বৌদ্ধ ঋষি মহাপ্রজ্ঞা (দেবনাগরী: बौद्ध ऋषि महाप्रज्ञा) (জন্ম নাম নানি কাজী শ্রেষ্ঠ) (২১ মে ১৯০১ – ১৯৭৯) ১৯২০ এর দশকে তিনি নেপালে থেরোবাদী বৌদ্ধধর্মের পুনর্জাগরণের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার কারণে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে স্বৈরশাসক রাণা রাজপরিবার কর্তৃক তাকে কারারুদ্ধ এবং পরবর্তীতে নেপাল নির্বাসিত করা হয়।[১][২]
মহাপ্রজ্ঞা (বিকল্প নাম: ভিক্ষু মহাপ্রজ্ঞা, পাল্ডেন শেরাব, এমপি প্রধান, প্রেম বাহাদুর শ্রেষ্ঠ) একজন লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি নেপাল ভাষা ও হিন্দি ভাষায় কবিতা, স্তুতিকাব্য ও বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।[৩]
মহাপ্রজ্ঞা কাঠমান্ডুর হ্লুঘয় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কুল নারায়ণ এবং মায়ের নাম হীরা মায়া শ্রেষ্ঠ। প্রাথমিক অবস্থায় তার নাম প্রেম বাহাদুর শ্রেষ্ঠ রাখা হয়। তরুণ অবস্থায় তিনি স্তুতিগান রচনা ও গাওয়ার প্রতি আকৃষ্ট হন।[৪] তিনি অল্প বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, যা পরবর্তীতে ভেঙে যায়।[৫]
প্রেম বাহাদুর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে কাঠমান্ডু ভ্রমণরত তিব্বতি বৌদ্ধ ভিক্ষু কিয়াংতসে লামার ধর্ম বাণিতে আকৃষ্ট হয়ে তার সাথে তিব্বতের কিরং পর্যন্ত যান। সেখানে আরও দুইজন নেওয়ারের সাথে তিনিও তিব্বতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনি তার পুরনো নাম ত্যাগ করে মহাপ্রজ্ঞা নাম ধারণ করেন। কাঠমান্ডুতে আরও একজন শিক্ষানবিশসহ ফেরত আসেন এবং নাগার্জুন টিলায় শেরিং নোরবু নামক তিব্বতীয় লামার সাথে বসবাস শুরু করেন। মহাপ্রজ্ঞার আরও তিনজন বন্ধু তাদের সাথে যুক্ত হন এবং বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন।[৫]
হস্তমোড়া গৈরিক পোশাকের কারণে কাঠমান্ডুর মানুষ মহাপ্রজ্ঞাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। রাণা শাসকেরা মহাপ্রজ্ঞার হিন্দু থেকে তিব্বতীয় ভিক্ষুতে পরিণত হওয়া কিংবা শহরে ভিক্ষার জন্য বের হওয়া রীতিমত অপছন্দ করতেন। সে কারণে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে শেরিং নোরবু এবং আরও পাঁচজন ভিক্ষু নেপাল থেকে ভারতে বহিষ্কৃত হন।[৬][৭] এই ছয়জন ভিক্ষু ভারতের বুদ্ধগয়ায় যান এবং একজন বর্মী শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় থেরোবাদী ভিক্ষুতে রূপান্তরিত হন। তারা তারপর কলকাতায় যান এবং মহাপ্রজ্ঞা শেরিং নোরবুর সাথে বৌদ্ধ ধর্মের ওপর জ্ঞান আহরণের জন্য তিব্বতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[৫]
লাসায় মহাপ্রজ্ঞা কুলমান সিংহ তুলাধর নামক একজনের সাথে পরিচিত হন, যিনি তার অনুপ্রেরণায় তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। কুল মান সিংহ কর্মশীল নাম ধারণ করেন এবং দুইজনে তিব্বতে ভ্রমণ করে ভারতের কুশীনগরে গমন করেন। সেখানে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তারা উভয়ে পুনরায় থেরোবাদী বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। কর্মশীল (যিনি পরবর্তীতে প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির নামে খ্যাত হন), যিনি চতুর্দশ শতাব্দীর পর কাঠমান্ডুর প্রথম থেরোবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু, ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে নেপালে ফিরে যান।[৮]
কিন্তু বহিষ্কারাদেশের কারণে নেপালে প্রবেশে বাধা পান। শেষ পর্যন্ত ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মহা শিবরাত্রিতে মহিলাত ছদ্মবেশে ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের সাথে কাঠমান্ডুতে অনুপ্রবেশে সক্ষম হন। তবে ধরা পড়ার ভয়ে স্বল্প সময় ব্যবধানে কুশীনগরে প্রত্যাগমন করেন। এরপর তিনি বার্মায় যান এবং ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কালিম্পংয়ে আসার পূর্বে বার্মার বিভিন্ন জঙ্গল ও মঠে বসবাস করেন।[৯]
মহাপ্রজ্ঞা কালিম্পংয়ে অবস্থান করে নেপালে প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষা করতে থাকেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুই সন্তানবিশিষ্টা বিধবা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য সন্ন্যাসব্রত ত্যাগ করেন। সেই সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দিতেন এবং সেই সাথে চিত্রগ্রাহক হিসেবেও কাজ করেন। কিন্তু ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তার বিয়ে ভেঙে যায় এবং কাঠমান্ডুতে বৌদ্ধ ঋষি হিসেবে বসবাস করতে থাকেন।[১০]
মহাপ্রজ্ঞা মোট ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বুদ্ধের প্রাথমিক জীবন সম্পর্কিত ললিতবিস্তার, যা ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়।[১১] এছাড়া ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তিন খণ্ডে তার আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়।[৩] "দ্য লাইট অব উইজডম হ্যাজ ডাইড" তার রচিত জনপ্রিয় স্তুতিগানগুলোর মধ্যে অন্যতম।[১২]