ব্যুরেট হল এক অংশাঙ্কিত কাচের নল যার একপ্রান্তে একটি ট্যাপের মাধ্যমে তার ভেতর থেকে জল বা অন্য কোন তরল জাতীয় পদার্থ নিসঃরনের ব্যবস্থা আছে। এটি একটি দীর্ঘ, অংশাঙ্কিত কাচের নল, যার নীচের প্রান্তে স্টপকক(তরল পদার্থ প্রভৃতির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ছিপি বিশেষ) এবং স্টপককের নির্গমনপথে একটি বক্র কৈশিক নল যুক্ত থাকে। নল থেকে ব্যুরেটের প্রান্ত পর্যন্ত তরল প্রবাহ স্টপককের ভালভ বা গতিনিয়ন্ত্রক কল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রধানত দুটি ধরনের বুরেট রয়েছে; আয়তনমাপিক ব্যুরেট এবং পিস্টন(চাপদণ্ড) বুরেট বা ডিজিটাল ব্যুরেট। একটি আয়তনমাপিক ব্যুরেট নির্দিষ্ট পরিমাণ তরল সরবরাহ করে। চাপদণ্ড ব্যুরেট প্রায় সিরিঞ্জের মতো, তবে এর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মাপের ছিদ্র এবং একটি ডাঁটি বা প্লাঞ্জার অংশ বর্তমান। পিস্টন ব্যুরেট মানুষের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে বা মোটর চালিত হতে পারে।[১] একটি ওজন ব্যুরেট পরিমাপযুক্ত ওজনের তরল সরবরাহ করে।[২]
ব্যুরেট হল তরলের আয়তন মাপার কাচনির্মিত এক বিশেষ যন্ত্র যা বিশ্লেষণাত্মক রসায়নে তরলকে সঠিক পরিমাণসহ বিতরণের জন্য, বিশেষত টাইট্রেশন প্রক্রিয়ায় সঠিক মাত্রায় বিকারক যুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।[৩] ব্যুরেটে ব্যবহৃত কাচনলটি অংশাঙ্কিত হয় যার মাধ্যমে নিঃসৃত তরলের আয়তন নির্ধারণ করা যায়।[৪] তাত্ত্বিকভাবে পিপেট -এর ন্যায় ব্যুরেটেও নির্ভুল ব্যবধানসহ অংশাঙ্কিত থাকে কিন্তু ব্যুরেটের মধ্যবর্তী তরল কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কখনোই সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার হয়না তাই ব্যুরেট -এর পরিমাপের যথাযথতা পিপেটের তুলনায় সামান্য কম।[৫] ব্যুরেট ও আয়তন পরিমাপক চোঙের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে ব্যুরেটের মধ্যস্থিত বা ব্যুরেট থেকে নিঃসৃত তরলের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ব্যুরেটের উপরের অংশ থেকে পর্যবেক্ষণ শুরু করে। রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরুর আগে ব্যুরেটের তরলের পরিমাণ ও বিক্রিয়া শেষ হওয়ার পর তরলের পরিমাণ এই দুইয়ের বিয়োগফল হল নিঃসৃত তরলের পরিমাণ।[৬] টাইট্রেশন পদ্ধতিতে এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।[৫]
একটি আয়তন মাপক ব্যুরেটে কাঁচ বা প্লাস্টিকের তৈরি হতে পারে এবং এটি একটি অংশাঙ্কিত স্কেল সহ একটি সরল নল। ব্যুরেটের ডগায় রাসায়নিক দ্রবণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে স্টপকক এবং ভালভ রয়েছে। স্টপককের ব্যারেল(নলের মত) অংশটি সাধারণত কাচ বা পিটিএফই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয়। কাচের ব্যারেল যুক্ত স্টপককগুলিকে ভ্যাসলিন বা একটি বিশেষ গ্রীস জাতীয় তৈল পদার্থ দিয়ে পিচ্ছিল করা দরকার। বুরেট নির্দিষ্ট কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়, এরা ক্লাস এ বা বি হিসাবে পৃথক পৃথক শ্রেনিভুক্ত হয় যা কাচের মধ্যে লেখা থাকে।
ব্যুরেটে কিছু তরল যোগ বা তরল নিঃসৃত করলে তার পরিমাণ নির্ধারণ করতে চোখের সাথে উলম্ব দৃষ্টি রেখে তরলের বক্র তলদেশের সরবনিম্ন তল (যা মেনিস্কাস নামে অভিহিত করা হয়) পর্যবেক্ষণ করা উচিত। ব্যুরেটের ভেতরকার তরল সম্পূর্ণ বুদবুদ মুক্ত হতে হবে।[৭] রাসায়নিক পরিক্ষার কারণে তরলের চূড়ান্ত এবং প্রাথমিক নথিকৃত আয়তনের পার্থক্য নিরুপন করা হয়।[৮] ব্যুরেটের মধ্যে কোন বর্ণহীন তরল ব্যবহার করলে তার মেনিস্কাস পর্যবেক্ষণ করতে অসুবিধা হয় এবং সেই জন্য এক বিশেষ ব্ল্যাক স্ট্রিপ বা কালো পটি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়[৯] যাতে ব্যুরেটের মধ্যবর্তী তরলের উপরিতল পরিমাপ করতে এবং পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়।
আয়তনমাপিক ব্যুরেটকে শনাক্ত করতে হিসাবে কিছু নির্দিষ্টকরণ ব্যবহৃত হয়।[১০] যাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সর্বনিম্ন আয়তন, আয়তন একক, ত্রুটির সীমা, ব্যুরেট উৎপাদন সম্পর্কিত নির্মাতার বিবরন। ব্যুরেট সহ প্রতিটি পরীক্ষাগার সরঞ্জাম ব্যবহারের জন্য তাদের সবিস্তার বিবরণী জানা আবশ্যক যাতে সঠিকভাবে কোন রাসায়নিক পরীক্ষা সম্পাদন করা যায়। নামমাত্র পরিমাণ, ত্রুটি এবং ইউনিটে ব্যুরেট থেকে মিলি বা সেমি৩ আয়তনের সঠিক পরিমাণ তরল বিতরণের জন্য সর্বনিম্ন আয়তন, ত্রুটির সীমা, আয়তন একক ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা জরুরী। বুরেটের আরেকটি নির্দিষ্টকরণ একককে বলা হয় ক্যালিগ্রেশন টিডি বা "ক্যালিগ্রেশন টু ডেলিভারি" যার মাধ্যমে ব্যুরেটের তরল বিতরন ও বিতরিত তরলের আয়তন সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্টকরণ বোঝান হয়।[১১]
পরিমাপের নির্ভুলতা ও সরঞ্জামের নির্দিষ্টকরণ অনুযায়ী ব্যুরেটকে ক্লাস এ এবং ক্লাস বি শ্রেণিভুক্ত করা হয়। আয়তন মাপার নির্ভুলতার জন্য ক্লাস এ -কে ক্লাস বি -এর থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। ক্লাস এ ব্যুরেটের যথার্থতা ০.১ শতাংশ এবং ক্লাস বি ব্যুরেটের ০.২ শতাংশ।[১২]
ডিজিটাল ব্যুরেটগুলি সিরিঞ্জ -এর গঠনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। পিপা আকৃতির ব্যারেল এবং ডাঁটি বা প্লাঞ্জার অংশটি সাধারণত কাচের তৈরি হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মাঝে মাঝে কিছু ক্ষারযুক্ত তরল ব্যবহার হয় যা গ্লাসকে সঙ্কুচিত করে, সেই অবস্থায় ব্যারেল এবং প্লাঞ্জার পলিথিন বা অন্য কোনও প্রতিরোধী প্লাস্টিকের উপাদান দিয়ে তৈরি হতে পারে। ব্যারেলটি একটি স্থির স্থানে রাখা হয় এবং প্লাঞ্জার অংশটি হাত দ্বারা বা মোটরের মাধ্যমে চালনা করা হয়। ব্যুরেটের ভেতরের তরলের আয়তন একটি ডিজিটাল ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত হয়। কখনও কখনও একটি নির্ভুল সিরিঞ্জ খুব সুনির্দিষ্ট অ্যালিকোটস সরবরাহ করতে ব্যবহৃত হয়। মোটরযুক্ত ডিজিটাল ব্যুরেটকে কম্পিউটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব; উদাহরণস্বরূপ, টাইট্রেশন প্রক্রিয়ায় নিঃসৃত তরলের পরিমাণ কম্পিউটারের মাধ্যমে ডিজিটালি নথিভুক্ত করা যায় এবং এরপর তার সঙ্খ্যাগত বিশ্লেষণ করে শেষ বিন্দুতে টাইটারের সন্ধান করা হয়।
ব্যুরেট প্রথম ১৮৪৫ সালে ফরাসি রসায়নবিদ এনটিয়েন ওসিয়ান হেনরি (১৭৯৮-১৮৭৩) আবিষ্কার করেছিলেন।[১৩][১৪] ১৮৫৫ সালে, জার্মান রসায়নবিদ কার্ল ফ্রেড্রিক মোর (১৮০৬–১৮৭৯) হেনরির আবিষ্কৃত ব্যুরেটের উন্নত সংস্করণ উপস্থাপন করেছিলেন, যাতে বুরেটের নলটিতে অংশাঙ্কিত ছিল।[১৫] "ব্যুরেট" নামটি ১৮২৪ সালে ফরাসি রসায়নবিদ জোসেফ লুই গে-লুসাক (১৭৭৮–১৮৫০)-এর দেওয়া।[১৬]