খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকেই ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাস আরম্ভ হয়। চীনা ইয়েন এবং লিডিয়ান ষ্টেটারের সাথে প্রাচীন ভারত মুদ্রার প্রারম্ভিক প্রচলনকারী দেশসমূহের অন্যতম।[২]
হিন্দী রুপিয়া শব্দটি পিটিয়ে চ্যাপ্টা করা রুপো (ধাতু) অর্থাৎ রুপোর মুদ্রা বা মোহর মেরে চিহ্নিত করা কাজকে বোঝানো সংস্কৃত শব্দ রূপার থেকে উদ্ভূত হয়েছে। [৩] এই রুপো শব্দটি আকার বা আকৃতি বোঝানো সর্বনাম পদ রূপএর থেকে এসেছে এবং এটি মূলতঃ দ্রাবিড় ভাষার শব্দ।[৪]
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ রুপোর মোহর রূপ্যরূপ, সোনার মোহর সুবর্ণরূপ এবং সীসার মোহর সীসারূপ এর কথা উল্লেখ আছে।[১]
শের শাহ শূরী তার পাঁচ বছরের শাসনকালে (১৫৪০-১৫৪৫) ১৭৮ রতি ওজনের রুপোর মুদ্রা রুপিয়া নামে প্রচলন করেছিলেন।[৩][৫] মোগল তথা মারাঠাদের রাজত্বকালের সঙ্গে ইংরেজশাসিত ভারতে রুপোর মুদ্রা প্রচলিত ছিল।[৬] কাগজের ব্যাঙ্কনোটের সর্বপ্রথম প্রচলনকারীর মধ্যে ছিল ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান (১৭৭০-১৮৩২), ওয়ারেন হেষ্টিংসের প্রতিষ্ঠা করা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল অ্যান্ড বিহার (১৭৭৩-৭৫) এবং বেঙ্গল ব্যাঙ্ক (১৭৮৪-৯১)।
১৯ শতকের সময়ে অন্যান্য সবল অর্থব্যবস্থাসমূহে সোনার ভিত্তিতে দেশীয় মুদ্রার মূল্য নির্ধারিত হওয়ার বিপরীতে ভারতীয় টাকা রুপোর (ধাতু) ওপর নির্ধারণ করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসনকাল এবং স্বাধীনোত্তর কালের প্রথমভাগে ভারতীয় এক টাকাকে আনা হিসাবে ১৬ আনায় ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি আনা ৪ পয়সা বা বারো পাইতে পুনরায় বিভাজিত করার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি এক টাকা ১৬ আনা বা ৬৪ পয়সা বা ১৯২ পাইয়ের সমান ছিল। ১৯৫৭ সালে এক টাকাকে নতুন করে ১০০ নয়া পয়সাতে ভাগ করা হয় এবং কিছু বছর পরেই আগের নয়া শব্দটি উঠিয়ে দেওয়া হয়।
কিছু বছর পর্যন্ত ইংরেজশাসিত এবং ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি স্থান যেমন পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আরব এবং পার্সিয়ান উপকূল ইত্যাদিতে ভারতীয় টাকা সরকারী মুদ্রা হিসাবে প্রচলিত হয়েছিল।
মৌর্য সাম্রাজ্যের সোনা, রুপো এবং সীসার মোহরের পরে মধ্যযুগে কোনো একটি নির্দিষ্ট মুদ্রা-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল না।[৭] শের শাহ শূরীকে ভারতীয় টাকার (রুপি) প্রথম প্রচলনকারী বলে মানা হয়।[৩]
প্রাচীন বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজত্বকালে যেরকম মুদ্রা প্রচলিত ছিল, তা ছিল সমচতুষ্কোণ। কোনও কোনও রাজার সময়ে সমষটকোণ মুদ্রাও তৈরী হত। মুদ্রায় বিশুদ্ধ রূপো ব্যবহৃত হত এবং সেই রূপোই আদর্শ চান্দী বলে মান্য হত। চব্বিশটি মুদ্রা এক সারিতে রাখলে যত বড় দীর্ঘ হত তার নাম ছিল এক হাত। সেই হাতের আশী হাতে এক রশি এবং একশো রশিতে এক ক্রোশ হত; সুতরাং সেই মুদ্রাই সমস্ত দৈর্ঘ্য পরিমাপের মূল ছিল। পরন্তু সেই টাকা একশতটির যে ওজন তারই নাম ছিল এক সের, চল্লিশ সেরে এক মণ এবং চৌষট্টি মণে এক রাশি বা পুঞ্জ হত; সুতরাং সেই মুদ্রাই ওজনের মূল ছিল। এভাবে সেই মুদ্রা সর্বপ্রকার তুলনার আধার ছিল বলে তাকে 'তোলা' বলা হত। সেই মুদ্রা যখন যে রাজার আমলে তৈরী হত, সেই রাজার নাম তাতে লেখা থাকত; তাঁর রাজ্যের নাম এবং শকাব্দ কিংবা সম্বৎ লেখা থাকত, কিন্তু কোন টাকায় কোন প্রতিমূর্তি থাকত না। আধুলি, সিকি বা দোয়ানী ছিল না; আনা পয়সা প্রভৃতিও ছিল না। মুদ্রা ভাঙালে এক বোঝা কড়ি মিলত, তা দ্বারাই কেনাবেচা চলত। পাঠান রাজত্বেও ঐরূপ ব্যবহারই ছিল। মোগল রাজ্যারম্ভে সর্বপ্রথম গোলাকার মুদ্রা প্রচলিত হয়। তুর্কী ভাষায় গোল টাকাকে 'তঙ্কা' বলে। সেই তঙ্কা শব্দের অপভ্রংশে বর্তমানে টাকা শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে।[৮]
ইংরেজ ঔপনিবেশিক সময়ে(১৭৫৭-১৯৪৭) পশ্চিম ভারত, দক্ষিণ ভারত এবং বঙ্গের (কলকাতা) উপনিবেশসমূহ ব্যবসায়-বাণিজ্যের জন্য নিজ নিজ ভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ করতে শুরু করে এবং আরো অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানি তাদের ঔপনিবেশিক বিস্তার শুরু করলে তাদের পৃথক মুদ্রা টঙ্কনের প্রক্রিয়া সূচিত হয়। ধীরে ধীরে নতুন নতুন মুদ্রা মুদ্রিত হয় যেমন - ক্যাশ, পাই, প্যাগোডা মুদ্রা, ব্রিটিশ সভারেন, রাজা উইলিয়াম এর সময় থেকে নতুন ধরনের রৌপ্যমুদ্রা, নতুন ধরনের আনা মুদ্রা, দুর্লভ স্বর্ণমুদ্রা (মোহর, ডবল মোহর), ব্রিটিশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবিত কিছু দেশীয় রাজার মুদ্রা (কিছু ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ছাপ যুক্ত),এছাড়াও নানা ধরনের ট্রেড ডলার ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদ টাঁকশাল থেকে নির্মিত মুদ্রার সাথে সাথে পরবর্তীকালে মাদ্রাজ, বোম্বে,ও অন্যত্র থেকেও মুদ্রা নির্মিত হয়। প্রাথমিক পর্বে মুদ্রা নির্মাণ নিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানির সাথে নবাবদের নানা সংঘাতের দৃষ্টান্ত রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে ভিক্টোরীয় যুগেও দেশীয় রাজাদের সাথে সরকারের মতভেদ ঘটেছিলো। পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের আমল থেকে বিশেষত ফররুখসিয়ারের সময় থেকে মুদ্রা নির্মাণে ব্রিটিশ প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
বঙ্গের মুদ্রাসমূহে মুঘল ধরন এবং মাদ্রাজী মুদ্রাসমূহে দক্ষিণ ভারতীয় ধরন বিকাশ লাভ করে। অন্যদিকে, পশ্চিম ভারতীয় ইংরেজ মুদ্রাসমূহে মোগল এবং ইংরেজ এই দুই ধরন বিকাশ লাভ করে। ১৭১৭ সালে ইংরেজগণ সম্রাট ফররুখসিয়ারের থেকে বোম্বে মুদ্রা নির্মাণশালায় মোগল মুদ্রা নির্মাণ করার অনুমতি পায়। ব্রিটিশ সোনার মুদ্রাকে কেরোলাইনা, রুপোর মুদ্রাকে এংলিনা, তামার মুদ্রাকে কাপারূন এবং টিনের মুদ্রাকে টিনি বলা হত। ১৮৩০ সালের প্রথমভাগে ইংরেজ ভারতের প্রভাবশালী শক্তি হিসাবে উঠে আসে। ১৮৩৫ সালে মুদ্রা আইনের জন্ম দিয়ে এটি কার্যকরী করা হয় এবং এটি সমগ্র ভারতে একক মুদ্রা ব্যবস্থার সূত্রপাত করে। নতুন মুদ্রাগুলির এক পিঠে ইংল্যান্ডের ৪র্থ উইলিয়ামের প্রতিকৃতি অঙ্কন করা হয়েছিল এবং অন্য পিঠে ইংরেজি ও ফার্সি ভাষাতে তার মূল্য অঙ্কিত ছিল। ১৮৪০ সালের পরে প্রবর্তন করা মুদ্রাগুলিতে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আবক্ষ প্রতিকৃতি অঙ্কিত করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসনাধিস্থতায় প্রথম মুদ্রা প্রচলন করা হয় ১৮৬২ সালে এবং ১৮৭৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারতের সম্রাজ্ঞীর উপাধি গ্রহণ করেন।
১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জ ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং নতুন করে মোহর তৈরি করেন। এই নতুন মোহরগুলিতে রাজাকে ভারতীয় হাতির সজ্জিত হার পরিহিত অবস্থায় অঙ্কন করা হয়েছিল। কিন্তু অতিশয় ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে হাতিগুলিকে শূকর-সদৃশ দেখা গিয়েছিল এবং এই বিষয়টি ভারতীয় মুসলমান সমাজকে ক্ষুণ্ণ করে তোলে। এর ফলে এই নক্সা তাৎক্ষণিকরূপে উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দেশজুড়ে রুপোর অভাব দেখা দেয় এবং এটি এক টাকা তথা বেশি মূল্যের টাকার কাগজের মুদ্রার প্রচলনে তৎপরতা যোগায় এবং রুপোর মুদ্রার কম মূল্যের ভাগসমূহ তামা এবং নিকেলের থেকে প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রুপোর বিশেষ ধরনের আকারের মুদ্রা তৈরি করা হয় এবং ১৯৪০ সাল থেকে এর শুরু করা হয়। ১৯৪৭ সালে এটি তুলে দিয়ে নিকেলের মুদ্রার প্রবর্তন করা হয়। স্বাধীনোত্তর কালের প্রথমদিকে ইংরেজ মুদ্রা ব্যবস্থাটিকে বহাল রাখা হয় এবং এক টাকার মূল্য ৬৪ পয়সা বা ১৯২ পাইতে স্থির থাকে।
১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আনা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয় এবং ভারত গণতন্ত্রের এটি প্রথম মুদ্রা ব্যবস্থা হিসাবে পরিগণিত হয়। সম্রাট অশোকের সিংহের প্রতীকচিহ্ন ইংল্যান্ডের রাজার আবক্ষ প্রতিকৃতির স্থান দখল করে। এই টাকার মুদ্রাগুলিতে ভুট্টার গুচ্ছ বাঘের স্থান নেয়। ১৬ আনার সমষ্টিতে এক টাকার হিসাব এই ব্যবস্থাটিতে বহাল রাখা হয়। ১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে ভারতে ভারতীয় মুদ্রা (সংশোধিত) আইন ১৯৫৫ বলবৎ করা হয় এবং এটি এক নতুন দশমিকীকরণ ব্যবস্থার শুরু করে। এই নতুন ব্যবস্থাতে ১ টাকাকে ১৬ আনা বা ৬৪ পয়সার পরিবর্তে ১০০ নয়া পয়সায় ভাগ করা হয়। এই নয়া পয়সাসমূহ ১, ২, ৫, ১০, ২০ এবং ৫০ নয়া পয়সা হিসাবে মুদ্রিত করা হয়েছিল এবং কিছুদিন পর্যন্ত আনা এবং নয়া পয়সা উভয়কেই বৈধভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের ১ জুন থেকে নয়া পয়সাসমূহের নয়া শব্দটি তুলে দিয়ে কেবল পয়সা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
ষাটের দশকে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকভাবে দেখা দেওয়ায় ধীরে ধীরে তামা, ব্রোঞ্জ, নিকেল এবং অ্যালুমিনিয়াম-ব্রোঞ্জের তৈরি মুদ্রার পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়ামের মুদ্রা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর সাথে সাথে ৩ পয়সার ষড়ভূজ মুদ্রার সূত্রপাত ঘটে। ১৯৬৮ সালে ২০ পয়সার মুদ্রা প্রচলন করা হয়েছিল, যদিও এটি বিশেষ জনপ্রিয় হয়নি।
লাভের তুলনায় খরচ বেশি হওয়ার অবস্থা হলে ১৯৭০ সালে ১, ২ এবং ৩ পয়সার মুদ্রাসমূহের প্রচলন বন্ধ করা হয়। এরপরে ক্রমে ১৯৮৮ সালে ১০, ২৫ এবং ৫০ পয়সার মুদ্রা এবং ১৯৯২ সালে এক টাকার মুদ্রাকে ভারতের অর্থব্যবস্থায় সংযোজিত করা হয়। এক টাকার, দু'টাকার এবং ৫ টাকার মুদ্রায় তুলনামূলকভাবে খরচ কম হওয়ার জন্য নব্বই-এর দশকে এই মুদ্রাসমূহের মুদ্রিতকরণ আরম্ভ হয়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৬৬ এবং ১৯৯১ সালে ভারতকে দুটি বৃহৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং টাকার মূল্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাওয়ার সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে হয়।[৯]
ভারতে টাকার দশমিকীকরণ:[১০]
সময়সীমা | মুদ্রাব্যবস্থা |
---|---|
১৮৩৫ সাল থেকে | ১ টাকা = ১৬ আনা = ৬৪ পয়সা = ১৯২ পাই |
১৯৫৭ সালের ১ এপ্রিল থেকে | ১ টাকা = ১০০ নয়া পয়সা |
১৯৬৪ সালের ১ জুন থেকে | ১ টাকা = ১০০ পয়সা |
১৯৫০ সাল থেকেই ভারত বাণিজ্যিক ঘাটতির মুখোমুখি হয়ে এসেছে। এই ঘাটতি ১৯৬০ সালে ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, সরকারের ঘাটতি বাজেটে সেই সময়ে অন্য এক সমস্যা ছিল এবং দেশের ব্যক্তিগত খণ্ডের সঞ্চয়ের ঋণাত্মক হারের কারণে ব্যক্তিগত খণ্ডের থেকে টাকা ধারে নেওয়ারও সুবিধা ছিল না। ফলস্বরূপ ভারত সরকার ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দীর্ঘকালীন ঋণপত্র অর্থাৎ বন্ড প্রদান করেছিলেন যার ফলে টাকার যোগান বৃদ্ধি পায় এবং এটি মুদ্রাস্ফীতির জন্ম দেয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের মিত্রতা থাকা দেশসমূহ ভারতের থেকে বৈদেশিক সাহায্য বাতিল করতে সুযোগ পায় যা টাকার মূল্য হ্রাসে ইন্ধন যোগায়। অবশেষে, ১৯৬৬ সালে ভারত লাভ করে আসা বৈদেশিক সাহায্যসমূহ কর্তন করা হয় এবং বলা হয় যে, এই সাহায্যসমূহ পুনরায় লাভ করতে ভারতকে বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষেত্রের বাধা-নিষেধসমূহ উঠিয়ে নিতে হবে। সেই সময়কালে কেবল প্রতিরক্ষা খাতে মোট ব্যয়ের ২৪.০৬%। টাকার মূল্য হ্রাসে ১৯৬৫-৬৬ সালের খারাপ পরিস্থিতির থেকে উদ্ভূত হওয়া মূল্যবৃদ্ধিও বহু পরিমাণে ইন্ধন যোগায়।
১৯৬৯ সালের শেষদিকে ভারতীয় টাকার মূল্য ছিল ১৩ ব্রিটিশ পেন্সের সমান। তার এক দশক পরে ১৯৭৯ সালে এর মূল্য হয় ৬ ব্রিটিশ পেন্স। ১৯৮৯ সালে এটি সর্বকালের সর্বনিম্ন মূল্য ৩ ব্রিটিশ পেন্স পায়।
১৯৯১ সালে ভারতে নির্দিষ্ট বিনিময় মূল্যব্যবস্থা বহাল ছিল, যেখানে ভারতীয় টাকার মূল্য বেশি বাণিজ্যিক মিত্রতা থাকা কয়েকটি দেশের মুদ্রার বিপরীতে নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯০ সালের শেষ পর্যন্ত দেশের ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের সমতায় কিছু সমস্যা দেখা দেয়। দেশের বৈদেশিক বিনিময়ের ভাণ্ডার শূন্য হয়ে পড়ে এবং এটি এমন এক পর্যায়ে যায় যে, অন্য তিন সপ্তাহের মোট আমদানির লেন-দেনসমূহ সম্পূর্ণ করায় সরকার অপারগ হয়ে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় এবং সরকারের ঘাটতি বাজেটও বিপজ্জনক রূপ নেয়। ফলস্বরূপ টাকার মূল্য হ্রাস করতে হয়।[৯]
১৯৯৯ সালের শেষ পর্যন্ত টাকার মূল্য অনেক হ্রাস পায়।
২০০০ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ভারতীয় টাকার মূল্য হ্রাস পাওয়া বন্ধ হয় এবং প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে এটি ৪৪-৪৫ টাকায় স্থিরতা লাভ করে। ২০০৭ সালের শেষদিকে সুচল বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় টাকার মূল্য সর্বোচ্চ ৩৯ টাকা হয়। অবশ্য এর ফলে দেশের মুখ্য রপ্তানিকারীগণ লোকসানে ডুবে যায়। ২০০৮ সালে সমগ্র বিশ্বকে ছুঁয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভারতে নিয়োজিত তাঁদের সম্পদের বহুলাংশ নিজ দেশে উঠিয়ে নেন।
২০১৩ সালের প্রথমভাগে নিশ্চল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ও হ্রাস পেতে থাকা বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে টাকার মূল্য ক্রমাগতভাবে কমে আসে[১১] এবং প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে এটি ৬৮.৮০ টাকা হয়। টাকার মূল্যের এই নিম্নগামী গতি হ্রাস করতে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়, যদিও এত সবকিছু বিফল হয়।[১২] ক্রমাগত মূল্যহ্রাস এবং মুদ্রাস্ফিতির পরে সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী ড° মনমোহন সিং সংসদে এই বিষয়ে এক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে, টাকার মূল্য হ্রাস হওয়ায় বৈশ্বিক কারকের সঙ্গে দেশের আভ্যন্তরীণ কারকসমূহেরও প্রভাব আছে। তাঁর সঙ্গে এই সমস্যার সাথে মোকাবিলা করতে বিরোধী দলসমূহকে তিনি সহযোগিতারও আহ্বান জানান।[১৩]
ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল প্রচলন করা নোটসমূহকে নিচে উল্লেখিত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১৮৬১ সালের কাগজের মুদ্রা আইন সরকারকে নোট প্রচলন করার একক অধিকার প্রদান করে। পরে মুদ্রা পরিচালনার ভার মুদ্রনকর্তা, হিসাবরক্ষক এবং মুদ্রা নিয়ন্ত্রকসমূহকে প্রদান করা হয়।
১৯৩৫ সালের পয়লা এপ্রিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আনুষ্ঠানিক শুভারম্ভ করা হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়া আইন ১৯৩৪-এর ২২ নং অনুচ্ছেদে নিজের নোট প্রস্তুত না হাওয়া পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে ভারত সরকারের চালিয়ে আসা নোটসমূহ প্রচলনের কর্তৃত্ব প্রদান করে। ১৯৩৮ সালে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ৬ঠ জর্জের প্রতিকৃতি অঙ্কিত প্রথম ৫ টাকার নোটের প্রচলন করে। এরপরে ১০ টাকার নোট ফেব্রুয়ারি, ১০০ টাকার নোট মার্চ, ১,০০০ এবং ১০,০০০ টাকার নোট জুন মাস থেকে প্রচলিত হয়। দ্বিতীয় গভর্নর স্যার জেমস টেইলর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রথম নোটসমূহে হস্তাক্ষর করেন। ১৯৪০ সালের আগস্টে যুদ্ধকালীন পদক্ষেপ হিসাবে এক টাকার নোটসমূহ পুনরায় প্রচলন করা হয়। সেই সময়ে জাপানীরা ভারতীয় টাকার উচ্চমানের জালনোট প্রস্তুত করে ফেলে এবং এর ফলে ওয়াটারমার্কটি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে। ৬ষ্ঠ জর্জের আবক্ষ প্রতিকৃতির পরিবর্তে সম্পূর্ণ প্রতিকৃতি অঙ্কন করা হয় এবং তখনই ভারতে প্রথমবারের জন্য সুরক্ষা সূত্র (security thread) সন্নিবিষ্ট করা হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই নোটসমূহ বহাল থাকে এবং স্বাধীনোত্তর কালের নোটসমূহ বলবৎ হাওয়ায় এটি অচল হয়ে পড়ে।
১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতের সরকার এক টাকার নোটের এক নতুন নক্সা অন্তর্ভুক্ত করে। প্রথমাবস্থায় রাজার পরিবর্তে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতি অঙ্কন করার কথা বিবেচনা করা হয়েছিল, যদিও পরে অশোক স্তম্ভের চিহ্ন নির্বাচন করা হয়। ১৯৫৩ সালে নোটগুলিতে হিন্দী ভাষাটি সংক্ষেপে নিচে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে হওয়া অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলস্বরূপ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত নোটসমূহের আকার ছোট করে ফেলা হয়। ১৯৭৮ সালে ১০,০০০ টাকার নোটসমূহর প্রচলন বন্ধ করা হয়।
১৯৯৬ সালে "মহাত্মা গান্ধী শৃঙ্খলা"র শুরু করা হয়। এই নতুন নোটসমূহে এক নতুন ওয়াটারমার্ক, ভিন্ন সুরক্ষা সূত্র এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সনাক্তকরণ চিহ্ন সন্নিবিষ্ট করা হয়।
১৯২৬ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় টাকার মূল্য ব্রিটিশ পাউণ্ডের সাথে যুক্ত করে এর বিপরীতে নির্ধারণ করা হত এবং ১৩.৩৩ টাকা ১ পাউণ্ডের সমান হিসাবে স্থির করা হত। ১৯৬৬ সালে টাকাকে মার্কিন ডলারের সাথে যুক্ত করা হয় এবং ১ ডলারের বিপরীতে ৭.৮ টাকা স্থির করা হয়।[১৪]
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; chip
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নিসাল | বিনিময়ের হার (প্রতি ডলারের বিপরীতে ভারতীয় টাকা) |
---|---|
১৯৪৮ | ৩.৩১ |
১৯৪৯ | ৩.৬৭ |
১৯৫০ - ১৯৬৬ | ৪.৭৬[১৫] |
১৯৬৬ | ৭.৫০[১৫] |
১৯৭৫ | ৮.৩৯[১৫] |
১৯৮০ | ৭.৮৬ |
১৯৮৫ | ১২.৩৮[১৬] |
১৯৯০ | ১৭.০১[১৬] |
১৯৯৫ | ৩২.৪২৭ |
২০০০ | ৪৩.৫০[১৬] |
২০০৫ (জানুয়ারি) | ৪৩.৪৭[১৬] |
২০০৬(জানুয়ারি) | ৪৫.১৯[১৬] |
২০০৭ (জানুয়ারি) | ৩৯.৪২[১৬] |
২০০৮ (অক্টোবর) | ৪৮.৮৮ |
২০০৯ (অক্টোবর) | ৪৬.৩৭ |
২০১০ (জানুয়ারি ২২) | ৪৬.২১ |
২০১১ (এপ্রিল) | ৪৪.১৭ |
২০১১ (সেপ্টেম্বর ২১) | ৪৮.২৪ |
২০১১ (নভেম্বর ১৭) | ৫৫.৩৯৫ |
২০১২ (জুন ২২) | ৫৭.১৫[১৭] |
২০১৩ (মে ১৫) | ৫৪.৭৩[১৮] |
২০১৩ (সেপ্টেম্বর ১২) | ৬২.৯২[১৯] |
২০১৪ (জানুয়ারি ১) | ৬২.৩[২০] |
২০১৪ (ডিসেম্বর ৩০) | ৬৩.৭১৬[২০] |
২০১৫ (জানুয়ারি ৮) | ৬২.৫২ |
২০১৫ (জুলাই ২৬) | ৬৪.১১ |
২০১৬ (মার্চ ১০) | ৬৭.৪৬[২১] |