ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব (ইং: Triangular Theory of Love) মানুষের আন্তসম্পর্ক বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী রবার্ট স্টার্নবার্গ প্রদত্ত একটি প্রস্তাব। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্টার্নবার্গ ১৯৮৫ সালে এই তত্ত্ব প্রচার করেন। অধ্যাপনাকালীন সময়ে তিনি বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা, জ্ঞান, নেতৃত্বদান, চিন্তার ধরন, নৈতিক যুক্তি, ভালোবাসা এবং ঘৃণা ইত্যাদি বিষয়ে বিষয় গবেষণা করেন। ত্রিভুজ তত্ত্ব অনুসারে ভালোবাসায় তিনটি পর্যায়ক্রমিক অংশ থাকে যথা আগ্রহ (passion) অংশ, অন্তরঙ্গতা (intimacy) অংশ, এবং দায়বদ্ধতা (commitment) অংশ।[১] আন্তরব্যক্তিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই তিন অংশের সমন্বয়ে ভালবাসার অবয়ব গড়ে ওঠে। তাঁর তত্ত্বের প্রধান সমালোচনা এই যে এতে পারস্পরিক কামজ আকর্ষণের বাস্তবতা যথাযথ গুরুত্ব লাভ করে নি।
আগ্রহ: আগ্রহ দৈহিক উত্তেজনা এবং আবেগীয় উদ্দীপনার সাথে সম্পর্কিত। এই আগ্রহকে তিনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়:
অন্তরঙ্গতা: অন্তরঙ্গতা হচ্ছে একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া এবং সংযুক্তির অনুভূতি। এটি দুজনের মাঝে বন্ধনকে শক্তিশালী করতে চায়। একই সাথে, অন্তরঙ্গতার অনুভূতি একে অপরের সাথে স্বাচ্ছন্দে থাকার অনুভূতি তৈরি করতে সাহায্য করে, যেখানে দুইজনই তাদের অনুভূতিতে একাত্ম হয়।
অন্তরঙ্গতাকে প্রাথমিকভাবে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে, এটা এমন কিছু যা ব্যক্তিগত এবং নিজস্ব প্রকৃতির; একে ঘনিষ্ঠতাও বলা যায়।[২]
প্রতিশ্রুতি: প্রতিশ্রুতি অন্য দুটো অংশের মত নয়, এক্ষেত্রে একে অপরের সাথে লেগে থাকার সচেতন সিদ্ধান্ত জড়িত থাকে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার সিদ্ধান্ত প্রধাণত পরিতৃপ্তির মাত্রার উপর নির্ভর করে যা উক্ত সম্পর্কের থেকেই লাভ করা যায়। প্রতিশ্রুতিকে সংজ্ঞায়িত করার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উপায় আছে:
"কোন ব্যক্তি কী পরিমাণ ভালোবাসা বোধ করে তা নির্ভর করে এই তিনটি অংশের চূড়ান্ত মাত্রার উপর, এবং কোন ব্যক্তির অভিজ্ঞতালব্ধ ভালোবাসা নির্ভর করে তাদের এই অংশগুলোর একে অপরের সাথে তুলনামূলক শক্তির তারতম্যের উপর।"[৩] ভালোবাসার বিভিন্ন পর্যায় এবং ধরনকে এই তিন অংশের বিভিন্ন সমাহার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন একটি প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমজনিত সম্পর্কের উন্নয়নের সাথে সাথে প্রতিটি অংশের তুলনামূলক প্রভাব পরিবর্তিত হয়। যেকোন একটি অংশের উপর ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সম্পর্কের টিকে থাকার সম্ভাবনা দুটো বা তিনটি অংশ নিয়ে টিকে থাকা সম্পর্কে সম্ভাবনার চেয়ে কম হয়।
ভালোবাসা নিয়ে প্রথম তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি তৈরি করেছিলেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। যেহেতু ফ্রয়েড সবসময়ই মানব প্রকৃতিকে অবচেতন আকাঙ্ক্ষার দ্বারা ব্যাখ্যা করতেন, তার ভালোবাসা নিয়ে তত্ত্বও "ইগো আইডিয়াল" এর আকাঙ্ক্ষার উপরেই কেন্দ্রিভূত ছিল।[৪] তার কাছে ইগো আইডিয়ালের সংজ্ঞা ছিল: একজন হতে চায় এমন একজন ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি, যা সেই সব ব্যক্তিদের উপরেই নকশা করে বানানো যাদেরকে সেই ব্যক্তি অনেক শ্রদ্ধা করেন।
মাসলো আরেকটি তত্ত্ব দান করেছিলেন। মাসলোর আকাঙ্ক্ষার ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ স্ব-বাস্তবায়নকে (self-actualization) সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়। তার মতে, যারা এই স্ব-বাস্তবায়নে পৌঁছেছেন তারাই ভালোবাসতে সক্ষম হন।[৫]
রাইক ভালোবাসা নিয়ে আরেকটি তত্ত্ব দান করেন। তিনি বলেন, তারাই ভালোবাসতে পারবেন যারা তাকে ভালোবাসে এমন ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা দিতে পারবেন, কেবল নিজের সমস্যার সমাধান করার জন্যই তারা এটা করেন না।[৫]
যখন ভালোবাসা নিয়ে তত্ত্বগুলো চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেল, তখন গবেষকগণ ভালোবাসার সক্ষমতার চেয়ে বরং ভালোবাসার ধরনের উপর মনোনিবেশ করতে শুরু করলেন।
ভালোবাসা নিয়ে প্রথম ও পরবর্তীতে তৈরি তত্ত্বসমূহের মধ্যে দুটো নির্দিষ্ট প্রাথমিক তত্ত্ব আছে যেগুলো স্টার্নবার্গের তত্ত্বকে প্রভাবিত করেছে।
এদের প্রথমটি হল জিক রুবিনের তত্ত্ব যার নাম হল পছন্দ করা বনাম ভালোবাসা এর তত্ত্ব। এই তত্ত্বে, প্রেমজনিত ভালোবাসাকে (romantic love) সংজ্ঞায়িত করার জন্য, রুবিন উপসংহার টানেন যে, সংযুক্তি, যত্ন নেয়া এবং অন্তরঙ্গতা হচ্ছে তিনটি প্রধান নীতি যেগুলো কোন ব্যক্তিকে পছন্দ করা এবং তাকে ভালোবাসার মধ্যে পার্থ্যকের সৃষ্টি করে। রুবিন বলেন, যদি কোন ব্যক্তি কেবলই অন্য একজন ব্যক্তির উপস্থিতি এবং তার সাথে সময় কাটানো পছন্দ করেন তাহলে সেই ব্যক্তি তাকে কেবল পছন্দ করেন। কিন্তু যদি সেই ব্যক্তি তার উপর অন্তরঙ্গতা এবং সংযোগের জন্য গভীর আকাঙ্ক্ষা বোধ করেন, একই সাথে তার আকাঙ্ক্ষা নিয়েও যত্নবান হন তাহলে সেই ব্যক্তি তাকে ভালোবাসেন।[৬]
স্টার্নবার্গের তত্ত্বে অন্তরঙ্গতা হচ্ছে এর প্রধান নীতিগুলোর মধ্যে একটি। এটা পরিষ্কার যে, অন্তরঙ্গতা হচ্ছে ভালোবাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর এর দ্বারাই চূড়ান্তভাবে আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা (passionate love) ও দরদী (compassionate love) ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য করা যায়।
দ্বিতীয় তত্ত্বটি হচ্ছে জন লি এর ভালোবাসার কালার হুইল মডেল। এই তত্ত্বে ভালোবাসার সাথে প্রাথমিক বর্ণগুলোর তুলনা করে লি ভালোবাসার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে ইরোস, লুডোস এবং স্টোরজ। তার তত্ত্বটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, তিনি উপসংহার টানেন যে, তিনটি প্রাথমিক বর্ণ যেমন অন্যান্য পরিপূরক বর্ণকে তৈরি করে, তেমনি ভালোবাসার এই তিন প্রাথমিক ধরন মিলে ভালোবাসার আনুষঙ্গিক আকারসমূহ তৈরি করে।[৭]
স্টার্নবার্গের তত্ত্বে, তিনি লি এর মত দেখান, তার তিনটি প্রধান নীতির সংমিশ্রণের দ্বারা ভালোবাসার বিভিন্ন ধরন তৈরি হয়।
স্টার্নবার্গ ভালোবাসার তিনটি মডেল- স্পিয়ারম্যানিয়ান, থমসনিয়ান ও থার্সটোনিয়ান মডেলকেও ব্যাখ্যা করেন। স্পিয়ারম্যানিয়ান মডেল মডেল অনুসারে, ভালোবাসা হচ্ছে ইতিবাচক অনুভূতি সমূহের একটি গুচ্ছ। থমসনিয়ান মডেল অনুসারে, ভালোবাসা হচ্ছে অনেকগুলো অনুভূতির একটি সংমিশ্রণ, যখন এগুলোকে একত্রে আনা হয়, তখন এটা একটা অনুভূতি তৈরি করে। স্পিয়ারম্যানিয়ান মডেলটি ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্বের সবচেয়ে নিকটতম, আর এটা অনুসারে ভালোবাসা তিনটি সমান অংশ দিয়ে তৈরি যেগুলোকে একটি একটি করে বোঝার চেয়ে একত্রে মিলিতভাবে বোঝাই অনেক সহজ। এই মডেলে বিভিন্ন ফ্যাক্টরগুলো অনুভূতি তৈরিতে সমানভাবে অবদান রাখতে পারে, এবং এদেরকে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।[৮]
স্টার্নবার্গের ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব এর উন্নয়ন হয় আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসাও দরদী ভালোবাসার চিহ্নিতকরণের পর। আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা এবং দরদী ভালোবাসা দুটো ভিন্ন রকমের ভালোবাসা কিন্তু সম্পর্কের ক্ষেত্রে এরা সম্পর্কযুক্ত।
আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর শক্তিশালী ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার শক্তিশালী অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এই ভালোবাসা উত্তেজনা এবং নতুনত্বে পরিপূর্ণ। সম্পর্কের শুরুতে আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি প্রায় এক বছরের মত থাকে। আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসার ক্ষেত্রে একটি রাসায়নিক উপাদান জড়িত থাকে। যারা আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা অনুভব করেন তারা একই সাথে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের বৃদ্ধি, বিশেষ করে ফিনাইলইথিলামিন[৯] এর বৃদ্ধি অনুভব করেন। এই অনুভূতিগুলো ভালোবাসার সবচেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে পাওয়া যায়।
আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসার পরে আসে দরদী ভালোবাসা। এই দরদী ভালোবাসাকে অনুরাগপূর্ণ ভালোবাসাও (affectionate love) বলে। যখন কোন জুটি ভালোবাসার এই মাত্রায় পৌঁছে যায়, তারা পারস্পরিক বোধশক্তি এবং যত্নশীলতা অনুভব করেন। সম্পর্কের টিকে থাকার জন্য এই ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ।[৯] এই ধরনের ভালোবাসা সম্পর্কের সময়কালের পরবর্তী সময়ে আসে এবং এর জন্য উভয় ব্যক্তি সম্পর্কেই নির্দিষ্ট মাত্রার জ্ঞানের প্রয়োজন হয়।
এরপর স্টার্নবার্গ তার ত্রিভুজটি তৈরি করেন। এই ত্রিভুজের বিন্দুগুলো হচ্ছে অন্তরঙ্গতা (intimacy), আগ্রহ (passion) এবং প্রতিশ্রুতি (commitment)।
ইন্টিমেট বা অন্তরঙ্গ ভালোবাসা হচ্ছে এই ত্রিভুজের একটি কোণা যেখানে প্রেমময় সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ বন্ধন থাকে। দুজন ব্যক্তির মধ্যে ইন্টিমেট ভালোবাসা থাকার অর্থ হচ্ছে তারা উভয়ের মধ্যেই উভয়ের প্রতি উচ্চমাত্রার সম্মানবোধ থাকবে। তারা উভয়েই একে অপরকে সুখী করতে চাবে, একে অপরের সাথে ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো, সুখ দুঃখের ব্যাপারগুলো ভাগাভাগি করবে, একে অপরের সাথে যোগাযোগ করবে, প্রয়োজনে একে অপরকে সহায়তা করবে। ইন্টিমেট বা অন্তরঙ্গ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধরত জুটি একে অপরকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করে।[৯] অন্তরঙ্গ ভালোবাসাকে "উষ্ণ" ভালোবাসাও বলে, কেননা এটা দুজন মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। এই ভালোবাসা নিয়ে স্টার্নবার্গের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, সম্পর্কটি কম বাঁধাগ্রস্ত হয়ে গেলে, আর এর ফলে সম্পর্কটিতে সাম্ভাব্যতা বৃদ্ধি পেলে এই ভালোবাসা কমতে শুরু করে।[১০]
আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা তাড়ণার উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসায় আবদ্ধ জুটি একে অপরের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে। সাধারণভাবে যৌনাকাঙ্ক্ষা আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসার একটি অংশ, যদিও আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা যৌন আকর্ষণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা কোন জুটির পরিচর্যা, কর্তৃত্ববোধ, আনুগত্য, স্ব-বাস্তবায়ন ইত্যাদি অনুভূতি প্রকাশের উপায়।[৯] আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসাকে ভালোবাসার "উত্তপ্ত" অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এক্ষেত্রে দুজন মানুষের শক্তিশালী কামোত্তেজনা উপস্থিত থকে। স্টার্নবার্গ বিশ্বাস করতেন যে, সম্পর্কের ইতিবাচক শক্তিগুলো বিপরীত শক্তিগুলোর দ্বারা অতিক্রান্ত হলে আগ্রহপূর্ণ ভালোবাসা কমতে শুরু করে। এই ধারণাটা এসেছে সলোমনের অপোনেন্ট ফোর্স থিওরি থেকে।[১০]
প্রতিশ্রুতি বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভালোবাসা হচ্ছে সেই সব প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য যারা দীর্ঘ সময়ের জন্য একত্রে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটা জিনিস বলে রাখা প্রয়োজন, তাহল একজন ব্যক্তি ভালোবাসার অনুভূতি লাভ ছাড়াই কোন ব্যক্তির উপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে থাকতে পারেন, এবং একজন ব্যক্তি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়েও ভালোবাসা অনুভব করতে পারেন।[৯] প্রতিশ্রুতিকে "ঠাণ্ডা" ভালোবাসা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এর জন্য কোন ধরনের অন্তরঙ্গতা বা আগ্রহের প্রয়োজন হয় না। স্টার্নবার্গ বিশ্বাস করতেন, সম্পর্কের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সাথে সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে থাকে।[১০] বন্ধুদের ক্ষেত্রেও প্রতিশ্রুতিকে বিবেচনা করা যায়।
স্টার্নবার্গ বিশ্বাস করতেন, ভালোবাসা ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় এমন উপায়ে উন্নতিলাভ করে এবং বিবর্তিত হয়; ভালোবাসায় থাকা সকল জুটিই একই নকশায় অন্তরঙ্গ, আগ্রহপূর্ণ এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভালোবাসার অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হবে।[১০]
যদিও এই ধরনের ভালোবাসাগুলোতে এমন গুণ থাকতে পারে যা প্রেম বহির্ভূত সম্পর্কগুলোতেও থাকতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতে এগুলো থাকেই। নিচে অন্যান্য ধরনের ভালোবাসার সাথে সাথে অ-ভালোবাসার বর্ণনাও দেয়া হল। এই ধরনের ভালোবাসাগুলো স্টার্নবার্গের ভালোবাসার ত্রিভুজের তিনটি কোণার বিভিন্ন সংমিশ্রণে গঠিত হয়।
ভালোবাসার তিনটি অংশগুলোকে ত্রিভুজের তিনটি কোণায় বিবেচনা করা যায় (যেমনটি চিত্রে করা হয়েছে) এবং এদের বিভিন্ন সংমিশ্রণে ভালোবাসার সাতটি বিভিন্ন ধরন তৈরি হয় (চিত্রে নন-লাভ বা অ-ভালোবাসা দেখানো হয় নি)। ত্রিভুজের আকার ভালোবাসার "পরিমাণকে" নির্দেশ করে। ত্রিভুজ যত বড় হয় ভালোবাসার পরিমাণও তত বড় হয়। প্রতিটি কোণায় নিজস্ব ভালোবাসার ধরন রয়েছে এবং এদের বিভিন্ন মিশ্রণে বিভিন্ন ধরনের ভালোবাসার তৈরি হয় যেগুলোর নামও চিত্রে দেয়া আছে। ত্রিভুজের আকৃতি কিরকম হবে তার উপর নির্ভর করে যে ভালোবাসার শৈলী কিরকম, যা সম্পর্কের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হতে পারে:
স্টার্নবার্গের ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব, তার ভালোবাসার পরবর্তী তত্ত্বের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করেছে, যেখানে ভালোবাসাকে একটি গল্প হিসেবে বলা হয়।[১৬] এই তত্ত্বে তিনি ব্যাখ্যা করেন, প্রচুর সংখ্যক অনন্য এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রেমের গল্প কীভাবে ভালোবাসাকে বোঝা যায় এই সত্যকে বহন করে। তিনি বিশ্বাস করে, সময়ের সাথে, এই প্রকাশের দ্বারা একজন ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে ভালোবাসা আসলে কী এবং তাদের কাছে এর অর্থ কী হওয়া উচিৎ।[১৭]
"ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো, যেগুলো সবচেয়ে বেশি দীর্ঘায়ু ও সন্তোষজনক হয়, সেগুলোতে সম্পর্কের অংশীদারগণ অনবরত অন্তরঙ্গতা ধরে রাখার জন্য কাজ করে যায়, এবং একে অপরের প্রতি প্রতিশ্রুতিকে আরও শক্তিশালী করে।"[১১]
মাইকেল একার এবং মার্ক ডেভিসের ১৯৯২ সালে করা একটি গবেষণায়, স্টার্নবার্গের ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্বের ন্যায্যতা পরীক্ষিত হয়। গবেষণায় সাধারণত ১৮ থেকে ২০ বছরের কলেজ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে করা হলেও সেই গবেষণায় এই বয়সের বাইরের লোকদের নিয়ে করা হয়, বৃহত্তর জনসংখ্যা নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে একার এবং ডেভিস মানুষের মধ্যকার ভালোবাসার পর্যায়সমূহকে আরও সঠিকভাবে দেখতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্টার্নবার্গের ভালোবাসার তত্ত্বের কিছু সমালোচনা হচ্ছে, স্টার্নবার্গ যদিও একজন ব্যক্তির উপর অন্য আরেকজন ব্যক্তির ভালোবাসার বিভিন্ন পর্যায়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তিনি সম্পর্কের সময়কালের ঠিক কোন সময়ে বা কোন বিন্দুতে পর্যায়গুলোর বিবর্তন ঘটবে তা নির্দিষ্ট করেন নি। তিনি এও নির্দিষ্ট করে বলেননি যে, ভালোবাসার বিভিন্ন অংশ সম্পর্কের সময়কালের উপর বা সম্পর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার উপর নির্ভরশীল কিনা। একার এবং ডেভিস বের করেন যে, সম্পর্কের পর্যায় এবং সময়কাল ভালোবাসার অংশগুলো এবং এগুলোকে জানার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।[১০]
তারা খুঁজে পান যে, এর কোন সঠিক উত্তর নেই, কারণ কেবল সকল জুটিই নয়, বরং একটি জুটির দুজন অংশীদারও ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভালোবাসার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্বের তিনটি উপলব্ধি আছে, বা "অনেকগুলো ত্রিভুজের সাম্ভাব্যতা" আছে। অনেকগুলো ত্রিভুজের অস্তিত্ব থাকতে পারে, কারণ একেকজন ভালোবাসার একেকটি অংশকে একেকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। একার এবং ডেভিসের মতে এই আলাদা আলাদা তিনটি ত্রিভুজগুলো হচ্ছে 'বাস্তব' ত্রিভুজ, 'আদর্শ ত্রিভুজ' এবং 'উপলব্ধ' ত্রিভুজ।[১০]
এই 'বাস্তব' ত্রিভুজগুলো নির্দেশ করে যে, কীভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি তার সম্পর্কের উন্নয়ন ও গভীরতাকে দেখেন। 'আদর্শ' ত্রিভুজগুলো নির্দেশ করে যে, প্রত্যেকে তার সঙ্গী বা সম্পর্ক সম্পর্কে কী আদর্শ ধারণা পোষণ করেন। 'উপলব্ধ' ত্রিভুজগুলো নির্দেশ করে প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গীরা সম্পর্কটাকে কীভাবে দেখছে সেসম্পর্কিত ধারণাকে। যদি এই আলাদা আলাদা ত্রিভুজগুলোর কোন একটার আকৃতি অন্যগুলোর চেয়ে ভিন্ন হয় তাহলে অসন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেতে পারে।[১০]
স্টার্নবার্গের ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্ব হয়তো একে প্রথমে যেরকম সরল লাগছিল তেমন নয়। স্টার্নবার্গ তার তত্ত্বকে সেই সব জুটির উপরেই পরিমাপ করেছিলেন যাদের সকলের বয়স মোটামুটি একই রকম ছিল (গড় বয়স ২৮), এবং যাদের সম্পর্কের সময়কালও একই রকম ছিল (৪ থেকে ৫ বছর)। তার স্যাম্পল এর আকার বৈশিষ্ট্যের বিভিন্নতায় সীমাবদ্ধ ছিল। একার এবং ডেভিস ঘোষণা করেছিলেন যে, এটা স্টার্নবার্গের তত্ত্বের বড় সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে প্রেমপূর্ণ ভালোবাসা, স্নাতকেতর (undergraduate) ব্যক্তিদের বেলায় যেরকম থাকে, যারা স্নাতকেতর না তাদের বেলায় তেমন থাকে না। একার এবং ডেভিস একটি স্যাম্পল নিয়ে কাজ করেন যেখানকার ব্যক্তিরা স্টার্নবার্গের স্যাম্পলের চেয়ে বেশি বয়সের ছিলেন।[১০]
স্টার্নবার্গের ভালোবাসার তত্ত্বে আরও দুটো বড় সমস্যা হচ্ছে, প্রথমত, ভালোবাসার অংশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির প্রশ্ন; দ্বিতীয়ত, পূর্বে যেসব মাপকাঠিতে বা উপায়ে ভালোবাসার তিনটি অংশকে পরিমাপ করা হয়েছিল সেই মাপকাঠি বা উপায়ের প্রশ্ন।[১০] স্টার্নবার্গের তত্ত্বের এই সমস্যাগুলো নিয়ে এখন কাজ চলছে।