ভূমিকম্প মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতির মধ্যে জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থাদি (এমন প্রস্তুতি যা ভূমিকম্প ঘটলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা উন্নত করে) এবং ক্ষতি লাঘবকারী ব্যবস্থাদি (যেগুলির উদ্দেশ্যে ভূমিকম্পের নেতিবাচক ফলাফল ন্যূনতম করা) - এই দুই ধরনের ব্যবস্থাগুলি অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে জরুরি অবস্থার জন্য খাবার এবং পানি/জল সংরক্ষণ করা এবং ভূমিকম্পের সময় ব্যক্তিদের কী করতে হবে, সে ব্যাপারে শিক্ষাদান করা।[১] ক্ষতি লাঘবকারী ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে বৃহৎ আসবাবপত্র (যেমন বইয়ের আলমারি এবং বড় দেরাজ/ক্যাবিনেট), টেলিভিশন এবং কম্পিউটার পর্দাগুলিকে দৃঢ়ভাবে সুরক্ষিত করা, যেগুলি অন্যথায় ভূমিকম্পের কারণে উল্টে পড়ে যেতে পারে। একইভাবে বিছানা বা গদিযুক্ত কেদারার (সোফা) উপরে জিনিসপত্র রাখা এড়িয়ে চললে সেগুলির মানুষের উপর পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ভূমিকম্প-সম্পর্কিত কোনও সুনামি মোকাবেলায় পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতিও ভূমিকম্প প্রস্তুতির অংশ হতে পারে।[২]
ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ভূমিকম্প সংক্রান্ত নিয়মনীতিগুলিতে নতুন ভবনগুলির ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। যেসব পুরাতন ভবন এবং বাড়ি ঐ নিয়ম মেনে চলে না, সেগুলির প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পরিবর্তন সাধন করা হতে পারে। উড়াল মহাসড়ক এবং সেতুগুলিতেও পরিবর্তন সাধন এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধী নকশা ব্যবহার করা হয়।
নিয়মনীতিগুলি এমনভাবে প্রণয়ন করা হয় না যাতে ভবনগুলিকে সম্পূর্ণ ভূমিকম্প-প্রতিরোধী করা যায়, অর্থাৎ ভবনের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। বেশিরভাগ ভবন নকশার লক্ষ্য হলো ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা, যাতে ভবনের বাসিন্দাদের জীবন রক্ষা পায়। কিছু সীমিত ক্ষয়-ক্ষতি সহ্য করা হয় এবং একটি প্রয়োজনীয় লাভ-ক্ষতি বিনিময়করণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ভবন-কাঠামোর উন্নতিসাধনের একটি পরিপূরক বা পূর্বসূরী হতে পারে ভূমিকম্প-প্রতিরোধী আসবাবপত্র নির্মাণ ও ব্যবহার।
ভবনের ভূমিকম্প প্রতিরোধী উন্নতিসাধন কৌশল এবং আধুনিক ভবন নির্মাণ নিয়মনীতিগুলি রিখটার মাপনীতে ৮.৫-এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের জন্য ভবনগুলির সম্পূর্ণ ধ্বংস রোধ করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে।[৩] যদিও রিখটার মাপনীকে প্রসঙ্গ হিসেবে ধরা হয়েছে, ভূমির স্থানীয় কম্পনের তীব্রতা ভবনের ঘাত-সহনশীলতার জন্য বিবেচ্য সবচেয়ে বড় নিয়ামকগুলির মধ্যে একটি।
পূর্বপ্রস্তুতির মূল প্রতিপাদ্য হলো ভূমিকম্পের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা। পূর্বপ্রস্তুতি একজন ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত। এর মধ্যে এমন সব জিনিসপত্র এবং প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে কার্যকর। পূর্বপ্রস্তুতি একক ব্যক্তি থেকে শুরু হয়ে পরিবার, স্থানীয় লোকালয়,[৪] এবং এরপর ব্যবসায়িক, অলাভজনক সংস্থা এবং সরকারি স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। কিছু প্রতিষ্ঠানের পূর্বপ্রস্তুতিতে বিভিন্ন স্তরের মিশ্রণ ঘটে। ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতার পরিকল্পনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিকে একটি দুর্যোগ সামলানোর পরিকল্পনা তৈরি করতে উৎসাহিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় জরুরি অবস্থা ব্যবস্থাপনা সংস্থা (ফেমা) সাধারণত পূর্বপ্রস্তুতিকে একটি শঙ্কু বা পিরামিডের আকারে উপস্থাপন করে, যার ভিত্তিতে থাকে নাগরিক এবং যার উপরে পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার অবস্থান করে।[৫]
শিশুদের বিশেষ সমস্যা হতে পারে, তাই কিছু পরিকল্পনা এবং সম্পদ সরাসরি তাদের সহায়তা করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় জরুরি অবস্থা ব্যবস্থাপনা সংস্থার পরামর্শ অনুসারে, "দুর্যোগের কারণে শিশুরা ভীত, বিভ্রান্ত এবং নিরাপত্তাহীন বোধ করতে পারে"। শিশুটি দুর্যোগের সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভ ছাড়াও বন্ধুর সাথে দুর্যোগ ঘটলে বা শুধুমাত্র টেলিভিশনে দুর্যোগ দেখলেও এমনটি ঘটতে পারে।[৬] প্রতিবন্ধী বা অক্ষম ব্যক্তিদের বা অন্যান্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বিশেষ জরুরি প্রস্তুতির প্রয়োজন থাকতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ফেমা-এর পরামর্শের মধ্যে রয়েছে ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্রের অনুলিপি হাতে রাখা, মোটরচালিত হুইলচেয়ারের মতো চিকিৎসা সরঞ্জামের জন্য বিদ্যুৎ আহিতকারক (চার্জিং) যন্ত্র এবং এক সপ্তাহের জন্য সহজলভ্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা। পূর্বপ্রস্তুতিতে পোষা প্রাণীগুলিও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
ভূমিকম্প মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পূর্বপ্রস্তুতিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: এক্ষেত্রে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের সদস্যবৃন্দ এবং তাদের সেবা প্রদানকারী দুর্যোগ কর্মীবৃন্দ - উভয়কেই সহায়তা করার বিভিন্ন উপায় নকশা করা হয়।
একটি বহুসংখ্যক সম্ভাব্য বিপদমূলক দৃষ্টিভঙ্গি (যেখানে স্থানীয় লোকালয়গুলিকে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য বিপদের জন্য প্রস্তুত করা হয়) একক বিপদমূলক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বেশি ঘাতসহ এবং ইদানিং এই দৃষ্টিভঙ্গির জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।[৭][৮][৯]
দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুৎ বিভ্রাট মূল দুর্যোগের চেয়েও বেশি ক্ষতি করতে পারে। জরুরি বিদ্যুৎ উৎপাদক (ইমারজেন্সি জেনারেটর) বা বিদ্যুতের অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে জরুরি বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সরবরাহ করে এ সমস্যাটির উপশম করা যেতে পারে।[১০] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছে: "বাড়ির মালিক, ব্যবসার মালিক এবং স্থানীয় নেতাদের নিজেদেরকেই বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন মোকাবেলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হতে পারে।"[১১] হাসপাতাল, সামরিক ঘাঁটি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলিতে প্রায়শই ব্যাপক মাত্রায় সহায়ক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা মোতায়েন থাকে।[১২] পূর্বপ্রস্তুতি কেবল বাসাবাড়িতে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকে না। [১৩] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব সেবা মন্ত্রণালয় হাসপাতালগুলিকে জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতিতে যেসব বিশেষ সমস্যাগুলির মোকাবেলা করতে হতে পারে, তার সমাধান প্রদান করে। এগুলির মধ্যে রয়েছে নিরাপদ তাপমাত্রা বজায় রাখা, জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং এমনকি চরম পরিস্থিতিতেও ভবন থেকে মানুষ অপসারণের কাজটি পরিচালনা করা।[১৪] ফেমা সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে একটি জরুরি অবস্থার প্রত্যুত্তর পরিকল্পনা তৈরি করতে উৎসাহিত করে [১৫] এবং মার্কিন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসন বিশেষভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা মালিকদের জরুরি পূর্বপ্রস্তুতির উপর মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেয় এবং বিভিন্ন ধরনের কার্যপত্র এবং উপায় সরবরাহ করে।
প্রাকৃতিক গ্যাস নল থেকে নিঃসরণের কারণে বিস্ফোরণের বিপদের পরিপ্রেক্ষিতে, রেডি.গভ বলেছে যে "প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ নল কীভাবে বন্ধ করতে হয় তা পরিবারের সকল সদস্যের জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ" এবং ভবনের বা ভূ-সম্পত্তির মালিকদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে তারা যে নির্দিষ্ট ধরনের গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করে, তা বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ সরঞ্জামগুলি লভ্য আছে। রেডি.গভ আরও উল্লেখ করেছে যে "কোথায় এবং কীভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করতে হবে তা সকল দায়িত্বশীল পরিবারের সদস্যদের শেখানো বুদ্ধিমানের কাজ।" তবে তারা সতর্ক করেছে যে প্রধান বর্তনী বিচ্ছিন্ন করার আগে একক বর্তনীগুলি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। রেডি.গভ আরও বলেছে যে "পরিবারের সকল সদস্যের জন্য বাড়ির প্রধান জল কপাটিকা বন্ধ করার পদ্ধতি শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ"। তারা মরিচা-পড়া জল কপাটিকাগুলি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। [১৬]
জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ভূমিকম্প মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতির মাত্রা সাধারণত কম হয়।[১৭]
দুর্যোগের মোকাবেলায় পূর্বপ্রস্তুতি প্রচারের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি বিদ্যমান, কিন্তু সেগুলির নথিগুলি তেমন সুলিখিত নয় এবং এগুলির কার্যকারিতা খুব কমই পরীক্ষিত।[১৮] মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনতে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ, মহড়া এবং মুখোমুখি আন্তঃক্রিয়া অধিকতর সফল প্রমাণিত হয়েছে।[১৯] এছাড়া ডিজিটাল (কম্পিউটারভিত্তিক) পদ্ধতিও ব্যবহার করা হয়েছে;[৯] শিক্ষামূলক ভিডিও খেলাগুলি এর একটি উদাহরণ।[২০]
|hdl-সংগ্রহ=
এর |hdl=
প্রয়োজন (সাহায্য)