মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের ধারণাটি বেসরকারি মহাকাশ সংস্থা ও বেসরকারি কর্পোরেশনগুলির কাছ থেকে যেমন ব্যাপক সাড়া পেয়েছে এবং বিজ্ঞান কথাসাহিত্য রচনা, চলচ্চিত্র ও শিল্পের ক্ষেত্রেও এ বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে।
সংস্থাগুলি বসতি স্থাপনের চেষ্টার প্রথম ধাপ হিসাবে মঙ্গল গ্রহে মানব অভিযানের পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছে, তবে কোনও মানুষ এখনো পর্যন্ত গ্রহটিতে পদার্পণ করেনি। তবে ল্যান্ডার ও রোভারগুলি গ্রহের উপরিভাগে সফলভাবে অন্বেষণ বা অনুসন্ধান করেছে এবং স্থলটির অবস্থার বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করেছে। গ্রহে কোনও মানুষদের অবতরণের আগে হ্যাপটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মঙ্গল গ্রহের ভার্চুয়াল দর্শন প্রস্তাব করা হয়েছে।[২]
মঙ্গলে বসতি স্থাপনের মূল কারণগুলোর মধ্যে আছে কৌতূহল, মানুষবিহীন রোভারের আরও গভীর পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করার প্রয়াস, এর উৎসসমূহে অর্থনৈতিক আগ্রহ এবং অন্যান্য গ্রহে বসতি স্থাপনের মাধ্যমে মানবজাতিকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার সম্ভাবনা সৃষ্টি। প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকির মধ্যে আছে মঙ্গলে ভ্রমণের সময় এর ভূপৃষ্ঠের বিকিরণের সংস্পর্শে আসা, বিষাক্ত মাটি, নিম্ন মধ্যাকর্ষন, সুপেয় জলের অভাব, শীতল তাপমাত্রা এবং পৃথিবী থেকে মঙ্গল গ্রহের দূরত্ব ও যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা যা একাকিত্বের সৃষ্টি করে।
স্থায়ী বসতি স্থাপন নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতি প্রদানকারী সরকারি মহাকাশ সংস্থাগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—নাসা, ইএসএ, রসকসমস, ইসরো ও সিএনএসএ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি হল—স্পেসএক্স, লকহীড মার্টিন ও বোয়িং।
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ মঙ্গল গ্রহে কতিপয় মানব অভিযানের প্রস্তাব দিয়েছে।
জাতীয় মহাকাশ সংস্থা কর্তৃক সরকারিভাবে পরিকল্পিত সকল মানব অভিযানমূলক কর্মসূচী সরাসরিভাবে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত মিশনের ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। নাসা, রসকসমস, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা দ্বারা পরিকল্পিত এ ধরনের অভিযানগুলো কেবলমাত্র পরীক্ষামূলক অনুসন্ধানের জন্যই পরিচালিত হয়েছে, একটি স্থায়ী ভিত্তি স্থাপন করা এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত মূল লক্ষ্য নয়।
বসতি স্থাপনের জন্য স্থায়ী আবাস প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন যার স্ব-বৃদ্ধি ও স্বনির্ভর হওয়ার ক্ষমতা আছে।মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য দুটি পূর্বগৃহীত প্রস্তাবনা হলো “মঙ্গল গ্রহে প্রত্যক্ষ” ও “আংশিক প্রত্যক্ষ” ধারণাগুলি যা মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের পক্ষে একজন অধিবক্তা, রবার্ট জুব্রিন কর্তৃক সমর্থিত।
স্পেস এক্স মঙ্গল গ্রহে চূড়ান্তভাবে বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে মঙ্গল পরিবহনব্যবস্থার পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব দিয়েছে। উক্ত মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে পুরোপুরি পুনঃব্যবহারযোগ্য উৎক্ষেপক যান, মানুষ পরিবহনযোগ্য মহাকাশযান, কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান চালক- ট্যাঙ্কার, অতি দ্রুত ঘূর্ণনশীল লঞ্চ প্যাড এবং ইন সাইটু রিসোর্স ইউটিলাইজেশন(আইএসআরইউ) এর মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহে রকেট জ্বালানি উৎপাদন এর অন্তর্ভুক্ত। স্পেস এক্স এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ২০২৪ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে সর্বপ্রথম মানুষ পাঠানো।[৩][৪]
বাল্কের বিশ্লেষণে আকৃতি, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দিক দিয়ে শুক্র গ্রহের সাথে পৃথিবীর সাদৃশ্য আছে, কিন্তু বসতি স্থাপনের কথা বিবেচনায় পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের আরো জোরালো মিল পাওয়া যায়।
[৫] এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ হলোঃ
বায়ুমণ্ডলীয় চাপের তুলনামূলক ছক
জায়গার নাম | বায়ুমণ্ডলীয় চাপ |
অলিম্পাস মনস চূড়া | ০.০৩ kPa
(০.০০৪৪ psi) |
মঙ্গল গ্রহ (গড়) | ০.৬ kPa
(০.০৮৭ psi) |
হেলাস প্ল্যানিশিয়া তলদেশ | ১.১৬ kPa
(০.১৬৮ psi) |
আর্মস্ট্রং সীমা | ৬.২৫ kPa
(০.৯০৬ psi) |
মাউন্ট এভারেস্ট চূড়া | ৩৩.৭ kPa
(৪.৮৯ psi) |
পৃথিবীর সমুদ্র সমতল | ১০১.৩ kPa
(১৪.৬৯ psi) |
মঙ্গল পৃষ্ঠের অভিকর্ষ শক্তি পৃথিবীর মাত্র ৩৮%। যদিও পৃথিবীর মাইক্রোগ্র্যাভিটি মানুষের পেশি ও হাড়ের ক্ষয়ক্ষতিজনিত সমস্যার কারণ,[৭][৮] মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণেরও একই প্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা এখনও জানা সম্ভব হয় নি। মঙ্গল গ্রহের ক্ষুদ্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মানুষের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে এ সম্পর্কে আরো জানার জন্য “মার্স গ্র্যাভিটি বায়োস্যাটেলাইট” নামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়।
ম্যাগনেটোস্ফিয়ার না থাকায় সৌর কণা, মহাজাগতিক রশ্মি অতি সহজেই মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারে। [৯][১০][১১]
মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডলীয় চাপ আর্মস্ট্রং সীমার চেয়ে অনেক কম, ফলে মানুষ চাপরোধক স্যুট ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। যেহেতু পৃথিবীকরণকে স্বল্পমেয়াদী সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, তাই মঙ্গল গ্রহে প্রেসার ভেসেল যুক্ত করে বাসযোগ্য কাঠামো নির্মাণ করতে হবে যা অনেকটা মহাকাশযানের অনুরূপ এবং ৩০ থেকে ১০০ কিলোপ্যাসকেল (kPa) চাপ ধারণে সক্ষম। এ গ্রহের বায়ুমণ্ডলও অত্যন্ত বিষাক্ত যার বেশিরভাগই কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিপূর্ণ ( ৯৫% কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ৩% নাইট্রোজেন, ১.৬% আর্গন এবং অক্সিজেনসহ অন্যান্য গ্যাসের পরিমাণ ০.৪% থেকেও কম )।
এই পাতলা বায়ুমণ্ডল সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিকে প্রতিফলিত করে না, ফলে তা পরমাণুগুলোর আণবিক বন্ধনে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে অ্যামোনিয়া (NH3) স্থিতিশীল নয় এবং কয়েক ঘণ্টা থাকার পরেই এর বন্ধন ভেঙ্গে যায়।[১২] এই সূক্ষ্ম বায়ুস্তরের কারণেই মঙ্গলে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য পৃথিবীর তুলনায় অনেক বেশি, যা সাধারণত ৭০°C (১২৫°F)[১৩] হয়ে থাকে। যা-ই হোক, ধূলিঝড়ের সময় দিন/রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য আরো কম থাকে কারণ তখন দিনের বেলায় খুব সামান্য আলো বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে যা মধ্যবর্তী বায়ুস্তরকে ঊষ্ণ করে তোলে।[১৪]
মঙ্গল গ্রহে জলের পরিমাণ অতি স্বল্প, স্পিরিট এবং অপারচুনিটি রোভারের সাহায্যে সেখানে পৃথিবীর শুষ্কতম মরুভূমি থেকেও স্বল্প পানির উৎসের সন্ধান মিলেছে।[১৫][১৬]
এ গ্রহের জলবায়ু পৃথিবীর তুলনায় অনেক শীতল, পৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৮৬ থেকে ২৬৮ কেলভিনের মধ্যে (-৮৭°C হতে -৫°C; -১২৫º থেকে ২৩°F) (ঋতু এবং অক্ষাংশের উপর নির্ভর করে)[১৭][১৮]।অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর সর্বকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল যা ছিল ১৮৪ K (-৮৯.২°C;-১২৮.৬°F)।
যেহেতু মঙ্গল গ্রহ সূর্যের প্রায় ৫২% দূরে অবস্থিত, তাই এ গ্রহের প্রতি একক অঞ্চলে সৌরশক্তি প্রবেশের পরিমাণ পৃথিবীর ঊর্ধ্বতর বায়ুস্তরে প্রবেশকৃত সৌরশক্তির মাত্র ৪৩.৩%,[১৯] তবুও অধিক পাতলা বায়ুস্তরের কারণে সূর্যরশ্মির একটি বড় অংশ মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায়।[২০][২১] মঙ্গলে সর্বাধিক সৌর বিকিরণ প্রায় ৫৯০ W/m2 যার তুলনায় পৃথিবী পৃষ্ঠে বিকিরণ প্রায় ১০০০ W/m2; মঙ্গল গ্রহের নিরক্ষীয় অঞ্চলের অনুকূল অবস্থা উত্তর মেরুর কানাডীয় অঞ্চলের ডেভন দ্বীপের জুন মাসের আবহাওয়ার সাথে তুলনা করা যায়।[২২]
ধূলিঝড় সারা বছরব্যাপী খুবই সাধারণ ঘটনা যা পুরো সপ্তাহ ধরে গ্রহকে ঢেকে রাখে এবং সূর্যরশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাঁধা দেয়।[২৩][২৪] ফলে কয়েক মাসের জন্য তাপমাত্রা প্রায় ৪°C (৭°F) হ্রাস পায়। এর সাথে পৃথিবীর তুলনামূলক ঘটনার মধ্যে আছে বিরল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা যেমনঃ ক্রাকাতোয়া, যা ১৮৮৩ সালে বায়ুমণ্ডলে প্রচুর ছাই ছড়িয়ে দেয়, ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১°C(২°F) হ্রাস পায়। সম্ভবত এই দুর্যোগগুলো সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রভাব ফেলে, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগেও ফলে বাধা সৃষ্টি হয়।[১৪][২৫]
বস্তুত মঙ্গল গ্রহে কখনো মেঘের সৃষ্টি হয় না এবং বৃষ্টিও হয় না, তাই ঠান্ডা হলেও এ গ্রহ সর্বদা রৌদ্রোজ্জ্বল (ধূলিঝড়ের সময় ব্যতীত)। এর মানে ধূলিঝড়-মুক্ত দিনগুলিতে সৌর প্যানেল সর্বাধিক সক্রিয়তার সাথে কার্য পরিচালনা করতে পারে। মঙ্গলের কক্ষপথ পৃথিবীর তুলনায় উৎকেন্দ্রিক, যা এক মঙ্গল বর্ষের সময়কালে তাপমাত্রা এবং সৌর ধ্রুবকের তারতম্যকে বৃদ্ধি করে।
ক্লোরিন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট যৌগগুলোর অধিক ঘনত্বের কারণে মঙ্গল গ্রহের মাটি অত্যন্ত বিষাক্ত যা সকল প্রকারের জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।[২৬][২৭]
যদিও কিছু আদি জীব পৃথিবীতে চরম ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে, আনুমানিক ধারণার ভিত্তিতে জানা গেছে যে, উদ্ভিদ ও প্রাণীরা মঙ্গল গ্রহের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকতে পারে না।[২৮]
শুক্র মেঘের শীর্ষ ব্যতীত তাপমাত্রা এবং সূর্যরশ্মি প্রাপ্তির দিক দিয়ে অন্য যেকোনো গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে মঙ্গল গ্রহের ভূপৃষ্ঠের অবস্থা পৃথিবীর কাছাকাছি। যা–ই হোক, উচ্চ বিকিরণ,অতিশয় সংকুচিত বায়ুচাপ এবং ০.১৬% অক্সিজেন দ্বারা গঠিত বায়ুমণ্ডল বিশিষ্ট এ গ্রহের পৃষ্ঠ মানুষ বা জীবনের পরিচিত কোনো রূপের জন্য বসবাসের যোগ্য নয়।[২৯]
২০১২ সালে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, কিছু লাইকেন এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া মার্স সিমুলেশন ল্যাবরেটরিতে জার্মান মহাকাশ কেন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত একটি পরীক্ষায় কৃত্রিমভাবে তৈরি মঙ্গল গ্রহের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণের ভিত্তিতে অসাধারণ অভিযোজন ক্ষমতা প্রদর্শন করে এবং ৩৪ দিন বেঁচে থাকে।[৩০][৩১][৩২] কিছু বিজ্ঞানী ধারণা করেন যে, সায়ানোব্যাকটেরিয়া মঙ্গল গ্রহে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র গড়ে তোলার মাধ্যমে কলোনির বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে।[৩৩] তারা প্রস্তাব করেন যে, সায়ানোব্যাকটেরিয়া খাদ্য, জ্বালানি ও অক্সিজেন উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে;আবার তাদের উৎপাদিত দ্রব্যগুলো পরোক্ষভাবে অন্যান্য জীবের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারবে, যা মঙ্গলের উৎসের উপর ভিত্তি করে জীবন রক্ষাকারী জৈব প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণে নতুন দুয়ার উন্মোচন করবে।
মানুষ পৃথিবীর এমন কিছু জায়গায় ভ্রমণ করেছে যাদের পরিবেশ কিছুটা মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের সাথে মিলে যায়। নাসার রোভার কর্তৃক প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে জানা গেছে, মঙ্গলের নিম্ন অক্ষাংশ বিশিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রার সমান।[৩৪] পৃথিবীতে পাইলট বেলুন দ্বারা আরোহণকৃত সর্বোচ্চ উচ্চতায় (১৯৬১ সালে ৩৫ কিমি বা ১১৪,০০০ ফুট এবং ২০১২ সালে ৩৮ কিমি)[৩৫] বায়ুমণ্ডলীয় চাপ মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের চাপের সমান।
মঙ্গলে মানুষের জীবনযাপনের জন্য জটিল ব্যবস্থা সংবলিত কৃত্রিম বাসস্থানের প্রয়োজন হবে। এক্ষেত্রে একটি অন্যতম বিবেচিত বিষয় হলো পানি প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থা। মানবদেহ প্রধানত পানি দিয়ে তৈরি হওয়ায়, পানির অভাবে সে কিছুদিনের মধ্যেই মারা যাবে। এমনকি শরীরের মোট পানি ৫-৮% হ্রাস পেলে তা ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ ও মাথা ঘোরার কারণ হয় এবং তা ১০% হ্রাস পেলে শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি হয় (পানিশুন্যতা দেখুন)।[৩৬] যুক্তরাজ্যে একজন ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে ৭০-১৪০ লিটার পানি ব্যবহার করে। আইএসএস এর মহাকাশচারীরা যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে এর চেয়ে আরো কম পানি ব্যবহার করা সম্ভব এবং এর মধ্যে ৭০% পানি আইএসএস পানি পুনঃবিশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনঃব্যবহার করা সম্ভব। পুরো পানির অর্ধেকই গোসলের কাজে ব্যবহৃত হয়। মঙ্গল গ্রহেও অনুরূপ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে, তবে তা আরো কার্যকরী হতে হবে যেহেতু মঙ্গলে রোবোটের সাহায্যে প্রতিনিয়ত জল সরবরাহ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল (আইএসএস এ প্রতিবছর চারবার জল সরবরাহ করা হয়)।[৩৭]
মঙ্গল গ্রহ মানব বসতি স্থাপনের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ প্রদর্শন করে। দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ অভিযানের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে যা মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনে সহায়ক হতে পারে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘতম স্পেস ফ্লাইটের রেকর্ডটি মহাকাশচারী ভ্যালেরি পলিয়াকভের,[৩৮] যা একটানা ৪৩৮ দিনের ছিল এবং জেনাদি পাদালকা দ্বারা মহাকাশে সর্বাধিক অর্জিত সময় হলো ৮৭৮ দিন।[৩৯] অ্যাপোলো ১৭ চাঁদে অবতরণের জন্য পৃথিবীর ভ্যান অ্যালেন বিকিরণ বেষ্টনীর সুরক্ষার বাইরে দীর্ঘতম সময়, প্রায় ১২ দিনের মতো অতিবাহিত করে।[৪০] কিন্তু নাসা কর্তৃক প্রস্তাবিত ২০২৮ সালের ১১০০ দিনের যাত্রার তুলনায় তা অনেক কম। বিজ্ঞানীরা এও অনুমান করেন যে, বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়াকলাপগুলি মঙ্গল গ্রহের বাহ্যিক পরিবেশ দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। উচ্চ মাত্রার বিকিরণের প্রচুর শারীরিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে, যা হ্রাস করা অত্যাবশ্যক।[৪১] উপরন্তু, মঙ্গল গ্রহের মাটিতে উচ্চ মাত্রার অধিবিষ আছে, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
মাধ্যাকর্ষণ বলের পার্থক্য হাড় ও পেশীর ক্ষয়সাধনসহ বিভিন্নভাবে মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। ফলে অস্টিওপোরোসিস এবং রক্ত-সংবহনতন্ত্রের রোগের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। বর্তমান কাক্ষিক আবর্তনচক্রে মহাকাশচারীদের আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের শূন্য মাধ্যাকর্ষণে প্রায় ৬ মাস অবস্থান করতে হয়, যা মঙ্গল গ্রহে একমুখী ভ্রমণের তুলনামূলক সময়ের সমান। যার ফলে মঙ্গলে গমনকারী নভোচারীরা কী ধরনের শারীরিক অবস্থার মধ্যে থাকবেন, তা গবেষকরা আরো ভালোভাবে বোঝার সুযোগ পান। মঙ্গলের পৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাত্র ৩৮%। মাইক্রোগ্র্যাভিটি রক্ত-সংবহনতন্ত্র, কঙ্কালতন্ত্র এবং নিউরোভেস্টিবুলার (কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র) সিস্টেমের উপর প্রভাব ফেলে। রক্ত-সংবহনতন্ত্রের প্রতিক্রিয়াগুলি অত্যন্ত জটিল। পৃথিবীতে,শরীরের ৭০% রক্ত হার্টের নিচে অবস্থান করে, কিন্তু মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে কোনো কিছুই রক্তকে শরীরের নিচের দিকে টানতে না পারার কারণ এটি নয়। এর অনেক ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে প্রবেশের সাথে সাথে শরীরের নিচের অংশ এবং পায়ের রক্তচাপ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।[৪২] এর ফলে পেশি ও হাড়ের ভর হারিয়ে পা দুর্বল হয়ে পড়ে। নভোচারীদের মধ্যে স্ফীত মুখ এবং “চিকেন লেগ সিনড্রোম” এর লক্ষণ দেখা যায়। পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের এক দিন পরে সংগৃহীত রক্তের নমুনায় রক্তরসে ১৭% হ্রাস দেখা গিয়েছিল, যা এরিথ্রোপয়েটিন নিঃসরণ রোধে ভূমিকা রেখেছিল। কংকালতন্ত্র, যা শরীরের অঙ্গবিন্যাস, সঞ্চালন ইত্যাদি বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রা ও মাইক্রোগ্র্যাভিটির সংস্পর্শে আসার ফলে পেশিশক্তি ক্ষয় এবং দেহের অভ্যন্তরীণ খনিজ চ্যুতি ঘটে। এই সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং মাইক্রোগ্র্যাভিটির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো কখনোই পুরোপুরিভাবে চলে যাবে না।[৪৩]
মঙ্গল গ্রহের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিলম্বের কারণে, মহাকাশচারীদের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের জন্য নতুন বিধান তৈরি ও প্রয়োগ করা প্রয়োজন। গবেষকরা হাই-সিএস (হাওয়াই এনালগ মহাকাশ অনুসন্ধান ও সিমুলেশন কেন্দ্র) নামে মঙ্গল গ্রহকেন্দ্রিক একটি সিমুলেশন ব্যবস্থা তৈরি করেছেন যার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এক বছরে একটি কৃত্রিম মঙ্গল পরীক্ষাগারে অবস্থান করে একাকিত্ব, পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে একসাথে বসবাস ইত্যাদি বিষয়ের মানসিক প্রভাব সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে পারেন। পৃথিবীর প্রফেশনালদের সাথে সরাসরি যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটলে সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এবং আন্তঃব্যক্তিগত বিষয়ে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করা হচ্ছে।[৪৪] মঙ্গল গ্রহে অভিযান পরিচালনা এবং বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে বর্তমান পরামর্শ হলো এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন করা যারা মনস্তাত্ত্বিক মূল্যায়ন কার্যক্রমে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্যও মনোসামাজিক অধিবেশনের পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে পারেন।
মূল প্রবন্ধঃ মঙ্গল গ্রহের পৃথিবীকরণ
বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস মঙ্গল গ্রহকে পৃথিবীকরণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে, যা মানুষসহ বিভিন্ন জীবপ্রজাতিকে মঙ্গলে নিশ্চিন্তভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। কিছু সম্ভাব্য প্রযুক্তির ধারণাগুলি আনুমানিকভাবে মঙ্গল গ্রহের পৃথিবীকরণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হলেও বাস্তবে কোনো কিছুই মঙ্গলকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে চিত্রিত পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য গ্রহে রূপ দিতে পারবে না।[৪৫]
অভ্যন্তরীণ ডায়নামো হারানোর কারণে মঙ্গলের ম্যাগনেটোস্ফিয়ার অত্যন্ত দুর্বল-আর এ কারণেই মঙ্গল পৃথিবীর তুলনায় সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করলেও ম্যাগনেটোস্ফিয়ার না থাকায় ভূপৃষ্ঠে এত বিকিরণ পৌঁছাতে পারে। পাতলা বায়ুমণ্ডল দ্বারা আবৃত হওয়ায় তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চার্জিত বিকিরণ মঙ্গল পৃষ্ঠে প্রবেশের অনুমতি দেয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের সুরক্ষার বাইরে মহাকাশ ভ্রমণে দুই ধরনের বিকিরণ ঝুঁকি আছে : ছায়াপথের মহাজাগতিক রশ্মি এবং সৌরশক্তিসম্পন্ন কণা। মার্স ওডিসি নামক মহাকাশযানটি গ্রহটির বিকিরণ পরিমাপের জন্য মঙ্গল বিকিরণ অবস্থা পর্যবেক্ষক ( ম্যারি ) বহন করে। ম্যারি অনুসন্ধানে আবিষ্কার করেছে যে, মঙ্গল গ্রহের উপরের কক্ষপথের বিকিরণ মাত্রা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে ২.৫ গুণ বেশি। দৈনিক গড় ডোজ ছিল প্রায় ২২০ µGy (২২ ম্র্যাড)-যা প্রতি বছর ০.০৮ Gy এর সমতুল। একটানা তিন বছর এই বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে তা নাসা কর্তৃক বর্তমানে সংজ্ঞায়িত সকল সতর্কতার মাত্রা অতিক্রম করবে এবং একটি মঙ্গল মিশনের পর বিকিরণের কারণে ক্যান্সার-আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বিজ্ঞানীরা যা অনুমান করেছিলেন তার তুলনায় দ্বিগুণ বেশি।[৪৬] এখনও মহাজাগতিক বিকিরণ সম্পর্কে জানার অনেক বাকি।
২০০৩ সালে লিন্ডন বি জনসন মহাকাশ কেন্দ্র কর্তৃক ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে নাসা মহাকাশ বিকিরণ ল্যাবরেটরি নামে একটি গবেষণা ব্যবস্থা চালু করে, যেখানে মহাকাশ বিকিরণ পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের কাজে কণা এক্সেলেরেটর ব্যবহৃত হয়।[৪৭] এই ব্যবস্থায় বিকিরণ জীবিত উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে এবং এর থেকে আত্মরক্ষার কলাকৌশল আলোচনা করে। ২০০৬ সালের একটি গবেষণা ফলাফলে দেখান হয়েছিল যে, মহাজাগতিক বিকিরণ পূর্বের ধারণার তুলনায় ডিএনএর দ্বিগুণ পরিমাণে ক্ষতি করতে পারে, যা নভোচারীদের ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিরল ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। এই ঝুঁকির হাত থেকে রক্ষায় নাসা এখন বিকল্প প্রযুক্তি এবং উপায় অনুসন্ধান করছে, যেমন মহাকাশচারী ও মহাকাশযানকে বিকিরণ থেকে রক্ষায় প্লাজমার ডিফ্লেক্টর শিল্ড তৈরি।[৪৮]
শুক্র ব্যতীত অন্য যেকোনো গ্রহের চেয়ে পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে প্রতি একক ভরে (ডেল্টা-ভি) কম শক্তি প্রয়োজন। হোহম্যান ট্র্যান্সফার অরবিট ব্যবহার করে মঙ্গল ভ্রমণে নয় মাসের কাছাকাছি সময় লাগে।[৪৯] অত্যাধুনিক স্থানান্তর আবর্তক দ্বারা মহাকাশে এই সময়কে কমিয়ে চার থেকে সাত মাসে নিয়ে আসা সম্ভব, তবে এর জন্য হোহম্যান ট্র্যান্সফার অরবিটের তুলনায়র প্রচুর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং জ্বালানি প্রয়োজন এবং রোবোটিক মঙ্গল অভিযানে ব্যবহারের জন্য তা অত্যন্ত উপযোগী। ভ্রমণ সময়কে ছয় মাসের বেশি কমানোর জন্য উচ্চতর ডেল্টা-ভি এবং ক্রমবর্ধমান এবং জ্বালানি প্রয়োজন যা করা রাসায়নিক রকেটের জন্য কঠিন। এটি অত্যাধুনিক মহাকাশযান প্রপালসন প্রযুক্তি দ্বারা কার্যকর করা সম্ভব, যার মধ্যে কোনো কোনোটি বিভিন্ন মাত্রায় পরীক্ষাও করা হয়েছে, যেমনঃ ভেরিয়েবল স্পেসিফিক ইম্পালস ম্যাগনেটোপ্লাজমা রকেট[৫০] এবং নিউক্লিয়ার রকেট।[৫১]
যাত্রার সময় মহাকাশচারীরা বিকিরণের মুখমুখি হতে পারেন, যার ফলে তাদের সুরক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। মহাজাগতিক রশ্মি ও সৌর বায়ু ডিএনএর ক্ষতিসাধন করে যা ক্যান্সারের ঝুঁকিকে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে দেয়। আন্তঃগ্রহবর্তী স্থানে দীর্ঘমেয়াদী ভ্রমণের প্রভাব এখনও অজানা, কিন্তু বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন মঙ্গলে গমন এবং পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সময় বিকিরণের ফলে ক্যান্সার-আক্রান্ত হয়ে পুরুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১% থেকে ১৯% এর মধ্যে (একটি অনুমান ৩.৪%) হওয়ার একটি অতিরিক্ত ঝুঁকি অনুমান করেছেন। নারীদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা আরো বেশি যার কারণ তূলনামূলক বড় গ্রন্থি টিস্যু।[৫২]
মঙ্গলের পৃষ্ঠের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ০.৩৮ গুণ এবং বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর ০.৬%।[৫৩] আপেক্ষিকভাবে শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ এবং বায়ুগতিয় প্রভাবের উপস্থিতি কেবল থ্রাস্টারযুক্ত, ভারী, মানুষ বহনকারী মহাকাশযানের অবতরণকে কঠিন করে তোলে, যেমনটি হয়েছিল অ্যাপোলো চাঁদে অবতরণের সময়, সেই সাথে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলও অনেক সরু যার কারণে বায়ুগতিয় প্রভাব অ্যারোব্র্যাকিংয়ে সহায়ক হয়ে একটি ভারী যান মঙ্গলপৃষ্ঠে নামাতে পারে না। তাই মঙ্গলে বা চাঁদে বিমানচালিত মিশন বা রোবোটিক মিশন পরিচালনায় গতিরোধকযুক্ত এবং অন্য যেকোনো বার থেকে ভিন্ন অবতরণ ব্যবস্থার পরিকল্পনা করতে হবে।[৫৪]
যদি কেউ ধারণা করে যে ১৩০ GPa (১৯,০০০,০০০ psi) এর সম শক্তিতে কার্বন ন্যানোটিউব নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য হয়, তবে মঙ্গলে মানুষ ও বস্তুসামগ্রী অবতরণে একটি স্পেস এলেভেটর নির্মাণ করা যেতে পারে।[৫৫] ফোবোসে একটি স্পেস এলেভেটর তৈরির প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।[৫৬]
মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের জন্য বিভিন্ন ধরনের সামগ্রীর প্রয়োজন হবে-মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে পরিষেবা প্রদানের জন্য এবং খাদ্য, পানযোগ্য পানি, চালক যন্ত্র, শ্বাস-প্রশ্বাসযোগ্য অক্সিজেন ইত্যাদি উৎপাদনমানব বসতি স্থাপনের জন্য উভয় ধরনের সামগ্রীই প্রয়োজন। এসকল সরঞ্জামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো:
কলোনিটি পূর্ণাঙ্গভাবে সক্রিয় হওয়ার জন্য মানুষের প্রয়োজনীয় উপযোগসমূহের প্রয়োজন হবে। এগুলো এমনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে যাতে মঙ্গল গ্রহের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এবং অন্যান্য সময়ও যেমন, ইভিএ স্যুট পরিহিত অবস্থায় বা মানুষের বাসযোগ্য অনুকূল পরিবেশে ব্যবহার উপযোগী হয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সৌরশক্তি-নির্ভর হয়, তাহলে ধূলিঝড়ের সময় বৃহৎ শক্তি সংরক্ষক ব্যবস্থাগুলিকে সুরক্ষা দিতে হবে হবে কেননা ঐ সময় বায়ুমণ্ডল ধুলায় ধূসরিত হয়ে যায় এবং সূর্যরশ্মি প্রবেশে বাঁধা দেয়। এর পাশাপাশি ভূপৃষ্ঠের বিকিরণ বা অন্যান্য পরিস্থিতির হাত থেকে মানুষকে রক্ষায় স্বয়ংক্রিয় ধুলা অপসারণ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।[৫৯] যদি কলোনিটিতে কিছুসংখ্যক লোকের চেয়ে বেশি মানুষ থাকে তখন পৃথিবী থেকে পুনঃসরবরাহ কমাতে সিস্টেমগুলো স্থানীয় উৎসের সর্বাধিক ব্যবহার করবে, উদাহরণস্বরূপ পানি ও অক্সিজেনের পুনঃব্যবহার করে এবং মঙ্গলে যেকোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত পানি ব্যবহারে সক্ষম হতে অভিযোজিত হয়ে।
অর্ধ-সলের সময় যখন পৃথিবী মঙ্গল দিগন্তের সরাসরি উপরে থাকে তখন পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে সহজ। যোগাযোগের জন্য নাসা এবং ইএসএ মঙ্গলের কক্ষপথের বেশ কয়েকটি সরঞ্জামের উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ ইতোমধ্যে মঙ্গল গ্রহের যোগাযোগ উপগ্রহ আছে। আলোর গতিবেগের পরিসর দ্বারা পৃথিবীর সাথে মঙ্গলের একমুখী যোগাযোগের বিলম্বটি সর্বাধিক নিকটে প্রায় ৩ মিনিট থেকে (মঙ্গলের অনুসূর থেকে পৃথিবীর অপসূর বিয়োগ করে অনুমিত) ২২ মিনিট যা সর্বাধিক সম্ভাব্য বহিঃগ্রহসংযোগের সময় হয়ে থাকে (মঙ্গল এবং পৃথিবীর অপসূর যোগ করে অনুমিত)। দীর্ঘ-মেয়াদি বিলম্বের কারণে বর্তমান সময়ের যোগাযোগ প্রক্রিয়া, যেমন টেলিফোনে বার্তালাপ অথবা ইন্টারনেট রিলে চ্যাট ইত্যাদি মঙ্গলের সাথে পৃথিবীর যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিতান্তই অকার্যকর। নাসা আবিষ্কার করেছে যে, প্রত্যেক সাইনডিক পর্যায়কালের সময় প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য পৃথিবীর সাথে মঙ্গলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বন্ধ থাকতে পারে, কেননা ঐ সময়কালে বহিঃগ্রহসংযোগের কারণে সূর্য সরাসরি পৃথিবী ও মঙ্গলের মাঝে অবস্থান করে।[৬০] যদিও যোগাযোগ বন্ধের পর্যায়কালের ব্যাপারটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং মিশন থেকে মিশনে পরিবর্তিত হয়। বাস্তবে বেশিরভাগ অভিযানের সময় মঙ্গলে যোগাযোগের পর্যায়কালের বিলম্ব মাসের ক্রমানুসারে হয়ে থাকে।[৬১]
L4 এবং L5 ল্যাগরেনজিয়ান পয়েন্টে স্যাটেলাইট স্থাপন এই সমস্যার সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে; এমনকি একঝাঁক যোগাযোগ উপগ্রহ প্রেরণও এই পুরো বসতি স্থাপন প্রকল্পে ক্ষুদ্র ব্যয় হিসেবে গণ্য হবে। অবশ্য L4 এবং L5 এর গন্তব্যগুলোকে রিলে স্টেশনের কাছে অবাস্তব করে তুলতে এই যন্ত্রসমূহের শক্তি ও আকার ব্যবহৃত হবে, এই অঞ্চলগুলোর অন্তর্নিহিত স্থিতিশীল পরিবেশ স্টেশন রক্ষায় উপযোগী হলেও তা ধূলিকণা ও গ্রহাণুদের আকর্ষণ করে, যা ঝুঁকির সৃষ্টি করতে পারে। এই ঝুঁকি সত্ত্বেও ২০০৯ সালের শেষাংশে L4 এবং L5 অঞ্চল কোনো বিপদের মুখোমুখি না হয়েই অতিক্রম করেছে।[৬২][৬৩]
মানব বসতির ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে বিভিন্ন রোবোটিক পদ্ধতির মাধ্যমে, যেমন মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার স্পিরিট, অপারচুনিটি, কিউরিওসিটি এবংপারসিভার্যান্স। এই যন্ত্রগুলি মঙ্গলে উৎস অনুসন্ধানে সহায়ক হতে পারে, যেমন ভূগর্ভস্থ জল বা বরফ, যা একটি কলোনিকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সাহায্য করবে। এই যন্ত্রগুলোর এক একটির আয়ুষ্কাল কয়েক বছর এমনকি কয়েক দশকও হতে পারে এবং সাম্প্রতিককালে বাণিজ্যিক মহাকাশবিমানের উন্নতি দৃশ্যমান হওয়ায় এই ব্যবস্থাপনাগুলোর সাথে ব্যক্তিগত এবং এমনকি সরকারি মালিকানাও যুক্ত হতে পারে। এই রোবোটিক ব্যবস্থাপনার খরচ পূর্ববর্তী অভিযানগুলোর তুলনায় অনেকাংশে কম এবং রাজনৈতিক ঝুঁকিও কম।
তারযুক্ত ব্যবস্থাপনাগুলি বিভিন্ন ব্যয়বহুল সামগ্রী যেমন জ্বালানি, অক্সিডাইজার, নির্মাণ সামগ্রী ইত্যাদি সরবরাহের মাধ্যমে পূর্ববর্তী ক্রুযুক্ত অভিযানগুলোতে অবতরণ ও ঘাঁটি নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করে থাকলেও, শক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আশ্রয়, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং উৎপাদনের মৌলিক বিষয়গুলি স্থাপনের সূচনা রোবোটিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করা যেতে পারে, যা ক্রুযুক্ত অভিযানের পূর্বপরিকল্পনা হতে পারে।
মার্স সারভেয়র ২০০১ অবতরণের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন প্রস্তুত সৌর কোষীয় প্রযুক্তিগুলোর পরীক্ষণ এবং শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার উপর মঙ্গলের ধুলার প্রভাব হ্রাস করা।[৬৪][৬৫]
স্পেসএক্স মার্স প্রোগ্রামে ধারণা করা হয় যে ২০২০ এর দশকে মঙ্গলে মানুষ স্থানান্তরের পূর্বে বেশ কয়েকটি কার্গো মিশন পরিচালনার মাধ্যমে অবশ্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, আবাস ও নির্মাণ সামগ্রী এবং বিভিন্ন পরিষেবা স্থানান্তর করা হবে।[৬৬] যেসকল সরঞ্জামাদি প্রয়োজন হবে তার মধ্যে রয়েছে এমন যন্ত্র যা জৈব সার, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে মিথেন এবং অক্সিজেন উৎপাদন করবে এবং গ্রহের ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের পানি এবং এর পাশাপাশি প্রাথমিক কৃষি অঞ্চলসমূহের জন্য অস্থায়ী ডোম নির্মাণের সামগ্রী।
নয়াবিশ্বের প্রথম দিকের উপনিবেশগুলোর সাফল্যের জন্য অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হতে পারে। মঙ্গল গ্রহের নিম্ন মহাকর্ষীয় বিভব এবং সৌরজগতে এর অবস্থান পৃথিবী-মঙ্গল বাণিজ্যের জন্য সুবিধাজনক এবং একই সাথে গ্রহটিতে স্থায়ী বসতি স্থাপনের পক্ষে একটি অর্থনৈতিক যুক্তি প্রদান করতে পারে। গ্রহটির আকার এবং উৎসসমূহ অনুমান করা যায় যে, গ্রহটি খাদ্য উৎপাদন এবং গ্রহাণু বেল্ট থেকে খনিজ উত্তোলনের যন্ত্র-সামগ্রী তৈরির জন্য উপযুক্ত স্থান হতে পারে।
প্রথম দিকের উপনিবেশগুলি মঙ্গলে ব্যবহারের জন্য পানি বা বরফের মতো স্থানীয় সংস্থানগুলোর বিকাশে বিশেষায়িত হতে পারে। এই স্থানীয় সংস্থানগুলো অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো নির্মাণেও ভূমিকা রাখতে পারে।[৬৭] মঙ্গল আকরিকের একটি পরিচিত উৎস হলো ধাতব লোহা যা নিকেল-লোহা উল্কাপিণ্ড হতে পাওয়া যায়। এই রূপে প্রাপ্ত লোহাকে গ্রহে বিদ্যমান আয়রন অক্সাইড হতে পৃথক করার চেয়ে সহজেই পৃথক করা যায়।
প্রথম দিকের উপনিবেশগুলিতে আন্তঃমঙ্গল বাণিজ্যের জন্য আরেকটি ভালো উদাহরণ হতে পারে সার।[৬৮] যেহেতু মঙ্গলে জীবনের অস্তিত্ব নেই, তাই মঙ্গলের মাটি শস্য উৎপাদন এবং গাছপালার বর্ধনের জন্য মোটেও উপযোগী নয়। আর এ কারণেই যতদিন পর্যন্ত না গ্রহটি রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে শস্য ও শাক-সবজি উৎপাদন উপযোগী হয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সার এবং অন্যান্য উর্বরতা বর্ধক যেকোনো মঙ্গল গ্রহবাসীর কাছে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে গণ্য হবে।
মঙ্গলে স্থাপিত নতুন কলোনিতে সৌরশক্তি শক্তির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেহেতু মঙ্গল সূর্য থেকে ৫২% দূরে অবস্থিত এবং দেদীপ্যমানতা দূরত্বের বর্গরূপে কমে যায়, তাই মঙ্গল গ্রহের সৌর দেদীপ্যমানতা (যে পরিমাণ সৌর বিকিরণ মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছায়) পৃথিবীর প্রায় ৪২%। কিন্তু এই পাতলা বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর তুলনায় প্রায় সবটুকু শক্তিকে মঙ্গল পৃষ্ঠে প্রবেশ করতে দেয়, আর মোটামুটিভাবে এক-চতুর্থাংশ সৌর বিকিরণ শোষণ করে। মঙ্গলের পৃষ্ঠে সূর্যরশ্মির পরিমাণ অনেকটা পৃথিবীর একটি মাঝারি মেঘলা দিনের মতো হবে।[৬৯]
মঙ্গলে বসতি স্থাপন তখনই সম্ভাব্য বলা যেতে পারে যখন এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদ্ধতিগুলো তুলনামূলক সহজলভ্য হয় (যেমন মহাকাশযাত্রার জন্য উৎক্ষেপণ ব্যবস্থাগুলি আরো সস্তা করার ব্যবস্থা) যাতে এই খাতে সঞ্চয়কৃত তহবিল প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারে।
যদিও গতানুগতিক উৎক্ষেপণ ব্যয়সহ মহাকাশে বসতি স্থাপনের অন্যান্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ হ্রাস পাওয়ার তাৎক্ষণিক কোনো সম্ভাবনা নেই, কারো কারো দৃষ্টিভঙ্গিতে ২০২০ এর দশকে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ খাতে আমূল ব্যয় হ্রাসের সম্ভাবনা আছে, কাজেই তা এই ক্ষেত্রে নেয়া যেকোনো উদ্যোগের ব্যয় সংক্ষেপণ করবে। নিম্ন ভূ-কক্ষপথে প্রতি ২২,৮০০ কেজি (৫০,৩০০ পাউন্ড) বা মঙ্গলে ৪,০২০ কেজি (৮,৮৬০ পাউন্ড) পেলোড অবতরণে ৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকাশিত মূল্যের সাথে স্পেস এক্স এর ফ্যালকন ৯ রকেটসমূহ এখন পর্যন্ত “এই শিল্পে সর্বাপেক্ষা সুলভ”।[৭০][৭১] স্পেস এক্সের পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযানভিত্তিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে আছে ফ্যালকন হেভি এবং মিথেন ভিত্তিক মহাকাশযান, যার মধ্যে স্টারশিপও অন্তর্ভুক্ত। যদি স্পেস এক্স পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে সক্ষম হয় তবে তা মহাকাশভ্রমণের সর্বমোট ব্যয়ের উপর বৃহৎ প্রভাব ফেলবে এবং এর পাশাপাশি মহাকাশ উৎক্ষেপণ পরিষেবাসমূহের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের পরিবর্তন ঘটাবে বলে ধারণা করা হয়।[৭২][৭৩]
মঙ্গলে প্রেরণের জন্য প্রস্তুতকৃত রোবোটিক মহাকাশযানগুলির অভ্যন্তরীণ ভাগ সূক্ষ্মভাবে ছিদ্রমুক্ত এবং জীবাণুমুক্ত করা অত্যাবশ্যক এবং যানটির বহির্ভাগে যাতে ৩০০,০০০ এর বেশি ছিদ্র না থাকে, অন্যথায় মহাকাশযানটি যদি পানি সংবলিত “বিশেষ অঞ্চলে” যাতায়াত করে,[৭৪] তখন দূষণের একটি ঝুঁকি থাকে যা জীবন অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি গ্রহেরও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মানবভিত্তিক অভিযানগুলোতে মহাকাশযানগুলো এই মাত্রায় জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব নয়, কেননা স্বাভাবিকভাবে মানুষ নিজেই মানব অণুজীবসমগ্রের হাজার হাজার ট্রিলিয়ন প্রজাতির অণুজীবের বাহক এবং মানুষের জীবন রক্ষা করে এদের অপসারণ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে ঝুঁকিটি পরিমিত মাত্রায় নিয়ন্ত্রণই একমাত্র পন্থা বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু মঙ্গল গ্রহে দুরূহ অবতরণের ক্ষেত্রে এটি প্রায় অসম্ভব।[৭৫] সমস্যাটি সমাধানের জন্য বেশ কয়েকটি গ্রহবিষয়ক কর্মশালা আয়োজিত হয়েছে, তবে ব্যাপারটি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা নেই।[৭৬] মানব অভিযাত্রীরা যদি কোনোভাবে মঙ্গলে বিদ্যমান অণুজীবসমূহের বাহকে পরিণত হন, তবে তারা পৃথিবীবাসীর জন্য ভীষণ ঝুঁকির কারণ হবেন এবং নিজেরাও অরক্ষিত হয়ে পড়বেন।[৭৭]
মার্স ওডিসি আরশিয়া মনস আগ্নেয়গিরির কাছে প্রাকৃতিক গুহা সদৃশ স্থাপনার আসল রহস্য জানতে পেরেছে। ধারণা করা হয় যে এ ধরনের স্থাপনা বাসিন্দাদের বিকিরণ ও ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড থেকে আশ্রয় দেবে। এও সন্দেহ করা হয় যে নিরক্ষীয় অঞ্চলে ভূতাপীয় শক্তির অস্তিত্ব আছে।[৭৮]
বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য মঙ্গলীয় লাভা টিউবের সম্মুখপ্রান্ত আরশিয়া মনসের প্রান্তদেশে অবস্থিত। পৃথিবীভিত্তিক তথ্যগুলো ঐ অঞ্চলে প্রশস্ত জায়গা থাকার ইঙ্গিত দেয় যা বিকিরণ থেকে পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারবে এবং নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে ফাঁকগুলি বন্ধ করা আপেক্ষিকভাবে সহজ।[৭৯]
হেলাস প্ল্যানিশিয়া মঙ্গলের ভূগাণিতিক উপাত্তের নিচে সবচেয়ে নিম্নাবস্থিত সমভূমি। মঙ্গলের অন্য কোনো স্থানের চেয়ে এই অঞ্চলের বায়ুচাপ তুলনামূলকভাবে বেশি।
এটি অপরিণামদর্শী যে মঙ্গল গ্রহে প্রথম মানুষের অবতরণ কীভাবে মহাকাশ অনুসন্ধান এবং মহাকাশস্থিত বিষয়সমূহের উপর অধিকারসংক্রান্ত বর্তমান নীতিমালাগুলোকে বদলে দেবে। ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের মহাকাশ চুক্তিতে নির্ধারিত হয়েছিল যে, পৃথিবীর কোনো দেশ মহাবিশ্বের কোনো গ্রহ বা তার বাসিন্দাদের স্বত্বাধিকারী হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারবে না।[৮০] যেহেতু মঙ্গল গ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং বিভিন্ন বিপজ্জনক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মানুষের বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বলে পরিগণিত হবে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ঐ গ্রহের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আইন-কানুন পৃথিবীর চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন হবে। ইলন মাস্কের মঙ্গলযাত্রা বিষয়ক পরিকল্পনাসমূহ ঘোষণা করার পর এ ব্যাপারটি এখনও অনিশ্চিত যে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রগতিশীলতায় মঙ্গল গ্রহে সম্ভাব্যভাবে সর্বপ্রথম মানুষ পাঠানোর পদক্ষেপটি কীভাবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা পালন করবে।[৮১] তহবিল বণ্টনে নাসাকে বেশ কয়েকবার কাটছাঁট করতে হয়েছিল। বারাক ওবামা রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে নাসার মঙ্গলে পৌঁছানোর লক্ষ্যটিকে নেপথ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।[৮২] ২০১৭ সালে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মানুষকে চাঁদ এবং অবশেষে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দেন [৮৩] এবং এই লক্ষ্যে নাসার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেন[৮৪], পাশাপাশি স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের অবকাঠামো উন্নয়নে মনোনিবেশ করেন।[৮৫][৮৬]
মূল প্রবন্ধঃ মহাকাশে উপনিবেশ স্থাপন
মহাকাশে উপনিবেশ স্থাপনের ধারণাটি সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের ধারাবাহিকতা হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে,[৮৭] বিশেষত মঙ্গল গ্রহের ঔপনিবেশিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ঔপনিবেশিক শ্রমের কারণসমূহ এবং ভূমির উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়াবলী উত্তর উপনিবেশবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সমালোচিত হয়েছে।[৮৮] মঙ্গল গ্রহ বা মহাকাশের যেকোনো অনুসন্ধানমূলক মিশন, স্থায়ী উদ্যোগ অথবা উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ[৮৯] এবং পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করায় এ উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলেই সামাজিক সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন এবং বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদসহ সকল প্রকারের কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি পরিহার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন।[৯০]
মহাকাশ অনুসন্ধানকে “নতুন সীমান্ত” হিসেবে বর্ণনাকৃত ধারণাটি বিবেচনাহীন বসতিস্থাপনপকারী উপনিবেশবাদের ধারাবাহিকতা এবং উদ্ভিগ্ন ভাগ্য হিসেবে সমালোচিত হয়েছে এবং উপনিবেশের অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণকে মানব প্রকৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে।[৯১][৯২][৯৩]
মহাশূন্যে আঞ্চলভিত্তিক উপনিবেশ স্থাপনের মুখ্য ধারণাটিকে সার্ফ্যাসিজম বলে, যা শুক্রের বদলে মঙ্গলে বসতি স্থাপনকে সমর্থন করে।[৯৪]
নভোচারীগণ মহাকাশ যাত্রাকালীন সময়ে যেসকল নৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন তাদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ অন্যতম। একজন গর্ভবতী সদস্য মহাকাশযানে উপস্থিত অন্যান্য সকল সদস্যের জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারেন। গর্ভবতী মা ও শিশুর সঠিক পুষ্টি এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে পৃথিবী থেকে অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি যথাযথ চিকিৎসা এবং পরিচর্যার প্রয়োজন হবে। গর্ভাবস্থা ঐ গর্ভবতী সদস্যের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাকে প্রভাবিত করবে, যার ফলে সে সঠিকভাবে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো পালন করতে পারবে না। মহাকাশযানের বাহ্যিক পরিবেশ একটি সদ্যোজাত শিশুর বিকাশে কীভাবে ভূমিকা রাখবে, এ বিষয়ে এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। যদিও এই বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত যে, অনাগত শিশুটি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সৌর বিকিরণ সংবেদনশীল হবে যা তার দেহস্থিত কোষ এবং জিনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।[৯৫]
বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন কারণ ও প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনকে সমর্থন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণতম প্রতিষ্ঠান হলো মার্স সোসাইটি যারা মঙ্গলে মানবযাত্রা সফল করতে এ উদ্দেশ্যে গৃহীত নাসার যেকোনো কর্মসূচির প্রচারণা করে এবং এর পাশাপাশি তারা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় মঙ্গল এনালগ গবেষণা স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেছে।
ইলন মাস্ক ‘মঙ্গলে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানব উপনিবেশ স্থাপনে সক্ষম’ এমন ধরনের প্রযুক্তি বিকাশের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে স্পেস এক্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৯৬] ২০১৫ সালে তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয় আগামী ১১-১২ বছরের মধ্যে আমরা একজনকে মঙ্গলে পাঠানোর আশা করতে পারি” (২০২৬-৭ এর মধ্যে)।[৯৭][৯৮] রিচার্ড ব্রানসন, তার জীবনকালে মঙ্গল গ্রহের প্রথম দিকের জনতার মধ্যে একজন হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি মনে করি এটি একেবারেই বাস্তবসম্মত। এটি অবশ্যই ঘটবে…… আমার মনে হয় আগামী ২০ বছরের মধ্যে [২০১২ হতে] আমরা আক্ষরিকভাবেই শতসহস্র মানুষকে মহাশূন্যে নিয়ে যেতে পারব যা আমাদের আরো বড় কিছু করার জন্য আর্থিক সংস্থান দেবে।“[৯৯]
২০১৩ সালে, মার্কিন প্রকৌশলী, সাবেক মহাকাশচারী এবং চাঁদে পদার্পণকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি, বাজ অলড্রিন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি মতামতে মঙ্গল গ্রহে মানব অভিযানকে সমর্থন করেন এবং চাঁদকে “গন্তব্য নয়, বরং যাত্রা শুরুর কেন্দ্রবিন্দু যা মঙ্গলকে আবাসযোগ্য গ্রহে পরিণত করে মানবজাতিকে দ্বি-গ্রহের প্রজাতিতে পরিণত করার আবক্র পথে রাখে”, এভাবে অবলোকন করেন।[১০০] ২০১৫ সালের আগস্টে অলড্রিন ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলোজির সাথে যৌথভাবে, নাসার উদ্দেশ্যে, নভোচারীদের জন্য এবং একটি “দশ বছরের দায়িত্ব সফর” এর পরিকল্পনা নিয়ে ২০৪০ সালের পূর্বে মঙ্গলে বসতি স্থাপনের একটি “মাস্টার প্ল্যান” প্রকাশ করেন।[১০১]