ভস্মীকরণ বলতে, সাধারণত খাদ বা অস্থিতিশীল পদার্থ অপসারণের উদ্দেশ্যে বায়ু বা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে উচ্চ তাপমাত্রায় কোনো বস্তুকে উত্তপ্ত করাকে বোঝায়।[১] যাইহোক, ভস্মীকরণ তাপীয় ক্ষয় আনতে আকরিক এবং অন্যান্য কঠিন উপাদানে প্রয়োগ করা হয় যা বায়ু বা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে একটি তাপীয় প্রক্রিয়া বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। ভস্মীকরণ শব্দের মূল অর্থ এর সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যবহারকে বোঝায়, যা ক্যালসিয়াম অক্সাইড(কুইকলাইম) উৎপাদনের জন্য দহনের মাধ্যমে চুনাপাথর থেকে কার্বন অপসারণ করাকে বোঝায়। ভস্মীকরণ বিক্রিয়াটি হলঃ CaCO3(s) → CaO(s) + CO2(g)। ক্যালসিয়াম অক্সাইড আধুনিক সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এবং এছাড়াও স্মেল্টিং একটি রাসায়নিক ফ্লাক্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়। শিল্পক্ষেত্রে ভস্মীকরণ সাধারণত কার্বন ডাই অক্সাইড(CO2) নিঃসরণ করে, এটি জলবায়ু পরিবর্তনে বিশেষ অবদান রাখে।
ভস্মীকারক হল একটি স্টিলের সিলিন্ডার যা একটি উত্তপ্ত চুল্লির অভ্যন্তরে ঘোরানো হয় এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে পরোক্ষভাবে উচ্চ-তাপমাত্রায়(৫৫০-১১১৫০°C, বা ১০০০-২২১০০°F) প্রক্রিয়াকরণ সম্পাদন করা হয়।[২]
ভস্মীকরণ প্রক্রিয়াটি ল্যাটিন শব্দ calcinare (চুনের দহন) থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যা সিমেন্ট তৈরি করার জন্য ক্যালসিয়াম কার্বনেট-কে(চুনাপাথর) ক্যালসিয়াম অক্সাইড(চুন) এবং কার্বন ডাই অক্সাইড-এ বিশ্লেষণ করাকে বোঝায়। ভস্মীকরণের ফলে সৃষ্ট উৎপাদকে সাধারণত "ক্যালসিন" হিসেবে উল্লেখ করা হয়, এমনকি তাপীয় প্রক্রিয়ার ফলে প্রকৃত খনিজ পদার্থ যাই হোক না কেন। ভস্মীকরণ প্রক্রিয়া শ্যাফট ফার্নেস, রোটারি কিন, মাল্টিপল হার্ট ফার্নেস, এবং ফ্লুইডাইজড বেড রিয়েক্টর সহ বিভিন্ন ডিজাইনের ফার্নেস বা চুল্লীতে সম্পন্ন করা হয়।
ভস্মিকরণ প্রক্রিয়ার উদাহরণ নিম্নে অন্তর্ভুক্তঃ
১. কার্বন ডাই অক্সাইড আলাদা করার জন্য চুনাপাথরের ভস্মীকরণের মত কার্বনেট আকরিকের বিশ্লেষণ;
২. জলীয় বাষ্প হিসাবে স্ফটিকের পানি অপসারণ করার জন্য হাইড্রেটেড খনিজ পদার্থ, যেমন বক্সাইট এবং জিপসামের ভস্মীকরণ;
৩. কোক সমন্বিত পেট্রোলিয়ামের অস্থিতিশীল পদার্থের বিশ্লেষণ;
৪. জিওলাইট সংশ্লেষণে অ্যামোনিয়াম আয়ন অপসারণ;
৫. ইউরেনিয়াম ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোফ্লোরিক অ্যাসিড গ্যাস তৈরি করতে ইউরেনাইল ফ্লোরাইডের অপসারণ।
ভস্মীকরণ বিক্রিয়া সাধারণত তাপীয় বিশ্লেষণ তাপমাত্রায়(বিশ্লেষণ এবং ভোলাটিলাইজেশন বিক্রিয়ার জন্য) অথবা পরিবর্তনশীল তাপমাত্রায়(পর্যায় পরিবর্তনের জন্য) সংঘটিত হয় । এই তাপমাত্রা সাধারণত সেই তাপমাত্রা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যেখানে একটি নির্দিষ্ট ভস্মীকরণ বিক্রিয়ার জন্য আদর্শ গিবস মুক্ত শক্তির মান শূন্য হয়।
চুনাপাথরের ভস্মিকরণে, বিশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি ৯০০ থেকে ১০৫০°C তাপমাত্রায় ঘটে, বিক্রিয়াটি হলঃ
CaCO3(s) → CaO(s) + CO2(g)
বর্তমানে, এই বিক্রিয়াটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিমেন্টের ভাটাতে ঘটে।
বিক্রিয়ায় আদর্শ গিবস মুক্ত শক্তির আনুমানিক মান ΔG°r ≈ ১৭৭,১০০ − ১৫৮ T (J/mol)।[৩] বিক্রিয়ায় আদর্শ মুক্ত শক্তি এই ক্ষেত্রে 0, যখন তাপমাত্রা, T, ১১২১ K বা ৮৪৮ °C এর সমান হয়।
কিছু ক্ষেত্রে, ধাতুর ভস্মীকরন ধাতুর জারণের ফলস্বরূপ হয়ে থাকে। জিন রে উল্লেখ করেছেন যে, লেড এবং টিন এর যখন ভস্মিকরণ করা হয় তখন এদের ওজন বেড়ে যায়, তা সম্ভবত যখন জারণ হচ্ছিল তখন।
আলকেমিতে ভস্মিকরণকে পদার্থের রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ১২ টি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি বলে মনে করা হত।
অ্যালকেমিস্টরা ভস্মীকরণকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন; প্রকৃত এবং সম্ভাব্য। প্রকৃত ভস্মীকরণ হচ্ছে প্রকৃত আগুন, কাঠ, কয়লা বা অন্যান্য জ্বালানী থেকে, যা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় উন্নীত হয়। সম্ভাব্য ভস্মীকরণ হচ্ছে সম্ভাব্য আগুন, যেমন ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য; উদাহরণস্বরূপঃ স্বর্ণকে, পারদ এবং সাল এমোনিয়াক এর সঙ্গে একটি পুনর্বারক চুল্লিতে ভস্মীকরণ করা; সাধারণ লবণ ও ক্ষারীয় লবণ এর সঙ্গে রূপার ভস্মিকরণ; লবণ ও সালফার সহ তামা; সাল এমোনিয়াক এবং ভিনেগারের সঙ্গে লোহা; এন্টিমনির সঙ্গে টিন; সালফার দিয়ে সীসা; এবং অ্যাকুয়া ফোর্টিসের সঙ্গে পারদের ভস্মীকরণ।[৪]
এছাড়াও ফিলোসফিক্যাল ভস্মীকরণ ছিল; বলা হতো যখন শিং, হুক ইত্যাদি, ফুটন্ত পানি বা অন্যান্য তরলের উপর ঝুলিয়ে রাখা হত, যতক্ষণ না তারা তাদের মিউসিলেজ হারিয়ে ফেলতো, এবং সহজেই পাউডারে পরিণত হতো।