পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র (ভূচৌম্বক ক্ষেত্র নামেও পরিচিত) হল এক ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র যা পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ থেকে শুরু করে মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে ক্ষেত্রটি সূর্য থেকে উৎপন্ন সৌর বায়ুর সাথে মিলিত হয়। ভূপৃষ্ঠে এর আয়তন ২৫ থেকে ৬৫ মাইক্রোটেসলা (০.২৫ থেকে ০.৬৫ গস)।[২] এটি পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের তুলনায় ১১ ডিগ্রি হেলানো চৌম্বক মেরু ক্ষেত্র। এটি দেখতে মনে হয় যেন পৃথিবীর কেন্দ্রে একটি চুম্বকের দণ্ড দেওয়া আছে। উত্তর ভূচৌম্বক মেরু উত্তর গোলার্ধে গ্রিনল্যান্ডের কাছে অবস্থিত, যা মূলত পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত, অন্যদিকে দক্ষিণ ভূচৌম্বক মেরু উত্তর মেরুতে অবস্থিত। চৌম্বক দণ্ডের মত, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় কারণ এটি ভূডায়নামোর (গলিত লোহার সংকরের গতি) ফলে উৎপন্ন হয়।
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রটি সৌর বায়ুকে অগ্রাহ্য করে, অন্যথায় এর চার্জযুক্ত কণাগুলো ওজোন স্তর দূরে রাখে যা পৃথিবীকে ক্ষতিকারক অতিবেগুনী বিকিরণ থেকে রক্ষা করে।[৩] একটি ছিন্নকারী কৌশল চৌম্বক ক্ষেত্রের বুদবুদে গ্যাসকে আটকানোর জন্য, যা সৌর বায়ুর ফলে উড়ে যেতে পারে।[৪] মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের হ্রাস পাওয়ার হিসাব থেকে দেখা যায় মঙ্গল গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্রের বিলুপ্তির ফলে এর বায়ুমণ্ডলের প্রায় সম্পূর্ণ হ্রাস পায়।[৫][৬]
মানুষ একাদশ শতাব্দী থেকে দিক নির্ণয়ের জন্য এবং দ্বাদশ শতাব্দী থেকে নৌচালনের জন্য কম্পাস ব্যবহার করছে।[৭] যদিও চৌম্বকীয় দিকনির্দেশনা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়, কিন্তু এই পরিবর্তন খুবই ধীরগতির যার ফলে নৌচালনায় সাধারণ কম্পাস তেমন উপকারী নয়।
যেকোন অবস্থানে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে তিনটি ভেক্টর দ্বারা প্রকাশ করা যায়। ক্ষেত্রের দিক নির্ণয়ের একটি সাধারণ উপায় হল চৌম্বকীয় উত্তর প্রান্ত নির্ধারণ করতে কম্পাসের ব্যবহার। চৌম্বকীয় উত্তর দিকের কৌণিক অবস্থান নির্ণায়ক হল বিষুবলম্ব (D)। চৌম্বকীয় উত্তর দিক বরাবর আনুভূমিকভাবে উৎপন্ন কোণ হল বক্রতা (I)। ক্ষেত্রের ঘনত্ব (F) চুম্বক থেকে উৎপন্ন বলের সমানুপাতিক। X এর দ্বারা উত্তর, Y এর দ্বারা পূর্ব এবং Z এর দ্বারা নিচের দিক নির্ণয়ও আরেকটি প্রচলিত প্রকাশভঙ্গি।[৮]
ক্ষেত্রের ঘনত্ব গস দিয়ে নির্ণয় করা হয় এবং ন্যানোটেসলায় প্রকাশ করা হয়, যেখানে ১ গস = ১০০,০০০ টেসলা। ন্যানোটেসলাকে গামাও (γ) বলা হয়।[৯]
একটি কোণের বক্রতা -৯০° উপরে থেকে ৯০° নিচে পর্যন্ত হতে পারে। উত্তর গোলার্ধে ক্ষেত্রটি নিম্নদিকে নির্দেশ করে আছে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে তা উপরের দিকে নির্দেশ করে আছে।
বিষুবলম্ব এই ক্ষেত্রের উত্তর দিক থেকে পূর্ব দিকের বিচ্যুতির ক্ষেত্রে ধনাত্মক।
চৌম্বক মেরুর অবস্থান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক দুই ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায়।[১০] একটি উপায়ে কোন মেরু হল এমন একটি বিন্দু যেখানে চৌম্বক ক্ষেত্র উলম্ব।[১১] বক্রতা পরিমাপের মাধ্যমে তা নির্ণয় করা যায়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের বক্রতা উত্তর চৌম্বক মেরুতে ৯০° (নিম্নমুখী) এবং দক্ষিণ চৌম্বক মেরুতে -৯০° (উর্ধ্বমুখী)। দুটি মেরু স্বাধীনভাবে একে অপরের দিকে নড়াচড়া করে এবং তারা গোলকে একে অপরের ঠিক বিপরীত দিকে নয়। তারা খুব দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে। উত্তর চৌম্বক মেরুতে এই স্থান পরিবর্তনের হার প্রতি বছরে ৪০ কিলোমিটারের বেশি। গত ১৮০ বছরে উত্তর চৌম্বক মেরু ১৮৩১ সালে বুথিয়া উপদ্বীপের কেপ অ্যাডিলেড থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৬০০ কিলোমিটার দূরে রিসোল্যুট বদ্বীপে স্থানান্তরিত হয়েছে।[১২]