চিকিৎসার ইতিহাসে ইসলামি চিকিৎসা হল চিকিৎসা বিজ্ঞান যা ইসলামি স্বর্ণযুগে উন্নত করা হয়। এসব লেখা হয় আরবিতে, যা ইসলামি জাতির লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।[১][২]
ইসলামি চিকিৎসা প্রাচীন কালের ধ্রুপদী চিকিৎসা বিজ্ঞানের সংরক্ষণ, শৃঙ্খলণ ও উন্নয়ন করে। যার মধ্যে হিপোক্রেটিস, গ্যালেন আর ডিসকরিডিস এর প্রধান কাজসমূহও অন্তর্ভুক্ত।[৩] ধ্রুপদী যুগ পরবর্তী সময়ে ইসলামি চিকিৎসা সমগ্র পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত ছিল, যা প্রাচীন গ্রীক, রোমান আর ফার্সি চিকিৎসা এমনকি প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিতসাকেও একীভূত করে নেয়। ১২শ শতকের রেনেসাঁর সময় ইউরোপিয়ান ডাক্তাররা ইসলামি চিকিৎসার লেখকগণের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে এবং পশ্চিমা ইউরোপে যখন অসংখ্য অগ্রগতি আর নতুনত্ব আসছিল, তখন মধ্যযুগীয় পশ্চিমা ইউরোপের চিকিৎসায় প্রাচীন ধ্রুপদী চিকিৎসার সাথে ইসলামি চিকিৎসাও গৃহীত হয়ে যায়।[৪]
প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অংশ হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উত্থান এর পূর্ব পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ইসলামি ডাক্তারগণ তাদের কর্তৃত্ব ধরে রাখে, যা শুরু হয়েছিল আলোকিত যুগে, তাদের বই ইউরোপে প্রচলিত হওয়র প্রায় ছয় শত বছর পর। তাদের লেখনীর বিভিন্ন অংশ আজ পর্যন্ত ডাক্তারদের আকর্ষিত করে।[৫]
চিকিৎসা মধ্যযুগীয় ইসলামি সংস্কৃতির একটি কেন্দ্রীয় অংশ ছিল। সময় এবং স্থানের বিভিন্ন রকম প্রতিকূলতার সামনে ইসলামি ডাক্তার আর বিদ্বানেরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশাল ও জটিল একটি পাঠ্যক্রম দাঁড় করান যেখানে তারা চিকিৎসার তত্ত্ব ও প্রয়োগ অনুসন্ধান, গবেষণা, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করেন। ইসলামি চিকিৎসা এর ভিত্তি ছিল ঐতিহ্য, মূলত তা ছিল মুহাম্মাদের সময়ের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান যা ঐ সময়ে আরবে জানা ছিল আর প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসা যেমন ইউনানি, প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা যেমন আয়ুর্বেদ এবং জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় এর প্রাচীন ইরানি চিকিৎসা। প্রাচীন গ্রিক আর রোমান চিকিৎসক যেমন হিপোক্রেটিস, গ্যালেন আর ডিসকরিডিস[৬] এর কাজসমূহও ইসলামি চিকিৎসার উপর বিশাল প্রভাব ফেলে।[৭] চিকিৎসার যে শাখাটি এই সময় সবচেয়ে বেশি সফলতা প্রাপ্ত হয় তা হল চক্ষু চিকিৎসা, যা তে ইবন আল-হায়সাম আধুনিক কালের প্রথম দিক পর্যন্ত কর্তৃত্বশালী ছিলেন।[৮]
‘অবিশ্বাসী’ জাতিসমূহ যা ইসলামি ভূমীসমূহের চারপাশে ছিল, তাদের ইসলামি বিশ্বাসের নিয়মনীতি মেনে চলতে হত। প্রথম দিকে, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে জ্ঞান অর্জন ও তা প্রয়োগ ধর্মপ্রাণদের কাজ বলে গণ্য হত এবং তা ইমান (বিশ্বাস) ও তাওয়াককুল (আল্লাহর উপর আস্থা) এর মূলনীতি ধরা হত।[২][৯]
জালাল আল-দ্বীন সুয়ুতী বলেন তার ‘নবীর চিকিৎসা’ গ্রন্থের ১২৫ নং পৃষ্ঠায় বলেন,
নবী শুধু রোগীদের ওষুধ নিতে বলেছেন এমন না, বরং এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তিনি নিজেই অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের দাওয়াত করে আনতেন।
সুস্থ জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মুহাম্মাদের মতামত অনেক আগেই সংগ্রহীত হয়েছিল এবং আলাদাভাবে সম্পাদিত হয়েছিল তিব্ব আন-নাববী (নবীর চিকিৎসা) নামে। ১৪শ শতকে ইবন খালদুন তার মুকাদ্দিমায় একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দিয়েছেন যাকে তিনি বলেছেন ‘চিকিৎসার শিল্প ও কৌশল’ যেথায় তিনি চিকিৎসাকে ধর্ম হতে আলাদা করেছেন,[১০]
আপনার জানতে হবে যে সকল অসুখ এর শিকড় পুষ্টিতে, যেমন নবী – তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক! বলেছেন সমস্ত চিকিৎসার ঐতিহ্যের ব্যাপারে, যা সাধারণভাবে সকল ডাক্তারদের জানা থাকে, যদিও এটি ধর্মীয় পণ্ডিতদের দ্বারা বিতর্কিত। এসব তার কথাঃ পেট হচ্ছে অসুখের ঘর, এবং সংযম হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। প্রত্যেক অসুখের কারণ হচ্ছে নিম্নমানের পরিপাক।
মুহাম্মাদ আল-বুখারী দ্বারা লিখিত সহিহ আল-বুখারী, যা নবীর ঐতিহ্যের একটি সংগ্রহ, বা হাদিস, এতে মুহাম্মাদের চিকিৎসার উপর কথাবার্তার উপর একটি সংগ্রহ রয়েছে। এখানে বর্ণনাকারী মুহাম্মাদের যুবক সাহাবী আনাস ইবন মালিক। আনাস দুইজন চিকিৎসকের কথা উল্লেখ করেন যারা তাকে গরম লোহার সেক দিয়েছিলেন। নবী এই চিকিৎসা না নিয়ে অন্য চিকিৎসা নিতে চাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে বর্ণনা পাওয়া যায় যে খলিফা ‘উসমান ইবন আফফান তার ঠিক করেছিলেন একটি তারের দ্বারা যা স্বর্ণ দিয়ে বানানো ছিল। আনাস ইবন মালিক আরও উল্লেখ করেন যে কাঠের তৈরি লাঠি দ্বারা দাঁত পরিষ্কারের অভ্যাসটি প্রাক-ইসলামি সময় থেকে হয়ে আসছে।[১১]
ইসলামি চিকিৎসার সেরা লেখকদের দ্বারা ‘নবীর চিকিৎসা’ এর উল্লেখ পাওয়া এক দুর্লভ ব্যাপার, কিন্তু এটি ঠিকই চিকিৎসার একটি মূল অংশ হিসেবে কয়েক শতাব্দী ধরে রয়ে যায়। আল-বিরুণী তার কিতাব আস-সায়দানা (নিরাময় এর বই) এ কিছু সংগৃহীত কবিতা আর অন্যান্য কাজের কথা উল্লেখ ও ব্যাখ্যা করেন যা ছিল প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের চিকিৎসা।[১১]
প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের সবচেয়ে বিখ্যাত ডাক্তার হলেন হারিস বিন কালাদা আস-সাকাফি, যে নবীর সময়েই জীবিত ছিল। জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় এর সাথে তার সংযুক্ত থাকার সম্ভাবনা আছে, হতে পারে তিনি সেখানে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বর্ণিত আছে যে তিনি প্রথম খসরু আনুশিরভান এর সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে একবার আলোচনাও করেছিলেন।[১২]
খুব সম্ভবত মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গ্রেকো-রোমান আর পরবর্তী সময়ের গ্রীক-সম্পর্কিত চিকিৎসার ব্যাপারে সরাসরি সেসব অঞ্চলের ডাক্তারদের থেকে জানতে পেরেছেন, যেসব মুসলিমরা নতুন মাত্র জয় করেছিল। এমন না যে মুসলিম চিকিৎসকগণ অনূদিত বই পড়েই সেসব অঞ্চলের চিকিৎসা সম্ভন্ধে জানতে পেরেছিলেন। ইসলামের রাজধানী দামেষ্কে পরিবর্তন এই প্রক্রিয়াকে সম্ভবত সহায়তা করেছিল, কেননা প্রাচীন চিকিৎসার ঐতিহ্যের একটি অংশ হল সিরিয় চিকিৎসা। দুইজন খৃষ্টান চিকিৎসকদের নাম জানা আছেঃ ইবন আতাল, উমাইয়্যা বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম মুয়াবিয়া এর দরবারে কাজ করত। এই খলিফা তার জ্ঞানের ভুল প্রয়োগ করে তার কিছু শত্রুকে বিষ খাইয়ে মারার জন্য। পরবর্তীতে আবুল হাকাম, যে ওষুধ বানাতো, তাকেও মুয়াবিয়া চাকরি দেয় এবং তার সন্তান, নাতি আর নাতির ছেলেও উমাইয়্যাদের খলীফাদের জন্য কাজ করছিল।[১১]
এই উৎস গুলো সাক্ষ্য দেয় যে ইসলামি সমাজের উঠতি চিকিৎসকেরা ইতোমধ্যে ধ্রুপদী চিকিৎসা ঐতিহ্যের ব্যাপারে জানত। সম্ভবত এই চিকিৎসার জ্ঞান আলেক্সান্দ্রিয়া হতে আসে আর সম্ভবত সিরিয় পণ্ডিত বা অনুবাদকদের দ্বারা ইসলামি বিশ্বে ঢুকে পরে।[১১]
ইসলামি বিশ্ব কীভাবে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য পায়, সে ব্যাপারে জানার জন্য অত্যন্ত কম উৎস রয়েছে। আব্দাল মালিক বেন আবগর আল-কিনানী নামক একজন ডাক্তারের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে যে সে উমার ইবন আব্দুল আযিয এর দরবারে আসার আগে আলেক্সান্দ্রিয়ার চিকিৎসা বিদ্যালয়ে কাজ করেছিল। উমার আলেক্সান্দ্রিয়ার চিকিৎসা বিদ্যালয় এন্টিয়কে নিয়ে যায়।[১৩] এটাও জানা যায় যে জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় এর সদস্যরা দামেষ্কে গিয়েছিলেন। যদিও অবশ্য, জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় আব্বাসি সাম্রাজ্যের সময়টিতে চালু ছিল।[১৪]
অষ্টম শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে প্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হল জাবির ইবন হাইয়ান এর ‘বিষের বই’। তিনি সেখানে আরবিতে অনুবাদ করা পূর্ববর্তী বইগুলোর উদ্ধৃতি দেন, যেসব তখন তার কাছে ছিল। সেখানে অন্তর্ভুক্ত হিপোক্রেটিস, প্লেটো, গ্যালেন, পিথাগোরাস আর এরিস্টটলের বই। সাথে দিয়ে জাবির ইবন হাইয়ান কিছু ওষুধ আর ঔষধি গাছের ফার্সি নামও উল্লেখ করেন।
৮২৫ সালে আব্বাসি খলিফা আল-মা’মুন বাগদাদে প্রজ্ঞার ঘর (আরবিঃ بيت الحكمة, বাইত আল-হিকমা) স্থাপন করেন, যা তৈরি হয়েছিল জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় অনুসরণে। খৃষ্টান ডাক্তার হুনাইন ইবন ইসহাক এর কর্তৃত্বে আর বাইজ্যান্টাইন অনুবাদকদের সহায়তায় সকল প্রাচীন কাজ এই সময় আরবিতে অনূদিত হয়ে যায় যার লেখকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত গ্যালেন, হিপোক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, টলেমি আর আর্কিমিডিস।
বর্তমানে বোঝা হয়ে থাকে যে প্রথম দিককার ইসলামি চিকিৎসা সরাসরি গ্রীক উৎস হতে প্রাপ্ত আলেক্সান্দ্রিয়ার শিক্ষালয় এর মাধ্যমে, আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে; ফার্সি প্রভাব দেখা যাচ্ছে যে ওষুধ বিজ্ঞান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, যদিও ফার্সি চিকিৎসকগণও গ্রিক উৎসসমূহের ব্যাপারে জ্ঞাত ছিলেন।[১৪]
চিকিৎসা-সংক্রান্ত প্রাচীন কালের বিভিন্ন রকমের কিছু কাজ আর সংগ্রহের অনুবাদের কথা ৭ম শতাব্দী হতেই জানা যায়। বাগদাদের প্রজ্ঞার ঘরের অনুবাদক দলের নেতা হুনাইন ইবন ইসহাক ধ্রুপদী চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্ত বই সমূহের অনুবাদে মূল চরিত্রের ভূমিকা পালন করেন। খলিফা আল-মা’মুন বাইজ্যান্টিয়াম এর রাজা থিওফিলস এঁর কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন এ বলে যে তার কাছে কোনওরকমের চিকিৎসা সংক্রান্ত বই থাকলে তা পাঠিয়ে দিতে। এভাবে হিপোক্রেটিস আর গ্যালেন এর সেরা সেরা কাজ আরবিতে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এছাড়াও যাদের বই অনূদিত হয়ঃ পিথাগোরাস, এগ্রিগেন্ট-এর অ্যাক্রন, ডেমোক্রিটাস, পলিবস, অ্যাপলনিয়া-এর ডাইওজিনিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, এথেন্স-এর নেসিথাস, যিনোক্রেটিস, পেডানিয়াস ডাইওসকরিডিস, ক্রিটোন, এফেসাস-এর সোরানাস, আরকিজিনিস, অ্যান্টিলিস, এফেসাস-এর রুফুস। এদের কাজ মূল বই হতে অনূদিত হয়। অন্যান্যদের কাজ, যেমন ইরাসিস্ট্রাটোস এর কাজসমূহ গ্যালেনের বইয়ে দেওয়া উদ্ধৃতি হতে জানা যায়।[১৫]
চতুর্থ শতকের রোমান রাজা জুলিয়ান এর চিকিৎসক অরিবাসিয়াস এর কথা জানা ছিল আর বারংবার বিস্তারিতভাবে মুহাম্মাদ ইবন যাকারিয়্যা আর-রাযী তার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। বিভিন্ন আরবি লেখক চতুর্থ শতকের এপিরাস-এর ফিলাগ্রিয়াস এর উদ্ধৃতি দেন। ষষ্ঠ শতকের দার্শনিক আর চিকিৎসক, ভাষাবিদ জন কে সুম্মারিয়া অ্যালেক্সানড্রিনোরাম এর ব্যাখ্যাকারক এর সম্মাননা দেওয়া হয়। এটি গ্যালেনের ১৬টি বইয়ের একটি সংগ্রহ, তবে কুসংস্কার দ্বারা বিকৃত হয়ে গিয়েছে।[১৬] মুসলিম চিকিৎসকেরা আবার পেট্রা-এর গেসিওস ও পালাডিওস কেও সুম্মারিয়ার লেখক বলে চিনত। আল-রাযী (Rhazes) তার করা গ্যালেনের সমালোচনাকে শক্তিশালি করার জন্য ট্রালেস-এর অ্যালেক্সেন্ডার এর উদ্ধৃতি দেন। অ্যামিডা-এর অ্যাইটিয়াস এর কথা পরবর্তীকালে মুসলিমরা জানতে পারে কেননা তার উদ্ধৃতি আল-রাযীও দেননি, ইবন আল-নাদিমও দেননি, কিন্তু পরে আল-বিরুণী ঠিকই দিয়েছেন তার কিতাব আস-সাইদানা তে, যা পরে ১০ম শতকে ইবন আল-হাম্মার অনুবাদ করেন।[১৫]
ষষ্ট শতকের আহ্রন দ্বারা লিখিত চিকিৎসা-সংক্রান্ত সংগ্রহ কুন্নাস হল গ্রিক থেকে সিরিয় এর মাধ্যমে আরবিতে অনূদিত হওয়া প্রথম দিককার একটি বই যা অনূদিত হয়েছিল চতুর্থ উমাইয়্যা খলিফা প্রথম মারওয়ান এর সময় মাসারগাওয়াই আল-বাসরি নামের এক ইহুদী পণ্ডিত দ্বারা। পরবর্তীতে হুনাইন ইবন ইসহাক এর একটি মার্জিত অনুবাদ প্রকাশ করেন।[১১]
যখন আরব ভূমী বাড়ছিল, ডাক্তার এজিনা-এর পল তখন অ্যালেক্সান্দ্রিয়ায় থাকতেন। প্রথম দিককার ইসলামী চিকিৎসকেরা তার বইকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন আর আল-রাযী থেকে ইবন সিনা পর্যন্ত প্রত্যেকে তার বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এজিনা-এর পল এর ব্যাপারটি পরবর্তীকালের বাইজ্যান্টাইন আর প্রথম দিককার ইসলামী চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাঝে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করছে।[১৫]
প্রথম দিককার ইসলামী চিকিৎসকগণ হিপোক্রেটিস এর জীবন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং এও জানতেন যে তার জীবনী আংশিক কিংবদন্তি বা অসত্য। তারা এটাও জানতেন যে অসংখ্য মানুষ ছিল যাদের হিপোক্রেটিস বলা হত এবং প্রত্যেকের কাজ কেবল মাত্র একটি নামে ছাপা হয়েছিলঃ ইবন আল-নাদিম একটি ছোট প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেন, সাবিত ইবন কুররার, যার নাম আল-বুকরাতুন (বিভিন্ন মানুষ যাদের নাম হিপোক্রেটিস)। নিশ্চিত ভাবেই হিপোক্রেটিস এর কিছু কাজের অনুবাদ হুনাইন ইবন ইসহাক এর আগেই বর্তমান ছিল, কারণ ইতিহাসবিদ আল-ইয়া'কুবী তার পরিচিত বইসমূহের একটি তালিকা বানিয়েছিলেন ৮৭২ সালে। সৌভাগ্যক্রমে, তার তালিকা উল্লিখিত কাজসমূহের সারাংশ, উদ্ধৃতি এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সমস্ত লেখাই উল্লেখ করে দিয়েছেন। দার্শনিক আল-কিন্দী একটি বই লিখেছিলেন যার নাম আত-তিব্ব আল-বুকরাতী (হিপোক্রেটিস এর চিকিৎসা), তার সমকালীন হুনাইন ইবন ইসহাক এরপর হিপোক্রেটিস এর উপর গ্যালেনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ অনূদিত করেন। আল-রাযী প্রথম মুসলিম ডাক্তার যিনি নিজের চিকিৎসা পদ্ধতিতে পরিপূর্ণ ভাবে হিপোক্রেটিসের কাজের ব্যবহার করেছেন। আলী আল-তাবারী বিশ্বাস করতেন যে তার সংগ্রহই (আল-মুয়ালাগাত আল-বুকরাতিয়া) সবচেয়ে সঠিক সারাংশ। মধ্যযুগীয় ইসলামী চিকিৎসার পুরোটা সময় ধরে হিপোক্রেটিসের কাজের উদ্ধৃতি দেওয়া হয় এবং ব্যাখ্যা করা হয়।[১৭]
গ্যালেন ধ্রুপদী প্রাচীনকাল এর সবচেয়ে বিখ্যাত পণ্ডিত আর চিকিৎসকদের একজন। আজ, তার কিছু মূল কাজ আর জীবনী সংক্রান্ত তথ্য হারিয়ে গিয়েছে, বাকিগুলো শুধু মাত্র এই কারণে বেঁচে আছে যে সেসব আরবিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।[১৮] জাবির ইবন হাইয়ান বারংবার গ্যালেনের বইয়ের উদ্ধৃতি দেন। ৮৭২ সালে আল-ইয়া’কুবী গ্যালেনের কিছু সেরা কাজের কথা উল্লেখ করেন। তিনি যেসব বইয়ের কথা উল্লেখ করেন সেসব হুনাইন ইবন ইসহাক অনুবাদ করার জন্য বাছাই করেননি। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে খুব সম্ভবত সেসবের অনুবাদ আগেই হয়ে গিয়েছিল। অনেক সময়েই হুনাইন ইবন ইসহাক উল্লেখ করেন যে তিনি বইটি অনুবাদ করছেন কারণ আগের অনুবাদ যথেষ্ট ভালো ছিল না। প্রথম দিককার অনুবাদ সম্ভবত ৮ম শতকে পাওয়া যাচ্ছিল; খুব সম্ভবত সেসব ফার্সি বা সিরিয় ভাষা হতে অনূদিত।[১৯]
মধ্যযুগীয় ইসলামী চিকিৎসায় হুনাইন ইবন ইসহাক ও তার তরুণ সমকালীন সাবিত ইবন কুররা গ্যালেনের বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদক ও ভাষ্যকার। তারা এ থেকে একটি গঠনমূলক চিকিৎসা বিজ্ঞান পদ্ধতিও বের করতে চেয়েছিলেন সে সময়ের চিকিৎসার জন্য। যাহোক, গ্যালেনের সমালোচনা সেই অষ্টম শতক থেকেই শুরু হয়েছিল জাবির ইবন হাইয়ান এর সাথে আর আল-রাযীর দ্বারা গ্যালেনের অনেক শক্ত সমালোচনা লেখা হয়। ১০ম শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ‘আলী ইবন আল-‘আব্বাস আল-মাজুসী লেখেনঃ[২০]
আর চমৎকার ও অসাধারণ গ্যালেনের ব্যাপারে বলতে গেলে তিনি অসংখ্য কাজ লিখে গিয়েছেন, যার প্রত্যেকটি বিজ্ঞানের শুধু একটি শাখা নিয়েই কথা বলে। সেখানে অপ্রয়োজনীয়ভাবে লম্বা রচনা রয়েছে, চিন্তা আর প্রমাণ নিয়ে অনেক সমস্যা, তার সমস্ত কাজ জুড়ে। [...] তার কোনটিকেই আমি [...] উঁচু মানের বলতে পারছি না।
১০ম শতকে ইবন ওয়াহশিয়্যা নাবাতীদের লেখাসমগ্র সংগ্রহ করেন, যার মধ্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যও ছিল। সিরিয় পণ্ডিৎ রেশাইনা-এর সারগিয়াস, হিপোক্রেটিস আর গ্যালেন এর বিভিন্ন কাজের অনুবাদ করেন যার ওষুধবিদ্যা সংক্রান্ত একটি বইয়ের ৬-৮ খন্ড ও অন্য বিষয়ে লেখা দুটি বইয়ের কিছু অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। এই বইগুলোর আরবি অনুবাদ করেন হুনাইন ইবন ইসহাক। আরেকটি কাজ, যা এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে যা লেখেছিলেন একজন সিরিয় ডাক্তার, সম্ভবত আরবি-লেখক ডাক্তারদের যথা আলী আল-তাবারী[২১] এবং ইউহান্না ইবন মাসাওয়ায়হ[২২] কে প্রভাবিত করেছিল।
সবচেয়ে প্রাচীন যে বইয়ের কথা বর্তমানে জানা আছে, তা হল আহ্রনের কুন্নাস যা তিনি নিজেই গ্রিক হতে সিরিয়তে অনুবাদ করেছেন। যা আরবিতে অনূদিত হয়েছিল সপ্তম শতকে মাসারগাওয়াই আল-বাসরী দ্বারা। জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয়েও সিরিয় ডাক্তাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাদের নাম সংরক্ষণ করা হয়েছিল কারণ তারা আব্বাসী খলিফাদের দরবারে কাজ করেছিলেন।[২২]
আবারও এখানে জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যার মাধ্যমে ফার্সি চিকিৎসা সংক্রান্ত বই সমূহ মুসলিম চিকিৎসকগণ এর হস্তগত হয়। এই শিক্ষালয়, গ্রেগোরিয়াস বার-হেব্রায়েস এর মতে, সাসানী শাসক প্রথম শাপুর ৩য় শতকে স্থাপন করেন। এটি প্রাচীন গ্রিক আর ভারতীয় চিকিৎসা ঐতিহ্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। আরব চিকিৎসকগণ যারা জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হন, হয়তবা এর সাথে প্রথম দিককার ইসলামী চিকিৎসার সম্পর্ক স্থাপন করে থাকতে পারেন। খৃষ্টান চিকিৎসক মাসারগাওয়াই (আল-বাসরী না, তার সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না) তার আব্দাল আল-আদউইয়্যাহ এর প্রথম বাক্যে লেখেছেন,[২৩]
এসব হল চিকিৎসা যা গ্রীক, ভারতীয় আর ফার্সি চিকিৎসকগণ শিখিয়েছেন।
আলী আল-তাবারী তার ফিরদাউস আল-হিকমা (প্রজ্ঞার স্বর্গ) বইয়ে মাত্র কয়েকটি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন, বিশেষ করে যখন নির্দিষ্ট রোগের কথা উল্লেখ করেন তখন। কিন্তু বিশাল সংখ্যক ওষুধ আর চিকিৎসা সংক্রান্ত গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের ফার্সি নামে, যা ইসলামী চিকিৎসার ভাষায় স্থান পেয়েছে।[২৪] আল-তাবারীর মত আল-রাযীও ফার্সি নাম অত্যন্ত কম ব্যবহার করেন, শুধুমাত্র দুইটি ফার্সি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন তিনিঃ কুন্নাস ফারিসী আর আল-ফিলাহা আল-ফারিসিয়্যাহ।[২২]
আব্বাসী খলিফা জা’ফার আল-মানসুর এর সময়ই ভারতীয় বৈজ্ঞানিক কাজ যেমন জ্যোতির্বিদ্যার উপর বই ইয়া’কুব ইবন তারিক ও মুহাম্মাদ আল-ফাযারী অনুবাদ করে ফেলেছিলেন। হারুন আল-রাশিদের পৃষ্ঠপোষকতায়, অন্তত, চিকিৎসা আর ঔষধবিদ্যা সংক্রান্ত ভারতীয় কাজসমূহ অনূদিত হয়। চিকিৎসার উপর একটি অধ্যায়ে ইবন আল-নাদিম তিনজন অনুবাদক নাম নেন, যারা হলেন মানকাহ, ইবন দাহ্ন আর আব্দআল্লাহ ইবন আলী।[২৫] চক্ষু চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি বইয়ে ইউহান্না ইবন মাসাওয়ায়হ একটি ভারতীয় পাঠ্যবই এর কথা উল্লেখ করেন।
আলী আল-তাবারী তার ফিরদাউস আল-হিকমার শেষ ৩৬টি অধ্যায় খরচ করেছেন ভারতীয় চিকিৎসার বর্ণনায়, যেখানে তিনি সুশ্রত, চারাকা আর আশতংগ হৃদয় , যা আয়ুর্বেদ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি, যা ৭৭৩ আর ৮০৮ এর মাঝে ইবন দাহ্ন অনুবাদ করেন, কে উদ্ধৃত করেন। আল-রাযী তার আল-হাওয়ী আর কিতাব আল-মানসুরী গ্রন্থে সুশ্রত আর চারাকা এর সাথে তার কাছে অজানা আরও অনেককে উদ্ধৃত করেন, যাদের তিনি চিহ্নিত করেন ‘মিন কিতাব আল-হিন্দ’ বা ‘ভারতের বই হতে’ হিসেবে।[২৬][২৭]
মেয়ারহফের মতে, ভারতীয় চিকিৎসা, ফার্সি চিকিৎসার মতই ইসলামী ঔষধবিদ্যায় মৌলিক প্রভাব ফেলে কেননা মুসলিমদের দ্বারা ভারতীয় ঔষধ ও ঔষধি গাছপালার বারংবার উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, যেসব গ্রিকদের কাছে অজানা ছিল।[২৮] সিরিয় চিকিৎসকগণ যেরূপ গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ছড়ান, তেমনই সম্ভবত ফার্সি চিকিৎসকগণ, হয়তবা জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয় দ্বারা ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞান ছড়ান মুসলিম বিশ্বে।[২৭]
ইসলামী স্বর্ণযুগের কর্তৃত্বশালি সেরামানের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীগণ শত শত বছর ধরে চিকিৎসার বিজ্ঞান ও শিল্প কে প্রভাবিত করে আসছেন। চিকিৎসা ও চিকিৎসা বিষয়ক আচার-ব্যবহার সম্পর্কে তাদের ধারণা ও বুদ্ধিসমূহ আজ পর্যন্ত আলোচিত হয়। ডাক্তারদের ব্যবহার আর রোগীর সাথে চিকিৎসকের সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত, তার জন্য মুসলিম চিকিৎসকগণ বর্তমান সময়ের ডাক্তারদের জন্য অনুসরণীয়।[৯][২৯]
সুস্থ করার শিল্প মৃত ছিল, গ্যালেন তাকে জীবন দান করে; তা বিক্ষিপ্ত ও অগঠিত ছিল, রাযী তা একীভূত ও গঠিত করে; সেটা অসম্পূর্ণ ছিল, ইবন সিনা তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে[৩০]
আলী ইবন মুসা আল-রিযা (৭৬৫ – ৮১৮) শিয়াদের অষ্টম ইমাম ছিলেন। তার গ্রন্থ ‘আল-রিসালাহ আল-যাহাবিয়্যাহ’ (স্বর্ণাক্ষরে রচিত গ্রন্থ) এ বিভিন্ন চিকিৎসা সম্পর্কীয় নিরাময় ও ভালো স্বাস্থ্যের দিকনির্দেশনা রয়েছে। এটি খলিফা মা’মুনের প্রতি উৎসর্গিত।[৩১] চিকিৎসাবিদ্যায় তার সময়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ছিল, আর মুসলিমদের ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারে ঐ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি ‘সোনালি গ্রন্থ’ নামে সম্মানিত কারণ খলিফা মা’মুনের আদেশে এর রচনা স্বর্ণাক্ষরে হয়।[৩২][৩৩] আল-রিযা তার কাজে হিউমরের চিকিৎসা এর ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত।[৩৪]
আরবি ভাষায় রচিত প্রথম চিকিৎসা বিশ্বকোষ হল ৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে আলী আল-তাবারী দ্বারা রচিত ফিরদাউস আল-হিকমা (প্রজ্ঞার স্বর্গ) যা ৭ খণ্ডে সমাপ্ত।[৩৫] শিশু উন্নয়ন এর পথিকৃৎ আল-তাবারী বলেন যে মনোবিজ্ঞানও চিকিৎসার মাঝে গভির সম্পর্ক রয়েছে। তিনিও এও উল্লেখ করেন যে মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে চিকিৎসা এর প্রয়োজন রয়েছে, আর রোগিদের চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করার সময় উপদেশ প্রয়োজন। তার বিশ্বকোষে তিনি সুশ্রত ও চারাকা এর প্রভাব সম্পর্কেও আলোচনা করেন।[৩৬] এছাড়াও মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে চিকিৎসা এর কথা উল্লেখ করেন তিনি।[৩৭]
ডাক্তার আল-তামীমী ওষুধ ঘনীকরণে তার দক্ষতার কারণে অত্যন্ত বিখ্যাত, বিশেষ করে থেরিয়াক এর জন্য, যা বিভিন্ন বিষের নিরাময়। তার কাজসমূহ, যার বেশিরভাগই হারিয়ে গিয়েছে, পরবর্তীকালের চিকিৎসকদের দ্বারা উদ্ধৃত। সেরামানের গ্রিক লেখকদের যা জানা ছিল, তা সাথে নিয়ে এবং তার সাথে নিজ হতে আরও তথ্য যোগ করে তিনি এক চমৎকার কাজ করেন, যার মাধ্যমে তিনি এই ক্ষেত্রে আভান্ত গার্ডে তে পরিণত হন।[৩৮]
আলী ইবন আব্বাস আল-মাজুসী (মৃত্যু ৯৯৪ খৃষ্টাব্দ), যার ল্যাটিন নাম হ্যালি আব্বাস, তার কিতাব আল-মালিকীর জন্য বিখ্যাত, যার অনূদিত ইংরেজি নাম Complete Book of the Medical Art। পরবর্তীতে এর নাম the royal book এ পরিণত হয়, যা আরও অধিক বিখ্যাত। এই বই আফ্রিকা-র কনস্ট্যানটিন অনুবাদ করেন এবং এটি সমগ্র ইউরোপে শল্যচিকিৎসার পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল।[৩৯] হ্যালি আব্বাস দ্বারা চিকিৎসা বিজ্ঞানে একটি শ্রেষ্ঠতম অবদান হল তার ‘রাজকীয় বই’ এ প্রাপ্ত কৈশিক সঞ্চালন এর বর্ণনা।[২]
মুহাম্মাদ ইবন যাকারিয়্যা আর-রাযী (ল্যাটিনঃ Rhazes) ইসলামী স্বর্ণযুগের সবচেয়ে বহুমুখী বিজ্ঞানীদের একজন। মূলত একজন ফার্সি চিকিৎসক, রসায়নবিদ আর দার্শনিক, তবে তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান নিয়েও লেখালেখি করেন, এমনকি পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত নিয়েও কাজ করেন তিনি। তার কাজসমূহ ১০/১১ শতাব্দীর দিকে উচ্চমাত্রায় সম্মানিত ছিল এবং বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক আল-বিরুণী ও আল-নাদিম তার আত্মজীবনীমূলক তথ্য সংগ্রহ করেন। তার উপর বিভিন্ন তালিকা ও ব্যাখ্যা প্রদানও করেন। তার লিখিত অসংখ্য বই ল্যাটিনে রূপান্তরিত হয় এবং তার কাজ ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে অবিতর্কিতভাবে কর্তৃত্বশালি ছিল।
চিকিৎসা তত্ত্বে আল-রাযী মূলত গ্যালেনের উপর নির্ভর ছিলেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে রোগীকে দেখার প্রতি তার ধারণা এবং এমন চিন্তা, যে প্রত্যেক রোগীকে ব্যক্তিগত ভাবে সময় দেওয়া উচিত আর পরিচ্ছন্নতা ও তার খাদ্য খাওয়ার নিয়মাবলী দেখলে হিপোক্রেটিক চিন্তাধারার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আল-রাযীর মতে, আবহাওয়া আর ঋতু স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন, রোগী ভালো বাতাস পাচ্ছে কিনা, তার জন্য কামরায় সঠিক তাপমাত্রা বজিয়ে রাখা হয়েছে কিনা। সতর্ক ভাবে পরিভাষণ ও রোগনির্ণয় করার প্রয়োজন বুঝতেন তিনি।[৪০][৪১]
রোগের শুরুতে, এমন ওষুধ ব্যবহার কর যা তে রোগীর শক্তি না কমে, […] যদি স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ভালো হয়, ওষুধ আর ব্যবহার করো না, আর যখনই মৌলিক ওষুধ দিয়ে কাজ চলে, তখন যৌগিক ওষুধ ব্যবহার করো না
- ইবন যাকারিয়্যা আল-রাযী
বইটির (الحاوي) ইংরেজি নামঃ The Comprehensive book of medicine। এটি আল-রাযীর সবচেয়ে বড় বইগুলোর একটি। এটি তার সম্পূর্ণ জীবনে নেওয়া চিকিৎসা সম্বন্ধীয় নোটসমূহের সমাহার। সম্পাদিত রূপে এটি ২৩ খণ্ড। আর-রাযী গ্রীক, সিরিয়, ভারতীয় আর পূর্বোক্ত আরবি কাজ হতে উদ্ধৃতি দেন, সাথে দিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণও তুলে ধরেন।[৪২][৪৩] প্রত্যেক খণ্ড শরীরের বিভিন্ন অংশের রোগ নিয়ে আলোচনা করে। আলী ইবন আব্বাস তার নিজ বই কামিল আস-সিনা’আ তে আল-হাওয়ী এর পর্যালোচনা করেন।
সে সুস্থ্য থাকার জন্য প্রত্যেক জিনিসের কথা উল্লেখ করেছে, আর ওষুধ ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস এর মাধ্যমে সুস্থ্য থাকার প্রক্রিয়াও উল্লেখ করেছে। সে অসুস্থতার প্রত্যেক নিদর্শনের কথা উল্লেখ করে এবং এমন কিছুই বাদ দেয় না যা কোন শিক্ষার্থী কে সুস্থতার বিজ্ঞান শিখা থেকে অপারগ রাখবে। অবশ্য, সে শারীরিক বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে নি, বা পদার্থ, হিউমর নিয়ে কিছু বলে নি। এমন কি শল্যচিকিৎসা নিয়েও লেখে নি সে। তার বইটি অগোছালো। পরীক্ষামূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণ করে নি সে। […] রোগের বর্ণনা, তার কারণ, নিদর্শন ও সমাধান এর ক্ষেত্রে গ্যালেন আর হিপোক্রেটিস থেকে শুরু করে হুনাইন ইবন ইসহাক ও তাদের মাঝে যতকেউ আছে, সবার প্রক্রিয়া উল্লেখ করে সে। একটিও বাদ না দিয়ে। খুবই সাবধানে এসব তুলে নেয় সে, যেন তার সময় পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের একদম সবকিছু থাকে সেখানে। - আলী ইবন আব্বাস (অনুবাদঃ লেকলের্ক, খণ্ড - ১, পৃষ্ঠাঃ ৩৮৬-৭)
১৭ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় সকল ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আল-হাওয়ী পাঠ্যবই ছিল। সে সময় এটিকে একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী দ্বারা লিখিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বই হিসেবে দেখা হত।[৩০] এটি প্রথম ল্যাটিনে অনুবাদ করেন ফারাজ বেন সালিম, ১২৭৯ সালে, একজন সিসিলি-ইহুদী ডাক্তার যে আনজু-র চার্লস এর জন্য কাজ করত।
কিতাব আল-মানসুরী (الكتاب المنصوري في الطب, লাতিনঃ Liber almansoris, Liber medicinalis ad Almansorem) সামানী রাজপুত্র আবু সালিহ আল-মানসুর ইবন ইসহাক, রাঈ এর গভর্নর এর প্রতি উৎসর্গিত।[৪৪] বইটি ১০টি অংশে সমন্বিত চিকিৎসার একটি বিশ্বকোষ। প্রথম ৬ অংশ চিকিৎসা তত্ত্ব নিয়ে, তাছাড়া শারীরবিদ্যা, অঙ্গব্যাবচ্ছেদ বিদ্যা, রোগবিদ্যা, ওষুধবিদ্যা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, সৌন্দর্যবিজ্ঞান আর পথ্যবিজ্ঞান ও আছে। বাকি ৪ অংশ শল্যচিকিৎসা, জ্বর ও বিষ বিদ্যা নিয়ে। বিভিন্ন লাতিন অনুবাদ যেমন Liber Nonus এ এর নবম অংশের অনুবাদে থাকা শরীরের বিভিন্ন অংশের রোগবিদ্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।[৪৫][৪৬]
আলী ইবন আব্বাস তার কামিল আস-সিনা’আ তে কিতাব আল-মানসুরী নিয়ে বলেনঃ
তার কিতাব আল-মানসুরী তে আল-রাযী চিকিৎসা সংক্রান্ত শিল্পের সকল কিছুর সারাংশ প্রদান করেন। এবং তার উল্লিখিত কোন বিষয় সে উপেক্ষা করে না। অবশ্য, তার উদ্দেশ্য অনুযায়ী, সবকিছু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত।
ক্রিমোনা-র জেরার্ড প্রথম বইটির লাতিন অনুবাদ প্রকাশ করেন ১১৭৫ সালে। ১৪৯০, ১৪৯৩ ও ১৪৯৭ সালে বিভিন্ন নামে এটি ভেনিস এ প্রকাশিত হয়।[৪৭][৪৮] ইউরোপের অসংখ্য মানুষ কিতাব আল-মানসুরী এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার মধ্যে আন্দ্রেয়াস ভেসালিয়াস একজন, যিনি আল-রাযীর সম্পূর্ণ কাজ নিজ ভাষায় উল্লেখ করেন, যার নামঃ Paraphrases in nonum librum Rhazae যা প্রথম লুভান এ প্রকাশিত হয়, ১৫৩৭ সালে।[৪৯]
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগের সমাধান করার প্রক্রিয়া বর্ণনা করে এই বইটি। বইটি সম্ভবত লেখা হয়েছিল বিত্তবানদের জন্য, যারা ক্রমাগত বেশি খাওয়ার জন্য বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ত।
আল-রাযীর আগে এ বিষয়ে সাবিত ইবন কুররার কাজ জানার আগ পর্যন্ত বসন্ত ও হাম নিয়ে আল-রাযীর প্রবন্ধ কে এই ধরনের রোগসমূহের ব্যাপারে সর্বপ্রাচীন লেখা ধরা হত। এই দুই রোগের যে সুস্পষ্ট বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, এর কারণ ও এ থেকে মুক্তি পাবার যে বর্ণনা, তাকে ইসলামী চিকিৎসার এক অন্যতম সেরা কাজ হিসেবে দেখা হয়।[৫০]
তার অন্যান্য কাজের মধ্যে রয়েছে A Dissertation on the causes of the Coryza which occurs in the spring when roses give forth their scent যেথায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে শুধু মাত্র বসন্ত মৌসুমে গোলাপ ফুলের গন্ধ নেবার কারণে কেন একজনের করাইযা হয়ে যায়। অন্য একটি কাজ হল Bur’al Sa’a (তাৎক্ষণিক মুক্তি) যেখানে তিনি এমন কিছু ওষুধের নাম উল্লেখ করেন যা সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট রোগ হতে মুক্তি দান করে।[৩০]
ইবন সিনা, যে পশ্চিমে স্বাভাবিকভাবে আভিসিনা নামে পরিচিত, ছিলেন ১০-১১শ শতকের একজন ফার্সি বহুবিদ্যাজ্ঞ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তিনি তার বৈজ্ঞানিক কাজের জন্য পরিচিত ছিলেন, তবে চিকিৎসা নিয়ে লেখালেখির জন্য বেশি বিখ্যাত ছিলেন।[৫১] অনেকের মতে, তিনি প্রথম দিককার আধুনিক চিকিৎসার জনক।[৫২] ইবন সিনাকে অসংখ্য চিকিৎসা বিষয়ক বিলোকন ও উদ্ঘাটন এর সম্মাননা দেওয়া হয়, যেমনঃ বায়ুবাহিত সংক্রমণ, বিভিন্ন ধরনের মনোবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে ধারণা প্রদান, ফেটাল ডিস্ট্রেস দ্বারা আলাদাকৃত বাচ্চা জন্মদানে ফোরসেপ্স এর ব্যবহার, মুখমণ্ডলের প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে সেন্ট্রাল ও পেরিফেরাল প্যারালাইসিসকে আলাদাকরণ আর গিনি ওয়ার্ম ইনফেকশন ও ট্রিজেমিনিয়াল নিউরালজিয়া এর বর্ণনা প্রদান।[৫৩] দুটি বইয়ের জন্য আলাদা ভাবে তাকে সম্মানিত করা হয়, একটি তার সবচেয়ে বিখ্যাত কানুন ফি আল-তিব্ব আর অন্যটি নিরাময়ের গ্রন্থ। তার অন্যান্য কাজে তিনি হৃদপিণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, বৃক্কের রোগে প্রয়োজনীয় ওষুধ আর অ্যানজেলোলজি নিয়ে লেখালেখি করেন।
ইবন সিনার চিকিৎসা ইসলামি চিকিৎসার মূল সূত্র হয়ে উঠে তার কানুন ফিত তিব্ব এর প্রভাবের মাধ্যমে। ইবন সিনার বিদ্যালয়ে বইটি মূলত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। বইটি ৫ খণ্ডে বিভক্তঃ প্রথম খণ্ড চিকিৎসা বিজ্ঞানের নীতিমালার সংগ্রহ, দ্বিতীয়টি বিভিন্ন ওষুধের তথ্যসূত্র, তৃতীয়টি অঙ্গ অনুযায়ী রোগের বর্ণনা দান করে, চতুর্থটি গঠনমূলক অসুস্থতা ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করে, পঞ্চমটি যৌগিক ওষুধ নিয়ে কথা বলে। এই কানুন পরবর্তী চিকিৎসা বিষয়ক বিদ্যালয় ও লেখকগণের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে।[৫৩]
এটি দাবি করা হয়েছে যে মানব দেহবিদ্যা এবং শারীরবৃত্তবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ইবন আল-নাফিসের দ্বারা করা হয়েছিল, কিন্তু মানব বিচ্ছেদের মাধ্যমে এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল কিনা তা সন্দেহজনক কারণ "আল-নাফিস আমাদের বলেন যে তিনি বিচ্ছেদের অভ্যাস এড়িয়ে চলেন শারিয়াহ এবং মানুষের দেহের জন্য নিজের সমবেদনা"।[৫৪][৫৫]
গ্রিক চিকিৎসকদের কাজের মাধ্যমে মানুষের দেহের রক্তের চলাচল প্রক্রিয়া জানা গেছে বলে মনে করা হয়।[৫৬] যাহোক, সারা দেহে প্রবাহিত হবার আগে, হৃদপিণ্ডের ডান বায়ুচক্র থেকে বাম বায়ুচক্রে রক্ত কীভাবে প্রবাহিত হয়, তা একটি প্রশ্ন ছিল।[৫৬] দ্বিতীয় শতাব্দীর গালেনের মতে, রক্ত বাম ভেন্ট্রিকেলের সেপটামের অদৃশ্য প্যাসেজের মাধ্যমে পৌঁছায়।[৫৬] ১৩ তম শতাব্দীর সিরিয়ান চিকিৎসক ইবন আল-নাফিস, ডান বায়ুচক্র থেকে বাম দিকে রক্ত প্রবাহে পূর্বের বিবৃতিটি মিথ্যা বলে মনে করেন।[৫৬] ইবন আল-নাফিস আবিষ্কার করেন যে, কোনরকম অদৃশ্য পথের অস্তিত্ব ছিল না, যা গালেনের ধারণাকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করে।[৫৬] ইবন আল-নাফিস আবিষ্কার করেন যে হৃদয়ের ডান বায়ুচক্রের রক্ত ফুসফুসের মাধ্যমে বাম দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।[৫৬] এই আবিস্কারটি ফুসফুসের সঞ্চালনের প্রথম বিবরণগুলির মধ্যে একটি ছিল।[৫৬] এই বিষয়ে তার লেখাগুলি শুধুমাত্র ২০ শতকে পুনর্বিবেচনা করা হয়েছিল[৫৭] এবং উইলিয়াম হার্ভের পূর্বের আবিষ্কার এটিকে সাধারণ মনোযোগে নিয়ে আসে।[৫৮]
প্রাচীন গ্রীকদের মতে, যেকোনো বস্তু দেখার জন্য চোখ নিজে আলোক রশ্মি পাঠায়।[৫৬] ১১তম শতাব্দীর ইরাকি বিজ্ঞানী ইবন আল হায়সাম, লাতিন ভাষায় আল-হেজেন নামেও পরিচিত, তিনি মানব দৃষ্টিভঙ্গির একটি নতুন ধারণা বিকাশ করেন।[৫৬] ইবন আল-হায়সাম দৃষ্টিশক্তি প্রতি সোজা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন যে, চোখ একটি অপটিক্যাল যন্ত্র।[৫৬] চোখের শারীরবৃত্তবিজ্ঞানের বিবরণ তাকে চিত্রের তত্ত্বের ভিত্তি তৈরি করতে পরিচালিত করেছিল, যা বিভিন্ন ঘনত্বের ২টি মিডিয়ার মধ্যবর্তী আলো রশ্মির অপ্রচলনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[৫৬] ইবন আল-হায়সাম পরীক্ষামূলক গবেষণা থেকে দর্শনে এই নতুন তত্ত্বটি বিকাশ করেছিলেন।[৫৬] ১২ শতাব্দীতে, তাঁর আলোকবিদ্যার বইটি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় এবং এটি ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামিক জগতে এবং ইউরোপে - উভয়েই অধ্যয়ন করা অব্যাহত ছিল।[৫৬]
মোসুলের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক আহমাদ ইবন আবি আল-আশআস তাঁর বই আল-কাদি ওয়া আল-মুকতাদী গ্রন্থে একটি জীবন্ত সিংহের পেটের শারীরবৃত্তীয় বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছিলেনঃ
যখন খাবার পেটে প্রবেশ করে, বিশেষত যখন এটি প্রচুর পরিমাণে থাকে, তখন পেট প্রসারিত হয় এবং তার স্তরগুলি প্রসারিত হয় ... দর্শকরা মনে করেন যে পেট বরং ছোট ছিল, তাই আমি তার গলায় জগের পরে জগ পুরে যাচ্ছিলাম ... দূরবর্তী পেটের ভিতরের স্তর বাহ্যিক পেরিটোনীয় স্তর এর মত মসৃণ হয়ে ওঠে। তারপর আমি পেট কেটে নিলাম এবং পানি বের করালাম। পেট সংকুচিত হয় আর আমি পায়লোতাস দেখতে পাই ...[৫৯]
আহমাদ ইবন আবি আল-আশআস ৯৫৯ সালে জীবিত সিংহের পেটের শারীরবৃত্তবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণটি করেছিলেন। এই বর্ণনাটি উইলিয়াম বায়ামন্টের প্রায় 900 বছর পূর্বে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে আহমদ ইবন আবি আল-আশআস গ্যাস্ট্রিক ফিজিওলজিতে পরীক্ষামূলক ইভেন্ট শুরু করেছিলেন।[৫৯] গালেনের মতে, তার দ্য ওসিব্বাস এড টিরোনস বই অনুসারে, নিম্ন চোয়াল দুটি অংশ নিয়ে গঠিত, এ থেকে প্রমাণিত হয় যে এটি রান্না করা অবস্থায় মাঝখানে বিভক্ত হয়ে যায়। আবদ আল-লতিফ আল-বাগদাদী, মিশর সফরকালে কায়রোর কাছে ক্ষুধার্ত থেকে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের অনেকগুলি কঙ্কালের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি কঙ্কাল পরীক্ষা করেন এবং বের করেন যে চোয়াল ১ ভাগ, গ্যালনের মতানুযায়ী ২ ভাগে বিভক্ত নয়।[৬০] তিনি তার বই আল-ইযাদা ওয়া-আল-ইত্তেবার আল-উমর আল মুশাহাদাহ ওয়াল-আল-হাওয়াদিত আল-মুয়ায়াহ্ দ্বী আযাদ মিসর, বা "মিশরের ভূমিতে সংঘটিত ঘটনাবলি এবং ঘটনাবলীর উপর নির্দেশনা ও উপদেশ বই" এ লিখেছেন:[৬০]
সমস্ত অঙ্গবিন্যাসীরা সম্মত হন যে নিচের চোয়ালের হাড়টি দুটি অংশ নিয়ে জড়ো হয়ে থাকে। [...] লাশের এই অংশের পরিদর্শন আমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করায় যে নিম্ন চোয়ালের হাড়টি এক, কোন যৌথ কিছু নয়। আমি প্রায় দুইশো মাথাতে পর্যবেক্ষণ বিভিন্ন মানুষের সাহায্যে করে দেখেছি [...] আমার অনুপস্থিতিতে এবং আমার উপস্থিতিতে, একই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত, আল-বাগদাদীর আবিষ্কার তাঁর সমসাময়িকদের কাছ থেকে বেশি মনোযোগ পায়নি, কারণ তথ্যটি ভূগোল, উদ্ভিদবিজ্ঞান, মিসরের স্মৃতিস্তম্ভ, দুর্ভিক্ষ এবং এর পরিণতির বিস্তারিত হিসাবের মধ্যে লুকিয়ে গেছে। তিনি নিজ ইচ্ছা মতো একটি পৃথক বইতে তার শারীরিক পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করতে পারেননি।[৬০]
মধ্যযুগীয় ইসলামি চিকিৎসকদের মেডিকেল অবদানগুলিতে উদ্ভিদকুলকে প্রতিকার বা ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মধ্যযুগীয় ইসলামি চিকিৎসকগণ ওষুধের উৎস হিসাবে প্রাকৃতিক পদার্থ ব্যবহার করতেনঃ পাপাভার সোম্নিফেরাম লিনাইয়াস, পপি, এবং ক্যানাবিস সাটিভা লিনইয়াস, শণ।[৬১] প্রাক-ইসলামি আরবের মধ্যে না পপ্পী না শণ পরিচিত ছিল।[৬১] ফার্সি ও গ্রিক সংস্কৃতি ও চিকিৎসা সাহিত্যের মাধ্যমে ভারত থেকে নবম শতাব্দীতে ইসলামি দেশগুলিতে শণ চালু করা হয়েছিল।[৬১] গ্রিক চিকিৎসক ডায়োসকোরিডস,[৬২] আরবদের মতে প্রাচীনকালের সর্বশ্রেষ্ঠ উদ্ভিদবিদ, শণের বীজকে "প্রজননের তৃষ্ণা মিটাবার জন্য" এবং তার রসটি ইয়ারচেসের জন্য সুপারিশ করেন।[৬১] ৮০০ সালে শুরু হওয়া এবং দুই শতাব্দী ধরে স্থায়ী হওয়া, পপ্পি ব্যবহার থেরাপিউটিক আওতার মধ্যে সীমিত ছিল।[৬১] তবে, ডোজগুলি প্রায়ই চিকিৎসা প্রয়োজন অতিক্রম এবং মূল সুপারিশকৃত সিমা ছাড়িয়ে বারবার ব্যবহৃত হত। ইউহান্না ইবন মাসাওয়ায়হ দ্বারা ওষুধ হিসেবে পুষ্পের ব্যবহার অনুপ্রাণিত ছিল ফুসফুস, আতঙ্ক, চোখের, মাথা এবং দাঁত ব্যথা, প্রশস্ততা, এবং ঘুম প্রলোভনের জন্য এবং পিত্তকোষের পাথরের আক্রমণ থেকে ব্যথা উপশম করার জন্য।[৬১] যদিও পপি ওষুধের উপকারিতা ছিল, আলী আল-তাবারী ব্যাখ্যা করেছিলেন যে পপি গাছের নির্যাস প্রাণঘাতী, এবং চা ও আফিম বিষাক্ত বিবেচনা করা উচিত।[৬১]
প্রাচীন ইসলামি সমাজে হাসপাতালগুলির বিকাশ ও বৃদ্ধি বর্তমানে শল্যচিকিৎসা নামে পরিচিত চিকিৎসাকে প্রসারিত করেছে। মধ্যযুগীয় সময়কালে চিকিৎসকদের কাছে অস্ত্রোপচার পদ্ধতিগুলি পূর্ববর্তী পাঠ্যসূচির মাধ্যমে পরিচিত ছিল যাতে পদ্ধতিগুলির বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৬৩] প্রাক-ইসলামি মেডিক্যাল পাবলিশিং থেকে প্রাপ্ত বই চিকিৎসক ও সার্জনদের অনুশীলন প্রসারিত করার জন্য একটি মৌলিক বিল্ডিং ব্লক। খুব কম সাফল্য হারের কারণে সার্জারির চিকিৎসক এবং অন্যান্য মেডিক্যাল এফিলিয়েটদের অস্বাভাবিকভাবে দেখা হত। যদিও পূর্ববর্তী রেকর্ডগুলি নির্দিষ্ট ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রে অনুকূল ফলাফল সরবরাহ করেছিল।[৬৩] প্রাচীন ইসলামে বিশেষ করে চক্ষুরোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ছিল।
রক্তছাড়ানো ও উত্তপ্ত শলাকা (বা রশ্মি) দ্বারা পোড়ান - রোগীদের চিকিৎসার জন্য থেরাপি হিসাবে চিকিৎসকদের দ্বারা প্রাচীন ইসলামি সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ছিল। এর ফলাফল বিস্তৃত থাকায় এর ব্যবহারও বেশি ছিল। উত্তপ্ত শলাকা (বা রশ্মি) দ্বারা পোড়ান, একটি ক্ষত চামড়া বা মাংস পোরানোর জন্য ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি, যা সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সঞ্চালিত হয়। চিকিৎসকরা একটি ধাতু বা রড উত্তপ্ত করে একটি ক্ষত মাংস বা ত্বক পুড়িয়ে এটি ব্যবহার করত। এটি রক্তের ক্ষত থেকে রক্ত বের করবে এবং অবশেষে ক্ষত নিরাময় করবে।[৬৪]
রক্তছাড়ন, রক্তের শল্যচিকিৎসামূলক অপসারণ, খারাপ 'হিউমর' দূর করার জন্য ব্যবহার করা হত, যাকে ঐ সময় ক্ষতিকর হিসেবে দেখা হত।[৬৪] একজন রোগীর রক্তছাড়নকারী ফ্লেবোটোমিস্ট সরাসরি শিরা থেকে রক্ত বের করে দেয়। "ভিজা" কাপিং, রক্তছাড়নের একটি প্রক্রিয়া, যা তে চামড়ার মধ্যে সামান্য কেটে একটি উত্তপ্ত কাপিং গ্লাস প্রয়োগ করে রক্তছাড়ানো হয়। গ্লাস থেকে তাপ এবং চাপ এর কারণে চামড়ার তলদেশে রক্তের উত্থান ঘটে। "শুকনো কাপিং", যা তে ব্যথা, খিটখিটে, এবং অন্যান্য সাধারণ অসুস্থতা থেকে মুক্ত করার জন্য রোগীর শরীরের নির্দিষ্ট এলাকায় একটি উত্তপ্ত কাপিং গ্লাস (কাটা ছাড়াই) স্থাপন করা হয়।[৬৪] যদিও এই পদ্ধতিগুলি ফ্লেবোটোমিস্টদের সঞ্চালনের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজ বলে মনে হয়, তেমনি এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল যেখানে একটি চর্ম তৈরির সময় অসহায়তার কারণে রোগীর আঘাত বা মৃত্যুর কারণে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হয়েছিল। রোগীর অসুস্থতার সময় কাপিং এবং ফ্লেবোটমি উভয়ই সহায়ক বলে মনে করা হয়।[৬৪]
চোখের সংক্রামক ব্যাধি এবং চোখের ছানিরোগ এর মতো চোখের জটিলতা সম্পর্কিত রোগীদের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চোখের সংক্রামক ব্যাধি রোগীদের একটি সাধারণ জটিলতা হল টিস্যুটির ভাস্কুলাইজেশন যা চোখের কর্নিয়ায় আক্রমণ করে, যা প্রাচীন ইসলামি চিকিৎসকদের দ্বারা রোগের কারণ বলে মনে করা হত। যে প্রক্রিয়াটির দ্বারা এই জটিলতার সমাধান করা হত তা অস্ত্রোপচার এর মাধ্যমে সম্পন্ন ছিল এবং এটি বর্তমানে পেরিটমি নামে পরিচিত। অস্ত্রোপচারের সময় "চোখ খোলা রাখতে, উত্তোলনের জন্য খুব ছোট ছোট হুক এবং উচ্চতার জন্য খুব পাতলা স্কালপেল ব্যবহার করার জন্য একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হত।"[৬৪] চোখের সংক্রামক ব্যাধির জটিলতার চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে একই রকম কৌশল, যা টেরিগিয়াম নামে পরিচিত, কর্নিয়া এর বালবার কনজাঙ্কটিভা এর ত্রিভুজাকার আকৃতির অংশ মুছে ফেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ছোট হুকের বৃদ্ধি বাড়িয়ে এবং তারপর একটি ছোট লেন্সেট দিয়ে কাটা দ্বারা সম্পন্ন করা হত। এই অস্ত্রোপচার কৌশল উভয় রোগীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং চিকিৎসক বা তার সহায়কদের সঞ্চালনের জন্য জটিল।[৬৪]
মধ্যযুগীয় ইসলামি চিকিৎসা সাহিত্যে, চোখের ছানিরোগ, ঝিল্লি বা একটি জড় তরল যা লেন্স এবং পিউপিল এর মধ্যে থাকে তা দ্বারা সৃষ্ট বলে ধারণা করা হত। মধ্যযুগীয় ইসলামের চোখের ছানিরোগ চিকিৎসা পদ্ধতি (couching হিসাবে ইংরেজিতে পরিচিত) এই কৌশলের উপর কৃত পূর্বোক্ত কাজও সমূহের অনুবাদ হতে জানা যা।[৬৪] একটি ল্যান্সেট দিয়ে স্ক্লেরায় একটি ছিদ্র করে পর্যবেক্ষণ করা হত, লেন্স কে চোখের এক পাশে ঠেলে দেওয়া হত। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে, চোখটি লবণাক্ত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হত এবং তারপর গোলাপ ও ডিমের সাদা অংশে তৈলাক্ত তুলো দিয়ে আবদ্ধ করা হত। অপারেশন করার পর, উদ্বেগ ছিল যে ছানি একবার এক দিকে ধাক্কা দেওয়া হয়ে গেলে, পুনর্মিলন করবে, সেজন্যই রোগীকে অস্ত্রোপচারের পর বেশ কয়েক দিনের জন্য তার পিঠের উপর শুয়ে থাকার নির্দেশ দেওয়া হত।[৬৪]
আল-রাযীর মত চিকিৎসকগণ চিকিৎসার নৈতিকতার গুরুত্ব সম্পর্কে লিখেছেন এবং ইসলামি মেডিসিনের নীতিশাস্ত্রের প্রথম ধারণা ইবন সিনা এবং ইবন আল-নাফিসের সাথে একত্রে উপস্থাপন করেছেন।[২৯] তিনি অনুভব করেছিলেন যে চিকিৎসককে শুধুমাত্র নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞই নয় বরং একজন রোল মডেলও হতে হবে। চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কিত তার চিন্তাসমূহ তিনটি ধারণার মধ্যে বিভক্ত ছিল: চিকিৎসকের রোগী ও নিজের প্রতি দায়িত্ব এবং রোগীদের দায়িত্ব চিকিৎসকদের প্রতি।[৬৫]
ইসহাক ইবন আলী আল-রুহাউইর আদাব আল-তাবীব (আরবী: أدب الطبيب, "চিকিৎসকের নৈতিকতা" বা "Practical Medical Deontology") চিকিৎসা সম্বন্ধীয় নৈতিকতার দিক থেকে সর্বপ্রথম (আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকা) আরবি কাজ। এটি যেসব কাজগুলির উপর ভিত্তি করে তা হল হিপোক্রেটস এবং গালেনের।[৬৬] আল-রুহাউই চিকিৎসককে "আত্মার ও দেহের অভিভাবক" বলে অভিহিত করেছেন, এবং চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে বিশ অধ্যায় লিখেছেন।[৬৭]
মূল প্রবন্ধসমূহঃ বিমারিস্তান ও ইসলামি হাসপাতাল
আরও দেখুনঃ হাসপাতালের ইতিহাস
প্রাথমিকভাবে ইসলামি যুগে অনেক হাসপাতাল গড়ে ওঠে। তাদেরকে বিমরিস্তান বলা হয়, বা দার আল শিফা। ফার্সী ও আরবি শব্দ দুটির অর্থ "অসুস্থদের ঘর [অথবা জায়গা]" এবং "নিরাময় ঘরের"।[৬৮] অসুস্থ মানুষের যত্নের জন্য হাসপাতালের ধারণাটি প্রাথমিক খলিফাদের থেকে নেওয়া হয়েছিল।[৬৯] মুহম্মদের সময়ই বিমরিস্তান দেখা যায় এবং মদীনা শহরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদটি প্রথম মুসলিম হাসপাতালের সেবা দেয়।[৭০] গাযওয়ায় খন্দক এর (খন্দকের যুদ্ধ) সময় মুহাম্মদ আহত সৈন্যবাহিনী দেখে এসে তাদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য একটি তাঁবু গড়ার আদেশ দেন।[৭০] সময়ের সাথে সাথে, খলিফা ও শাসকগণ ভ্রমণরত বিমারিস্তানের ব্যবস্থা প্রসারিত করেন যাতে ডাক্তার ও ওষুধতৈরিকারকদের তাতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে দামেষ্কে প্রথম বিমারিস্তান নির্মাণের জন্য স্মরণকৃত।[৭১] বিমরিস্তানে বেতনভোগী চিকিৎসক এবং ভাল সজ্জিত ওষুধের সরবরাহখানা অবস্থিত ছিল।[৭০] এটি অন্ধ, কুষ্ঠরোগী এবং অন্যান্য অক্ষম মানুষকে চিকিৎসা করত, এবং অন্যান্য রোগীদের থেকে কুষ্ঠ রোগীদেরও পৃথক রাখত।[৭০] কেউ কেউ বিমরিস্তানকে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসালয় এর চেয়ে বেশি বিবেচনা করে না কারণ এটি শুধুমাত্র কুষ্ঠ রোগীদের পৃথক করত।[৭১] খলিফা হারুন আল-রশিদের শাসনামলে প্রথম সত্য ইসলামি হাসপাতাল নির্মিত হয়েছিল।[৬৯] খলিফা প্রধান চিকিৎসক জিব্রিল ইবন বুখতিশুর পুত্রকে বাগদাদের নতুন বিমারিস্তানের প্রধান হিসেবে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এটি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করে এবং বাগদাদে অন্যান্য হাসপাতালকে উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করে।[৭২]
ইসলামি সভ্যতার সময় গড়ে ওঠা হাসপাতালগুলি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। বিমরিস্তানসমূহ ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। তাদের মাঝে জাতি, ধর্ম, নাগরিকত্ব, বা লিঙ্গ বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সমস্ত মানুষকে সেবা করছিল।[৬৯] ওয়াকফের নথিতে বলা হয়েছে যে, কাউকে কখনও ফিরিয়ে দেওয়া হত না।[৭০] সমস্ত চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল তাদের রোগীদের সুস্থতার জন্য একসাথে কাজ করা। একজন রোগীর রোগী হিসাবে থাকার কোনও সময়সীমা ছিল না;[৭১] ওয়াকফের নথিতে বলা হয়েছে যে রোগীদের সম্পূর্ণরূপে নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে রাখতে হবে। পুরুষদের এবং মহিলাদের পৃথক কিন্তু সমানভাবে সজ্জিত ওয়ার্ডে ভর্তি করা হত।[৬৯] পৃথক ওয়ার্ডগুলি আরও মানসিক রোগ, সংক্রামক রোগ, অ-সংক্রামক রোগ, সার্জারি, ঔষধ এবং চোখের রোগে বিভক্ত।[৭১] সম-লিঙ্গ নার্স আর কর্মীদের দ্বারা রোগীদের সেবা দেওয়া হত। প্রতিটি হাসপাতালে একটি বক্তৃতা হল, রান্নাঘর, ফার্মেসী, গ্রন্থাগার, মসজিদ এবং মাঝে মাঝে খ্রিস্টান রোগীদের জন্য একটি চ্যাপেল থাকত।[৭৩] বিনোদনমূলক উপকরণ এবং সঙ্গীতশিল্পীদের প্রায়ই রোগীদের সান্ত্বনা ও আনন্দিত করার জন্য নিযুক্ত করা হত।[৭০]
হাসপাতাল রোগীদের চিকিৎসার জন্য শুধু একটি জায়গা ছিল না: এটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করণ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি মেডিকেল স্কুল হিসাবেও কাজ করত। প্রাথমিক বিজ্ঞান প্রস্তুতি ব্যক্তিগত শিক্ষক, স্ব-অধ্যয়ন এবং বক্তৃতা মাধ্যমে শেখা হত। ইসলামি হাসপাতালে প্রথম রোগীদের লিখিত রেকর্ড এবং তাদের কি ধরনের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে তার রেকর্ড রাখা হচ্ছিল।[৭০] ছাত্ররা রেকর্ডগুলি রাখার জন্য দায়ী ছিল, পরবর্তীতে ডাক্তারদের দ্বারা সম্পাদিত এবং ভবিষ্যতে চিকিৎসার জন্য এসব ব্যবহার করা হত।[৭১]
এই যুগে, আব্বাসীয় খিলাফতে, চিকিৎসক লাইসেন্স বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে।[৭১] ৯৩১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আল-মুক্তাদির চিকিৎসকের ভুলের ফলে তার এক প্রজন্মের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তিনি অবিলম্বে তার মুহতসীব সিনান ইবন সাবিতকে নির্দেশ দেন যে, পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রতিরোধ করা উচিত।[৭১] এই সময় থেকে, লাইসেন্স পরীক্ষার প্রয়োজন ছিল এবং শুধুমাত্র যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকদের ঔষধ অনুশীলন করার অনুমতি দেওয়া হত।[৭৩]
একটি স্বাধীন, সুনির্দিষ্ট পেশা হিসাবে ফার্মেসি মুসলিম পণ্ডিতদের দ্বারা নবম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আল-বিরুণী বলেছেন যে "ফার্মেসি, ওষুধ থেকে স্বাধীন হয়ে ওঠে যেমন ভাষা, বাক্য পদবিন্যাস থেকে আলাদা, কবিতা, জ্ঞান থেকে এবং দর্শন, যুক্তি থেকে , কারণ এটি [ফার্মেসি] দাসের বদলে চিকিৎসার প্রতি একটি সাহায্য"। সবুর (মৃত্যু। ৮৬৯) ফার্মেসির প্রথম পাঠ্য লিখেছেন।[৭৪]
মধ্যযুগীয় সময়ে চিকিৎসকদের দ্বারা হিপোক্রেটিক চর্চাগুলি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, এর কারণ চর্চাগুলি বাস্তবতা ও সহজলভ্যতা।[৭৫] মহিলা রোগ সম্পর্কে আলোচনা করার সময় স্ত্রি রোগ বিজ্ঞান এবং ধাত্রীবিদ্যা এর ক্ষেত্রে হিপোক্র্যাটিক চর্চা সাধারণত মুসলিম চিকিৎসকদের দ্বারা উল্লেখ করা হয়। হিপোক্রেটিক লেখকগণ নারীর সাধারণ ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অঙ্গ এবং চলনধরনকে সম্পর্কযুক্ত করেছিলেন, যার কোনও প্রতিরূপ পুরুষের দেহে ছিল না।[৭৫]
হিপোক্র্যাটিকরা মহিলাদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির, যেমন সিজোফ্রেনিয়া, এর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভকে দোষারোপ করে।[৭৫] তারা গর্ভকে মহিলা দেহের অভ্যন্তরে একটি স্বাধীন প্রাণী বলে বর্ণনা করেছিল; এবং, যখন গর্ভাবস্থায় গর্ভ স্থির থাকে না, তখন তাদের ধারণা মতে গর্ভ যা আর্দ্রতা কামনা করে, যকৃত, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মতো আর্দ্র দেহের অঙ্গগুলিতে স্থানান্তরিত হয়।[৭৫] গর্ভের আন্দোলনটি বেশিরভাগ স্বাস্থ্যের অবস্থার কারণ বলে বিবেচিত হয়েছিল, বিশেষ করে ঋতুস্রাবে মহিলাদের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করা হয়েছিল।
ইসলামি প্রেক্ষাপটে নারীর দেহ ও তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক বিশ্বাস ধর্মীয় সাহিত্যে পাওয়া যেতে পারে যা "নবীর ঔষধ" নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে পুরুষরা যেন ঋতুস্রাবের সময় মহিলাদের থেকে দূরে থাকে, "এই রক্ত দূষিত", এবং প্রকৃতপক্ষে যাদের গায়ে এটি লাগে তাদের ক্ষতি হয়।[৭৬] মহিলা স্বাস্থ্য এবং বিশেষত বাচ্চা জন্মদান উত্সাহিত করার জন্য সঠিক ডায়েটের সাথে সর্বাধিক পরামর্শ দেওয়া হত। উদাহরণস্বরূপ: কুইন্স একটি মহিলার হৃদয় নরম এবং ভাল করে তোলে; ধূমপানের ফলে নারী পুরুষকে জন্ম দেবে; গর্ভবতী অবস্থায় তরমুজ ব্যবহারের ফলে শিশুটি ভাল চরিত্রের হতে পারে; সন্তানের জন্মকে উত্সাহিত করার জন্য এবং পরবর্তীতে মহিলাটির স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য সন্তান জন্মের আগে খেজুর খাওয়া উচিত; পার্সলি এবং খেজুর গাছের ফল যৌন মিলনকে উদ্দীপিত করে; শতমূলী শ্রম ব্যথা সহজ করে তোলে; এবং গরুর মাংস খাওয়ানো মহিলাদের মধ্যে স্তন্যদান বৃদ্ধি করে।[৭৭] ধর্মীয়ভাবে উল্লেখযোগ্য কার্যকলাপ হিসাবে দেখা হওয়ার পাশাপাশি, পুরুষ এবং মহিলাদের উভয় ক্ষেত্রে যৌন কার্যকলাপের সংযম স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয়। যাইহোক, সন্তানের জন্মের সাথে যুক্ত ব্যথা ও চিকিৎসা ঝুঁকি এতটাই সম্মানিত ছিল যে জন্ম দেওয়ার সময় যে মহিলারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের শহীদ হিসাবে দেখা হয়।[৭৮] আল্লাহর কাছে দোয়া এবং নামাজের ব্যবহার নারীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি অংশ ছিল, সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য একজন ক্রীতদাসীর ব্যাপারে মুহাম্মাদের মত, যার খোঁচা শরীরটি তিনি বদনজর এর দ্বারা হয়েছিল বলে মনে করেছিলেন। তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন যে এমন বদনজর থেকে বাঁচার জন্য নির্দিষ্ট দোয়া করা উচিত।[৭৯]
লেখা হয়েছে যে পিতামাতা এবং স্বামী হিসাবে পুরুষ অভিভাবকরা তাদের স্ত্রী বা কন্যাদের পুরুষ অনুশীলনকারীদের দ্বারা পরীক্ষণ করার অনুমতি ততক্ষণ পর্যন্ত দিতেন না, যতক্ষন না মৃত্যুর মতো পরিস্থিতি তৈরি হত।[৮০] গোপনীয়তার জন্য পুরুষরা তাদের মহিলাদের নিজেই দেখে নিতেন বা মহিলা ডাক্তারদের দিয়ে দেখিয়ে নিতেন।[৮০] নারীগণও একইভাবে অনুভব করেছিলেন; যেমন গর্ভাবস্থা এবং সন্তানের জন্ম এবং বুকের দুধ খাওয়ানো সহ প্রক্রিয়াগুলি, যা অন্য মহিলাদের দ্বারা দেওয়া উপদেশের উপর নির্ভরশীল ছিল।[৮০] চিকিৎসা ক্ষেত্রের মধ্যে পুরুষ কর্তৃত্ব সত্ত্বেও প্র্যাকটিশনার হিসাবে মহিলাদের ভূমিকা বেশ কয়েকটি কাজে উপস্থিত হয়। ইবন যুহ্রের পরিবারের দুই মহিলা চিকিৎসক ১২ তম শতাব্দীতে আলমোহাদ শাসক আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল-মনসুরকে সেবা করেছিলেন।[৮১] পরে ১৫ শতাব্দীতে, শারাফুউদ্দিন সাবুনচুয়োগ্লু এর সিরাহিয়াইয়েতুল-হানিইয়্য (ইম্পেরিয়াল সার্জারি) - এ প্রথমবারের মতো মহিলা সার্জনদের চিত্রিত করা হয়।[৮২] পুরুষদের দ্বারা নারীদের প্রদত্ত চিকিৎসাটি নবীজীর ওষুধ (তিব্ব আল-নাবাউই) দ্বারা অন্যায্য, অন্যথায় "নবীর ঔষধ" (তিব্ব আল-নবী) নামে পরিচিত, যা যুক্তি দিয়েছিল যে পুরুষরা নারীকে এবং নারী পুরুষকে, এমনকি যদি দরকার পড়ে তবে প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে রোগীর গোপনীয়তা প্রকাশ করারও অনুমতি রয়েছে।[৮০]
মহিলা ডাক্তার, ধাত্রী এবং ভিজা নার্সের কথা সব সময়কালের ইসলামি সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে।[৮৩]
জুন্দিশাহপুরে একটি হাসপাতাল ও চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। জুন্দিশাহপুর শহরটি শাহরিয়ার রাজা প্রথম শাপুর ২৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত করে। এটি ফার্সি সাম্রাজ্যের, যা আজ ইরান, তার খুযেস্তান প্রদেশের অন্যতম প্রধান শহর। জনসংখ্যার একটি বড় শতাংশ ছিল সিরিয়াক, যাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান ছিল। প্রথম খসরু এর শাসনামলে গ্রিক নেস্তোরিয়ান খ্রিস্টান দার্শনিকদের এডেসা (উরফা) এর ফার্সি স্কুল (এছাড়াও এথেন্সের একাডেমী বলা হয়), যা একটি খ্রিস্টান ধর্মীয় ও চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়, এর পণ্ডিতদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। সম্রাট জাস্টিনিয়ান কর্তৃক একাডেমি বন্ধ করার পর এই পণ্ডিতরা ৫২৯ সালে জুন্দিশাহপুর যাত্রা করেন। তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানে জড়িত ছিলেন এবং চিকিৎসা পাঠ্যের প্রথম অনুবাদ প্রকল্প শুরু করেছিলেন।[৮৪] এডেসার এই মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার আগমনের ফলে জুন্দিশাহপুরের হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রের শুরুকে চিহ্নিত করে।[৮৫] এটি একটি মেডিকেল স্কুল এবং হাসপাতাল (বিমারিস্থান), একটি ফার্মাকোলজি ল্যাবরেটরি, একটি অনুবাদ ঘর, একটি গ্রন্থাগার এবং একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণাগার।[৮৬] ভারতীয় ডাক্তাররাও জুন্দিশাহপুর শিক্ষালয়ে অবদান রাখেন, বিশেষত চিকিৎসা গবেষক মানকাহ। ইসলামিক আক্রমণের পরে, মানকাহ ও ভারতীয় চিকিৎসক সুস্তুরার লেখাগুলি বাগদাদে আরবিতে অনুবাদ করা হয়।[৮৭] দাউদ আল-আনতাকী প্রভাবশালী আরব খৃস্টান লেখকদের শেষ প্রজন্মের একজন।
ইসলামের নতুন চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির প্রতি গ্রহণযোগ্যতা চিকিৎসাকে বিশাল ভাবে উন্নিত করতে সহায়তা করে, প্রাচীন চিন্তাধারা ও কৌশল যুক্তকরণ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও তদসম্পর্কিত প্রতিস্থানের ব্যাপক উন্নয়ন, অস্ত্রোপচার ও মানবদেহ এর বুঝ এর ক্ষেত্রসমূহে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলিমরা সেরা কাজ করে। যদিও অবশ্য, অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত এখনও ইসলামি প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করেননি (তারা রোমান ও গ্রিক প্রভাব এর প্রতি অন্ধ)।[৫৬]
হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের মাধ্যমে, প্রাচীন ইসলামি চিকিৎসকগণ রোগীদের নিরাময়ের জন্য আরও স্বতন্ত্র ক্রিয়াকলাপ সরবরাহ করতে সক্ষম হন,যেমন চক্ষু চিকিৎসায়। এটি চিকিৎসাকে বৃহদিত করতে সহায়তা করে এবং ভবিষ্যতের উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
দুই প্রধান মুসলিম দার্শনিক ও চিকিৎসক, আল-রাযী ও ইবনে সিনার অবদান মুসলিম চিকিৎসার উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা জ্ঞান সংকলনের মাধ্যমে তাদের কাজ ইসলামি সংস্কৃতিতে চিকিৎসা জ্ঞান পরিশ্রুতকরণের উপর প্রভাব ফেলে।
উপরন্তু, এই সময়ে কিছু সেরা মানের মুসলিম নারী ছিলেন, যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এদের মধ্যে আছেনঃ ডাক্তার, চিকিৎসক, শল্যচিকিৎসাবিদ, দুধমাতা ও ধাত্রী।
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)
|তারিখ=
(সাহায্য)