মঙ্গোল গৃহযুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিভাজনের অংশ | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
কুবলাই খান ও তার মিত্রপক্ষ | আরিক বোকে ও তার মিত্রপক্ষ | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
কুবলাই খান হালাকু খান লিয়ান শিশিয়ান কাদান |
আরিক বোকে বারকা খান আলগু (দলত্যাগী) আলান্দার খারা বুখা লিউ তাইপিং |
মঙ্গোল গৃহযুদ্ধ ১২৬০ থেকে ১২৬৪ সাল পর্যন্ত কুবলাই খান ও তার ছোট ভাই আরিক বোকের মধ্যে সংঘটিত হয়।[১] ১২৫৯ সালে মংকে খান মারা যাওয়ার সময় কোনো উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে যাননি। এরপর তোলুইয়ের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়।[১] মঙ্গোল গৃহযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সংঘটিত বারকা-হালাকু যুদ্ধ ও কাইদু-কুবলাই যুদ্ধের ফলে মঙ্গোল সাম্রাজ্যে খাগানের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্য বিভিন্ন খাগানাতে বিভিক্ত হয়ে পড়ে।[২]
১২৫১ সালে মংকে খান নতুন খাগান হন।[৩] খাগান পদপ্রার্থী প্রার্থী শিরেমুন ও নাখু এতে অসঙ্গুষ্ট হয়ে মংকেকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন।[৪] প্রতিশোধ হিসেবে মংকে খান এরপর চাগাতাই ও ওগেদাই পরিবারে তার প্রতিপক্ষদের উৎখাত করেন।[৫]
১২৫২ সালে মংকে খান ককেসাসের নিয়ন্ত্রণ গোল্ডেন হোর্ডের তুলে দেন। মংকের অনুমোদনক্রমে বাতু খানের ভাই বারকা খান গোল্ডেন হোর্ডের খান হিসেবে ১২৫৫ সালে বাতুর উত্তরসূরি হন। হালাকু খান গোল্ডেন হোর্ডের কাছ থেকে ককেসাসের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিয়েছিলেন।[৬] ১২৫৮ সালে হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বারকা খান ইতিপূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণে রাগান্বিত হন।[৭] ১২৫৯ সালে মংকে খান কোনো উত্তরসূরি নির্বাচন না করে মারা যান। তিনি আরিক বোকেকে ১২৫৮ সালে সাম্রাজ্যের রাজধানী কারাকোরামের নেতা নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা প্রদান নিয়ে কিছু জানিয়ে যাননি।[১]
১২৬০ সালে আরিক বোকে যখন ক্ষমতা উত্তরাধিকার দাবি করেন তখন কুবলাই খান দক্ষিণ সুং রাজবংশের বিরুদ্ধে অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন।[৮] আরিক বোকে তার পক্ষে শক্তিশালী মঙ্গোল অভিজাতদের সমর্থন আদায় করেছিলেন।[৯] মংকে খানের পরিবারের অনেকেই এসময় আরিককে সমর্থন করেছিল।[৭] আরিক বোকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কুবলাই সুংদের বিরুদ্ধে নিয়োজিত তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেন।[১০] চীনে তিনি একটি কুরুলতাইয়ের আয়োজন করেন। এখানে তাকে খাগান ঘোষণা করা হয়।[১১] মঙ্গোল আবাসভূমির বাইরে খাগান ঘোষণার জন্য আহূত এটি প্রথম কুরুলতাই ছিল।[১২] অন্যদিকে এক মাস পর আরিক বোকে কারাকোরামে একটি কুরুলতাই আহ্বান করে নিজেকে খাগান ঘোষণা করেন।[১৩] হালাকু খানও কুরুলতাইয়ে অংশ নেয়ার জন্য মঙ্গোলিয়ায় ফিরে আসেন। এসময় মামলুকরা আইন জালুতের যুদ্ধে মঙ্গোলদের পরাজিত করে।[১০] বারকা খান মামলুকদের বিজয়কে কাজে লাগিয়ে ইলখানাতে হামলা করেন। ফলে বারকা-হালাকু যুদ্ধ শুরু হয়।[৬]
আরিক বোকের সাথে গোল্ডেন গোর্ডের বারকা খান এবং চাগাতাই খানাতের আলগু যোগ দেন। হালাকু খান ছিলেন কুবলাই খানের মিত্র।[১০] হালাকুর উপর বারকা ক্ষুব্ধ ছিলেন তাই তিনি আরিকের সাথে যোগ দেন।[৭] হালাকু ও বারকা উভয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ার ফলে আর তোলুই পরিবারের যুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি।[১৪]
কুবলাই খানের কাছে চীনের উর্বর অঞ্চলের সরবরাহ ছিল। অন্যদিকে আরিক বোকেকে কারাকোরামে বাইরে থেকে আমদানি করতে হত।[১৫] চীনের সরবরাহের কারণে যুদ্ধে জয়ের জন্য কুবলাই খানের চীনা সমর্থন প্রয়োজন ছিল।[১০] তিনি তার চীনা উপদেষ্টাদের সহায়তায় প্রজাদের মধ্যে তার সমর্থন বৃদ্ধি করেন। তিনি নিজেকে একজন যোগ্য শাসক ও আরিক বোকেকে ক্ষমতাদখলকারী হিসেবে তুলে ধরেন।[১৪] কুবলাই খান খাজনার পরিমাণ হ্রাসের ওয়াদা করেন, চীনের রাজবংশের আদলে তার সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে গঠন করেন।[১৬] তার নীতিসমুহ উত্তর চীনে জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ সুং রাজবংশের সাথে তার সম্পর্কে এর প্রভাব পড়েনি। কুবলাই খান গৃহযুদ্ধে জড়িত থাকার সময় সুংদের তরফ থেকে হামলা করে ইতিপূর্বে মঙ্গোলদের কাছে হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করা হয়।[১৭] কুবলাই খান দক্ষিণের শাসকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য তার দূত হাও জিংকে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু সুংরা কুবলাই খানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দূতকে বন্দী করে রাখে।[১৫]
কুবলাই খানের হাতে কারাকোরামে সরবরাহ চারটি সরবরাহ পথের তিনটির নিয়ন্ত্রণ ছিল। কুবলাই খানের মিত্র কাদান সাবেক পশ্চিম শিয়ার এলাকাসমুহ আরিক বোকের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন এবং গানসুতে অবস্থিত সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন। কুবলাই খানের বাহিনী ইয়ানের (বর্তমান বেইজিং) আশপাশের এলাকার প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। এসময় উত্তরপশ্চিমের ইয়েনিসেই নদী উপত্যকার সরবরাহ পথটি আরিকের জন্য উন্মুক্ত ছিল।[১৮] ১২৬০ সালের শেষদিকে কুবলাই খান কারাকোরামের দিকে অগ্রসর হওয়ার পর আরিক বোকে কারাকোরাম ত্যাগ করে ইয়েনিসেইয়ের করদ রাজ্যে আশ্রয় নেন। শীত এসে পড়ায় তারা উভয়ে শিবির স্থাপন করে বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন।[১৮]
এই অপেক্ষমাণ সময়ে কুবলাই আরো রসদ ও সেনা সরবরাহ পান। তিনি ইয়ান ও উত্তর চীনের সীমানার প্রতিরক্ষা মজবুত করেন।[১৯] মধ্য এশিয়ার বাণিজ্য পথসমূহের সুরক্ষার জন্য প্রেরিত সেনাপতি আলান্দারকে কাদান পরাজিত ও হত্যা করেছিলেন। কুবলাই খানের উপদেষ্টা লিয়ান শিশিয়ান পশ্চিম চীনে সৈনিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। উত্তর চীনে তিনি আরিক বোকের মিত্র লিউ তাইপিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হন এবং আরিক বোকের বাহিনীর খাদ্য সরবরাহ তার হস্তগত হয়। এছাড়াও লিয়াংজু ও গাঞ্জু শহর থেকে আরিক বোকের সমর্থকদেরকে লিয়ান বের করে দেন। দক্ষিণপশ্চিম চীনে তার বাহিনী সিচুয়ানকে আরিকের বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছে। সামরিক দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালনের জন্য কুবলাই খান কাদান ও লিয়ান শিশিয়ানকে পুরষ্কৃত করেছিলেন।[২০]
কুবলাইয়ের এসব বিজয়ের পর আলগু ছিলেন আরিক বোকের একমাত্র মিত্র। আরিক তাকে চাগাতাই খানাত দখল করে দেয়ার জন্য রাজি করান। চাগাতাইয়ের খান কারা হালাকু সম্প্রতি মারা গিয়েছিলেন। আলগুর সাথে লড়াইয়ে খানাতের মসনদের দাবিদার আবিশকা নিহত হন।[২০] আরিক এরপর আলগুকে চাগাতাইয়ের খান মনোনীত করেন। এরপর চাগাতাই খানাত আরিকের সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠে।[১৫] এই অঞ্চলের কর সংগ্রহের জন্য আরিক তাকে সম্পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছিলেন।[২১]
১২৬১ সালে কুবলাই খান ও আরিব বোকে শিমুলতাইয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আরিক এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পিছু হটেন। দশদিন পর তিনি ফিরে এসে পুনরায় লড়াই শুরু করেন। আরিক বোকে যেই সেনাদলের উপর আক্রমণ করেছিলেন তাতে কুবলাই খান নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন না এবং এটি ছিল কুবলাই খানের বাহিনীর ছোট একটি অংশ। কোনো ফলাফল ছাড়াই এই যুদ্ধ শেষ হয়। এই সময়ে মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল কুবলাই খানের নিয়ন্ত্রণে ছিল ফলে ইয়েনিসেই উপত্যকার সরবরাহ পথের উপর ঝুকি রয়ে গিয়েছিল।[২১] এই অবস্থায় আরিক আলগুর সহায়তা চান এবং আলগুর সংগৃহিত করে অংশ দাবি করেন। আলগু তা ফিরিয়ে দিয়ে আরিকের দূতকে হত্যা করেন।[২২]
এসময় চীনে একটি বিদ্রোহের ফলে কুবলাই খান গৃহযুদ্ধ থেকে মনোযোগ সরিয়ে এনে কাইপিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কুবলাই খানের দিক থেকে হুমকি কমে আসার পর আরিক আলগুর সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এতে আলগুর হাতে আরিকের সেনাপতি খারা বুখা পরাজিত হন। কিন্তু একইসময় আলগু আলমালিখে তার সদরদপ্তর আরিকের কাছে হারান। এরপর তিনি তারিম অববাহিকায় পিছু হটে আসেন।[২২]
এই অবস্থায় আরিকের পক্ষে অল্পসংখ্যক মিত্র ছিল।[১৫] তার অনেক সমর্থক এসময় তার পক্ষ ত্যাগ করে।[২২] মংকে খানের ছেলে উরুং তাশ পক্ষত্যাগ করে তার বাবা মংকের তামগা আরিকের কাছ থেকে নিয়ে আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে কুবলাই খানের কাছে সমর্পণ করেন। এরপর শিনজিয়াং থেকে আরিক বোকেকে উৎখাত করার জন্য আলগু ফিরে আসেন। আরিক বোকের হাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় তিনি একা শাংদু সফর করে ১২৬৪ সালে কুবলাই খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হয়।[২৩]
আত্মসমর্পণের পর কুবলাই খান আরিককে গ্রেপ্তার করেন।[১৫] কিন্তু তাকে তৎক্ষণাৎ কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি। কুবলাইয়ের সমর্থকরা আরিকের শাস্তি চাইছিল তাই কুবলাই খান শাস্তি হিসেবে এক বছর পর্যন্ত আরিককে উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন। তিনি আরিকের সমর্থক মঙ্গোল কর্মকর্তাদের উৎখাত করেছেন। তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মঙ্গোল কর্মকর্তা বোলগাইকে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অভিযুক্ত করে তাকে ও অন্যান্য আরিক সমর্থকদের মৃত্যুদণ্ড দেন। আরিক বোকের শাস্তি নির্ধারণ এবং নিজের ক্ষমতার দাবির ভিত্তি মজবুত করার জন্য কুবলাই খান একটি কুরুলতাইয়ের আয়োজন করেন।[২৩] মঙ্গোল অভিজাতদের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া কুবলাই খান তার ভাইয়ের শাস্তি দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।[২৩] ১২৬৬ সালে বন্দী অবস্থায় আরিক মারা যান।[২৪] ধারণা করা হয় যে কুবলাই খান তাকে গোপনে বিষপ্রয়োগ করেছিলেন।[১৫]
আরিক বোকের পরাজয়ের ফলে সাম্রাজ্যের বিভাজন বন্ধ হয়নি।[২৫] ১২৬৫ সালে হালাকু খানের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বারকা খান ও হালাকু খান লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন।[২৪] ওগেদাইয়ের পরিবার এই অনৈক্যকে নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার করতে চেয়েছিল। কাইদু বিশ্বাস করতেন যে ওগেদাইয়ের পরিবারের সদস্যরা খাগান খেতাবের অধিক দাবিদার। ১২৬৯ সালে তিনি কুবলাই খানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন যা অনেক বছর টিকে ছিল।[৬]
পশ্চিমা খানাতসমূহের অধিকাংশ কুবলাই খানকে খাগান হিসেবে মেনে নেয়নি। তাদের মধ্যে কিছু নিজেদের খানের ক্ষমতার পক্ষে কুবলাই খানের অনুমোদন নিলেও চারটি খানাতই কার্যত স্বাধীন ছিল।[২৪][২৬] পারস্যের ইলখানাত ও চীনের ইউয়ানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও মঙ্গোল খানাতসমূহের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা দেখা যায়নি।[২৬]