বোডো লীগের গণহত্যা | |
---|---|
স্থান | কোরিয়া |
তারিখ | ১৯৫০ | -এর গ্রীষ্ম
লক্ষ্য | কমিউনিস্ট এবং সন্দেহভাজন কমিউনিস্ট সহানুভূতিশীলদের[১] |
হামলার ধরন | গণহত্যা |
নিহত | ৬০,০০০–২০০,০০০[২] |
হামলাকারী দল | দক্ষিণ কোরিয়ার কমিউনিস্ট-বিরোধীরা |
কারণ | সাম্যবাদবিরোধীতা; উত্তর কোরিয়ার সহযোগীদের ভয় |
বোডো লীগের গণহত্যা (কোরীয়: 보도연맹 학살사건; হাঞ্জা: 保導聯盟虐殺事件) একটি যুদ্ধাপরাধের ঘটনা যা ১৯৫০-এর গ্রীষ্মে কোরীয় যুদ্ধের সময় ঘটেছিল। কমিউনিস্ট এবং সন্দেহভাজন কমিউনিস্ট সহানুভূতিশীলদের (এদের অনেকেই ছিলেন সাধারণ নাগরিক এবং সাম্যবাদ বা কমিউনিস্টদের সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না) বিরুদ্ধে এই গণহত্যা আয়োজন করেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার কমিউনিস্ট-বিরোধীরা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার, যাদের সমর্থন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশগুলি। কতজনের মৃত্যু হয়েছিল, এই বিশয়ে ঐক্যমত্য নেই। কোরীয় যুদ্ধের ঐতিহাসিক এবং বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছেন যে কমপক্ষে ৬০,০০০-১১০,০০০ (কিম দং-চুন) থেকে ২০০,০০০ (পার্ক মায়ুং-লিম) জনের মৃত্যুও হতে পারে।[২] কমিউনিস্টদের উপর এই গণহত্যার দায় মিথ্যাভাবে দেওয়া হয়েছিল।[৩] দক্ষিণ কোরিয়া সরকার চার দশক ধরে এই গণহত্যা গোপন করার চেষ্টা করেছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তাদের এই গণহত্যার কথা প্রকাশ করতে নিষিদ্ধ করে সরকার; কারণ সরকার সন্দেহ করেছিল যে এরা কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল; যারা এই গণহত্যার খবর প্রাকাশ্যে এনেছিল তাদের নির্যাতন ও মৃত্যুর হুমকি দিয়েছিল সরকার। নব্বইয়ের দশক এবং পরবর্তী সময়ে গণকবর থেকে বেশ কয়েকটি লাশ খনন করা হয়েছিল, ফলে গণহত্যার বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছিল।[৪][৫]
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি রী সিংম্যান প্রায় ৩০০,০০০ সন্দেহভাজন কমিউনিস্ট সহানুভূতিশীল বা তার রাজনৈতিক বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ড থেকে রক্ষা করার অজুহাতে জাতীয় বোডো লীগ[৬] (বা জাতীয় পুনর্বাসন ও গাইডেন্স লীগ, ন্যাশনাল গার্ড জোট,[৭] জাতীয় গাইডেন্স জোট[৮] গুকমিন বোদো ইওনম্যাং, 국민보도연맹, 國民保導聯盟) নামে পরিচিত একটি সরকারী "পুনঃশিক্ষা" আন্দোলনে নাম লিখিয়েছিলেন।[৩][৯] বোডো লিগটি কোরীয় আইনজীবিদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল যারা জাপানিদের সহযোগিতা পেয়েছিল।[১০] অ-সাম্যবাদী সহানুভূতিশীল এবং অন্যান্যদেরও বোডো লীগে তালিকাভুক্তি কোটা পূরণ করতে বাধ্য করে ঢোকানো হয়েছিল।[১১]
১৯৪৯ সালের জুনে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার স্বাধীনতা কর্মীদের বোডো লীগের সদস্য বলে অভিযোগ করে। [৭] ১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি রী সিংম্যান প্রায় ২০,০০০ অভিযুক্ত কমিউনিস্টকে বন্দী করেছিলেন।[১২]
১৯৪৮ সালের ২৫ আগস্ট সম্পূর্ণ কোরিয়ায় সংসদ নির্বাচন হয়, এবং বিধানসভার ৫৭২-এর মধ্যে ১৫৭টি আসনে কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টি জয় লাভ করে। অন্যান্য বামপন্থী দলের সঙ্গে জোট করে কিম ইল-সাং প্রিমিয়ার হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং কিম টু-বং প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচন মানতে অস্বীকার করে, প্রথম প্রজাতন্ত্রী কোরিয়া গঠন করে দক্ষিণ কোরিয়ার মার্কিন নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে এবং বল প্রয়োগ করে রী সিংম্যানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসিয়ে দেয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয় এবং সম্পূর্ণ কোরিয়া নির্বাচিত সরকারের অধীনে আনতে কিম ইল-সাং-এর নেতৃত্বে, উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনী ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর থেকে আক্রমণ করে। এরপর কোরীয় যুদ্ধ শুরু হয়।[১৩] কিম মান্সিক, একজন উচ্চ সামরিক পুলিশ অফিসারের মতে, রাষ্ট্রপতি রী সিংম্যান ২৭ জুন ১৯৫০ সালে আদেশ দেন বোডো লীগ বা দক্ষিণ কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে সম্পর্কিত সব মানুষকে হত্যা করার।[১৪][১৫] প্রথম গণহত্যা একদিন পরে ২৮ শে জুন গাংভন-ডু-এর হোয়েংসিয়ংয়ে শুরু হয়েছিল।[১৬] দক্ষিণ কোরিয়ার বাহিনী এবং সাম্যবাদবিরোধী দলগুলি[১৭] বোডো লীগের অনেক সদস্যকে এবং অভিযুক্ত কমিউনিস্ট বন্দীদের হত্যা করে।[৩] কোনও বিচার বা সাজা না দিয়ে হত্যা কার্যকর করা হয়েছিল।[১৮] সিউল মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান কিম তায়ে সান যুদ্ধের সূত্রপাতের পরে ব্যক্তিগতভাবে কমপক্ষে ১২ জন "কমিউনিস্ট এবং সন্দেহভাজন কমিউনিস্ট"-দের হত্যা করার কথা স্বীকার করেছিলেন।[১২] ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যখন সিউল পুনরায় দখল করা হয়েছিল, তখন আনুমানিক ৩০,০০০ দক্ষিণ কোরীয়কে সন্দেহ করা হয়েছিল যে তারা উত্তর কোরীয়দের সহযোগী এবং এদেরকে কোরীয় প্রজাতন্ত্রের বাহিনী গুলি করে হত্যা করে।[১৯] কমপক্ষে একজন মার্কিন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানা গেছে, যখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার একজন কর্নেলকে বলেছিলেন যে উত্তর কোরিয়ার সেনারা এগিয়ে আসলে তিনি বুসানে প্রচুর সংখ্যক বন্দীকে হত্যা করতে পারেন। সেই গ্রীষ্মে বুসানের কাছে ৩,৪০০ জন দক্ষিণ কোরীয়কে গণহত্যা করা হয়েছিল।[২০]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক প্রমাণাদি দেখায় যে আমেরিকান অফিসাররা গণহত্যার সাক্ষী ছিল এবং ছবি তুলেছিল।[১৮] একটি ক্ষেত্রে একজন মার্কিন কর্মকর্তা রাজনৈতিক বন্দীদের হত্যা করার আদেশ দেন, এই কারণ দেখিয়ে যে এদের শত্রুর হাতে পড়তে দেওয়া চলবেনা।[৩][২১] অন্য একটি যুক্তরাষ্ট্রের দাপ্তরিক নথিতে দেখা যায় যে জন মুশিও, তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়াতে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত, সুপারিশ করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট রী সিংম্যান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শিন সাং-মো যে অবিছারে হত্যা বন্ধ করতে হবে। আমেরিকান প্রত্যক্ষদর্শীরা ১২ বা ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়েকে হত্যা করার দৃশ্যটি জানিয়েছিল।[৮] এই গণহত্যার খবর জানানো হয়েছিল ওয়াশিংটনে এবং জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারকে, যিনি এই গণহত্যাকে "অভ্যন্তরীণ বিষয়" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।[১৯][২২] এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, ৪০ জন নাগরিকের পিঠ ভেঙে দেওয়া হয় রাইফেল বাট দিয়ে এবং পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। সমুদ্রের তীরবর্তী গ্রামগুলিতে মানুষদের একত্রে বেঁধে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।[২০] অবসরপ্রাপ্ত দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যাডমিরাল নাম সাং-হুই স্বীকার করেছে যে সে ২০০ জন মানুষের লাশ সমুদ্রে নিক্ষেপ করার আদেশ দিয়েছিল এবং বলেছে, "তাদের বিচারের সময় হয়নি।"
ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলীয় সাক্ষীও ছিলেন।[৩][২৩] গ্রেট ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সমস্যাটি কূটনৈতিক পর্যায়ে উত্থাপন করেছিল, যার ফলে ডিন রাস্ক, সুদূর পূর্বাঞ্চলের বিষয়ক সহকারী সচিব ব্রিটিশদের জানিয়েছিল যে মার্কিন কমান্ডাররা "এই ধরনের নৃশংসতা রোধে সবরকম চেষ্টা করবে"।[৮] গণহত্যার সময় ব্রিটিশরা তাদের মিত্রদের রক্ষা করেছিল এবং কিছু নাগরিককে বাঁচিয়েছিল।[২৪][২৫]
কমিউনিস্ট অধিকৃত উত্তর কোরিয়ার প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসমর্থন আছে দেখে, দক্ষিণ কোরিয়া দখলকৃত অঞ্চলগুলি পুনরুদ্ধার করার পরে পুলিশ এবং মিলিশিয়া (সৈন্যবাহিনী) গ্রুপ উত্তর কোরিয়ার সন্দেহভাজন সমর্থকদের হত্যা করতে শুরু করে। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে গোয়াং জিউমজিয়ং গুহা গণহত্যা ঘটে। ডিসেম্বরে, ব্রিটিশ সেনারা দেখে দক্ষিণ কোরিয়ার আধিকারিকদের আদেশে গুলি করার জন্য সারিবদ্ধভাবে বেসামরিক লোকদের দাঁড় করানো হয়েছে এবং তাদের বাঁচায়। ব্রিটিশ সেনারা আরও গণহত্যা আটকাতে সিউলের বাইরে একটি মৃত্যুদণ্ডের জন্য বরাদ্দ সাইট দখল করে।[৮][২৪] ১৯৫১ সালের ৪ জানুয়ারি, দক্ষিণ কোরিয়ার পুলিশ গ্যাংওয়া গণহত্যা করেছিল; উত্তর কোরীয়দের সাথে তাদের সহযোগিতা রোধ করার জন্য ১৩৯ জন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "যুদ্ধের সরঞ্জাম জোগান দেয় ডানপন্থী নাগরিক সংস্থাগুলিদের, যেমন গাংওয়া স্ব-প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সহায়তা করেছিল।"[২৬]:৭৪–৭৫
২০০৮ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার দেজন এবং অন্যান্য সাইটে কয়েকটা খাত পাওয়া যায়, যেখানে শিশুদের মৃতদেহ লোকানো ছিল।[২][২১] দক্ষিণ কোরিয়ার সত্য ও পুনর্মিলন কমিশন এখনও বেঁচে থাকা এবং প্রাক্তন দেজন কারাগার প্রাক্তন লি জুন-ইয়ং-সহ বোডো লীগ সদস্যদের হত্যাতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষ্য দলিল করেছে।
যে খাতে হত্যা করা হয়েছিল, সে সাইটের ফটোগ্রাফ ছাড়াও, ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত জাতীয় সংরক্ষণাগার (ন্যাশনাল আর্কাইভস) দেজনসহ অন্যান্য স্থানে (যেখানে হত্যা করা হয়েছিল) মার্কিন সেনাদের ছবি প্রকাশ করে, এবং নিশ্চিত করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই গণহত্যা বিষয়ে সামরিক জ্ঞান এবং সমর্থন ছিল।[২১]