ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো (তিব্বতি: བསོད་ནམས་རྒྱ་མཚོ་, ওয়াইলি: bsod nams rgya mtsho), (১৫৪৩-১৫৮৮) তিব্বতী বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মসম্প্রদায় দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের তৃতীয় দলাই লামা ছিলেন। দলাই লামাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন প্রথম যিনি তার জীবদ্দশায় দলাই লামা উপাধি লাভ করেন।
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য তিব্বতের দ্বুস অঞ্চলের ক্যিশোদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা র্নাম-র্গ্যাল-গ্রাগস-পা (ওয়াইলি: rnam rgyal grags pa) ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজ্যের একজন আধিকারিক ছিলেন। তার মাতার নাম ছিল দ্পাল-'দ্জোম-বু-খ্রিদ (ওয়াইলি: dpal 'dzom bu khrid)। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় রা-নু-সি-ছোস-'গেল-ব্জাং-পো (ওয়াইলি: ra nu sri chos 'phel bzang po) দুই বছর বয়সে তাকে দ্গে-'দুন-র্গ্যা-ম্ত্শোর অবতাররূপে চিহ্নিত করা হয়।[১] ১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজ্যের শাসকের নির্দেশে তাকে দ্রেপুং বৌদ্ধবিহারের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি পান-ছেন-ব্সোদ-নাম্স-গ্রাগ্স-পা নামক বৌদ্ধভিক্ষুর নিকট শিক্ষার্থীর শপথ গ্রহণ করেন, যিনি তার নতুন নামকরণ করেন ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো-দ্পাল-ব্জাগ-পো-ব্স্তান-পা'ই-ন্যি-মা-ফ্যোগ্স-থাম্স-চাদ-লাস-র্নাম-পার-র্গ্যাল-বা (ওয়াইলি: bsod nams rgya mtsho dpal bzang po bstan pa'i nyi ma phyogs thams cad las rnam par rgyal ba)। ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সেরা বৌদ্ধবিহারের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।[২]:১৩৯ ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভিক্ষুর শপথ গ্রহণ করেন। তার পূর্বসুরী দ্গে-'দুন-র্গ্যা-ম্ত্শোর মতোই তিনিও তিব্বতের শাসকশক্তিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন। গুজ রাজ্যের রাজা 'জিগ-র্তেন-দ্বাং-ফ্যুগ-পাদ-দ্কার-ল্দে (ওয়াইলি: 'jig rten dbang phyug pad dkar lde) তাকে ঐ রাজ্যে প্রচারের আমন্ত্রণ জানান, কিন্তু সম্ভবতঃ তিনি ঐ আমন্ত্রণরক্ষা করেননি। তিনি ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাগ-মো-গ্রু-পা রাজসভায় এক মন্ত্রী রূপেও অধিষ্ঠিত ছিলেন।[৩]
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শোর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় বিজয় ছিল মঙ্গোলদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন যা পরবর্তীকালে তিব্বতে দ্গে-লুগ্স ধর্মস্মপ্রদায় ও দলাই লামাদের রাজনৈতিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। তুমেত মঙ্গোল নেতা আলতান খান ১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তাকে মঙ্গোলিয়া যাত্রার আমন্ত্রণ জানালে ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তার এক শিষ্যকে সেই স্থানে পাঠান। তার শিষ্য মঙ্গোলিয়া থেকে ফিরে এসে ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শোকে মঙ্গোলিয়ায় তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম প্রচারের বিশাল সুযোগ সম্বন্ধে অবহিত করেন।[৪]:২১৮ ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দে আলতান খান পুনরায় তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি আহ্রিক কার্পাতাং নামক স্থানে যাত্রা করেন, যেখানে তাকে মহাসমারোহে স্বাগত জানানো হয়। তাকে হাজারখানেক গৃহপালিত পশু দান করা হয় এবং পাঁচশত ঘোড়সওয়ার তাকে আলতান খানের রাজসভায় নিয়ে যান। সেখানে দশ হাজার মানুষের সাথে শ্বেত বস্ত্র পরিহিত আলতান খান তাকে স্বাগত জানান।[৫] অনেকের মতে[৬] আমদো অঞ্চলে আবার অনেকের মতে[৭] কোকনর হ্রদের তীরে এই সাক্ষাৎকার ঘটেছিল।
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো নিজেকে সা-স্ক্যা ধর্মসম্প্রদায়ের সপ্তম সা-স্ক্যা-খ্রি-'দ্জিন 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পার অবতাররূপে ঘোষণা করেন এবং আলতান খানকে 'গ্রো-ম্গোন-ছোস-র্গ্যাল-'ফাগ্স-পার পৃষ্ঠপোষক কুবলাই খানের অবতাররূপে বর্ণনা করেন।[২]:১৪৬ এই সময় আলতান খান ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শোকে ঘাইখামসিঘ বচির-আ দার-আ সে-ইন চোঘ-তু বুয়ান-তু দলাই উপাধি দান করেন যা পরবর্তীকালে দলাই লামা হিসেবে সংক্ষেপিত ও বিখ্যাত হয়।[৮]
আলতান খান এই সময় মঙ্গোলিয়ার প্রথম বৌদ্ধবিহার থেগছেন ছোনখোর স্থাপন করেন এবং তিব্বতী গ্রন্থ থেকে মঙ্গোলিয় ভাষায় অনুবাদের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেন। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীতে পরিণত হন এবং দশ হাজারের ওপর ভিক্ষু দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের অন্তর্গত হন।[২]:১৪৪ ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো মঙ্গোলিয়ায় পশুবলি ও মানবুহত্যা নিষিদ্ধ করেন, মঙ্গোল দেবদেবী মূর্তি ও চিত্রগুলিকে বিনষ্ট করার নির্দেশ দেন ও সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।[৪]:২১৯[৯] [১০]
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো বেশ কয়েকটি বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল র্নাম-র্গ্যাল বৌদ্ধবিহার। প্রথম দিকে ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বৌদ্ধবিহার দ্রেপুং অঞ্চলে গ্র্বা-ত্শাং-ফান-ব্দে-লেগ্স-ব্শাদ-গ্লিং (ওয়াইলি: grwa tshang phan bde legs bshad gling) নামে স্থাপিত হলেও পরবর্তীকালে পঞ্চম দলাই লামা পোতালা প্রাসাদের অংশ হিসেবে একে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।[১১] ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলিয়া যাত্রার সময় তিনি দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ত্সোং-খা-পা-ব্লো-ব্জাং-গ্রাগ্স-পার জন্মস্থানে পৌঁছন। ঐ স্থানে ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে রিন-ছেন-ব্র্ত্সোন-'দ্রুস-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: rin chen brtson 'drus rgyal mtshan) একটি ছোট মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শোর অনুরোধে তিনি ঐ মন্দিরটিকে বর্ধিত করে ১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে স্কু-'বুম বৌদ্ধবিহার নামক বিশাল বৌদ্ধবিহার স্থাপন করেন। ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে খাম্স অঞ্চলে লিথাং বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন।[৩]
মঙ্গোলিয়ায় বসবাস কালে চীনের মিং সম্রাট তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেই আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করেন। এই সময় তিনি তিব্বত ফিরে গেলে ছাব-ম্দো-ছোস-'খোর-ব্যাম্স-পা-গ্লিং বৌদ্ধবিহারের (ওয়াইলি: chab mdo chos 'khor byams pa gling) দ্বাদশ প্রধান ল্হা-দ্বাং-ছোস-ক্যি-র্গ্যাল-ম্ত্শান (ওয়াইলি: lha dbang chos kyi rgyal mtshan) তাকে তার বৌদ্ধবিহারের প্রধান হওয়ার আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেই স্থানে ছয় মাস প্রধানের দায়িত্ব পালন করে লাসা শহরে ফিরে আসেন। ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে আলতান খানের মৃত্যুর পরেও তার পুত্র দুগুরেংয়ের আমন্ত্রণে তিনি প্নরায় মঙ্গোলিয়া যান। এই সময় তিনি খালখা মঙ্গোল ও ওদ্রোস মঙ্গোলদের মধ্যেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কয়েকদিন শারীরিক অসুস্থার পর তার মৃত্যু হয়।[৩]
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
পূর্বসূরী দ্গে-'দুন-র্গ্যা-ম্ত্শো |
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো তৃতীয় দলাই লামা |
উত্তরসূরী য়োন-তান-র্গ্যা-ম্ত্শো |
পূর্বসূরী ল্হা-দ্বাং-ছোস-ক্যি-র্গ্যাল-ম্ত্শান |
ব্সোদ-নাম্স-র্গ্যা-ম্ত্শো ছাব-ম্দো-ছোস-'খোর-ব্যাম্স-পা-গ্লিং বৌদ্ধবিহারের ত্রয়োদশ প্রধান |
উত্তরসূরী ম্থোং-বা-দোন-ল্দান |