ভারতীয় চুক্তি আইন ১৮৭২ | |
---|---|
সূত্র | Act No. 9 of 1872 |
ভারতবর্ষে চুক্তি সম্পর্কীয় আইন ভারতীয় চুক্তি আইন ১৮৭২ (ইংরেজি: Indian Contract Act, 1872) তে সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে। এই আইনটি ইংরেজ শাসনের সময়ে অনুমোদিত এবং এটি ইংরেজ সাধারণ আইনের (British Common Law) নীতিসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে সমগ্র ভারতে ভারতীয় চুক্তি আইনটি প্রযোজ্য। এই আইনটি কোন্ পরিস্থিতিতে কোনো কাজের জন্য দুটি দলের হওয়া চুক্তি আইনমতে পালনীয় হবে তাকে নির্ণয় করে। প্রত্যেক লোকই প্রতিদিন বিভিন্ন চুক্তিতে জড়িত হয়ে পড়ে। এই চুক্তিসমূহ থেকে কিছু অধিকার এবং কর্ত্তব্যর সৃষ্টি হয়। ভারতীয় চুক্তি আইনে ভারত এই অধিকার এবং কর্ত্তব্যসমূহের সুরক্ষা তথা পালনের বিষয় সামগ্রিকভাবে নেয়।
১৮৬১ সালে ইংরেজ শাসনকালে চেয়ারম্যান স্যার জন রমিলির (Sir John Romilly) তত্ত্বাবধানে স্যার এডওয়ার্ড রিয়ান, আর. লোব, জে. এম. মেকলয়েড, স্যাার ডব্লিউ. আরলি এবং জাষ্টিস উইলসকে প্রারম্ভিক সদস্য হিসাবে নিয়ে গঠন করা তৃতীয় আইন আয়োগ (The Third Law commission) ভারতের জন্য চুক্তি আইনের এক প্রতিবেদন খসড়া হিসাবে দাখিল করে। এই খসড়া ১৮৭২ সালের ২৫ এপ্রিল সেই বর্ষের নবম আইন হিসাবে গৃহীত হয় এবং ১৮৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভারতীয় চুক্তি আইনটি কার্যকরী হয়।
ভারতীয় চুক্তি আইন ১৮৭২ গৃহীত হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতে চুক্তির জন্য কোনো সংগঠিত আইন ছিল না। দেশটির মুখ্য নগরসমূহ অর্থাৎ মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলিকতায় বিভিন্ন চুক্তিসমূহ রাজা ১ম জর্জ ১৭২৬ সালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অনুমোদন করা এক সনদমতে সম্পন্ন হয়েছিল। এর পরে ১৭৮১ সালে ইংরেজ সরকার নিষ্পত্তি আইন বলবৎ করে। নিষ্পত্তি আইন অনুসারে ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয় চুক্তি সম্পর্কিত বিষয়সমূহ সওয়াল-জবাব করেছিলেন। পক্ষের ধর্ম অনুসারে বিবাদসমূহের মীমাংসা হিন্দু আইন অথবা মুসলিম আইনমতে হয়েছিল। অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে পদকীয় আইন প্রযোজ্য ছিল। মূল শহরগুলির বাইরের চুক্তিসমূহ ইংরেজ চুক্তি আইনসমূহের মতে সম্পন্ন করা হয়েছিল।
গৃহীত হওয়ার সময়ে আইনটির ২৬৬ টা ধারা ছিল। আইনটি যথেষ্ট বড় পরিসরের ছিল এবং এটি নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ নিয়ে হয়েছিল।
ভারতীয় চুক্তি আইনে সামগ্রী বিক্রয় এবং অংশীদারী ব্যবসায় সম্পর্কীয় সরল এবং প্রাথমিক নীতিসমূহ সামরি লৈছিল। বাণিজ্য ক্ষেত্রটির প্রগতির ফলত উদ্ভব হওয়া নতুন নিয়ম-নীতিসমূহ সামরি ল'বলৈ চুক্তি আইনটি যঠেষ্ট নাছিল। গতিকে ১৯৩০ এবং ১৯৩২ সালে সামগ্রী বিক্রয় এবং অংশীদারী ব্যবসায়র জন্য দুটি নতুন আইন ক্রমে সামগ্রী বিক্রয় আইন ১৯৩০ এবং অংশীদারী ব্যবসায় আইন ১৯৩২ গৃহীত করা হয়।
বর্তমান সময়ে ভারতীয় চুক্তি আইনে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ এসেছে।
আইনটির ধারা ২(এইচ) মতে "আইনমতে বলবৎ হওয়া যেকোনো বন্দোবস্তই"চুক্তি। অর্থাৎ বৈধ চুক্তির জন্য এক বন্দোবস্ত ও থাকা এবং এটি আইনমতে বলবৎ হওয়া প্রয়োজনীয়।[২]
ধারা ২(ই) মতে "পরস্পরের জন্য লাভের সৃষ্টি করা সকল অঙ্গীকার এবং অঙ্গীকারের সকল সমষ্টি" বন্দোবস্ত।[২]
ধারা ২(বি) মতে "যখন একজন লোক তাঁকে দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয় তখন প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়া বলে ধরা হয়। যখন একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় তখন এটি একটি অঙ্গীকার হয়ে যায়।"[২]
ধারা ১০ অনুসারে, "সবধরণের বন্দোস্তই চুক্তি, যদি এইসমূহ দুইপক্ষের মুক্ত সম্মতি, চুক্তির জন্য যোগ্যতার, এক ন্যায্য সামগ্রীর সঙ্গে ন্যায্য লাভের জন্য হয়, এবং যদি একে প্রকাশ্যে অবৈধ বলে স্বীকৃত দেওয়া না হয়।"
ভারতীয় চুক্তি আইন ১৮৭২ ধারা ২(এ) ত প্রস্তাবের সংজ্ঞা এরকম দেওয়া হয়েছে, "যখন একজন ব্যক্তি অন্য একজনের সম্মতি নিয়ে কোনো এক কাজ করার বা কাজটি করার থেকে মুক্ত থাকার ইচ্ছা অন্যজনকে ব্যক্ত করে, তখন তাঁকে একটা প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে ধরা হয়।" এইমত এক ন্যায্য প্রস্তাব হতে হলে কাজটি করা বা না করার ইচ্ছার বিষয়টি ব্যক্ত করা জরুরী। কিন্তু কেবল ইচ্ছা ব্যক্ত করলেই এটি ন্যায্য প্রস্তাব হয় না। এই ইচ্ছার কথা প্রস্তাব পাঁচজনকে তাদের সম্মতি নিয়ে প্রত্যেককে জানাতে হয় এবং এই প্রস্তাবে এমন কোনো শর্ত্ত থাকবে না যেটি পূর্ণ না হলে প্রস্তাব গৃহীত হল বলে ধরা যায়।
প্রস্তাবের বিভাগসমূহ: ১. সাধারণ প্রস্তাব : সকলের জন্য। ২. বিশেষ প্রস্তাব : নির্দিষ্ট লোকর জন্য। ৩. বিপরীতমুখী প্রস্তাব : দুইপক্ষ পরস্পরকে দেওয়া একই প্রস্তাব। ৪. পরিবর্ত্তিত প্রস্তাব : মূল প্রস্তাবের শুদ্ধি। ৫. স্থিত প্রস্তাব : কোনো বিশেষ সময় পর্যন্ত থাকা প্রস্তাব।
ধারা ২(বি) মতে "যখন একজন লোক তাঁকে দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয় তখন প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে বলে ধরা হয়। যখন একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।"
ন্যায্য প্রস্তাব গ্রহণের নিয়মসমূহ:
১. প্রস্তাব গ্রহণ এবং পাশ করতে হবে।
২. প্রস্তাব দাতাকে সম্মতির বিষয়ে অন্যজনকে জানাতে হবে।
৩. প্রস্তাবটি নির্ধারিত উপায়ে গ্রহণ করতে হবে।
8. নির্দিষ্ট করে দেওয়া অথবা এক যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।
৫. মৌনতাকে প্রস্তাব গ্রহণ হিসাবে ধরা হয় না।
৬. দুইপক্ষ বিষয়টিতে সম্মত হতে হবে।
ধারা ২(ডি) র সংজ্ঞা অনুযায়ী, "when at the desire of the promisor, the promisee or any other person, has done or abstained from doing, or does or abstains from doing, or promises to do or abstain from doing, something, such act or abstinence or promise is called a consideration for the promise."[৩]
বন্দোবস্ত একটি দুইপক্ষের একটা ন্যায়সংগত লাভের (consideration) জন্য হতে হবে।
সেই লাভ আইনসংগত হবে না যদি এটি:
আইনটির ধারা ১১ অনুযায়ী এক বৈধ চুক্তির জন্য পক্ষসমূহের নিম্নলিখিত যোগ্যতা থাকতে হবে।
ধারা ১৩ অনুযায়ী, দুজন বা ততোধিক ব্যক্তিকে তখনই সম্মত হওয়া বলে ধরা হয় যখন তারা কোনো এক বিষয়ে একই অর্থে একমত হয়।[৪]
একটি সম্মতি তখনই মুক্ত হয় যখন এটি বাধ্যকরণ (ধারা ১৫), দমনীয় প্রভাব (ধারা ১৬), জাল (ধারা ১৭), অপবর্ণনা (ধারা ১৮) এবং ভুলের দ্বারা (ধারা ১৯) প্রভাবিত না হয়।
চুক্তি একটি নিম্নলিখিত ধরনে নির্বাহ অথবা রদ করা হতে পারে।
১. একমত মাধ্যমে নির্বাহ (ধারা ৬২, ৬৩)
দুইপক্ষের মুক্ত সম্মতি থাকলে একটি চুক্তি নির্বাহ করতে পারা যায়।[৫]
২. রূপায়ণের মাধ্যমে নির্বাহ (ধারা ৩৭, ৩৮)
চুক্তি অনুযায়ী কার্য সমাপন হলেই সেই চুক্তি নির্বাহ হয়।[৬]
৩. আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাহ
চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তির মৃত্যু হ'লে অথবা তিনি দেউলীয়া অবস্থাত পড়লে আইন হস্তক্ষেপ করে চুক্তিটি বাতিল করে। কোনো ক্ষেত্রে যদি পূর্বের অধিকার নতুন অধিকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় তবে পূর্বের অধিকার সম্বন্ধীয় চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।[৭]
৪. চুক্তি ভংগকরণের মাধ্যমে নির্বাহ (ধারা ৩৯)
কোনো পক্ষই চুক্তি অনুসারে কার্য না করলে সেই চুক্তি বাতিল হয়। এইক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত অন্য পক্ষ প্রথম পক্ষের বিপক্ষে আইনের কাছে যেতে পারে।[৮]
৫. রূপায়ণ করার সম্ভাবনাহীনতার মাধ্যমে (ধারা ৫৬)
একটি চুক্তি রূপায়ণ করা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লে এটি নির্বাহ হয়।[৯]
৬. সময় পেরোনোর ফলে
চুক্তি রূপায়ণের সময় পেরিয়ে গেলে এটি বাতিল হয়ে যায়। মেয়াদ আইন ১৯৪০ (The Limitation Act 1940) অনুযায়ী একটি চুক্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রূপায়িত করতে হয়।[১০]