ভুটানে স্বাস্থ্যখাত সরকারের উন্নয়ন এবং আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে অন্যতম সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। স্বাস্থ্য এবং এ সম্পর্কিত বিষয়গুলির তদারকি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী দ্বারা নির্বাহী লেনঝে ঝুংসঙে (মন্ত্রিপরিষদে) উপস্থাপিত হয়। সামগ্রিক জাতীয় সুখের একটি উপাদান হিসাবে সাশ্রয়ী এবং সুলভ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা ভুটানের কেন্দ্রীয় জননীতি।[১][২][৩][৪]
ভুটানের সংবিধান রাজকীয় সরকারকে "নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ" নিশ্চিত করার এবং "আধুনিক এবং ঐতিহ্যবাহী উভয় ঔষুধে বিনামূল্যে মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা" দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ করেছে।[৫]:৫:২(d); ৯:২১
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১৯৭০ এর দশক থেকে ভুটানে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে আসছে। স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো এবং পরিষেবাগুলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (এফওয়াইপি) মাধ্যমে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়।[৬] গণতান্ত্রিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী লিয়নপো তান্দিন ওয়াংচুক হলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান।[৭]
ভুটানের আইনের দুটি প্রধান অংশ হলো কর্মী এবং ওষুধের জন্য একটি অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। ২০০২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ কাউন্সিল অ্যাক্ট মেডিকেল এবং স্বাস্থ্য কাউন্সিলকে মেডিকেল স্কুল, কোর্স এবং পেশাদারিত্ব আস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনগত সংস্থা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে।[৮] ২০০৩ সালের মেডিসিন অ্যাক্টের মাধ্যমে ভুটান মেডিসিন বোর্ড এবং ড্রাগস কারিগরি পরামর্শদাতা কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আইন ভুটানিজ ড্রাগ রেগুলেটরি অথরিটি, ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি এবং ড্রাগ ইন্সপেক্টর সহ একাধিক সহায়ক সংস্থাকে অনুমোদন দেয়। এই সংস্থাগুলি ড্রাগ, মেডিসিন এবং এমনকি মূল্য নিয়ন্ত্রণের উপর বিধিমালা তৈরির এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, তবে তা অবশ্যই ভুটানের আইন অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে।[৯] পেনাল কোড অনুযায়ী আইনের উভয় সংস্থা প্রাসঙ্গিক অপরাধ বিষয়ে জরিমানা করার অধিকার রাখে।[৮]:VIII[৯]:IX
২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী সারা ভুটানে ৩২ টি হাসপাতাল ছিল। গাসা বাদে বেশিরভাগ জংখাগে কমপক্ষে একটি হাসপাতাল আছে। থিম্পুতে ৫ টি হাসপাতাল ছিল, চূখা, সাম্টসে এবং ট্র্যাশিগাং জেলায় প্রত্যেকটিতে ৩ টি করে হাসপাতাল আছে। প্রতিটি জংখাগে অনেকগুলি ছোট ছোট চিকিৎসা সুবিধা কেন্দ্র আছে এবং থিম্পুতে একটি দেশীয় হাসপাতালের সুবিধা আছে।[১]
এই হাসপাতালগুলি এবং ছোট ছোট স্বাস্থ্য সুবিধা কেন্দ্রগগুলিতে তেরটি বিভাগে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কর্মচারীরা নিয়োজিত আছে : ২৪৪ জন চিকিৎসক; ৯৫৭ জন নার্স; ৯২ জন নার্সের সহকারী; ৫০৫ জন "স্বাস্থ্যকর্মী"; ৩৫ জন জংখাগ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও সহকারী; ৪১ জন ড্রাঙ্গশস (প্রচলিত চিকিৎসক); ৫২ জন স্মেনপাস (প্রচলিত চিকিৎসক); ১২ জন ফার্মাসিস্ট; ৭৯ জন ফার্মেসী সহকারী ও টেকনিশিয়ান; ১৩ জন ল্যাব টেকনোলজিস্ট; ৫৪৯ জন অন্যান্য টেকনিশিয়ান ও সহকারী; এবং ১,৬০১ জন প্রশাসনিক এবং সহায়তা কর্মী নিয়োজিত আছে।[১]:iii
দুই মাসব্যাপী পরীক্ষামূল সেবা সফল প্রমাণিত হওয়ার পর ২ মে, ২০১১ সালে ভুটান তার টেলিফোনিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র (এইচএইচসি) চালু করে। এইচএইচসি নম্বরটি হলো ১১২। এইচএইচসিতে দুটি সেবা পাওয়া যায়: জরুরী প্রতিক্রিয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা হেল্পলাইন, ল্যান্ড এবং মোবাইল উভয়ই ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায়। জিপিএস এবং জিআইএস প্রযুক্তিতে সজ্জিত রাজ্যব্যাপি ৫৯ জন স্বাস্থ্য টেকনিশিয়ান সহ ৩৭ টি স্থানে ৬১টি এম্বুলেন্স জরুরী অবস্থায় সরবরাহের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়। স্বাস্থ্যসেবা হেল্পলাইনে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়।[১০]
স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাগুলির ব্যয় এবং প্রাপ্যতা - যার মধ্যে কিছু ২৪ ঘণ্টা ভিত্তিতে কাজ করে - এটি ভুটানে আলোচ্য বিষয়। সাশ্রয়ী এবং টেকসই-এর বিষয়গুলি ভুটানের প্রস্তাবিত তহবিল প্রকল্পগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।[১১]
২০০৯ সাল পর্যন্ত বেশিরভাগ ভুটানি সুপেয় পানি (৮৩%) এবং মৌলিক স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ব্যবস্থার (৯১%) আওতায় ছিল। ব্যাপক স্বাস্থ্য উদ্বেগের মধ্যে আছে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ডায়রিয়া (প্রতি ১০,০০০ জনে ২,৮৯২) এবং নিউমোনিয়া (১,০৩১); ত্বকের সংক্রমণ (১,৩২২ জন); চোখ উঠা বা কনজাঙ্কটিভাইটিস (৫৪২); উচ্চ রক্তচাপ (৩১০); এবং অন্ত্রের কৃমি (১৭০)। কম পরিমানে দেখা যায় ডায়াবেটিস (প্রতি ১০,০০০ লোকের মধ্যে ৩৮ জন); মাদকজনিত লিভার ডিজিজ (২৩); এবং ক্যান্সার (১৭)। ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মা রোগের সংখ্যা সাধারণত প্রতি ১০,০০০ জনে যথাক্রমে ১০ এবং ১৫ জনের কম।[১]:iii, ৪–৫
ভুটানে এইচ১এন১ ("সোয়াইন ফ্লু") এবং এইচ৫এন১ ("বার্ড ফ্লু") স্ট্রেইন সহ ইনফ্লুয়েঞ্জা রয়েছে। ২০০৯ সালের মধ্যে এইচ১এন১-এ নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত ৬ জন ব্যক্তি পাওয়া যায়, যার মধ্যে কোনটিই মারাত্মক ছিল না। তবে ফুন্টসলিংয়ে কমপক্ষে একবার বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এটিকে "গুরুতর উদ্বেগ" হিসাবে নিয়েছে।[১]:৫
মূল নিবন্ধ: ভুটানে এইচআইভি/এইডস
২০১১ সালে এইচআইভি-র ২৪৬ টি ঘটনা ঘটে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৩% এর বেশি।[১২] ২০১০-এর মধ্যে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেলেও সহনীয় পর্যায়ে থাকে, মোট ১৮৫ জন এইচআইভি আক্রান্ত পাওয়া যায় যা মোট জনসংখ্যার ০.১%। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বাছবিচারহীনভাবে মিলিত হওয়া, মাদক গ্রহণ এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতে এইচআইভি/এইডস এর প্রসারকে দায়ী করে।[১]:৪
২০০৮ সাল নাগাদ ৯০% জনগোষ্ঠি সরকারের টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ছিল।[১]:iii ২০১০ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভুটানের মহিলাদের মধ্যে অনিরাপদ গর্ভপাতের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির প্রবণতা (২০০৩ সালে ৪৬৬; ২০০৯ সালে ১,০৫৭) চিহ্নিত করে, যা সম্ভবত প্রতিবেশী দেশ ভারতে সম্পাদিত হয় এবং তা ভুটানের উচ্চ মাতৃমৃত্যু হারের জন্য দায়ী।[১]:৩
২০১১ সালে ভুটানে মাতৃমৃত্যু হার ছিল প্রতি ১০০,০০০ জনে ২০০ জন। এটিকে ২০০৮ সালে ২৫৪.৯ এবং ১৯৯০ সালে ১১৪৫.৪ জনের সাথে তুলনা করা হয়। পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজার জন জন্মগ্রহণ করা শিশুর মধ্যে ৮১ জন এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হারের মধ্যে নবজাতক মৃত্যুর হার ছিল ৪৩ জন। ভুটানে প্রতি ১০০০ জন জীবিত জন্মদানের জন্য ধাত্রীর সংখ্যা ১৫ এবং গর্ভবতী মহিলাদের মৃত্যুর আশঙ্কা প্রতি ১৭০ জনে ১ জন।[১৩]
ভুটান ২০০৫ সালের খাদ্য আইন অনুসারে খাবারের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ করে।[১৪] খাদ্য আইনটির অধীনে জাতীয় খাদ্য মান ও নিরাপত্তা কমিশন এবং ভুটান কৃষি ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ("বাফরা") প্রতিষ্ঠিত হয়, উভয় সংস্থাই কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় এককভাবে খাদ্য আইনের অধীনে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ তবে কৃষিমন্ত্রী চাইলে স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও শুল্ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদেরকে দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন।[১৪]:§§ ৩–৯, ৮৮
জাতীয় খাদ্য মান ও নিরাপত্তা কমিশন কৃষিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এবং কৃষি, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, স্বরাষ্ট্র, আইন বিষয়ক এবং পরিবেশ নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সরকারি মন্ত্রণালয় এবং এজেন্সিগুলির দশ জন সদস্য নিয়ে গঠিত।[১৪]:§ ১০ কমিশন সরকারের খাদ্যনীতি তৈরি করে, যদিও বাফরা স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা পরিদর্শন সহ কমিশনের নীতিমালা সম্পর্কে পরামর্শ ও প্রয়োগের জন্য দায়বদ্ধ।[১৪]:§§ ১৫–২১, ৩৩–৫২
বাফরা পরিদর্শকগণের যেখানে খাদ্য স্থানান্তর, মজুদ, প্রস্তুতকরণ বা পরিবেশন করা হয় সেখানে অনুসন্ধান, নথীপত্র পরীক্ষা এবং জব্দ করার ব্যাপক ক্ষমতা আছে; "মানব স্বাস্থ্যের বা পরিবেশের জন্য স্পষ্টত এবং উপস্থিত বিপদজনক" খাদ্য প্রস্তুত করার সময় পরিদর্শকরা অনিরাপদ খাবারও ধ্বংস করতে পারেন।[১৪]:§§ ৩৯–৪৯ এই আইনে খাদ্য পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার বিধান সহ খাদ্য পরিবেশন বা লেনদেন করার ব্যবসায় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে[১৪]:§§ ৫৩–৫৮ এবং খাদ্য আমদানি ও রফতানি নিয়ন্ত্রণে সরকারী কর্তৃত্বকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।[১৪]:§§ ৬১–৬৭ ভুটানের অন্যান্য আইনগুলির মতো খাদ্য আইনও অনুমোদিত আইন ও বিধিমালা মেনে চলতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট অপরাধ এবং জরিমানার সংজ্ঞা দেয়।[১৪]:§§ ৫৮–৮৭
ভুটান সরকার শিক্ষা, অর্থনৈতিক এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তামাক বিক্রয় ও সেবনকে সক্রিয়ভাবে নিরুৎসাহিত করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ, আমদানির উপর শুল্ক আরোপ এবং একজন ব্যক্তির ব্যবহারের পরিমান ও স্থান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।[২]:§§ ১১–১৭ এই আইনটি তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ বোর্ডকে স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে নিবারণ কর্মসূচি সরবরাহ এবং তামাক নির্ভরতা নির্ণয় ও পরামরর্শ সম্পর্কিত পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলির সাথে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।[২]:§§ ২২–২৩
তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় ভুটান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দ্বারা অধিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং এটি নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে চলে। কার্যালয়টি ভুটানের তামাক নীতি বাস্তবায়নের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের জন্য বোর্ডের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে।[২]:§§ ২৯–৩২ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই এক্টের আইনসমূহ এবং নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বোর্ডের নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য দায়বদ্ধ।[২]:§§ ৩৩–৩৭, ৪২
২০১১ সালে সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে, যা মদের উপর পূর্ববর্তী সময়ের তিনগুণ শুল্ক আরোপ করে। ফলে মদের দাম বেড়ে যায় এবং বিক্রি হ্রাস পায়।[১৫] শিক্ষার্থীদের মধ্যে মদ গ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে, ফলস্বরূপ ভুটানের অভিজাত শেরবত্সী কলেজ থেকে বেশ কয়েকটি বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে।[১৬]
ভুটানের ঐতিহ্যবাহী মদ আরা বা আরগ বেশিরভাগ সময় চাল বা ভুট্টা থেকে গাঁজন অথবা পাতিত করে তৈরি করা হয়[১৭] এবং তা কেবলমাত্র আইনগতভাবে উৎপাদন এবং ব্যক্তিগতভাবে সেবন করা যেতে পারে। আরার উৎপাদন পদ্ধতি এবং মান উভয়ই নিয়ন্ত্রণহীন, ভুটানে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পর থেকে এর বিক্রয় নিষিদ্ধ। তবে ভুট্টার অন্যান্য ব্যবহারের চেয়ে আরা অনেক বেশি লাভজনক হওয়ার কারণে অনেক ভুটানি কৃষক আইনি সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছে।[১৮] ইতোমধ্যে ভুটান সরকার কর ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অতিরিক্ত মদ্যপান, অপব্যবহার এবং এর সাথে সম্পর্কিত রোগকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।[১৯][২০]
পূর্ব ভুটানের লুন্ৎসে জেলায় আরা উৎপাদন ও ব্যবহার হ্রাস করার সরকারী প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্থানীয়রা স্বীকার করেছেন যে প্রচুর মদ্যপানের পূর্ব ভুটানের স্বতন্ত্র ঐতিহ্য রোধ করতে কিছু করা উচিত। সরকারের কৌশল হলো আরা উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ধীরে ধীরে এর ব্যবহার হ্রাস করা। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে মদ্যপান এবং আরা উৎপাদন ভুটানের রাজনৈতিক আলোচনার বিশেষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।[২১] যদিও আরা ধর্মীয় এবং ঔষধি ব্যবহারের জন্য সাংস্কৃতিকভাবে সম্পর্কযুক্ত।[২২][২৩]
ভুটান চেতনা নাশক ঔষধ এবং নেশা উদ্রেগকারী দ্রব্য এবং দ্রব্যের ব্যবহার আইন ২০০৫ (”মাদকদ্রব্য আইন”) এর মাধ্যমে - ফার্মাসিউটিক্যালস থেকে মাদকদ্রব্য পর্যন্ত ড্রাগস নিয়ন্ত্রণ করে।[৪] উল্লিখিত আইনের উদ্দেশ্য "ওষুধগুলি কেবলমাত্র চিকিৎসা, পশুচিকিৎসা এবং বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যেই পাওয়া যায় তা নিশ্চিত করা"। এই লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য আইন অবৈধ ড্রাগ ব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপায় হিসাবে শিক্ষা এবং চিকিৎসার উপর জোর দেয়।[৪]:§§ ৩৫–৪২ এই আইনের তফসিল-I এ সবচেয়ে সীমাবদ্ধ দ্রব্য অন্তর্ভুক্ত করে, এর অধীনে দ্রব্যের দাম পাঁচগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং তফসিল-V এ দ্রব্যগুলি "অপব্যবহারের জন্য দায়ী তবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে [পতনশীল নয়]" অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[৪]:§§ ৩–৬; i–v
মাদক সম্পর্কিত সমস্যাগুলি মোকাবেলায় মাদকদ্রব্য আইন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড পুরোপুরি সরকারীভাবে নিয়োগকৃতদের সমন্বয়ে গঠিত এবং "সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর" সভাপতিত্বে ড্রাগ নীতি প্রণয়নের জন্য দায়বদ্ধ,[৪]:§§ ৫৯–৬৩ যেখানে এর অন্তর্ভুক্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বোর্ডের নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রধানত দায়বদ্ধ।[৪]:§§ ৬৪–৭৯ মাদকদ্রব্য আইন রাজকীয় ভুটানি পুলিশ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সহ ঔষধ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলিকে আইন প্রয়োগ ও তদন্তের ক্ষমতা প্রদান করে।[৪]:§§ ৭০–৮৬ মাদকদ্রব্য আইনের অধীনে প্রতিটি ব্যক্তি এবং সত্তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিদর্শনের অধীন।[৪]:§§ ২৬–৩০, ৭০–৭১
মাদকদ্রব্য আইন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ড্রাগ চিকিৎসার এবং পুনরায় অপরাধ ও চিকিৎসার শর্তাবলী ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করে।[৪]:§§ ৫০–৫৩ মধ্যস্থতা, পরামর্শদান এবং বিষাক্ত দ্রব্য অপসারণ প্রক্রিয়া মাধ্যমে মাদকাশক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, এবং সামাজিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করার জন্য বোর্ড বাধ্য; আইন দ্বারা এই জাতীয় সেবা প্রদানের জন্য পর্যাপ্ত কর্মী এবং প্রতিষ্ঠান বজায় রাখা প্রয়োজন।[৪]:§§ ৩৮–৩৯ চিকিৎসার নথিপত্রগুলি অবশ্যই গোপন রাখতে হবে।[৪]:§ ৫৬ মাদকাশক্ত ব্যক্তিরা বাধ্যতামূলক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের অধীন; যারা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয় তাদের অবশ্যই অপরাধের হেফাজতে আটক থাকতে হবে।[৪]:§§ ৩৬–৫৫
আইনটি মাদক সংক্রান্ত মামলায় সাজা প্রদানের অংশ হিসাবে আদালতকে চিকিৎসা চাপিয়ে দেওয়ার কর্তৃত্ব দেয় এবং প্রবেশনকালের মতো "চিকিৎসা ও অগ্রগতির পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের জন্য প্যানেলের সামনে পর্যায়ক্রমে উপস্থিত হওয়ার ব্যবস্থা করে।" আদালতকে এই জাতীয় ব্যবস্থা সফলভাবে মেনে চলা ব্যক্তির মাদকদ্রব্য সম্পর্কিত অন্যান্য জরিমানা যেমন জেলের মেয়াদ এবং জরিমানা মাফ করার ক্ষমতা দেয়।[৪]:§§ ৪৪–৪৭, ৫৭ [২৪] মাদকদ্রব্য আইন এই আইনের সাথে সম্পর্কিত আরও প্রায় এক ডজন অপরাধ ও জরিমানা নির্ধারণ করে, যা অধিকতর দন্ডবিধির পরিপূরক।[৪]:§§ ৯০–১০৩
ভুটানি সম্প্রচার মাধ্যম মাদকদ্রব্য এবং মদের অপব্যবহারের ফল এবং এর সাথে জড়িত মারাত্মক সামাজিক সমস্যাগুলিকে তুলে ধরেছে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে ভুটানের প্রথম বেসরকারি সংবাদপত্র ভুটান অবজার্ভার আরোগ্যলাভে সচেষ্টদের সমর্থন করার জন্য ধর্ম এবং সমাজকে প্রণোদিত করেছে।[২৫]
মূল নিবন্ধ: ভুটানে আত্মহত্যা
২০১১ সালে ভুটানের আত্মহত্যার হার ছিল ১০০,০০০ জনের মধ্যে ১৬.২ জন। এই পরিসংখ্যানটি বিশ্বের বিশতমতম শীর্ষ আত্মহত্যাকারি দেশ হিসাবে রাজ্যটিকে স্থান দিয়েছে এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ষষ্ঠ অবস্থানে।[২৬]
২০১১ সাল থেকে ২০১২ এবং ২০১৩ সালে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০% বৃদ্ধি পাওয়ার রেকর্ড করা হয়েছে,[২৭] যাতে স্পষ্টতই হিমালয়ের রাজ্যটিকে বিশ্বের সর্বোচ্চ আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলির মধ্যে স্থান করে দিয়েছে। ভুটান বর্তমানে এশিয়া অঞ্চলে পাঁচ নম্বর অবস্থানে আছে।[২৮] যদিও ভুটানের উচ্চ হারে আত্মহত্যার বিষয়ে স্পষ্ট কোনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি তবে চাকরির সুযোগের অভাব, অত্যন্ত উচ্চ হারে পারিবারিক ভাঙ্গন এবং উচ্চ হারে পারিবারিক সহিংসতাকে প্রধান কারণ হিসাবে মনে করা হয়।
১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা এবং সারাদেশে নতুন হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয় খোলার মাধ্যমে ভুটানের স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। ১৯৯০এর দশকের গোড়ার দিকে, উনত্রিশটি জেনারেল হাসপাতাল (পাঁচটি কুষ্ঠরোগ হাসপাতাল, তিনটি সেনা হাসপাতাল এবং একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল সহ), ছেচল্লিশটি দাতব্য চিকিৎসালয়, সাতষট্টিটি মৌলিক স্বাস্থ্য ইউনিট, চারটি দেশীয়-ঔষুধের ঔষধালয় এবং পনেরোটি ম্যালেরিয়া নির্মূল কেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। প্রধান হাসপাতালগুলি থিম্ফু, জিলিগফুগ এবং ট্র্যাশিগাংয়ে অবস্থিত। ১৯৮৮ সালে হাসপাতালগুরোর মোট শয্যা সংখ্যা ছিল ৯৩২। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর মারাত্মক ঘাটতি আছে, উক্ত তথ্যমতে মাত্র ১৪২ জন চিকিৎসক এবং ৬৭৮ জন প্যারামেডিকস আছেন, অর্থাৎ প্রায় ২,০০০ লোকের জন্য এক জন পেশাদার স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং প্রায় ১০,০০০ মানুষের জন্য কেবলমাত্র একজন চিকিৎসক আছেন।
১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জিগমে ডোরজি ওয়াংচুক জাতীয় রেফারাল হাসপাতালের সাথে সংযুক্ত রাজকীয় স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট স্বাস্থ্যসেবা সহকারী, নার্স, ধাত্রী এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বিদ্যালয়ের স্নাতকগণ জাতীয় জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রবিন্দু এবং সারা দেশে মৌলিক স্বাস্থ্য ইউনিটগুলির প্রাথমিক চিকিৎসা কর্মীদের সহায়তা করেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে থেকে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে।[২৯]
সরকার তার নাগরিকদের জন্য বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা বজায় রেখেছে। তবে ভুটানে হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং ক্যান্সারের মতো কিছু রোগের চিকিৎসা ভুটানে করা যায় না। যে সকল রোগীদের চিকিৎসা ভুটানে করা যায় না তাদের ভারতের হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং তাদের চিকিৎসা ব্যায় ভুটান সরকার বহন করে।[২৯]
১৯৮০ এর দশকে সর্বাধিক সাধারণ রোগগুলি ছিল পানিবাহিত পরজীবীদের কারণে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সংক্রমণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিষ্কার খাবার পানির অভাব এর জন্য দায়ী। সর্বাধিক ঘন ঘন আক্রান্ত হওয়া রোগগুলি হ'ল শ্বাস নালীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও আমাশয়, কৃমি, ত্বকের সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া, অপুষ্টি এবং চোখ উঠা। ১৯৭৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হো) ভুটানকে গুটিবসন্ত-মুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৯ সালে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি চালু করা হয়। ১৯৮৭ সালে হো’র সহায়তায় সরকার ১৯৯০ সালের মধ্যে সকল শিশুকে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার, পোলিও, যক্ষ্মা এবং হামের টিকা প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২০০০ সালের মধ্যে সরকারের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রধান লক্ষ্য ছিল পানিবাহিত পরজীবী, ডায়রিয়া ও আমাশয়, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া এবং গলগন্ড নির্মূল করা। ১৯৭০ এবং ১৯৮০এর দশকে কুষ্ঠরোগ নির্মূলের অগ্রগতি হয়, সেই সময়ে রোগীর সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি হ্রাস পায় এবং ১৯৮৮ সালে সরকার আশাবাদী ছিল যে ২০০০ সালের মধ্যে এই রোগটি নির্মূল করা সম্ভব হবে।[২৯]
১৯৮৮ সালে ধারণা করা হয় যে প্রতি ১০০০ জনের মধ্যে ৮ জনই কেবল সুপেয় পানির সুবিধা পেয়েছে। সরকারী অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে উন্নত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা সত্ত্বেও, ভুটান এখনও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবেলা করছে। দেশের উচ্চ রোগের হার এবং মৃত্যু হারের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে মারাত্মক জলবায়ু, নিম্নমানের স্বাস্থ্যবিধিসম্মত জীবনযাপন, উদাহরণস্বরূপ শীত কালে দীর্ঘসময় বদ্ধ ঘরে বসবাস, এটি এমন একটি পরিস্থিতি যা কুষ্ঠরোগের প্রবণতা বাড়ায় এবং অপ্রতুল বাতাস চলাচলের কারণে রান্নার সরঞ্জাম থেকে সৃষ্ট ধূয়ায় শ্বাস গ্রহণ। তা সত্ত্বেও ১৯৮০ সালে অনুমান করা হয় যে ৯০% ভুটানি দৈনিক পর্যাপ্ত ক্যালোরি গ্রহণ করে।[২৯]
যদিও ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে অর্জিত প্রতিরক্ষার অভাবজনিত রোগলক্ষণসমষ্টি (এইডস)-এর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি তথাপি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৯৮৭ সালে একটি জনসচেতনতা কর্মসূচি গ্রহণ করে। ডাব্লুএইচও’র পৃষ্ঠপোষকতায় থিম্ফু জেনারেল হাসপাতালে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এইডস এবং মানব প্রতিরক্ষা অভাবসৃষ্টিকারী ভাইরাস (এইচআইভি) পরীক্ষা করার জন্য একটি "রেফারেন্স ল্যাবরেটরি" প্রতিষ্ঠা করা হয়। আরও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধিদের এইডস সচেতনতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর প্রশিক্ষণের জন্য ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।[২৯]