ব্রহ্মলোক

ব্রহ্মলোক, বিষ্ণুর বিশ্বরূপের মাথায় জড় জগতের উর্ধ্বভাগে দেখা যায়।

ব্রহ্মলোক (সংস্কৃত: ब्रह्मलोक) বা সত্যলোক হল হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার বাসস্থান।[][][] পুরাণে একে ব্রহ্মপুর[] নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রহ্মলোক প্রজাপতি লোক থেকে ৬০,০০০,০০০ মাইল উপরে অবস্থিত। এই স্থানকে মহান মুক্তি তত্ত্ব বলে মনে করা হয়। ব্রহ্মলোকের বাসিন্দারা কদাপি মৃত্যুকে জানে না, তারা চিরকাল যোগীদের সাথে বসবাস করে এবং চমৎকার যোগরূপ অমৃত পান করে। [] হিন্দুধর্মানুসারে, এটি জাগতিক জগতের সর্বোচ্চ অংশ, যেখানে ব্রহ্মা ও বিশুদ্ধ আত্মাগণের উপস্থিতি রয়েছে।[]

বৌদ্ধধর্মে ব্রহ্মলোক স্বর্গ ও আধ্যাত্মিক রাজ্য নামে পরিচিত।[] হিন্দুধর্মবৌদ্ধধর্মে, এটি বহুস্তরবিশিষ্ট মহাবিশ্বের সেই অংশ যা পবিত্র আধ্যাত্মিক আত্মার ক্ষেত্রভূমি।[]

বৌদ্ধধর্ম

[সম্পাদনা]

বৌদ্ধধর্ম-এ ব্রহ্মলোককে উচ্চতম স্বর্গীয় জগৎ বলা হয়। এখানে ব্রহ্মাগণ বাস করেন । এটি বিশটি অংশ দ্বারা গঠিত, যথা:

  • নয়টি সাধারণ ব্রহ্ম-জগৎ,
  • বেহাপ্পলা,
  • আসনসত্তা,
  • পাঁচটি শুদ্ধাবাস,
  • চারটি অরূপলোক,

চারটি অরুপ লোক বাদে বাকী সকল আবাস রূপ জগতের মধ্যে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে (যার বাসিন্দারা জড় পার্থিব জগতের অন্তর্ভুক্ত।) ব্রহ্মলোকের অধিবাসীরা ইন্দ্রিয়জাত কামনা থেকে মুক্ত। ব্রহ্মলোকে কেবলমাত্র উচ্চতর দেবতা বা উচ্চতর স্বর্গীয় প্রাণীকে ব্রহ্মা বলা হয়। ধ্যানের ফলে অর্জিত মহাপুণ্যের ফলভোগাকাঙ্ক্ষী ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হন। জাতক কাহিনীতে তপস্বীদের এরকম বিভিন্ন দৃষ্টান্তও রয়েছে। তারা ধ্যান অনুশীলন করার ফলে তাদের ব্রহ্মলোকে মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হয়েছিল। তদ্ব্যতীত এটি বিশ্বাস করা হয় এক কপ্পের শেষে বিশ্বের অবশিষ্ট অংশ ধ্বংস হয়ে গেলেও ব্রহ্মলোক বিদ্যমান থাকবে এবং পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রথম প্রাণীরা আবাসার ব্রহ্মলোক থেকে আসবে। এখানে ব্রহ্মাদেরকে পৃথিবী পরিদর্শন করা এবং মানুষের কার্যকলাপ দর্শনে আগ্রহী বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ জন্যই মহানিপাত জাতকে ভগবান ব্রহ্মা-নারদ কাহিনীতে রাজা অঙ্গতির ধর্মদ্রোহীতা দূর করতে নারদ ব্রহ্মলোক থেকে অবতীর্ণ হন।

থেরবাদ বৌদ্ধধর্মে ব্রহ্মলোক

[সম্পাদনা]

অরূপলোক সকল ঐশ্বরিক জগৎ ব্রহ্মলোকের মধ্যে সর্বোচ্চ। যেহেতু এই ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণকারী প্রাণীরা দীর্ঘ আয়ু নিয়ে নিরাকারলোক, তাই অনেক বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ধম্ম প্রচার করেছিলেন, এমনকি যদি প্রাণীরা অম মহানির্বাণ পর্যন্ত পূর্ণ হয়, তারা ধম্ম শুনতে পায় না। যে সময়ে মহান বোধিসত্ত্ব কঠিন কাজ সম্পাদন করছিলেন, সেই সময়ে আলারা কালামা এবং উদ্দাকরপুত্ত, যারা শিক্ষক ছিলেন, ধ্যানের দ্বারা এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তারা এই বুদ্ধ আসনে নির্বাণ পাননি।

যারা গঠনমূলক ধ্যান করেছে তারা মৃত্যুর পর নিরাকার ব্রহ্মলোকে জন্ম নেবে এবং যারা উচ্চতর নিরাকার ধ্যান করেছে তারা মৃত্যুর পর নিরাকার ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করবে। তার জন্য অর্জিত ধ্যানের অবনতি ছাড়াই মৃত্যুবরণ করতে হবে। কিন্তু অষ্টসমপত্তি হিসাবে নেওয়া জাগতিক ধ্যানের অবনতি ঘটতে পারে। অতএব, ধ্যানের দ্বারা অর্জিত সেই শক্তি ক্ষয় না করে সংরক্ষণ করা উচিত।

বুদ্ধ ও অর্হৎদের সাথে সম্পর্কিত রূপবচর এবং অরূপবাচার ধ্যানের সাথে কির্যা মনের জন্ম হয়েছিল। এই রূপবাচার, অরূপবাচার ধ্যান মনকে অভিধম্মে মহাগতা মনও বলা হয়। যারা রহৎ নয় তাদের জন্য মেধাবী মন বিবেচিত হয়। অর্হৎদের হৃদয় কোমল থাকবে। মনের মধ্যে প্রতিদানের শক্তি নেই। এভাবে আবেগী মনের মতো প্রতিসন্ধি মনও বিপাক মন। অর্থাৎ যা মনের উদ্দেশ্য তাও প্রতিসন্ধি মনের উদ্দেশ্য। এবং উপরোল্লিখিত ব্রহ্মলোকের মধ্যে একটি বামবালোও রয়েছে, যেখানে চতুর্থ ধ্যান বাড়ুবা অসঞ্জসন্ত হিসাবে জন্মগ্রহণ করে। সাধু, যোগী যারা তীব্র ধ্যানে বেড়ে উঠেছেন, তারা এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তাদের কেবল একটি শারীরিক দেহ রয়েছে। সেখানে মন নেই। যোগীরা চতুর্থ ধ্যানের মতো একই সময়ে ধীরে ধীরে মনকে এক লক্ষ্যে নিবদ্ধ করে মনকে শরীর থেকে বের করে নেয়। এর জন্য থাকতে হবে প্রবল মানসিক একাগ্রতা। মনুষ্যলোকে জন্মের সময় যেমন পশু-জন্তু তথা এই ব্রহ্মলোকের জন্ম হয়েছিল, তেমনই এই লোকে জন্ম নেওয়ার সংকল্প নিতে হবে চতুর্থ ধ্যানাদ্দোকে। যদিও এটি একটি রূপক লোক, তবে নির্দিষ্ট আয়ু শেষ হলে এটি পরিত্যাগ করা উচিত। এর কারণ এই যে, অস্থিরতা যা অন্য জগৎকে প্রভাবিত করে তা এই ব্রহ্মলোকে সাধারণ। এছাড়াও, যখন ব্রহ্মার জগতে, যেমন শুদ্ধাবাসে জন্ম হয়, জীবনকাল খুব দীর্ঘ হয়, তাই সমস্ত পারমিতাসম্পন্ন মহৎ ব্যক্তি বুদ্ধের শিক্ষা শুনতে পারেন এবং ব্রহ্মার জগতে নির্বাণ দেখতে পারেন।

বুদ্ধ তাই বলেছেন কারণ ব্রহ্মলোকের জীবদ্দশায়, পৃথিবীতে প্রচুর সংখ্যক বুদ্ধ আবির্ভূত হন। এইভাবে আবির্ভূত সমস্ত বুদ্ধ ধম্ম প্রচার করতে সর্পলোকে যান।

ব্রহ্মলোকের প্রকৃতি ও গঠন সম্পর্কে বলা হয়, মহাব্রহ্মার অধিবাসীরা ব্রহ্ম পরিসজ্জায় বাস করে। ব্রহ্মপুরোহিতে মহাব্রহ্মার উপদেষ্টারা থাকেন। মহাব্রহ্মলোকে মহাব্রহ্মা বাস করেন। প্রথভায় হল ম্লান আলোর ব্রহ্মলোক। অপ্পামানভার আলো অপরিমেয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অভস্সারে ব্রহ্মারা বাস করেন যাদের দেহের আলো অত্যন্ত বিস্তৃত। পরিত্তাসুভাতে ব্রহ্মারা বাস করে যারা তাদের আলো একটু একটু করে ছড়িয়ে দেয়। ব্রহ্মা, যিনি অসীম আনন্দের অপরিমেয় আলো ছড়িয়ে দেন, বন্ধ হয়ে যায়। শুভ কিন্‌হাতে অপরিবর্তনীয় দৈহিক আলো বিকিরণকারী ব্রহ্মাগণ বাস করেন। যে ব্রহ্মারা বেহপ্পলায় মহৎফল মহানীসংসা লাভ করেছে তারা বন্ধ। ধম্মও উপরে উল্লিখিত দেহের আলোকে খ্যাম প্রভাব বলে উল্লেখ করেছে।

বৌদ্ধধর্ম অনুসারে, ব্রহ্মলোকের সংখ্যা দিব্যলোকের সংখ্যার চেয়ে বিশটি বেশি। বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা অনুসারে, ব্রহ্মলোক সম্পর্কে বিশদ বিবরণ নীচে দেওয়া হল।

রূপবাচার ব্রহ্মলোক

[সম্পাদনা]

১. ব্রহ্ম পারিষদ্য

২. ব্রহ্ম পুরোহিতয়

৩. মহা ব্রহ্ময়

৪. পরিত্তাভয়

৫. অপ্পমানাভয়

৬. আভাস্সরয়

৭. পরিত্তসুভয়

৮. অপ্পমান সুভয়

৯. শুভকিণ্‌হক

১০.বেহপ্ফলয়

১১.অস্সগ্ন তলয়

শুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোক

[সম্পাদনা]

১২. অবিহয়

১৩. অতপ্পয়

১৪. সুদস্সয়

১৫. সুদস্সিয়

১৬. অকনিষ্টয়

অরূপাবচর ব্রহ্মলোক

[সম্পাদনা]

১৭. আকাসনচায়তনয়

১৮. ভিন্নাচায়তনয়

১৯. আকিচনায়তনয়

২০. নেবসন্নানাসন্নায়তনয়

বিবরণ

[সম্পাদনা]

ব্রহ্মলোক হল সম্পূর্ণরূপে ব্রহ্মার শক্তি দ্বারা গঠিত রাজ্য, যা স্বর্গলোকের থেকে উচ্চতর বলে বিবেচিত এবং নির্মল শক্তি, জ্ঞান ও আনন্দে পরিপূর্ণ। এটি ভগবানের বাসস্থান গ্রহ হিসেবেও পরিচিত।[]

কখনো কখনো ব্রহ্মলোক বলতে শাশ্বত বৈকুণ্ঠ কে বোঝায়, যা সৃষ্টি বা জড় জগতের মধ্যে অবস্থিত নয় এবং এটি পরমাত্মার বাসস্থান নামেও বিখ্যাত। উপনিষদ-এ এই পরমাত্মার বাসস্থানকেই ব্রহ্মলোক বলা হয়েছে।

ব্রহ্ম-লোকঃ এষ আত্ম-লোকঃ
ব্রহ্মলোক হল পরমাত্মার আবাস।

ছান্দোগ্য উপনিষদের ৮.১.১ শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে:[১০]

তারা তাকে বলে: "এখন, বাসস্থান সম্পর্কে বলুন। এই ব্রহ্মনগরে ছোট পদ্ম এবং এর মধ্যে ছোট আকাশ আছে - এর মধ্যে কী আছে যা অনুসন্ধান করা উচিত এবং সেখানে কী আছে যা ব্যক্তির অনুধাবন করা উচিত?" তারপর তিনি (আচার্য) বলেন: "প্রকৃতপক্ষে এই বিশাল আকাশ যতদূর প্রসারিত হয়, ততদূর পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে আকাশকে প্রসারিত করে। স্বর্গ ও পৃথিবী উভয়ই এর মধ্যে রয়েছে, অগ্নি এবং বায়ু, সূর্য ও চন্দ্র উভয়ই সেখানে রয়েছে। বিদ্যুৎ ও নক্ষত্র; তথা এই পৃথিবীতে যা কিছু আছে (অর্থাৎ মূর্ত বস্তু) এবং যা কিছু নেই (বিমূর্ত), তারই মধ্যে (হৃদয়াকাশে) সকল বস্তু রয়েছে "।

সেই ছান্দোগ্য উপনিষদেই (৮/৪/৩) , ব্রহ্মলোককে একটি রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা একজন ব্যক্তি ব্রহ্মচর্য অনুশীলন করে অর্জন করতে পারে:[১১]

সুতরাং, যারা ব্রহ্মচর্য জীবন যাপন করে এই ব্রহ্মলোকের সন্ধান করে তারাই সেই জগতের অধিকারী হয় এবং তারা সমস্ত জগতে চলাফেরার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।

ভগবদ্গীতার অষ্টম ও পঞ্চদশ অধ্যায়ে ভগবান কৃষ্ণ ব্রহ্মলোক সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন।[১২][১৩] ব্রহ্মলোক হচ্ছে আনন্দপূর্ণ ও চিরস্থায়ী ফুলের বাগান।[১৪] বেদান্তঅনুসারে ব্রহ্মলোক হলো অসীম খাঁটি চেতনা-সুখসমন্বিত নিত্য ও স্থায়ী চূড়ান্ত বাস্তবতা ও গন্তব্য।[১৫] ব্রহ্মলোকের সর্বত্র বিশাল বিশাল পদ্মফুল রয়েছে এবং এগুলির মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তি প্রবাহিত হয়।[১৬] ব্রহ্মলোকের কেন্দ্রে ব্রহ্মপুর। ব্রহ্মপুরে বিশাল প্রাসাদে ব্রহ্মা বাস করেন। ব্রহ্মলোকের নীচে তপলোক এবং উপরে জাগতিক মহাবিশ্বের সমাপ্তি ও বৈকুণ্ঠ গ্রহসমূহের সূচনা।[১৭] এটি স্বর্গের চেয়ে উন্নত ও চিরন্তন, এবং জ্ঞান ও আনন্দ দ্বারা পরিপূর্ণ।[১৮]

নৃসিংহ পুরাণ মতে, ব্রহ্মলোক পাঁচ কোটি যোজন ( প্রায় ষাট কোটি কিলোমিটার) পরিমিত স্থান জুড়ে ছত্রাকারে মহাকাশে অবস্থান করছে।

মহাভারতে নিম্নোক্ত প্রকারে ব্রহ্মলোকের উল্লেখ রয়েছে। যেমন:

নারদ কহিলেন, হে ধর্ম্মরাজ ! এক্ষণে পিতামহ ব্ৰহ্মার সভা বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন! ঐ সভার তুলনা নাই। পূর্ব্বকালে সত্যযুগে ভগবান আদিত্য মর্ত্যলোকদর্শনাথী হইয়া পরমসুখে ভূলোকে অবতীর্ণ হইবার নিমিত্ত নরকলেবর পরিগ্রহ করিয়া অপরিশ্রান্তচিত্তে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে করিতে ব্ৰহ্মার মানসী সভা অবলোকন করেন। সভা দৰ্শন করিয়া তিনি আমাকে অকপটে কহিলেন, “হে নারদ! ব্রহ্মার মানসী সভা অনির্দেশ্য, অপ্রমেয় ও সর্ব্বভূত-মনোরম।” আমি আদিত্যমুখে ব্ৰহ্মসভার শোভাবর্ণন শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ তদ্দর্শনে একান্ত কুতুহলোক্রান্ত হইয়া তাঁহাকে কহিলাম, “ভগবান! এক্ষণে সর্ব্বপাপনাশিনী শুভা ব্রহ্মসভা সন্দর্শন করিতে আমার সাতিশয় অভিলাষ হইতেছে, অতএব আমি যেরূপ তপস্যা, ঔষধ, যোগ ও কর্ম্ম দ্বারা তাহা দেখিতে পাই, এমত বলিয়া দিউন।” দিবাকর এই কথা শুনিয়া বৰ্ষসহস্রসাধ্য ব্রতের কথা উত্থাপন করিয়া কহিলেন, “হে তপোধন! তুমি একান্তমনে ব্ৰহ্মব্ৰত অনুষ্ঠান কর।”

অনন্তর আমি তদীয় আদেশে হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশে ঐ মহাব্ৰত সাধন করিলাম। তৎপরে তাহার সমভিব্যাহারে ব্ৰহ্মসভায় উপনীত হইয়া দেখিলাম, দৃষ্টান্তপ্রদর্শনপূর্ব্বক ঐ অপূর্ব্বসভা নির্দেশ করা যায় না, ক্ষণে ক্ষণে উহা নানা রূপ ধারণ করে, পরিমাণ ও সংস্থানবিষয়ে উহার কেহই কিছুই অবধারণ করিতে পারে না। ফলতঃ আমি ঐরূপ অদৃষ্টপূর্ব্ব বস্তু কদাচ প্রত্যক্ষ করি নাই। ঐ সভা অতিশয় সুখপ্রদ ও নাতিশীতোষ্ণ, তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইলে লোকের ক্ষুৎপিপাসাজনিত ক্লেশ ও গ্লানিচ্ছেদ হয়, আপাততঃ দেখিলে প্ৰতীত হয়, যেন সভা নানাবিধ অতিভাস্বর মণিদ্বারা নির্মিত হইয়াছে। স্তম্ভ দ্বারা ঐ শাশ্বতী সভা অবলম্বিত নহে, তথাচ স্বস্থান হইতে বিচলিত হইতেছে না। তথায় নানাবিধ দিব্য ও অমিতপ্ৰভ ভাবসমুদয় আবির্ভূত রহিয়াছে। ব্ৰাহ্মী সভার প্রভাপুঞ্জ চন্দ্ৰ, সূৰ্য্য, অগ্নি ও বিদ্যুৎকে উপহাস করিয়া নভোমণ্ডলে শোভা বিস্তার করিতেছে। তন্মধ্যে অদ্বিতীয় ভগবান সর্ব্বলোকপিতামহ ব্ৰহ্মা স্বয়ং দেবমায়া পরিগ্রহ করিয়া অধ্যাসীন হইয়া থাকেন। প্রজাপতিগণ তাঁহার উপাসনা করিতেছেন। আর দক্ষ, প্রচেতাঃ, অঙ্গিরাঃ, পুলহ, মরীচি, কশ্যপ, ভৃগু, অত্ৰি, বশিষ্ঠ, গৌতম, পুলস্ত্য, ক্রতু, প্ৰহ্লাদ, কর্দম, অথর্ব্ব আঙ্গিরস, বালখিল্য, মরীচিপ, মন, অন্তরীক্ষ, বিদ্যা, বায়ু, তেজ, জল, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ, প্রকৃতি, বিকৃতি, পৃথিবীর অন্যান্য কারণসমুদয়, মহাতেজাঃ অগস্ত্য, বীৰ্য্যবান মার্কণ্ডেয়, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, সংবৰ্ত্ত, চ্যবন, মহাভাগ দুর্ব্বাসা, পরম-ধাৰ্মিক ঋষ্যশৃঙ্গ, ভগবান, সনৎকুমার, মহাতপাঃ যোগাচাৰ্য্য অসিত, দেবল, তত্ত্ববিৎ জৈগীষব্য, জিতশত্রু, ঋষভ, মহাবীৰ্য্য মণি, অষ্টাঙ্গসম্পন্ন বিগ্ৰহধারী আয়ুর্ব্বেদ, নক্ষত্রগণপরিবৃত চন্দ্ৰ, সহস্রকর দিবাকর, বায়ু, ক্রতুগণ, সঙ্কল্প ও প্রাণ এই সমস্ত মহাব্ৰতপরায়ণ মূর্তিমান মহাত্মা ও অন্যান্য বহুসংখ্যক ব্যক্তিগণ ব্ৰহ্মার উপাসনা করিতেছেন। ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, হর্ষ, দ্বেষ, তপস্যা ও সপ্তবিংশতি অপ্সরোগণ তথায় আগমন করিয়া থাকেন। লোকপালবৰ্গ, শুক্ৰ, বৃহস্পতি, অঙ্গারক, শনৈশ্চর, রাহু প্রভৃতি গ্রহসমস্ত, মন্ত্র, রথীন্তর, হরিমান, বসুমান, নামদ্বন্দ্বাদাহৃত, অধিরাজসহ আদিত্যগণ, মরুৎ সমুদয়, বিশ্বকর্ম্মা, বসুবৰ্গ, পিতৃগণ, সমস্ত হবিঃ, ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদ, অথর্ব্ববেদ, সর্ব্বশাস্ত্র, ইতিহাস, উপবেদ, বেদাঙ্গ সমুদয়, যজ্ঞ, সোম, দেবগণ, দুৰ্গতিরণী, সাবিত্রী, সপ্তবিধ বাণী, মেধা, ধৃতি, স্মৃতি, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, যশ, ক্ষমা, সাম, স্তুতিশাস্ত্ৰ, বিবিধ গাথা, দেহসম্পন্ন তর্কযুক্ত ভাষ্য, নানাপ্রকার নাটক, বিবিধ প্রকার কাব্য, বহবিধ কথা, সমস্ত আখ্যায়িকা, সমুদয় কারিকা, এই সমস্ত পাবন ও অন্যান্য গুরুপূজকগণ তথায় অবস্থান করিয়া থাকেন। ক্ষণ, লব, মুহূর্ত, দিবা, রাত্রি, পক্ষ, মাস, ছয় ঋতু, সংবৎসর, পঞ্চযুগ, চতুর্বিধ অহোরাত্র, দিব্য নিত্য অক্ষয় অব্যয়, কালচক্র ও ধর্ম্মচক্ৰ ইহারাও প্রতিনিয়ত আসিয়া থাকেন। দিতি, অদিতি, দনু, সুরসা, বিনতা, ইরা, কালিকা, সুরভি, দেবী সরমা গৌতমী, প্রতা, কদ্রু, দেবমাতৃগণ, রুদ্রাণী, শ্ৰী, ভদ্রা, ষষ্ঠী, মূর্তিমতী দেবী পৃথিবী, হ্রী, স্বাহা, কীর্তি, সুরা দেবী, শচী, পুষ্টি, অরুন্ধতী, সংবৃত্তি, আশা, নিয়তি, সৃষ্টি, দেবী রতি ও অন্যান্য দেবীগণ ভগবান ব্ৰহ্মার উপাসনা করিয়া থাকেন। দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, উনপঞ্চাসৎ মরুৎ ও অশ্বিনীকুমারযুগল, বিশ্বদেবীসমূহ, সাধ্যসার্থ মনোজব পিতৃগণ সকলে সভাসীন ব্ৰহ্মার উপাসনা করেন। হে পুরুষৰ্ষভ! ঐ পিতৃলোকদিগের সপ্তগণ, তন্মধ্যে চতুষ্টয় শরীরধারী ও ত্রয় অশরীরী। সকলেই বিরাট-প্রভাব, লোকবিশ্রুত ও চতুর্ব্বর্গপূজিত; প্রথম গণের নাম অগ্নিষ্বাত্ত, দ্বিতীয়ের নাম গার্হপত্য, তৃতীয়ের নাম নাকচার, চতুর্থের নাম সোমপ, পঞ্চমের নাম একশৃঙ্গ, ষষ্ঠের নাম চতুর্ব্বেদ, সপ্তমের নাম কলা। ইহারা প্রথমত আপ্যায়িত হইলে সোম পরিতৃপ্ত হয়েন। রাক্ষসগণ, পিশাচবৰ্গ, দানবসমুদয়, গুহ্যকসকল, নাগসার্থ, সুপর্ণসমূহ ও পশুসমুদয় পিতামহ ব্ৰহ্মার আরাধনা করে। স্থাবর-জঙ্গমসকল, মহাভূত সমুদয়, দেবেন্দ্র পুরন্দর, বরুণ, কুবের, যম, ঊমাসহ মহাদেব তথায় সর্ব্বদা সমাগত হইয়া থাকেন। মহাসেন, দেব নারায়ণ, দেবর্ষিবর্গ, বালখিল্য ঋষিগণ, যোনিজ ও অযোনিজ ঋষি-সকল আর ত্ৰিভুবনে যে সমস্ত স্থাবর-জঙ্গম দেখিতে পাওয়া যায়, ইহারা সকলেই ব্ৰহ্মার উপাসনা করেন। হে নরাধিপ! আমি স্বয়ং তথায় উপস্থিত হইয়া এই সমস্ত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি। অষ্টাশীতি সহস্ৰ ঊৰ্দ্ধরেতা ঋষি, প্ৰজাবান, পঞ্চাশৎ ঋষি ও অন্যান্য দেবতা সকলে ব্ৰহ্মাকে মনোবাঞ্ছা পূরণপূর্ব্বক দর্শন ও প্ৰণাম করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিয়া থাকেন।

সর্ব্বভুতদয়াবান ব্ৰহ্মা অভ্যাগত অতিথিগণ, দেব, দৈত্য, নাগ, দ্বিজ, যক্ষ, সুপর্ণ, কালেয়, অপ্সরা ও গন্ধর্ব্ব সকলেরই সমুচিত অভ্যর্থনা করিয়া থাকেন। তিনি যথাযোগ্য সমাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক সাত্ত্বনাবাদ, সম্মান ও অর্থপ্ৰদান দ্বারা তাহাদিগের প্রীতি সম্পাদন করেন। এই সমস্ত আগন্তুকদিগের সমাগমে ও দগড়বাদ্যে সেই সুখপ্ৰদা সভা আকুল হইয়া উঠে। সর্ব্বতেজোময়ী, দিব্যা, ব্রহ্মর্ষিগণসেবিতা, শ্রমাপহারিণী, সেই সভা ব্রাহ্মী শ্ৰী দ্বারা দীপ্যমান হইয়া অদ্ভুত শোভা পাইয়া থাকে। হে রাজশাৰ্দূল! যাদৃশ তোমার এই সভা মনুষ্যলোকের দুর্লভ, তাদৃশ ত্ৰিলোকমধ্যে ব্ৰহ্মসভা দুষ্প্রাপ্য। হে ভারতবংশশ্রেষ্ঠ! আমি দেবলোকে এই সমস্ত সভা প্রত্যক্ষ করিয়াছি, এক্ষণে মনুষ্যলোকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠতম তোমার এই সভা দৰ্শন করিলাম।

মহাভারত,সভাপর্ব,কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদ[১৯]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Brahmaloka (the world of Brahmā/ brahman’), Oxford Reference। A Dictionary of Hinduism, W. J. Johnson, Oxford University Press. "Brahmaloka: The highest world or heaven in the cosmology of the Purāṇas, also known as ‘Satyaloka’ (‘the world of truth’)."
  2. Brahmaloka, Brahma-loka, Brahman-loka: 21 definitions
  3. Mādhava (১৯৮৬)। Srimad Sankara digvijayam (ইংরেজি ভাষায়)। Padmanaban। পৃষ্ঠা 86। 
  4. "'Verse 5.' Bramha Samhita - ISKCON Desire Tree"ISKCON Desire Tree। সংগ্রহের তারিখ ২২ জুন ২০২২ 
  5. Soifer, Deborah A.। Myths of Narasimha and Vamana, The: Two Avatars in Cosmological Perspective (ইংরেজি ভাষায়)। SUNY Press। পৃষ্ঠা 53। আইএসবিএন 978-1-4384-2063-9 
  6. Definition of 'Brahmaloka', Brahmaloka in American English Hinduism: The highest part of Kamaloka, where refined souls exist in blissful contemplation of Brahma.
  7. Brahma-loka Brahma-loka (Skt.; Pāli, Brahma world) is used in two senses to refer to the heavens or spiritual realms in Buddhist cosmology.
  8. Brahma-loka, Hinduism and Buddhism. "Brahma-loka, in Hinduism and Buddhism, that part of the many-layered universe that is the realm of pious celestial spirits. In Theravāda Buddhism, the brahma-loka is said to consist of 20 separate heavens: the lower 16 are material worlds (rūpa-brahma-loka) inhabited by progressively more radiant and subtle gods, the remaining 4 higher realms are devoid of substance and form and are said to constitute the arūpa-brahma-loka. Theravāda Buddhists hold that rebirth in the brahma-loka is the reward enjoyed by an individual who has accompanied great virtue with meditation. The actual level an individual attains is determined by his faithfulness to the Buddha, the dhamma (Sanskrit dharma, “teachings”), and the saṅgha (the religious community), as well as the depth of his insight into the true formless nature of the universe. Like all other worlds in Theravāda cosmology, the brahma-loka undergoes constant change, destruction, and re-creation.'
  9. Sri Brahma Samhita: with the commentary Dig-darsani-tika of Sri Jiva Gosvami। The Bhaktivedanta Book Trust। আইএসবিএন 9789171497093 
  10. "Holy Upanishads: Chhandogya Upanishad: Part 8"। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ 
  11. Olivelle 1998, পৃ. 277।
  12. বাংলা গীতা। অক্ষরব্রহ্মযোগ, শ্লোক ১৬। "আব্রহ্মভুবনাল্লোকাঃ পুনরাবর্তিনোঽর্জুন । মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে ॥"
  13. বাংলা গীতা। পুরুষোত্তমযোগ, শ্লোক ৬। "ন তদ্ ভাসয়তে সূর্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ। যদ্ গত্বা ন নিবর্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।"
  14. K. Wagle, Narendra (১৯৯৫)। Society at the Time of the Buddha। Popular Prakashan। পৃষ্ঠা 97। আইএসবিএন 9788171545537 
  15. সংস্কৃত "श्रीमद् भगवद्गीता। आब्रह्मभुवनाल्लोकाः पुनरावर्तिनोऽर्जुन। मामुपेत्य तु कौन्तेय पुनर्जन्म न विद्यते।। 8.16।।" English Translation By Swami Gambirananda. "O Arjuna, all the worlds together with the world of Brahma are subject to return. But, O son of Kunti, there is no rirth after reaching Me."
  16. "Hinduism, Chhandogya upanishad, part 08, English translation by Swami Nikhilananda."। ৫ আগস্ট ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২১ 
  17. Satyaloka Satyaloka is the highest loka in the material universe and is the abode of Lord Brahma. It is also called Brahmaloka.
  18. Sri Brahma Samhita: with the commentary Dig-darsani-tika of Sri Jiva Gosvami. 
  19. কালীপ্রসন্ন সিংহ। মহাভারত। সাহিত্য তীর্থ পাবলিশার্স। 

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]