি হন। তিনি পাঁচ হাজার ভিক্ষু নিয়ে বৈশালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজগৃহ থেকে গঙ্গা পর্যন্ত পথটি বিম্বিসার সাজিয়ে দেন এবং পথকষ্ট লাঘবের জন্য যথোচিত ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে আস্নে। পাঁচ দিনের যাত্রা শেষে বুদ্ধ যখন গঙ্গাতীরে উপস্থিত হন, তখন বিম্বিসার কণ্ঠ অবধি জলে নেমে বুদ্ধকে বিদায় জানান। গঙ্গার অপর পাড়ে লিচ্ছবিরা বুদ্ধকে আরও সম্মান প্রদর্শন করেন। বুদ্ধ বজ্জিতে প্রবেশ করা মাত্র ঝড় ওঠে ও প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। গঙ্গাতীর থেকে বৈশালী অবধি পথ অতিক্রম করার পর নগরে প্রবেশ করলে সক্ক তাকে অভ্যর্থনা জানান। দেবতাদের দেখতে পেয়ে ভূতপ্রেত ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বুদ্ধ আনন্দকে রতন সুত্ত শিক্ষা দেন এবং বলেন শহরের তিন প্রাচীরের মধ্যে ঘুরে সেই সুত্ত পাঠ করতে। আনন্দ রাতে সেই সুত্ত পাঠ করলে নগরবাসীর সকল দুঃখ দূর হয়। সমবেত জনতার সামনে বুদ্ধ নিজে রতন সুত্ত পাঠ করেন। চুরাশি হাজার সত্ত্বা এই সময় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। সাত দিন একাদিক্রমে এই সুত্ত পাঠ করার পর বুদ্ধ বৈশালী ত্যাগ করেন। লিচ্ছবিরা গঙ্গাতীর অবধি বুদ্ধের সঙ্গে আসেন এবং তাকে আরও সম্মান প্রদর্শন করেন। নদীতে দেবতা ও নাগেরাও বুদ্ধকে সম্মান জানান। অপর পাড়ে বিম্বিসার অপেক্ষা করছিলেন। বুদ্ধ সেখানে পৌঁছালে বিম্বিসার বুদ্ধকে আবার রাজগৃহে ফিরিয়ে নিয়ে যান। সেখানে ফিরে বুদ্ধ শঙ্খ জাতকের কাহিনি শোনান।
বুদ্ধ ঠিক কতবার বৈশালীতে এসেছিলেন তা জানা যায় না। তবে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করলে অনুমিত হয়, তিনি বেশ কয়েকবার বৈশালীতে আসেন। বিভিন্ন বিনয় গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থটি বৈশালীতে প্রদত্ত হয়েছিল।[১৮] সর্বশেষ প্রেক্ষাপটের আগমনটি সম্ভবত দীর্ঘ সময়ের জন্য ছিল। এই সময় বুদ্ধ ভিক্ষুদের নির্দেশ দিয়েছিলেন লিচ্ছবি বুদ্ধের উপর তাদের ভিক্ষাপাত্র স্থাপন করতে। বৈশালীতে অন্যান্য বিনয় নিয়মাবলিও রচিত হয়।[১৯] কপিলাবস্তু থেকে একবার বৈশালীতে আসার পথে মহাপজাপতি গোতমী পাঁচশো শাক্যনারীকে নিয়ে তাকে অনুসরণ করেন। আনন্দের অনুরোধে ব্দধ তাদের সংঘে প্রবেশের অনুমতি দেন।[২০]
ধর্মগ্রন্থগুলির বর্ণনা অনুসারে,[২১] কুশিনরে যাওয়ার পথে বুদ্ধ শেষবার বেশালিতে আসেন। অবস্থানের শেষ দিন ভোজনের পর বুদ্ধ নিদ্রার জন্য কাপাল চেতিয়ায় আনন্দের কাছে যান। সেখানে কথাপ্রসঙ্গে তিনি আনন্দকে বৈশালীর সৌন্দর্য, উদেনা চেতিয়া, গোতমক চেতিয়া, সত্তমবক চেতিয়া, বাহুপুত্ত চেতিয়া ও সারনদদ চেতিয়ার কথা বলেন।[২২] একটি কপিনয়হ চেতিয়ার উল্লেখও পাওয়া যায়। এই সবকটি আগে স্থানীয় দেবতাদের স্থান ছিল। বৈশালীতে বুদ্ধের আগমনের পর এগুলি বৌদ্ধ ধর্মস্থানে পরিণত হয়। বৈশালীর কাছে অন্যান্য মঠেরও (যেমন পাতিকারাম, বালিকারাম) উল্লেখ পাওয়া যায়।
বৈশালীতে এলে বুদ্ধ সাধারণত কুতগরসলে থাকতেন। তবে মনে করা হয়, কখনও কখনও তিনি উক্ত স্থানগুলিতেও অবস্থান করতেন।[২৩] কাপালা চেতিয়ায় শেষবার অবস্থানের সময় বুদ্ধ তিন মাসের মধ্যে দেহত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন বৈশালী ছেড়ে ভন্ডগমে যাওয়ার আগে তিনি “হাতির মতো নিজের শরীরটিকে একবার দেখেন।”[২৪] এর আগের বর্ষায় তিনি বৈশালীর উপকণ্ঠে বেলুবগমে ছিলেন। সেই সময় ভিক্ষুরা বৈশালীতে বা বৈশালীর আশেপাশে ছিল। বস্সয়ে প্রবেশের আগের দিন আম্রপালি বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান। ভোজের পর আম্রপালি তার অম্ববন সংঘকে দান করেন।[২৫]
যে সকল প্রধান সুত্ত বৈশালীতে প্রচারিত হয়েছিল, সেগুলি হল মহালি, মহাসিহনাদ, কুল সক্কক, মহা সক্কক, তেবিজ্জ, বচ্ছগোত্ত, সুনক্কহট্ট ও রতন। বুদ্ধের দেহত্যাগের পর তার দেহাবশেষের একাংশ বৈশালীতে একটি স্তুপে রক্ষিত হয়।[২৬] একশো বছর পর বৈশালী আবার বৌদ্ধদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সময় বজ্জিপুত্তক ‘দশ ধারণা’র অবতারণা করেন এবং এই বিতর্কের প্রেক্ষাপটে বালিকারামে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতি আয়োজিত হয়।
শ্বেতাম্বর জৈনরা বলেন, সর্বশেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর বৈশালীর ক্ষত্রিয়কুণ্ডে রাজা সিদ্ধার্থ ও রানি ত্রিশীলার পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই প্রতিপালিত হন। বৈশালী ছিল জৈন নির্গ্রন্থদের একটি অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। কথিত আছে, মহাবীরের পরবর্তী জীবনের বিয়াল্লিশটি বর্ষা তিনি বৈশালীতে অতিবাহিত করেছিলেন।[২৭]
![]() |
![]() |
![]() |
টেমপ্লেট:Ppn টেমপ্লেট:RBK টেমপ্লেট:Suttas টেমপ্লেট:Vaishali district topics