মধ্যযুগীয় প্রযুক্তি বলতে খ্রিস্টীয় শাসনাধীন মধ্যযুগীয় ইউরোপে ব্যবহৃত প্রযুক্তিকে বোঝায়। দ্বাদশ শতাব্দীর রেনেসাঁর পরে, মধ্যযুগীয় ইউরোপ নতুন উদ্ভাবনের হার, উৎপাদনের ঐতিহ্যগত উপায়গুলি পরিচালনার উপায়ে উদ্ভাবন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি আমূল পরিবর্তন দেখেছিল।[২] এই সময়কালে বারুদ গ্রহণ, উল্লম্ব বায়ুকল, চশমা, যান্ত্রিক ঘড়ি, উন্নত পানিকল, নির্মান কৌশল (গথিক স্থাপত্য, মধ্যযুগীয় দুর্গ), এবং কৃষিতে (তিন-ক্ষেত্র ফসল আবর্তন) সহ বড় ধরণের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দেখা যায়।
পানিকলের উন্নয়ন এই অগ্রগতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। প্রাচীনকাল থেকেই পানিকল ব্যবহার করা হতো, কিন্তু মধ্যযুগে এর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে কাঠ ও পাথর কাটার কারখানায় পর্যন্ত, পানিকল বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হত। ইংল্যান্ডে, ডুমসডে বইয়ের সময়কালে, বেশিরভাগ বড় গ্রামেই ঘূর্ণায়মান পানিকল ছিল।[৩] খনন কাজেও পানিশক্তি ব্যবহার করা হতো।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে (১২শ থেকে ১৪শ শতাব্দী) প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটে। এই অগ্রগতির মূলে ছিল দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যা রোমান ও বাইজেন্টাইন সভ্যতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। এছাড়াও, ইসলামি বিশ্ব, চীন ও ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করে। উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলেও, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগই ছিল মধ্যযুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বারুদের উদ্ভাবন চীনাদের হলেও, ইউরোপীয়রাই এর সামরিক ব্যবহারের সম্ভাবনা পুরোপুরি বিকশিত করে। এর ফলে আধুনিক যুগে ইউরোপের বিস্তার এবং ঔপনিবেশিকতার সূচনা হয়।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের (১২শ থেকে ১৪শ শতাব্দী) প্রযুক্তিগত অগ্রগতি কেবল স্থলভাগেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সমুদ্রেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জাহাজ নির্মাণ কৌশলের উন্নয়ন, নতুন নৌ-চালনা কৌশল আবিষ্কার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান মধ্যযুগীয় ইউরোপকে সমুদ্রের অধিপতি হতে সাহায্য করে। জাহাজ নির্মাণ কৌশলে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়। বহু-পাল বিশিষ্ট জাহাজ, ল্যাটিন পাল, জাহাজের পেছনের দিকে রাডার বসানো এবং কঙ্কাল-ভিত্তিক হাল তৈরির কৌশল জাহাজগুলোকে আরও দ্রুত, স্থিতিশীল এবং দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত করে তোলে। নতুন নৌ-চালনা কৌশল আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে শুকনো কম্পাস, জ্যাকবের ছড়ি এবং অ্যাস্ট্রোলেব। এই সরঞ্জামগুলো জাহাজীদের দিক নির্ণয় এবং অবস্থান নির্ধারণে সহায়তা করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদান-প্রদান মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামুদ্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলামি বিশ্ব, চীন এবং ভারতের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা নতুন নতুন নৌ-চালনা কৌশল এবং জাহাজ নির্মাণের কৌশল সম্পর্কে জানতে পারে। মধ্যযুগীয় ইউরোপের সামুদ্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে ইউরোপীয়রা আশেপাশের সমুদ্র এলাকার অর্থনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। পাশাপাশি এই অগ্রগতি অনুসন্ধান যুগের (Age of Exploration) সূচনা করে এবং জলপথে বিশ্ব আবিষ্কারের দিকে পরিচালিত করে।
রেনেসাঁর (১৪শ-১৬শ শতাব্দী) সূচনালগ্নে জ্ঞানের প্রসারে গুটেনবার্গের যান্ত্রিক ছাপাখানার আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান সীমিত সংখ্যক পণ্ডিতের মধ্যে আবদ্ধ থাকার পরিবর্তে ব্যাপক জনগণের কাছে পৌঁছাতে শুরু করে। যান্ত্রিক ছাপাখানার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এটি শিক্ষার ধরন ও প্রসারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। বইমুদ্রণের সহজলভ্যতা জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি করে এবং সমাজে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মধ্যযুগের শেষভাগের শিল্পী-প্রকৌশলী গুইডো দা ভিগেভানো এবং ভিলার্ড দি হনেকোর্টের কারিগরি অঙ্কন তাকোলা, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো রেনেসাঁর শিল্পী-প্রকৌশলীদের কাজের পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের কাজে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের প্রয়োগ এবং নকশার নির্ভুলতা রেনেসাঁর যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রেনেসাঁর জ্ঞানের প্রসার কেবল সমাজের কাঠামো পরিবর্তন করে না, বরং ইউরোপীয়দের অন্যান্য সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতেও সাহায্য করে। বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার এবং অভিজ্ঞতার সাহায্যে ইউরোপীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
নিচে মধ্যযুগীয় সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রযুক্তির তালিকা দেওয়া হলো। ইউরোপে প্রথম উল্লেখ বা ব্যবহারের আনুমানিক তারিখসহ এগুলো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, অনেক ক্ষেত্রেই বহু-সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে এই প্রযুক্তিগুলোর আদান-প্রদান হয়েছে। তাই সর্বপ্রথম কোথায় আবিষ্কৃত হয়েছিল তা এখানে তালিকাভুক্ত করা হয়নি (প্রতিটি বিষয়ের মূল লিঙ্কগুলোতে আরও বিস্তারিত ইতিহাস পাওয়া যাবে)।
[৪]ক্যারুকা (Carruca ) (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতাব্দী)
এটি উত্তর ইউরোপে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত এক ধরনের ভারী চাকাযুক্ত হাল।[৫] এই যন্ত্রটি চারটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত। প্রথম অংশটি হালের নীচের দিকে থাকা একটি 'কোল্টার'।[৬] এই ছুরির মতো অংশটিকে উল্লম্বভাবে মাটি কাটার জন্য ব্যবহার করা হত, যাতে পরবর্তীতে লাঙ্গলশলাকা (plowshare) কাজ করতে পারে।[৭] দ্বিতীয় অংশ ছিল লাঙ্গলশলাকা যা অনুভূমিকভাবে মাটি কেটে নিচের অংশকে আলাদা করে দিত।[৮] তৃতীয় অংশটি ছিল 'মোল্ডবোর্ড', যা মাটিকে বাইরের দিকে ঘুরিয়ে দিত।[৯] আর চতুর্থ অংশটি ছিল আটটি ষাঁড়ের দল, যা কৃষক দ্বারা পরিচালিত হতো।[১০] এই ধরনের লাঙ্গল মাটিকে শুধুমাত্র বাইরের দিকে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে আস্ত একটি আবরণকে উল্টে দিতে পারতো, ফলে ক্রস-লাঙ্গল করার প্রয়োজনীয়তা থাকতো না।[১১] চাকার উপর নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট গভীরতা নির্ধারণ করে দেওয়া যেত, যার ফলে সারা জমি জুড়ে বীজ স্থাপন আরও সুষম হত। এই ধরণের হালের একটি অসুবিধা ছিল এর তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। যেহেতু এই সরঞ্জামটি বড় ছিল এবং ষাঁড়ের দল দ্বারা চালিত হত, হালটিকে ঘোরানো কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ছিল। এই কারণে অনেক কৃষক প্রথাগত বর্গাকার ক্ষেত ত্যাগ করে দীর্ঘতর, আয়তাকার ক্ষেত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যাতে সর্বাধিক কর্মদক্ষতা নিশ্চিত করা যায়।[১২]
[১৩]আর্ড (লাঙ্গল) (৫ম শতাব্দী)
প্রাচীনকাল থেকেই লাঙ্গল ব্যবহার করা হলেও, মধ্যযুগে লাঙ্গলের প্রযুক্তিতে দ্রুত উন্নতি ঘটে।[১৪] মধ্যযুগীয় লাঙ্গল, কাঠের মোটা তক্তা দিয়ে তৈরি হত এবং মানুষ বা ষাঁড়ের দলের কাঠামোতে (yoke) যুক্ত করে যেকোনো ধরণের জমিতে চাষের জন্য টেনে নেওয়া যেত। এর ফলে উত্তর ইউরোপের বনাঞ্চলগুলো, যেখানকার মাটিতে পাথর ও ঘন জমাটবদ্ধ গাছের শিকড় ছিল, দ্রুত কৃষিকাজের উপযোগী করে তোলার পথ সুগম হয়।[১৫] খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে আরও বেশি মানুষ এই অঞ্চলগুলোতে বসবাস করতে সক্ষম হয়।
ঘোড়ার জোয়াল (Horse Collar) (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতাব্দী)[১৬]
মধ্যযুগে (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শতাব্দী) কৃষিকাজে ষাঁড়ের পরিবর্তে ঘোড়ার ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ষাঁড়ের জন্য তৈরি 'জোয়াল' (yoke) ঘোড়ার গঠনের সাথে মানানসই ছিল না। ফলে ঐতিহ্যবাহী 'জোয়াল' ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। ঘোড়ার জন্য বিশেষ জোয়ালের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।[১৭] প্রথম দিকে 'গলায় ও বুকে দড়ি দিয়ে বাঁধা' (throat-and-girth-harness) জোয়াল ব্যবহার করা হত।[১৮] কিন্তু এই জোয়াল নির্ভরযোগ্য ছিল না।[১৯] কাজের সময় দড়ি সরে যেত এবং ঘোড়ার দম বন্ধ হয়ে যেত।[২০] অষ্টম শতাব্দীর দিকে 'অনমনীয় গলার অঙ্গ' (rigid collar) আবিষ্কার হয়।[২১] এই জোয়াল ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে পরিয়ে ঘাড়ের উপর স্থাপন করা হত।[২২] এটি ঘোড়াকে শ্বাস নিতে কোন প্রকার বাধা দিত না এবং ভারী আকর্ষণ যেমন হাল টানা বা গাড়ি টানার সময় চাপটি এমন স্থানে প্রয়োগ করত যেখানে ঘোড়া সবচেয়ে ভালভাবে তা বহন করতে পারে।[২৩]
ঘোড়ার খুর রক্ষাকবচ (Horseshoe) (৯ম শতাব্দী)
ঘোড়া খুরের সুরক্ষার জন্য নাল ব্যবহারের ইতিহাস বেশ পুরনো। যদিও ঘোড়া খুরের কোন প্রকার আবরণ ছাড়াই বিভিন্ন ভূখণ্ডে চলাচল করতে পারে, তবুও নাল ব্যবহারের ফলে ঘোড়া কঠিন ও অসমতল পথে দ্রুত চলাচল করতে পারে।[২৪] রোমান সাম্রাজ্যে প্রথম ঘোড়ার খুরে নাল ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু মধ্যযুগে এর জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং একাদশ শতাব্দীতে এসে ফের নাল ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।[২৫] দক্ষিণের নরম মাটিতে ঘোড়া সহজেই কাজ করতে পারলেও, উত্তরের পাথুরে ভূমি ঘোড়ার খুরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছিল।[২৬] যেহেতু উত্তরাঞ্চলের পথ সমস্যাগ্রস্ত ছিল, সেখানেই প্রথম ঘোড়ার নাল বহুল প্রচলিত হয়।[২৭] নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তা তৈরির পর নাল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পায়।[২৮] নালযুক্ত ঘোড়া এই রাস্তায় নাল ছাড়া ঘোড়ার তুলনায় অনেক বেশি ভার বহন করতে পারত।[২৯] চতুর্দশ শতাব্দীতে কেবলমাত্র ঘোড়া নয়, অনেক কৃষক খুরের আয়ু বাড়াতে ষাঁড় এবং গাধার খুরেও নাল লাগাতে শুরু করেন।[৩০] মধ্যযুগে ঘোড়ার নালের আকার ও ওজন ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।[৩১] দশম শতাব্দীতে ছয়টি পেরেক দিয়ে নালগুলিকে খুরে আটকানো হত এবং সেগুলোর ওজন ছিল প্রায় এক পাউন্ডের এক চতুর্থাংশ। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নালের আকার বৃদ্ধি পায়। চতুর্দশ শতাব্দী নাগাদ এগুলিকে আটটি পেরেক দিয়ে লাগানো হত এবং ওজন হতো প্রায় অর্ধ পাউন্ড।[৩২]
দুই-ক্ষেত্র পদ্ধতি
ফসল আবর্তনের এই সরল পদ্ধতিতে, একটি জমিতে ফসল ফলানো হতো এবং অন্য জমিটিকে অনাবাদী (উদ্ভিদহীন) রাখা হতো। দ্বিতীয় জমিটি গবাদিপশুর বিষ্ঠা দিয়ে সার প্রয়োগের মাধ্যমে চাষের সময় হারানো পুষ্টিগুণ পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যবহৃত হতো।[৩৩] জমির যাতে পুষ্টিগুণের ঘাটতি না হয় সেজন্য প্রতি বছর দুটি জমির ব্যবহার পরিবর্তন করা হতো।[৩৪] একাদশ শতাব্দীতে এই পদ্ধতিটি সুইডেনে চালু হয় এবং পরবর্তীতে কৃষিকাজের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিতে পরিণত হয়।[৩৫] বর্তমান সময়েও অনেক কৃষক এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন, এক বছর জমিতে ভুট্টা চাষ করেন এবং পরের বছর সেই জমিতে শিম জাতীয় শস্য চাষ করেন।[৩৬]
তিন-ক্ষেত্র পদ্ধতি (অষ্টম শতাব্দী)
মধ্যযুগীয় কৃষকরা দুই-ক্ষেত্র পদ্ধতি ব্যবহার করলেও, এর পাশাপাশি আরও একটি ভিন্ন পদ্ধতি তৈরি হয়। তিন-ক্ষেত্র পদ্ধতিতে, একটি জমিতে বসন্তকালীন ফসল যেমন যব বা ওট বপন হত, দ্বিতীয় জমিতে শীতকালীন ফসল যেমন গম বা রাই বপন করা হত এবং তৃতীয় জমিটিকে অনাবাদী রাখা হতো যা পরবর্তীতে পশুদের খাদ্য সরবরাহ করত।[৩৭] প্রতি বছরের পর তিনটি জমির চাষের ধরন পরিবর্তন করা হত। এর ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত।[৩৮] তিন-ক্ষেত্র পদ্ধতি দুই-ক্ষেত্র পদ্ধতির থেকে বেশি কার্যকর কারণ এক্ষেত্রে এখানে মাত্র জমির তিন ভাগের এক ভাগ অনাবাদী রাখা হয় অর্ধেক জমির পরিবর্তে।[৩৯] বহু গবেষক বিশ্বাস করেন যে এই পদ্ধতিতে শস্যের উৎপাদন প্রায় ৫০% বাড়ানো গিয়েছিল।[৪০]
ওয়াইন প্রেস (দ্বাদশ শতাব্দী)
মধ্যযুগে ওয়াইন প্রেস ক্রমশ উন্নত হয়ে আরও আধুনিক ও কার্যকরী যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। এই যন্ত্র ব্যবহারে ওয়াইন উৎপাদকরা কম পরিশ্রমে বেশি ওয়াইন উৎপাদন করতে পারতেন।[৪১] সমতল পৃষ্ঠে ওয়াইন সংগ্রহের জন্য এটি ছিল প্রথম ব্যবহারিক যন্ত্র।[৪২] ওয়াইন প্রেস ছিল একটি বিশাল কাঠের ঝুড়ি, যা কাঠের বা ধাতুর বন্ধনী দিয়ে শক্তভাবে আবদ্ধ থাকত। ঝুড়ির উপরে থাকত একটি বড় চাকতি। চাকতি নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করে ঝুড়ির মধ্যে থাকা আঙুরগুলোকে পিষে রস বের করত। এই রসই পরবর্তীতে ওয়াইন তৈরিতে ব্যবহার করা হত।[৪৩]
ওয়াইন প্রেস ছিল বেশ ব্যয়বহুল যন্ত্র। তাই শুধুমাত্র ধনী ব্যক্তিরাই এটি কিনতে পারতেন। অনেকেই কম খরচে 'পা দিয়ে মাড়ানো' পদ্ধতি ব্যবহার করতেন।[৪৪] হোয়াইট ওয়াইন তৈরিতে আঙুরের রঙ ধরে রাখার জন্য দ্রুত রস বের করা জরুরি। তাই এই ক্ষেত্রে ওয়াইন প্রেস ব্যবহার অপরিহার্য ছিল।[৪৫] অন্যদিকে, রঙিন ওয়াইনের ক্ষেত্রে রঙের গুরুত্ব কম। তাই প্রথমে পা দিয়ে মাড়িয়ে আঙুরের রস বের করা হত। এরপর অবশিষ্ট রস বের করার জন্য ওয়াইন প্রেস ব্যবহার করা হত।[৪৬]
কানাত (পানি প্রণালী) এবং পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি (পঞ্চম শতাব্দী)
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানি অপরিহার্য। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সভ্যতা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ এবং দৈনন্দিন কাজের জন্য পানির উপর নির্ভরশীল ছিল। 'কানাত' বা 'কারিজ' নামক ভূগর্ভস্থ পানি প্রণালী তাদের পানির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৪৭] কানাত হলো ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ যা পানির উৎস (যেমন ভূগর্ভস্থ পানিস্তর বা নদী) থেকে গ্রাম বা শহরে পানি সরবরাহ করে। সুড়ঙ্গগুলো এতটাই প্রশস্ত যে একজন খননকারী সহজেই প্রবেশ করে পানির উৎস খুঁজে বের করতে পারে। পানি স্বাভাবিকভাবে ঢালু দিকে প্রবাহিত হয় এবং সেচ ও খাবার পানির জন্য ব্যবহার করা হয়।[৪৮] মধ্যপ্রাচ্যে 'কানাত' ব্যবস্থার প্রচলন ছিল এবং আজও এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় যেখানে পানির উৎস সহজলভ্য নয়।[৪৯] 'কানাত' ব্যবস্থার একটি বড় সুবিধা হলো পানির অপচয় কম হয়। রোমান সাম্রাজ্যের 'একুয়াডাক্ট' ছিল উন্নত পানি প্রণালী, যা 'কানাত' ব্যবস্থার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। মধ্যযুগের প্রকৌশলীরা গ্রামগুলোতে দ্রুত ও সহজে পানি সরবরাহের জন্য 'একুয়াডাক্ট' ব্যবস্থাকে 'ব্লুপ্রিন্ট' হিসেবে ব্যবহার করত। 'কানাত' ও 'একুয়াডাক্ট' ব্যবস্থার আবিষ্কারের পর পানিবাহী বিভিন্ন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটে। মধ্যযুগে পানিকল, বাঁধ, কূপ ইত্যাদি পানির সহজ ব্যবহার নিশ্চিত করে।[৫০]
পেন্ডেন্টিভ স্থাপত্য (৬ষ্ঠ শতাব্দী)
গম্বুজকে অবলম্বন (support) প্রদানের জন্য বিশেষায়িত গোলাকার কাঠামো। তৃতীয় শতাব্দীতে এ সম্বন্ধে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হলেও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ষষ্ঠ শতাব্দীতে এসে এর পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর্টিসিয়ান কূপ (১১২৬)
ভূগর্ভস্থ পানির চাপকে কাজে লাগিয়ে কোন পাম্প ব্যবহার ছাড়াই পানি তোলার এক ধরনের কূপ। লোহার শক্ত ধারযুক্ত সরু দণ্ডকে খননকৃত গর্তের ভিতর স্থাপন করা হয় এবং হাতুড়ি দিয়ে বারবার আঘাত করলে ভূগর্ভস্থ পানির চাপে পানি গর্ত দিয়ে ওপরে উঠে আসে। ফ্রান্সের আর্টোইস (Artois) শহরে যেখানে প্রথম ১১২৬ সালে কার্থুসিয়ান সন্ন্যাসীরা এই কূপ খনন করেন, তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।
ভূগর্ভস্থ তাপ প্রণালী (৯ম শতাব্দী)
মধ্যযুগের প্রথম দিকে আল্পস পর্বতমালার উচ্চভূমি অঞ্চলে রোমানদের 'হাইপোকস্ট' পদ্ধতির পরিবর্তে চুল্লি থেকে ভূগর্ভস্থনালীর মাধ্যমে তাপ বণ্টনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় তাপ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। রাইখেনাউ অ্যাবি-তে পরস্পর যুক্ত তাপ প্রণালীর মাধ্যমে শীতের মাসগুলোতে এক বিশাল ৩০০ বর্গমিটার সমাবেশে কক্ষ গরম রাখার ব্যবস্থা করা হতো। এই পদ্ধতির কর্মক্ষমতা প্রায় ৯০% বলে হিসাব করা হয়েছে।[৫১]
রিব ভল্ট (১২শ শতাব্দী)
গথিক স্থাপত্যশৈলীর উত্থানের জন্য অপরিহার্য রিব ভল্টের ব্যবহার বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের আয়তক্ষেত্রাকার কাঠামোর ওপর প্রথমবার ভল্ট নির্মাণের পথ সুগম করে। এই নির্মাণ কাঠামোতে পূর্ববর্তী 'গ্রইন ভল্ট' প্রতিস্থাপিত হয়।
চিমনি (১২শ শতাব্দী)
৮২০ সালে সুইজারল্যান্ডের একটি মনাস্ট্রিতে প্রাথমিক ধরনের প্রথম চিমনির আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু অগ্নিকুণ্ড (fireplace) সহ আধুনিক ধাঁচের চিমনি আবিষ্কারের জন্য ১২শ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।[৫২]
সেগমেন্টাল আর্চ ব্রিজ (১৩৪৫)
ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের পন্তে ভেক্কিও সেতুকে শাস্ত্রীয় সভ্যতার অবসানের পর ইউরোপের প্রথম পাথরের তৈরি সেগমেন্টাল আর্চ ব্রিজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ট্রেডহুইল ক্রেন (১২২০ এর দশক)
ট্রেডহুইল ক্রেন ব্যবহারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১২২৫ সালে ফ্রান্সে।[৫৩] এরপর ১২৪০ সালে ফ্রান্সের একটি পান্ডুলিপিতে এর চিত্র পাওয়া যায়।[৫৪] ট্রেড-ড্রাম ছাড়াও ক্রেন চালানোর জন্য উইন্ডলাস এবং ক্র্যাঙ্ক ব্যবহার করা হত।[৫৫]
স্থায়ী বন্দর ক্রেন (১২৪৪)
স্থায়ী বন্দর ক্রেন মধ্যযুগের একটি উদ্ভাবন। ১২৪৪ সালে নেদারল্যান্ডসের উট্রেচ-এ এর প্রথম ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।[৫৬] সাধারণত বন্দরে যে ক্রেন ব্যবহৃত হতো তা কেন্দ্রীয় অক্ষের উপর ঘুরতে সক্ষম কাঠামো এবং দুটি ট্রেডহুইল দিয়ে সজ্জিত ছিল।[৫৭] দুই প্রকারের ক্রেন ছিল: কাঠের গ্যান্ট্রি ক্রেন এবং পাথরের টাওয়ার ক্রেন। এই ক্রেনগুলো পণ্য উঠানো ও নামানোর জন্য ব্যবহৃত হত।[৫৮] ১৩৪০ সালের দিকে Slewing ক্রেন ব্যবহার শুরু হয়।[৫৯]
চতুর্দশ শতাব্দীতে ভাসমান ক্রেন ব্যবহারে আসে। এগুলো পুরো বন্দর এলাকায় ব্যবহার করা যেত।[৬০][৬১]
ক্রেন জাহাজ, ক্রেন বার্জ বা ভাসমান ক্রেন হলো বিশেষ ধরনের জাহাজ যাতে ভারী বোঝা উত্তোলনের জন্য বিশেষায়িত ক্রেন থাকে। সাধারণত আধুনিক জাহাজগুলো ১,৫০০ টনেরও (১,৪৭৬ লং টন; ১,৬৫৩ শর্ট টন) বেশি ওজন তুলতে সক্ষম। বৃহত্তম ক্রেন জাহাজগুলি সামুদ্রিক নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত হয়। এই বিশেষ ক্রেনগুলি সাধারণত একক হালের জাহাজ (monohull) ও বার্জে লাগানো হয়। তবে, বৃহত্তর ক্রেন জাহাজগুলি প্রায়শই ক্যাটামারান বা আধা-নিমজ্জিত (semi-submersible) ধরনের হয় যেগুলো জাহাজটিকে উন্নত স্থিতিশীলতা এবং কম নড়াচড়া নিশ্চিত করে। অনেক ক্রেন জাহাজে এক বা একাধিক ঘূর্ণনক্ষম ক্রেন লাগানো থাকে। বৃহত্তম ক্রেন জাহাজগুলোর কিছুতে স্থায়ী শিয়ারলেগ (sheerleg) ব্যবহার করা হয়; এই নকশায় ক্রেনটি জাহাজের তুলনায় ঘুরতে পারে না এবং মালামাল রাখার জন্য পুরো জাহাজটিকেই কৌশলে সরাতে হয়। কিছু জাহাজে বড় গ্যান্ট্রি ক্রেন (gantry crane) ব্যবহার করা হয় যেগুলো বোঝার উপর দিয়ে অবস্থান করে।
গডাঙ্কস্ক, কোলোন এবং ব্রেমেনের মতো বন্দরে নতুন নির্মিত জাহাজে মাস্তুল (mast) সংযোজনের জন্য বিশেষায়িত ক্রেন ব্যবহৃত হতো।[৬২]
[৬৩]চাকার গাড়ি (১১৭০ এর দশক)
হুইলব্যারো নির্মাণ কাজ, খনির কাজ এবং কৃষিকাজে কার্যকর প্রমাণিত হয়। ১১৭০ এবং ১২৫০ সালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে হুইলব্যারো ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর প্রাচীনতম চিত্র পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ম্যাথু প্যারিসের একটি অঙ্কনে। চাকার-ঠেলাগাড়ি হল এক ধরনের হাতে চালিত ছোট যান, যাতে সাধারণত একটি মাত্র চাকা থাকে। একজন ব্যক্তি পেছনের দুটি হাতল দিয়ে একে ঠেলে নিয়ে যান। "চাকার-ঠেলাগাড়ি" (wheelbarrow) শব্দটির দুটি অংশ রয়েছে: "চাকা" (wheel) এবং "barrow"। ‘Barrow’ শব্দটি প্রাচীন ইংরেজি ‘barew’ থেকে এসেছে, যেটি মাল বহনের জন্য ব্যবহৃত হত। চাকার-ঠেলাগাড়ি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, বহন করা মালের ওজন চাকা এবং ব্যবহারকারীর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ফলে, ব্যবহারকারী একাই বহন করলে যত ওজন নিতে পারতেন, তার চেয়ে অনেক ভারী ও বড় মাল বহন করা সহজ হয়। এ কারণে এটিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার হিসেবে ধরা হয়। যদিও প্রথাগত চীনা ঠেলাগাড়িতে মাঝখানে একটি চাকা থাকত যা পুরো বোঝা বহন করত। নির্মাণ শিল্পে এবং বাগানের কাজে চাকার-ঠেলাগাড়ির ব্যবহার খুবই সাধারণ। সাধারণত একটি ঠেলাগাড়িতে প্রায় ১০০ লিটার (৩.৫৩ ঘনফুট) পদার্থ বহন করা যায়। দুই চাকার ঠেলাগাড়ি সমতল জমিতে বেশি স্থিতিশীল হয়, অন্যদিকে প্রায় সব জায়গায় ব্যবহৃত এক-চাকার ঠেলাগাড়ি ছোট জায়গায়, কাঠের তক্তায়, পানিতে বা অসমতল জমিতে সহজে চালানো যায় যেখানে একটু হেলানোতেই ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।এক চাকা থাকার কারণে গাড়ির মাল খালি করার সময় নিয়ন্ত্রণ করাটাও অনেক সুবিধাজনক হয়।
তৈল রঙের ইতিহাস
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে 'টেম্পেরা পেইন্টিং' -এ বিস্তারিত বর্ণনা যোগ করতে এবং কাঠের মূর্তি আঁকতে তৈল রঙ ব্যবহার করা হত। তবে তখনকার তৈল রঙের মিশ্রণ দীর্ঘস্থায়ী ছিল না এবং সহজেই নষ্ট হয়ে যেত। ফ্লেমিশ চিত্রশিল্পী 'ইয়ান ভ্যান আইক' ১৪১০ সালের দিকে তৈল রঙের একটি উন্নত ও স্থিতিশীল মিশ্রণ আবিষ্কার করেন। এই মিশ্রণ দীর্ঘস্থায়ী ছিল এবং চিত্রকর্মকে উজ্জ্বল ও স্পষ্ট রঙ প্রদান করত। ইয়ান ভ্যান আইকের তৈল রঙের মিশ্রণ আবিষ্কার চিত্রকলার জগতে বিপ্লব ঘটায়। এর ফলে চিত্রশিল্পীরা আরও জীবন্ত ও বাস্তবসম্মত চিত্রকর্ম তৈরি করতে সক্ষম হন।[৬৪]
তেল রঙ হলো এক ধরণের ধীরে-শুকানো রঙ যেটি শুকিয়ে যাওয়া তেলের সাথে রঞ্জক পদার্থের কণা মিশিয়ে তৈরি করা হয়। লিনসিড তেল এখানে বহুল ব্যবহৃত তেল। টার্পেনটাইন বা হোয়াইট স্পিরিটের মতো দ্রাবক যোগ করে রঙের ঘনত্ব পরিবর্তন করা যেতে পারে। তেল রঙের শুকনো পৃষ্ঠের চকচকে ভাব বাড়ানোর জন্য বার্নিশও ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও, অয়েল বা অ্যালকাইড মিডিয়াম যোগ করে তেল রঙের ঘনত্ব এবং শুকানোর সময় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তেল রঙের ব্যবহার প্রথম দেখা যায় এশিয়ায়, সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে আফগানিস্তানের বৌদ্ধ চিত্রকর্মে। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে তেল-ভিত্তিক রঙের ব্যবহার শুরু হয়, তবে পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে শৈল্পিক মাধ্যম হিসেবে তেমন জনপ্রিয় হয়নি। তেল রঙের আধুনিক ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে কাঠ ও ধাতুর উপর প্রলেপ হিসেবে, যেমন বাড়ি বা জাহাজ ও ব্রিজের মতো উন্মুক্ত ধাতব কাঠামো। কাঠ এবং ধাতুর উপর রঙের দীর্ঘস্থায়ী বৈশিষ্ট্য এবং উজ্জ্বল বর্ণের কারণে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই তেল রঙের চাহিদা রয়েছে। এর ধীরে-শুকানোর বৈশিষ্ট্যের জন্য, সম্প্রতি পেইন্ট-অন-গ্লাস অ্যানিমেশনে এই রঙের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তেল রঙের শুকানোর সময়ের উপর এর প্রলেপের পুরুত্বের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে; এর পাতলা প্রলেপ তুলনামূলকভাবে দ্রুত শুকিয়ে যায়।
ঘড়ি বা সময়-নির্ণায়ক যন্ত্র একটি এমন যন্ত্র যা সময় মাপে এবং দেখায়। ঘড়ি হল প্রাচীনতম মানব আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি, যা দিন, চন্দ্রমাস এবং বছরের মতো প্রাকৃতিক এককের চেয়ে ছোট সময়ের ব্যবধান পরিমাপ করার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে। সহস্রাব্দ ধরে, বিভিন্ন ভৌত প্রক্রিয়ায় কাজ করা যন্ত্রগুলি ব্যবহার করা হয়েছে। আধুনিক ঘড়ির কিছু পূর্বসূরী প্রকৃতির চলাচলের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেগুলোকেও "ঘড়ি" বলা যেতে পারে: যেমন, একটি সূর্যঘড়ি একটি সমতল পৃষ্ঠের উপর একটি ছায়ার অবস্থান প্রদর্শন করে সময় দেখায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সময়কাল পরিমাপকও রয়েছে, যার একটি সুপরিচিত উদাহরণ আওয়ারগ্লাস বা বালুঘড়ি। সূর্যঘড়ির সাথে জলঘড়ি সম্ভবত সবচেয়ে পুরানো সময়-পরিমাপক যন্ত্রগুলির মধ্যে পড়ে। প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ির আবিষ্কারের ফলে ঘড়ির ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি ঘটেছিল, যা প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ভার্জ এসকেপমেন্টের (verge escapement) আবিষ্কারের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছিল। এই ঘড়িগুলো ব্যালেন্স হুইলের মতো দোদুল্যমান টাইমকিপার ব্যবহার করে সময় রাখত। প্রচলিতভাবে, সময় নির্ধারণের বিজ্ঞানের অর্থাৎ হোরোলজির ক্ষেত্রে, একটি ঘড়িকে স্ট্রাইকিং ক্লক হিসেবে অভিহিত করা হত যে ঘড়ি ঘন্টাধ্বনি উৎপন্ন করে। অপরদিকে যে ঘড়ি ঘন্টাধ্বনি তৈরি না করে সময় দেখায়, তাকে টাইমপিস বলা হতো। বর্তমানে সাধারণত এই পার্থক্যটি আর করা হয় না। হাতঘড়ি এবং অন্যান্য টাইমপিস, যেগুলো একজন ব্যক্তি সহজে বহন করতে পারেন, সেগুলোকে সাধারণত ঘড়ি হিসাবে উল্লেখ করা হয় না। ১৫শ শতাব্দীতে স্প্রিংচালিত ঘড়ি আবির্ভূত হয়। ১৫শ এবং ১৬শ শতাব্দীতে ঘড়ি নির্মাণ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করে। এরপর ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস কর্তৃক পেন্ডুলাম ঘড়ির আবিষ্কারের পর ঘড়ির নির্ভুলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি বড়ধরনের উন্নতি সাধিত হয়। নেভিগেশনের (দিকনির্ণয়) জন্য সঠিক সময় গণনার গুরুত্ব ছিল ঘড়ির নির্ভুলতা এবং নির্ভরযোগ্যতা উন্নয়নের একটি প্রধান উদ্দীপক। স্প্রিং বা ওয়েট দ্বারা চালিত গিয়ারের একটি সিরিজ সম্বলিত টাইমপিসের প্রক্রিয়াকে ক্লকওয়ার্ক বলা হয়। এই শব্দটি সম্প্রসারণের মাধ্যমে এমনই ধরণের প্রক্রিয়া যা টাইমপিসে ব্যবহৃত হয় না, সেগুলোর জন্যও ব্যবহার করা হয়। ১৮৪০ সালে বৈদ্যুতিক ঘড়ির পেটেন্ট করা হয়েছিল এবং বিংশ শতাব্দীতে ইলেকট্রনিক ঘড়ি চালু হয়েছিল, যা ছোট ব্যাটারিচালিত সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসের উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি প্রযুক্তি হয়ে ওঠে। প্রতিটি আধুনিক ঘড়ির সময় নির্ধারণ উপাদানটি একটি হারমোনিক অসিলেটর, যা একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে কম্পিত বা দোদুল্যমান একটি ভৌত বস্তু। এই বস্তুটি একটি পেন্ডুলাম, একটি ব্যালেন্স হুইল, একটি টিউনিং ফর্ক, একটি কোয়ার্টজ স্ফটিক বা পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের কম্পন হতে পারে যখন তারা মাইক্রোওয়েভ নির্গত করে। মাইক্রোওয়েভ নিঃসরণকারী ঘড়ির প্রযুক্তি এতটাই সঠিক যে এটি সেকেন্ডের সংজ্ঞা হিসাবে কাজ করে। ঘড়িগুলোতে সময় প্রদর্শনের বিভিন্ন উপায় রয়েছে। অ্যানালগ ঘড়ি একটি প্রচলিত ঘড়ির মুখ এবং চলমান হাত দিয়ে সময় নির্দেশ করে। ডিজিটাল ঘড়ি সময়ের একটি সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব প্রদর্শন করে। সময় দেখানোর দুটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে: ১২-ঘণ্টার নোটেশন এবং ২৪-ঘণ্টার নোটেশন। বেশিরভাগ ডিজিটাল ঘড়িতে ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়া এবং LCD, LED বা VFD ডিসপ্লে ব্যবহার করা হয়। অন্ধদের জন্য এবং টেলিফোনের মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য, স্পিকিং ক্লক কথ্যভাবে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে সময় বলে দেয়। অন্ধদের জন্য এমন কিছু ঘড়িও রয়েছে যাদের ডিসপ্লে স্পর্শের মাধ্যমে পড়া যায়।
বালুঘড়ি ছিল সময় পরিমাপের এক অভিনব উপায়। এটি অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং যথেষ্ট নিখুঁত ছিল। পানিঘড়ির বিপরীতে, বালুঘড়িতে বালু প্রবাহের গতি স্থায়ী ছিল এবং তা জমে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল। বালুঘড়ি মধ্যযুগে ইউরোপে আবিষ্কৃত হয় এবং সর্বপ্রথম ইতালির সিয়েনাতে এর ব্যবহার নথিভুক্ত হয়।
ইতিহাস
প্রাচীন যুগ
আওয়ারগ্লাস বা বালুঘড়ির উৎপত্তি অস্পষ্ট। এর পূর্বসূরি ক্লেপসিড্রা বা জলঘড়ি সম্পর্কে আমরা জানি যে, এটি খ্রিস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীতে ব্যাবিলন ও মিশরে ব্যবহৃত হত।
মধ্যযুগ
মধ্যযুগের শেষার্ধের আগে ইউরোপে আওয়ারগ্লাস ব্যবহারের কোনো নথিভুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। সবচেয়ে পুরনো তথ্যটি পাওয়া যায় চতুর্দশ শতাব্দীতে; আমব্রোজিও লোরেনজেত্তি কর্তৃক অঙ্কিত ১৩৩৮ সালের 'সুশাসনের রূপক' ('Allegory of Good Government') ফ্রেস্কোতে আওয়ারগ্লাসটি দেখতে পাওয়া যায়।
চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই সমুদ্রের বালুঘড়ি ব্যবহারের নথিভুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কিত অধিকাংশ লিখিত তথ্য ইউরোপীয় জাহাজের লগবুক থেকেই পাওয়া গেছে। একই সময়কালে, আওয়ারগ্লাসের উল্লেখ জাহাজের মালপত্রের তালিকাতেও পাওয়া যেতে শুরু করে। সমুদ্রযাত্রায় বালুঘড়ি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে এমন সবচেয়ে প্রাচীন তথ্যটি পাওয়া যায় আনুমানিক ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ইংল্যান্ডের তৃতীয় এডওয়ার্ডের আমলে - রাজার জাহাজ 'লা জর্জ'- এর কেরানি থমাস ডি স্টেটেশামের একটি রসিদে এই তথ্য পাওয়া যায়। মূল লাতিন লেখাটির অনুবাদ এমন দাঁড়ায়:
১৩৪৫ সালে একই থমাস ফ্ল্যান্ডার্সের লাসক্লাসে বারোটি গ্লাস হোরোলজের জন্য ("pro xii. orlogiis vitreis") প্রতিটির মূল্য ৪.৫ গ্রস বা ৯ শিলিং হিসেবে অর্থ পরিশোধের হিসাব রাখেন। একই স্থানে একই ধাঁচের চারটি হোরোলজের ("de eadem secta") এর জন্য প্রতিটি ৫ গ্রস বা ৩ শিলিং ৪ ডেনারিয়াস মূল্য পরিশোধিত হয়।
সমুদ্রযাত্রায় বালুঘড়ি
সমুদ্রযাত্রায় অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সময় নির্ণায়ক হিসেবে বালুঘড়ি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ক্লেপসিড্রার মতো নয়, জাহাজের দোল খাওয়া বা তাপমাত্রার পরিবর্তন (ক্লেপসিড্রার ভেতর জল জমতে পারত) বালুঘড়িকে প্রভাবিত করত না। সমুদ্রযাত্রায় দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের জন্য সূর্যের আপাত দুপুরের (solar noon) সাথে বালুঘড়ি যথেষ্ট নির্ভুল না হলেও, জাহাজের গতি পরিমাপ করার জন্য 'চিপ লগ'-এর সাথে বালুঘড়ি নির্ভুলভাবেই ব্যবহৃত হত।
স্থলভাগেও মেকানিক্যাল ঘড়ির বিকল্প হিসেবে বালুঘড়ি বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনায় বক্তৃতার সময় নির্ণয়, রান্নার সময়, বা শ্রম থেকে বিরতির সময় নির্ধারণে বালুঘড়ির বহুল প্রচলন ছিল। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আওয়ারগ্লাসগুলি তৈরি হতে শুরু করে আকারে ছোট হতে। কারণ ছোট মডেলগুলি ব্যবহারে সহজ এবং অপেক্ষাকৃত বেশি গোপনীয়তা বজায় রাখত।
১৫০০ সালের পর বালুঘড়ির ব্যবহার কমতে থাকে। যান্ত্রিক ঘড়ির আবির্ভাব এর প্রধান কারণ। যান্ত্রিক ঘড়ি বালুঘড়ি অপেক্ষা অধিক নির্ভুল, ছোট, সস্তা এবং ব্যবহার-সুবিধাজনক ছিল। তবে বালুঘড়ি একেবারে অপ্রচলিত হয়ে যায়নি। সময় দেখার একটি হাতিয়ার হিসেবে যান্ত্রিক ঘড়ির প্রাধান্য বাড়লেও, নিজস্ব নান্দনিকতার জন্য বালুঘড়ি সমাদৃত ছিল। সবচেয়ে পুরনো বালুঘড়িটি বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে।
আঠারো শতকে এসে জন হ্যারিসন একটি মেরিন ক্রনোমিটার উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত সমুদ্রযাত্রায় বালুঘড়ির উপর নির্ভরতা কমেনি। বালুঘড়ির নকশার কয়েকটি বিষয় কাজে লাগিয়ে ১৭৬১ সালে তিনি এমন একটি ক্রনোমিটার তৈরি করতে সক্ষম হন যা ইংল্যান্ড থেকে জ্যামাইকার সমুদ্রযাত্রার সময়টি মাত্র পাঁচ সেকেন্ডের ভুলের মধ্যে নির্ণয় করতে পারত।
ওজনচালিত যান্ত্রিক ঘড়ি ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে এগুলো মূলত ঘড়িঘরে (clock tower) ব্যবহৃত হত।
যান্ত্রিক জল ঘড়ি
প্রথম পরিচিত গিয়ার-চালিত ঘড়িটি তৃতীয় শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহান গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলী আর্কিমিডিস দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল। আর্কিমিডিস তার জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ঘড়ি তৈরি করেছিলেন, যা একটি কোকিল ঘড়িও ছিল; এতে প্রতি ঘণ্টায় পাখিরা গান গাইত ও নড়াচড়া করত। এই ঘড়িতে চোখের পিটপিট করা একটি মানুষের চিত্রও ছিল, যে কিনা পাখির গানে আশ্চর্য হয়ে যেতো। এটিই প্রথম ক্যারিলন ঘড়ি হিসাবে পরিচিতি পায় কারণ এটি যন্ত্রের সুরের সাথে তাল মিলিয়ে সঙ্গীত বাজাতে পারত। আর্কিমিডিসের ঘড়িটি চারটি ওজন, কাউন্টারওয়েট এবং স্ট্রিংগুলির একটি সিস্টেম দিয়ে কাজ করে, যা সাইফনের মাধ্যমে জল-পাত্রে ভাসমান কিছু বস্তু (float) দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতো; এই সাইফনগুলি ঘড়ির স্বয়ংক্রিয় ধারাবাহিকতা বজায় রাখত। গণিতবিদ এবং পদার্থবিদ হিরো এই ধরণের ঘড়ির মূলনীতিগুলি বর্ণনা করেছেন, উল্লেখ করেছেন যে এর কয়েকটি একটি চেইনের মাধ্যমেও কাজ করে যেটি এক্ষেত্রে যন্ত্রের একটি গিয়ারকে ঘোরায়।
আলেকজান্ডারের সময়ে গ্রিসে সম্ভবত আরেকটি ঘড়ি তৈরি হয়েছিল, যা প্রোকোপিয়াস গাজায় বর্ণনা করেছিলেন। গাজা ঘড়িটি সম্ভবত একটি 'মেটিওরোস্কোপিয়ন' ছিল, অর্থাৎ, এমন একটি ভবন যা আকাশের ঘটনা এবং সময় দেখাত। এটিতে সময়ের নির্দেশক ছিল এবং আর্কিমিডিসের ঘড়ির মতো কিছু স্বয়ংক্রিয় বৈশিষ্ট্যও ছিল। প্রতি ঘণ্টায় খোলা ১২টি দরজা ছিল, যেখানে হারকিউলিস তার কীর্তিগুলো সম্পাদন করতেন। যেমন, একটায় সিংহ, ইত্যাদি। আর রাতে প্রতি ঘণ্টায় একটি প্রদীপ দৃশ্যমান হতো এবং সময় দেখানোর জন্য ১২টি জানালা খুলে যেতো।
তাং রাজবংশের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ই জিং সরকারি কর্মকর্তা লিয়াং লিংজানের সঙ্গে ৭২৩ (বা ৭২৫) সালে একটি জলচালিত যান্ত্রিক ঘড়ির গোলার্ধে (armillary sphere) এস্কেপমেন্ট (একধরণের যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রক) যুক্ত করেন। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম ঘড়ির এস্কেপমেন্ট । সু সং (১০২০-১১০১) নামে সুং রাজবংশের একজন বহুবিদ্যাবিশারদ এবং প্রতিভাবান ব্যক্তি ১০৮৮ সালে কাইফেং-এ তার যুগান্তকারী জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি-মিনারে এই প্রযুক্তি সন্নিবেশিত করেন। তার এই জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি এবং ঘূর্ণায়মান গোলার্ধটি বসন্ত, গ্রীষ্ম ও শরৎ ঋতুতে জলের প্রবাহের উপর নির্ভরশীল ছিল। আর শীতের হিমশীতল তাপমাত্রায় তরল পারদের ওপর নির্ভরশীল ছিল (অর্থাৎ, এটি জলবিদ্যুৎচালিত ছিল)। সু সং-এর জলচক্রের লিঙ্কওয়ার্ক যন্ত্রে, একটি সীমিত আকারের তরলপূর্ণ পাত্রের প্রবাহ নিয়ন্ত্রিতভাবে থেমে থেমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এস্কেপমেন্টের কাজ সম্পাদিত হতো। কাজেই, সু সং-এর ঘড়িটি একক বিবর্তনের ধারায় ক্লেপসিড্রা (জলঘড়ি) এবং যান্ত্রিক ঘড়ির ধারণাগুলিকে যান্ত্রিক ও জলচালিত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত একটি ডিভাইসে একীভূত করেছিল। তার স্মৃতিকথায়, সু সং এই ধারণাটি সম্পর্কে লিখেছেন:
"আপনার বিনীত দাসের মতে, বিগত রাজবংশগুলোর সময় জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত যন্ত্রের অনেক সিস্টেম এবং নকশা ছিল যেগুলো ক্ষুদ্র বিষয়ে একে অপরের থেকে আলাদা। কিন্তু চালিকা শক্তি হিসেবে জলশক্তি ব্যবহারের নীতি সবসময় একই ছিল। আকাশ নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে, তেমনি জলও প্রবাহিত হয় (এবং পতিত হয়)। সুতরাং, যদি জলকে পুরোপুরি সমানভাবে ঢালা হয়, তবে ঘূর্ণমান গতির (আকাশ ও যন্ত্রের) তুলনা করলে কোনো বৈসাদৃশ্য বা দ্বন্দ্ব দেখা যাবে না। কারণ, এক্ষেত্রে অবিরাম গতি অনবরত গতিরই অনুসরণ করে।"
সু সং এর আগে ঝাং সিক্সুন (৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক নির্মিত গোলার্ধ দিয়েও প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ঝাং সিক্সুন-ও তার জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি মিনারের জলচক্রে এস্কেপমেন্ট ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিলেন এবং পানির পরিবর্তে তরল পারদ ব্যবহার করেছিলেন। সু সং-এর জ্যোতির্বিদ্যা মিনারের যান্ত্রিক ঘড়ির চালিকা-চক্রটি ব্যাসে ১১ ফুটের ছিল, যাতে ৩৬টি স্কুপ (scoops) ছিল; এগুলোর প্রত্যেকটিতে "ধ্রুব-স্তরের ট্যাঙ্ক" থেকে সমান গতিতে জল ঢালা হতো। লোহার তৈরি এই চালিকা-শ্যাফটের বেলনাকার গ্রীবাগুলো লোহার অর্ধচন্দ্রাকৃতির বিয়ারিং দ্বারা সমর্থিত ছিল। শ্যাফটটি নলাকার যে দাঁত রয়েছে তা নিচের দিকের খাঁজকাটা চাকার(gear wheel) সাথে যুক্ত ছিল; আর এই খাঁজকাটা চাকা মূল উল্লম্ব ট্রান্সমিশন শ্যাফটের নিচের প্রান্তে থাকত। প্রায় দশ মিটার উঁচু (প্রায় ৩০ ফুট) এই জলবিদ্যুৎচালিত জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি মিনারে একটি ঘড়ির এস্কেপমেন্ট ছিল এবং পতিত পানি বা তরল পারদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে চালিত হত। সু সং-এর ঘড়ির নকশা এবং যান্ত্রিক চিত্রকর্মের ভিত্তিতে চীনের প্রজাতন্ত্র (তাইওয়ান)-এর জাতীয় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান জাদুঘর, তাইচুং শহরে সু সং-এর ঘড়ির একটি পূর্ণ-আকারের কার্যকরী প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। এই পূর্ণ-আকারের, সম্পূর্ণ কার্যকরী প্রতিকৃতিটি, যা প্রায় ১২ মিটার (৩৯ ফুট) উঁচু, সু সং-এর মূল বিবরণ এবং যান্ত্রিক চিত্রকর্মের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। চীনা এস্কেপমেন্ট পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা এস্কেপমেন্ট প্রযুক্তির উৎস হয়ে ওঠে।
১২শ শতাব্দীতে, মেসোপটেমিয়ার একজন প্রকৌশলী আল-জাজারি (১১৩৬-১২০৬ সালে জীবিত) দিয়ার-বকরের আর্তুকিদ রাজা নাসির আল-দিনের জন্য বিভিন্ন আকারের ও আকৃতির অসংখ্য ঘড়ি তৈরি করেছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ঘড়িগুলোর মধ্যে ছিল হাতি, লেখক এবং দুর্গ ঘড়ি, যার কয়েকটি সফলভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। সময় বলা ছাড়াও, এই বিশাল ঘড়িগুলো ছিল উর্তুক রাষ্ট্রের মর্যাদা, বৈভব এবং সম্পদের প্রতীক। আরবি এবং স্প্যানিশ পাঠ্য অনুবাদের মাধ্যমে এই পারদ এস্কেপমেন্ট সম্পর্কে জ্ঞান সম্ভবত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পুরোপুরি যান্ত্রিক ঘড়ি
'হরোলজিয়া' শব্দটি (গ্রীক 'হরা' - 'ঘণ্টা' এবং 'লিগেইন' - 'বলা' থেকে উদ্ভূত) প্রাথমিক যান্ত্রিক ঘড়ি বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু, সময় নির্ধারণকারী সকল যন্ত্রের জন্য এই শব্দের ব্যবহার (এখনও বেশ কিছু রোমান্স ভাষায় প্রচলিত) এই যন্ত্রগুলোর প্রকৃত কার্যপদ্ধতি আড়াল করে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ১১৭৬ সালে, ফ্রান্সের সেন্স ক্যাথেড্রালে একটি 'হরলজ' স্থাপনের নথি আছে, কিন্তু কী পদ্ধতিতে এটি কাজ করতো তা জানা যায় না।
জোসলিন ডি ব্র্যাকলন্ডের মতে, ১১৯৮ সালে, সেন্ট এডমন্ডসবেরি অ্যাবে (বর্তমানে বুরি সেন্ট এডমন্ডস) অগ্নিকাণ্ডের সময় সন্ন্যাসীরা জল সংগ্রহ করতে 'ঘড়ির দিকে দৌড়ে গিয়েছিলেন'। এটা প্রমাণ করে যে, তাদের ব্যবহৃত ওয়াটার ক্লক বা জল-ঘড়িতে অগ্নি নির্বাপণের মতো কাজে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট বড় জলাধার ছিল। 'ক্লক' শব্দটি (মধ্যযুগীয় লাতিন 'ক্লোকা' থেকে যা ওল্ড আইরিশ 'ক্লোক' থেকে গৃহীত, উভয়ের অর্থই 'ঘণ্টা') ধীরে ধীরে 'হরলজ'-কে ছাড়িয়ে যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপব্যাপী চার্চের নথিগুলিতে ঘড়ি এবং হরলজের উল্লেখ বৃদ্ধি এই ইঙ্গিত দেয় যে, সম্ভবত তখন ঘড়ির একটি নতুন কার্যপ্রণালী আবিষ্কৃত হয়েছিল।
বিদ্যমান জলচালিত ঘড়ির যন্ত্রাংশগুলিকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হচ্ছিল যাতে সেগুলো ওজনের পতনের শক্তিতে চলতে পারে। নিয়ন্ত্রিত এই শক্তি প্রয়োগ - 'এস্কেপমেন্ট'-ই হল আসল যান্ত্রিক ঘড়ির সূচনা, যা পূর্ববর্তী কগ্হুইল ঘড়ি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভার্জ এস্কেপমেন্ট কৌশলটি যান্ত্রিক ঘড়ির বিকাশের যে ঢেউয়ে আবির্ভূত হয়, তাতে পানি বা পারার মতো তরল শক্তির কোনো প্রয়োজন ছিল না।
এই যান্ত্রিক ঘড়িগুলির দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল: সংকেত ও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া (যেমন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পাবলিক ইভেন্টের সময় নির্ধারণ) এবং সৌরজগতের মডেলিং। প্রথম উদ্দেশ্যটি প্রশাসনিক; দ্বিতীয়টি জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে পণ্ডিতদের আগ্রহ থেকে এবং এই বিষয়গুলি তৎকালীন ধর্মীয় দর্শনের সাথে কীভাবে সংযুক্ত ছিল - সেখান থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল । অ্যাস্ট্রোলেব জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষী উভয়ই ব্যবহার করতেন। সৌরজগতের একটি কার্যকরী মডেল তৈরি করতে ঘড়ির কার্যপ্রণালীর সাথে একটি ঘূর্ণায়মান প্লেট যুক্ত করা স্বাভাবিক ছিল।
মূলত বিজ্ঞপ্তির কাজে ব্যবহৃত সাধারণ ঘড়িগুলি টাওয়ারে স্থাপন করা হতো এবং সেগুলিতে সর্বদা ডায়াল বা কাঁটা থাকতো না। এই ঘড়িগুলি ধর্মীয় সময়সূচী বা নির্ধারিত প্রার্থনার মধ্যবর্তী সময়গুলি ঘোষণা করত। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মীয় সময়সূচীর দৈর্ঘ্যও বদলে যেত। আরও উন্নত জ্যোতির্বিদ্যা-ভিত্তিক ঘড়িগুলিতে চলমান ডায়াল বা কাঁটা থাকতো এবং তৎকালীন জ্যোতির্বিদদের নির্ধারণ করা 'ইটালিয়ান আওয়ারস', 'ক্যানোনিকাল আওয়ারস'-সহ নানা সময় পদ্ধতিতে সময় প্রদর্শন করতো। উভয় ধরনের ঘড়িতে বিস্তৃত বৈশিষ্ট্য যেমন অটোমাটা, যুক্ত হতে শুরু করে।
১২৮৩ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের বেডফোর্ডশায়ারের ডানস্টেবল প্রাইরিতে একটি বড় ঘড়ি স্থাপন করা হয়। রুড স্ক্রিনের উপরে এর অবস্থান থেকে বোঝা যায় যে, এটি জল-ঘড়ি ছিল না। ১২৯২ সালে ক্যান্টারবেরি ক্যাথেড্রালে একটি 'বিশাল হরলজ' স্থাপন করা হয়। পরবর্তী ৩০ বছরে ইংল্যান্ড, ইতালি ও ফ্রান্সের নানা গীর্জা-প্রতিষ্ঠানে ঘড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৩২২ সালে নরউইচে একটি নতুন ঘড়ি স্থাপন করা হয়; ১২৭৩ সালে সেখানে থাকা একটি পুরানো ঘড়ির পরিবর্তে এটি বসানো হয়েছিল। নতুন ঘড়িটি বেশ ব্যয়বহুল ছিল, এতে একটি বড় (২ মিটার) জ্যোতির্বিদ্যা-ভিত্তিক ডায়াল, অটোমাটা ও ঘণ্টাধ্বনি ছিল। স্থাপনার খরচের মধ্যে দুই বছরের জন্য দুইজন ঘড়ি-রক্ষকের পূর্ণকালীন বেতনও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কম্পাউন্ড ক্র্যাঙ্ক হলো এক ধরণের যান্ত্রিক প্রযুক্তি যা দুটি বা ততোধিক সরল ক্র্যাঙ্ককে একত্রিত করে তৈরি করা হয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি বল প্রয়োগ করে কাজ করা সম্ভব। ইতালীয় চিকিৎসক গুইডো দা ভিগেভানো ১৩৩৫ সালে তার "থিসরাস" (Texturus) নামক যুদ্ধযন্ত্র সংকলন গ্রন্থে প্রথম কম্পাউন্ড ক্র্যাঙ্কের ধারণা প্রদান করেন। তিনি পবিত্রভূমি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে যুদ্ধরথ ও প্যাডেল চালিত নৌকা হস্তচালিত করার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। কম্পাউন্ড ক্র্যাঙ্কে, দুটি বা ততোধিক ক্র্যাঙ্ক একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। যখন একজন ব্যক্তি একটি ক্র্যাঙ্ক ঘোরায়, তখন অন্য ক্র্যাঙ্কও একই সাথে ঘোরে। এর ফলে, প্রয়োগ করা বল বৃদ্ধি পায় এবং কাজ করা সহজ হয়।[৬৫]
ব্লাস্ট ফার্নেস বা মারুত চুল্লি হলো এক ধরণের ধাতুবিদ্যা চুল্লি যা লোহা আকরিক থেকে কাঁচা লোহা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। ব্লাস্ট ফার্নেস নামটি এসেছে "ব্লাস্ট" (স্ফোটন) এবং "ফার্নেস" (চুল্লি) শব্দ দুটি থেকে। কারণ এই চুল্লিতে উচ্চ চাপে গরম বাতাস প্রবাহিত করে লোহা আকরিক গলানো হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীরও আগে থেকেই চীনে ব্লাস্ট ফার্নেস ব্যবহার করা হচ্ছিল।[৬৬] কিন্তু ইউরোপে ব্লাস্ট ফার্নেসের ব্যবহার শুরু হয় অনেক পরে, প্রায় ১১৫০ সালের দিকে।[৬৭] মধ্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে (যেমন সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি) প্রায় একই সময়ে ব্লাস্ট ফার্নেসের ব্যবহার শুরু হয়। ধারণা করা হয়, ইউরোপে ব্লাস্ট ফার্নেসের উদ্ভাবন স্বাধীনভাবে ঘটেছিল। ব্লাস্ট ফার্নেসে লোহা আকরিক, কোক (জীবাশ্ম জ্বালানি) এবং চুনাপাথর একসাথে মিশিয়ে উচ্চ তাপমাত্রায় গলানো হয়। এই প্রক্রিয়ায় লোহা আকরিকের অক্সিজেন বেরিয়ে যায় এবং তরল লোহা তৈরি হয়। এই তরল লোহাকে "কাঁচা লোহা" বলা হয়। ব্লাস্ট ফার্নেস উৎপাদিত কাঁচা লোহা ইস্পাত তৈরির প্রধান উপাদান। ইস্পাত নির্মাণ, যন্ত্রপাতি তৈরি, এবং অন্যান্য অসংখ্য ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ব্লাস্ট ফার্নেস ধাতুবিদ্যার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। এই চুল্লির আবিষ্কারের ফলে ইস্পাত উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং আধুনিক শিল্পায়নের পথ সুগম হয়।[৬৮][৬৯]
শিপ মিল (ষষ্ঠ শতাব্দী)
শিপ মিল হলো বাইজেন্টাইনদের আবিষ্কৃত এক ধরণের মিল/কল যা পানিবিদ্যুৎ ব্যবহার করে দানা পেষাই করত। এই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে ইউরোপের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং উনিশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত ব্যবহৃত হত।
কাগজের কল (ত্রয়োদশ শতাব্দী)
পানি-চালিত কাগজের কলের প্রথম নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় ১২৮২ সালে।[৭০] চীনা[৭১][৭২] ও মুসলিম[৭৩] উভয় কাগজ তৈরির ক্ষেত্রেই এর প্রমাণ খুব কম।
রোলিং মিল (পঞ্চদশ শতাব্দী)
একই বেধের ধাতুপাত তৈরির জন্য ব্যবহৃত হত। নরম, নমনীয় ধাতু, যেমন সীসা, সোনা এবং টিনের উপর প্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়। কার্যকরী লোহার জন্য রোলিং মিলের বর্ণনা প্রথম লক্ষ্য করা যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির লেখায়।
জোয়ার-ভাটার কল (ষষ্ঠ শতাব্দী)
আয়ারল্যান্ডের উপকূলে প্রথম জোয়ার-ভাটার কল আবিষ্কৃত হয়। ওয়াটারফোর্ডের কাছে কিলোটেরানে ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি উল্লম্ব ওয়াটারহুইল দ্বারা চালিত টাইড কল পাওয়া যায়।[৭৪] লিটল আইল্যান্ডে যমজ-ফ্লুম আনুভূমিক-চাকাযুক্ত মিল (আনুমানিক ৬৩০) এবং একটি উল্লম্ব আন্ডারশট ওয়াটারহুইল দ্বারা জোয়ারের শক্তি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।[৭৫][৭৬] আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ৭৮৭ সালের নেনড্রাম মনাস্ট্রি কল যা শীর্ষে সাত থেকে আট অশ্বশক্তি উৎপন্ন করতে পারত বলে ধারণা করা হয়।[৭৭][৭৮]
উল্লম্ব বায়ুকল (১১৮০-র দশক)
ইউরোপে পিভোটেবল পোস্ট মিল নামে পরিচিত, এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৮৫ সালে ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে। দানা পেষাই এবং জল নিষ্কাশনের কাজে এগুলো বেশ কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে স্থির টাওয়ার মিলও উদ্ভাবিত হয়।
পানি হাতুড়ি (দ্বাদশ শতাব্দী বা তারও আগে)
ধাতুবিদ্যায় ব্লুমারিজ এবং ক্যাটালান ফোর্জ থেকে ধাতব ফুল তৈরিতে এগুলো ব্যবহৃত হত। এগুলো ম্যানুয়াল হাতুড়ির কাজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হত। উনিশ শতকে বাষ্প হাতুড়ি উদ্ভাবনের ফলে পানি হাতুড়ি প্রতিস্থাপিত হয়।
কম্পাস হলো এক ধরনের চৌম্বকীয় যন্ত্র যা নেভিগেশন এবং দিকনির্দেশনার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ভৌগোলিক মূল বিন্দুর (cardinal points) দিক নির্দেশ করে। একটি কম্পাসের সাধারণ কাঠামোয় একটি কম্পাস রোজ থাকে, যেখানে চারটি প্রধান দিক দেখানো থাকে: পূর্ব (E), দক্ষিণ (S), পশ্চিম (W) এবং উত্তর (N)। ঘড়ির কাঁটার দিকে কোণ পরিমাপ বৃদ্ধি পায়। উত্তর ০° মানের সাথে মিলে যায়, তাই পূর্ব ৯০°, দক্ষিণ ১৮০° এবং পশ্চিম ২৭০°। কম্পাসের ইতিহাস ২০০০ বছরেরও বেশি পুরনো। চীনের হান রাজবংশের সময়কালে (খ্রিস্টপূর্ব ২০২ - খ্রিস্টাব্দ ২২০) প্রথম কম্পাস তৈরি করা হয়েছিল। প্রথম কম্পাসগুলি লোডস্টোন দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, এটি প্রাকৃতিকভাবে চৌম্বকীয় আকৃষ্ট লোহার একটি পাথর। একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, চীনের সং রাজবংশের দিকে (খ্রিস্টাব্দ ৯৬০ - ১২৭৯), একে "দক্ষিণ নির্দেশক মাছ" বলা হত এবং স্থল নেভিগেশনের জন্য ব্যবহৃত হতো।[৭৯][৮০] ১০৮৮ সালে প্রথমবারের মতো চৌম্বকীয় সূচ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন শেন কুও। ১১১১-১১১৭ সালের মধ্যে লেখা "পিংঝো টেবিল টকস" বইটিতে চু ইয়ু সমুদ্র নেভিগেশনে সূচের ব্যবহার উল্লেখ করেন।[৮১][৮২] পরবর্তীতে, কম্পাসগুলি লোহার সূচ দিয়ে তৈরি করা হতো ও লোডস্টোনের আঘাতে চুম্বকত্ব লাভ করত। ইংরেজ ধর্মতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার নেকাম (১১৫৭-১২১৭ খ্রিস্টাব্দ) প্রথম মধ্যযুগীয় ইউরোপে চৌম্বকীয় সূচ ও কম্পাসের বর্ণনা দিয়েছিলেন। পশ্চিম ইউরোপে প্রায় ১১৯০ সালে এবং ইসলামিক বিশ্বে ১২৩২ সালে কম্পাসের প্রথম ব্যবহার নথিবদ্ধ করা হয়।[৮৩] মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রায় ১২৬৯ সালে এবং মধ্যযুগীয় ইসলামিক বিশ্বে ১৩০০ সালে 'ড্রাই' কম্পাস উপস্থিত হতে শুরু করে।[৮৪][৮৫][৮৬] বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তরল-পূর্ণ চৌম্বকীয় কম্পাস এটির স্থলাভিষিক্ত হয়।[৮৭]
শুষ্ক কম্পাস (১২শ শতাব্দী)
ইউরোপে দিকনির্ণয় যন্ত্রের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আলেকজান্ডার নেকহ্যামের "On the Natures of Things" (অন দ্য ন্যাচার অফ থিংস) গ্রন্থে, যা প্যারিসে ১১৯০ সালের দিকে রচিত।[৮৮] ধারণা করা হয়, এটি চীন বা আরব থেকে আসা প্রযুক্তি অথবা সম্পূর্ণভাবে একটি স্বাধীন ইউরোপীয় উদ্ভাবন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ১৩০০ সালের দিকে শুষ্ক কম্পাস আবিষ্কৃত হয়।[৮৯]
জ্যোতির্বিজ্ঞানিক কম্পাস (১২৬৯)
ফরাসি পণ্ডিত পিয়েরে দে মারিকোর্ট ১২৬৯ সালে "Epistola de magnete" (এপিস্টোলা ডি ম্যাগনেট) নামক তার পরীক্ষামূলক গবেষণায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের জন্য তৈরি তিনটি ভিন্ন ধরনের কম্পাসের বর্ণনা দেন।[৯০]
জাহাজের পেছনের রাডার (Stern-mounted rudders) (১১৮০-এর দশক)
১১৮০ সালের দিকে গির্জার খোদাই করা নকশায় প্রথম জাহাজের পেছনের রাডারের চিত্র পাওয়া যায়। উত্তর ও বাল্টিক সাগরে কোজ জাহাজে (cog) এগুলো প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল। এরপর দ্রুত এটি ভূমধ্যসাগরে ছড়িয়ে পড়ে। লোহার কব্জা ব্যবস্থা ছিল প্রথম স্থায়ীভাবে জাহাজের তলদেশে সংযুক্ত পেছনের রাডার, যা আবিষ্কারের যুগে এবং তার পরবর্তী সময়ে নৌ-চালনার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৯১]
চলমান টাইপের মুদ্রণযন্ত্র (১৪৪০-এর দশক)
ইয়োহানেস গুটেনবার্গের মুদ্রণ প্রক্রিয়াটি আসলে নতুন কিছু ছিল না। উডব্লক প্রিন্টিং-এর কাঠ খোদাই করে তৈরি প্লেট ব্যবহারের পরিবর্তে তিনি পৃথক পৃথক অক্ষর (টাইপ) ব্যবহার করে প্রতি পৃষ্ঠার প্রিন্টিং প্লেট তৈরি করেন। এর ফলে অক্ষরগুলো বারবার ব্যবহার করা সম্ভব হত এবং পৃষ্ঠার ছাঁচ তৈরির কাজ অনেক দ্রুততর হয়েছিল।
চীনে আবিষ্কৃত কাগজ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলামিক স্পেনের মাধ্যমে ইউরোপে পৌঁছায়। ইউরোপে পানিচালিত মিল ও কাগজের প্রেসের মাধ্যমে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া যান্ত্রিক করা হয়।
কাগজ হলো সেলুলোজ তন্তু থেকে তৈরি একটি পাতলা শীট জাতীয় বস্তু। সেলুলোজ তন্তু কাঠ, ফেটানো কাপড়, ঘাস বা অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে যান্ত্রিক ও রাসায়নিক পদ্ধতির মাধ্যমে পাওয়া যায়। পানিতে এই তন্তুগুলোকে ভিজিয়ে একটি সূক্ষ্ম জালের মধ্য দিয়ে পানি ছেঁকে ফেলা হয়, যার ফলে তন্তুগুলো জালের উপরে সমানভাবে জমা হয়। এরপর সেগুলো চাপ প্রয়োগ করে শুকানো হয়। প্রাথমিকভাবে কাগজ হাতে তৈরি করা হতো। বর্তমানে, প্রায় সব কাগজই বড় বড় যন্ত্রের মাধ্যমে তৈরি হয়। কিছু মেশিন ১০ মিটার প্রশস্ত কাগজের রোল তৈরি করতে পারে, যা প্রতি মিনিটে ২০০০ মিটার পর্যন্ত চলতে সক্ষম এবং বছরে ৬০০,০০০ টন পর্যন্ত কাগজের উৎপাদন সম্ভব।
কাগজ বহুমুখী ব্যবহারের একটি বস্তু। ছাপানো, আঁকা, বিভিন্ন নকশা করা, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, প্যাকেজিং, সাজসজ্জা, লেখালেখি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সহ আরও অনেক ক্ষেত্রে কাগজের নিবিড় ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া ফিল্টার পেপার, ওয়ালপেপার, বইয়ের এন্ডপেপার, কনজারভেশন পেপার, ল্যামিনেটেড ওয়ার্কটপ, টয়লেট টিস্যু, মুদ্রা ও সুরক্ষা কাগজ (সিকিউরিটি পেপার) হিসেবে বা শিল্প ও নির্মাণ কাজের বিভিন্ন প্রক্রিয়াতেও কাগজ ব্যবহার করা হয়।
কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া পূর্ব এশিয়াতে উদ্ভাবিত হয়েছিল, সম্ভবত চীনে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে চীনে তৈরি কাগজের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে হান রাজবংশের খোজা সাই লুনকে কাগজ নির্মাণ পদ্ধতির আবিষ্কারক হিসেবে গণ্য করা হয়, যিনি ১০৫ খ্রিস্টাব্দে এই পদ্ধতি চালু করেন।
আধুনিক পাল্প ও কাগজ শিল্প বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। এই শিল্পে চীন সবচেয়ে এগিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে।
প্রচলিত আছে যে ৭৫১ খ্রিস্টাব্দের তালাসের যুদ্ধের পর দুইজন চীনা কাগজ নির্মাতাকে বন্দী করা হলে কাগজ তৈরির জ্ঞান ইসলামিক বিশ্বে চলে আসে। যদিও এই গল্পের সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, শীঘ্রই সামারকান্দে কাগজ তৈরি শুরু হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, জ্ঞান এবং কাগজের ব্যবহার মধ্যপ্রাচ্য থেকে মধ্যযুগীয় ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে প্রথম পানিচালিত কাগজকল নির্মিত হয়েছিল। বাগদাদের মাধ্যমে কাগজ পশ্চিমা বিশ্বে প্রবেশ করায় ইউরোপে সেটি প্রাথমিকভাবে 'ব্যাগডাটিকোস' নামে পরিচিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে, শিল্পায়নের ফলে কাগজ উৎপাদনের খরচ অনেক কমে যায়। ১৮৪৪ সালে, কানাডিয়ান আবিষ্কারক চার্লস ফেনার্টি এবং জার্মান আবিষ্কারক ফ্রেডরিখ গটলব কেলার স্বাধীনভাবে কাঠের তন্তু থেকে পাল্প তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
ঘূর্ণায়মান বুকমার্ক (ত্রয়োদশ শতাব্দী)
এটি একটি গোলাকার ডিস্ক ও সুতো দিয়ে তৈরি যন্ত্র যা পাঠক ছেড়ে যাবার সময় পাতা, কলাম এবং লাইন চিহ্নিত করতে ব্যবহার করতেন। এটি চামড়া, ভেলুম (এক ধরনের মোটা কাগজ), কিংবা কাগজ দিয়ে তৈরি করা হতো।
চশমা (১২৮০-এর দশক)
ফ্লোরেন্সে আবিষ্কৃত প্রথম চশমায় কনভেক্স লেন্স ব্যবহার করা হত, যা শুধুমাত্র দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য কার্যকর ছিল। কনকেভ লেন্স পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।
কাগজের ছাপ বা ওয়াটারমার্ক (১২৮২)
এই মধ্যযুগীয় উদ্ভাবন কাগজের পণ্যের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করতে এবং জালিয়াতি রোধ করতে ব্যবহৃত হত। ইতালির বোলোনায় প্রথম এর ব্যবহার শুরু হয়।
বলতে তত্ত্ব (ষষ্ঠ শতাব্দী)
ষষ্ঠ শতাব্দীতে জন ফিলোপোনাস নামে একজন পণ্ডিত "বলতে তত্ত্ব" নামে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রবর্তন করেন। এই তত্ত্বে তিনি অ্যারিস্টটলের পদার্থবিদ্যার মূলনীতির সমালোচনা করেন। ফিলোপোনাসের এই তত্ত্ব মধ্যযুগের পণ্ডিতদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। এমনকি দশ শতাব্দী পরে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সময় বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলে তার রচনায় ফিলোপোনাসের তত্ত্বের উল্লেখ করেন এবং অ্যারিস্টটলীয় পদার্থবিদ্যার ত্রুটিগুলো ব্যাখ্যা করেন। বলতে তত্ত্ব ধ্রুপদী বলবিজ্ঞানে জড়তা, ভরবেগ এবং ত্বরণের ধারণার পূর্বসূরি হিসেবে বিবেচিত হয়।
চুম্বকত্বের উপর প্রথম গ্রন্থ (ত্রয়োদশ শতাব্দী)
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পেট্রাস পেরেগ্রিনাস দে মেরিকোর্ট "Epistola de magnete" (এপিস্টোলা দে ম্যাগনেটে)নামে চুম্বকত্বের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি চুম্বকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রথম প্রচলিত গবেষণাগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত।
আরবি সংখ্যা (ত্রয়োদশ শতাব্দী)
আরবি সংখ্যার ব্যবহার ইউরোপে ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম নথিভুক্ত করা হয়। তবে, ১২০২ সালে ফিবোনাচ্চি "Liber Abaci" (লিবার অ্যাবাসি) নামক গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে এই সংখ্যা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রচার করেন।
একাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে প্রথম মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাক্ষরতা ও শিক্ষার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আজ শিক্ষার ধারণা ও প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী গৃহীত হয়েছে।[৯২]
কার্যকরী বোতাম (১৩শ শতাব্দী)
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জার্মানিতে বোতাম আবিষ্কারের মাধ্যমে বস্ত্র শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে।[৯৩] দেহ-সংলগ্ন পোশাকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বোতাম দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বর্তমানে পোশাকের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
অনুভূমিক তাঁত (১১শ শতাব্দী)
একাদশ শতাব্দীতে অনুভূমিক তাঁতের উদ্ভাবন বস্ত্র উৎপাদন প্রক্রিয়াকে দ্রুততর ও আরও কার্যকর করে তোলে। পায়ের প্যাডেল দ্বারা চালিত এই তাঁতগুলো পূর্ববর্তী তাঁতের তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদনশীল ছিল।
রেশম (৬ষ্ঠ শতাব্দী)
ষষ্ঠ শতাব্দীতে পূর্ব ইউরোপে এবং একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে রেশম উৎপাদন শুরু হয়। প্রাচীনকাল থেকেই সিল্ক রোডের মাধ্যমে রেশম আমদানি করা হত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে টাসকানিতে 'সিল্ক নিক্ষেপ' (silk throwing) প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হওয়ার পর রেশম উৎপাদন আরও উন্নত হয়। রেশম বয়নের কাজে পানিশক্তি ব্যবহার করা হত। অনেকে মনে করেন, এই প্রক্রিয়া ছিল প্রথম যান্ত্রিকায়িত বস্ত্রকল।
চরকা (১৩শ শতাব্দী)
চরকা সম্ভবত ভারত থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপে আনা হয়। চরকার ব্যবহার সূতা তৈরির প্রক্রিয়াকে অনেক সহজ করে তোলে এবং বস্ত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দাবা (Chess) (১৪৫০)
দাবা খেলার প্রাচীনতম পূর্বপুরুষরা ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে আবির্ভূত হয়। তারপর পারস্য এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্য দিয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে খেলাটি ইউরোপে এর বর্তমান রূপে পরিণত হয়েছিল।
ফরেস্ট গ্লাস (Forest Glass) (আনুমানিক ১০০০)
এই ধরণের গ্লাস তৈরিতে কাঠের ছাই এবং বালি প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। গ্লাসের রঙে সবুজ-হলুদাভের বৈচিত্র দেখা যায়।
ঘষা পাথর (Grindstones) (৮৩৪)
লোহার জিনিস ধার করার জন্য ঘষা পাথর ব্যবহার করা হয়। পাথরগুলো সাধারণত বেলেপাথর দিয়ে তৈরি হয়। প্রথম ঘূর্ণমান 'grindstone' (একটি হাতল দিয়ে ঘুরানো) দেখা যায় "Utrecht Psalter" (ইউট্রেচ সল্টার)-এ, যেটি ৮১৬ এবং ৮৩৪ এর মধ্যে চিত্রিত করা হয়েছে।[৯৪] হ্যাগারম্যানের মতে, কলম দিয়ে আঁকা ছবিটি একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপির নকল।[৯৫] "Luttrell Psalter" (লাট্রেল সল্টার)-এ ১৩৪০ সালে অঙ্কিত ছবিতে একটি ক্ল্যাংক দেখা যায়, যেটি এক্সেলের অপর প্রান্তে লাগানো ছিল।[৯৬]
মদ (Liquor) (১২শ শতাব্দী)
ব্যাবিলনীয়রাও[৯৭] প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয়রা আদিম ধরনের 'distillation' (পাতন প্রক্রিয়া) সম্পর্কে জানতো।[৯৮] 'আলেকজান্দ্রিয়া' (রোমান মিশর-এ)-তে প্রথম শতাব্দীতে কাজ করা রসায়নবিদদের কাছ থেকেও পাতন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়।[৯৯] মধ্যযুগীয় আরব রসায়নবিদরা পাতন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে[১০০] এবং পরে তা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সালের্নো ও কোলনে জল, মদ এবং অন্যান্য 'spirits' এর পাতনের উপর গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।[১০১]
চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগ এবং পরে মধ্যযুগে ইউরোপে মদের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। কারণ, পাতনের মাধ্যমে তৈরি মদ 'কালো মৃত্যু' রোগের প্রতিকার হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এই 'spirits' গুলোতে রসায়নবিদের শুদ্ধ পাতিত মদের তুলনায় অনেক কম অ্যালকোহল (ABV- প্রায় ৪০%) থাকত এবং সম্ভবত এগুলোকে প্রথমে ভেষজ 'elixirs' (ঔষধি প্রলেপ) হিসেবে ভাবা হতো। ১৪০০ সালের দিকে, গম, বার্লি এবং রাই থেকে 'spirits' পাতনের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এভাবে জিন (ইংল্যান্ড) এবং গ্রাপ্পা (ইতালি) সহ ইউরোপের "জাতীয়" পানীয়গুলোর সূচনা হয়।[১০২]
চুম্বক (Magnets) (১২শ শতাব্দী)
১১৫৫ এবং ১১৬০ এর মধ্যে রচিত "Roman d'Enéas" (রোমান ডি'এনিয়াস)-এ প্রথম চুম্বকের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আয়না (Mirrors) (১১৮০)
১১৮০ সালে আলেকজান্ডার নেকহ্যাম প্রথম "কাচ" আয়নার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন "কাঁচের পিছনে থাকা সীসা সরিয়ে দিলে আয়নায় কারো প্রতিবিম্ব দেখা যাবে না।"
চিত্রিত শল্য চিকিৎসার মানচিত্র (Illustrated Surgical Atlas) (১৩৪৫)
গুইডো দা ভিগেভানো (প্রায় ১২৮০-১৩৪৯) প্রথম লেখক যিনি তার শারীরবৃত্তীয় বর্ণনায় চিত্র যুক্ত করেন। তাঁর "Anathomia" (অ্যানাথোমিয়া) বইতে স্নায়ু-শারীরবৃত্তীয় কাঠামো ও কৌশলের ছবি পাওয়া যায়, যেমন মাথার খুলি 'ট্রেফিনেশন' পদ্ধতিতে বিচ্ছেদ, 'মেনিনজেস', 'গুরুমস্তিষ্ক', এবং 'সুষুম্নাকাণ্ড' এর চিত্র।[১০৩]
সঙ্গনিরোধ (Quarantine) (১৩৭৭)
'কালো মৃত্যু' রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসেবে রাগুসা প্রজাতন্ত্র কর্তৃক প্রাথমিকভাবে চল্লিশ দিনের জন্য 'সঙ্গনিরোধ' প্রবর্তন করা হয়েছিল। পরে ভেনিস এটি গ্রহণ করে এবং সেখান থেকে অনুশীলনটি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ইঁদুরধরা ফাঁদ (Rat traps) (১১৭০-র দশক)
ক্রিশ্চিয়ান ডি ট্রয়েস-এর 'Yvain, the Knight of the Lion' নামক মধ্যযুগীয় রোমান্স গল্পে ইঁদুরের ফাঁদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়।
স্তরযুক্ত বর্ম (৫ম শতাব্দীর পূর্বে - ১৪শ শতাব্দী)
৫ম থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করা হত। এই সময়ের অধিকাংশ সৈন্য 'প্যাডেড' বা 'স্তরযুক্ত' বর্ম ব্যবহার করত। এটি ছিল সবচেয়ে সস্তা এবং সহজলভ্য বর্ম, যা অধিকাংশ সৈন্যের জন্য উপযুক্ত ছিল। 'স্তরযুক্ত' বর্ম সাধারণত মোটা লিনেন ও উল দিয়ে তৈরি জ্যাকেট, যা ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত ও হালকা আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারত। যদিও এই প্রযুক্তি ৫ম শতাব্দীর আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছিল, তবুও এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। কারণ এটি ছিল কম খরচে তৈরি করা সম্ভব এবং সেই সময়ের অস্ত্র-প্রযুক্তির কারণে গ্রিক ও রোমানদের ব্রোঞ্জের বর্ম প্রায় অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল। 'স্তরযুক্ত' বর্ম অন্যান্য ধরণের বর্মের সাথেও ব্যবহার করা হত। এটি সাধারণত চামড়ার, 'মেল' বর্মের এবং পরবর্তীতে 'প্লেট' বর্মের উপরে বা নীচে পরা হত।[১০৪]
কুইয়ার বুইলি (৫ম - ১০ম শতাব্দী)
কুইয়ার বুইলি (Cuir Bouilli) নামে পরিচিত শক্ত চামড়ার বর্ম ছিল স্তরযুক্ত (quilted) বর্মের তুলনায় উন্নত। চামড়াকে নরম করার জন্য এবং আকার দেওয়ার জন্য প্রথমে একে পানি, মোম অথবা তেলে সেদ্ধ করা হত। এরপর একে শুকাতে দেওয়া হত এবং চামড়া শক্ত ও দৃঢ় হত। এই প্রক্রিয়ায় বক্ষপট্ট (breastplates), হেলমেট এবং লেগ গার্ডের মত বর্মের বড় অংশগুলো তৈরি করা হত। অনেক সময় ছোট ছোট টুকরোকে স্তরযুক্ত বর্মের সাথে সেলাই করে দেওয়া হত অথবা লিনেন জ্যাকেটের বাইরের দিকে রেখা বরাবর সেলাই করে দেওয়া হত। স্তরযুক্ত বর্মের তুলনায় এটি অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল ছিল, কিন্তু ধারালো বা তীক্ষ্ণ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক ভালো সুরক্ষা প্রদান করত।
চেইন মেইল (১১শ - ১৬শ শতাব্দী)
১১শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে হবারক (Hauberk) নামে পরিচিত চেইন মেইল বর্ম সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হত। এটির আরেক নাম ক্যারোলিনজিয়ান বাইর্নি (Carolingian byrnie), যা ১১শ শতাব্দীর আগে প্রচলিত ছিল।[১০৫] এই বর্ম পরস্পর জড়িত ধাতব রিং দিয়ে তৈরি করা হত এবং এতে মাথার জন্য কইফ (coif) এবং ধড়, বাহু ও হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে রাখার জন্য টিউনিক (tunic) থাকত। হালকা ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য চেইন মেইল বেশ কার্যকর ছিল। তবে, ভেদকারী বা ছুরিকাঘাত ঠেকাতে এটি ততটা কার্যকর ছিল না। এর বড় সুবিধা ছিল এটি শরীরে চলাচলের স্বাধীনতা দিত এবং স্তরযুক্ত (quilted) বা শক্ত চামড়ার বর্মের তুলনায় তুলনামূলক হালকা ও নিরাপদ ছিল। তৈরিতে বিপুল শ্রমের প্রয়োজন হওয়ায় চেইন মেইল শক্ত চামড়া বা স্তরযুক্ত বর্মের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয়বহুল ছিল। তাই এটি সাধারণ সৈন্যদের ক্রয়সীমার বাইরে ছিল এবং শুধুমাত্র ধনী সৈন্যরা এটি কিনতে পারত। পরবর্তীতে, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্যান্ডেড মেইল (banded mail) জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[১০৬] ওয়াশার আকৃতির লোহার রিংগুলো একের উপর এক স্তরে সাজিয়ে চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে এই ব্যান্ডেড মেইল তৈরি করা হত। এটি তৈরি করা ছিল অনেক সাশ্রয়ী। ওয়াশারগুলো এত ঘন করে বোনা থাকত যে তা ভেদ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং তীর বা বোল্টের আক্রমণ থেকেও বেশি নিরাপত্তা প্রদান করত।[১০৭]
জ্যাজারেন্ট (একাদশ শতাব্দী)
জ্যাজারেন্ট বা জ্যাজারেইন্ট ছিল চেইন মেইলের এক উন্নত রূপ। এই বর্মে লিনেন বা স্তরযুক্ত (quilted) বর্মের স্তরের মধ্যে চেইন মেইল সেলাই করে দেওয়া হত।[১০৮] হালকা ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাত প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত কার্যকর ছিল এবং তীরের মত ছোট ছুঁড়ে মারা অস্ত্রের আঘাত থেকেও কিছুটা উন্নত সুরক্ষা প্রদান করত। তবে, গদা বা কুঠারের মত বড় ভোঁতা অস্ত্রের বিরুদ্ধে এটি তেমন সুরক্ষা দিতে পারত না। জ্যাজারেন্ট বর্মের ধারণার ফলে আরো শক্তিশালী চেইন মেইলের জন্ম হয়, যা দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই শক্তিশালী বর্মে চেইন মেইলের সাথে ধাতব প্লেট বা শক্ত চামড়ার প্লেট সেলাই করে দেওয়া হত। এটি ছুরিকাঘাত বা তীরের আঘাত থেকে অনেক ভালো সুরক্ষা প্রদান করত।
স্কেল বর্ম (দ্বাদশ শতাব্দী)
স্কেল বর্ম লেমেলার বর্মের (Lamellar armour) একটি প্রকার।[১০৯] এটি সম্পূর্ণভাবে ছোট ছোট ও অধিক্রমণশীল (overlapping) প্লেট দিয়ে তৈরি করা হত। এই প্লেটগুলো সাধারণত চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে একসাথে সেলাই করা হত, অথবা লিনেন বা স্তরযুক্ত (quilted) বর্মের মতো একটি আস্তরণের সাথে যুক্ত করা হত। স্কেল বর্ম তৈরিতে চেইন মেইলের তুলনায় অনেক কম শ্রমের প্রয়োজন হয় এবং তাই এটি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সাশ্রয়ী ছিল। এটি ছুরিকাঘাত ও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের বিরুদ্ধে চেইন মেইলের তুলনায় অনেক ভালো সুরক্ষা প্রদান করত। তবে, স্কেল বর্ম বেশ ভারী ও শক্ত ছিল এবং শরীরে চলাচলে বাঁধা সৃষ্টি করত।
প্লেট বর্ম (চতুর্দশ শতাব্দী)
প্লেট বর্ম পুরো শরীরকে ঢেকে রাখত। ১২৫০ সালের দিকে হাঁটু ঢাকার জন্য পোলেইন (Poleyns) এবং কনুই রক্ষা করার জন্য কাউটার (Couters) এর মত প্লেট বর্ম ব্যবহার করা হলেও,[১১০] কোন কাপড়ের ব্যবহার ছাড়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্লেট বর্ম দেখা যায় ১৪১০-১৪৩০ সালের দিকে।[১১১] মধ্যযুগীয় প্লেট বর্মের একটি সম্পূর্ণ স্যুট তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলো হল কুইরাস (cuirass), গর্জেট (gorget), ভ্যামব্রেস (vambraces), গন্টলেটস (gauntlets), কুইসিস (cuisses), গ্রীভস (greaves), এবং সাবাটন (sabatons) যা চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে একসাথে আটকানো থাকত। ক্রসবো এবং লংবো-র মত উন্নত অস্ত্রের বিকাশের ফলে অস্ত্রের আঘাতের ক্ষমতা এবং ব্যাপ্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। এই অস্ত্রগুলো সহজেই চেইন মেইল হবারক ভেদ করতে পারত।[১১২] পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে হবারক ছাড়াই প্লেট বর্ম ব্যবহার শুরু হয়।[১১৩] ব্লাস্ট ফার্নেস (blast furnace) এর মত ধাতুবিদ্যার অগ্রগতি এবং ধাতুকে শক্ত করার নতুন কৌশলের ফলে প্লেট বর্ম প্রায় অভেদ্য হয়ে ওঠে এবং সেসময়ে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করত। যদিও প্লেট বর্ম মোটামুটি ভারী ছিল, তবুও পরিধানকারীর মাপ অনুযায়ী তৈরি করা হত বলে তাতে চলাচলে তেমন সমস্যা হত না। এক সম্পূর্ণ প্লেট বর্মের স্যুট ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং বেশিরভাগ সৈন্যের জন্য অপ্রাপ্য। শুধুমাত্র ধনী ভূস্বামী এবং অভিজাত শ্রেণীর মানুষই এটি কিনতে পারত। ধাতুবিদ্যায় দক্ষতার বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লেট বর্মের গুণমানও উন্নত হতে থাকে। প্লেট বর্মের স্যুট সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে এবং অলংকরণ ও খোদাই দিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করা হত। সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত যুদ্ধে প্লেট বর্মের ব্যবহার অব্যাহত ছিল।
বক্রাকৃতির স্যাডল (একাদশ শতাব্দী)
বক্রাকৃতির স্যাডল অশ্বারোহীদের কাঁধের নিচ দিয়ে বর্শা ব্যবহার করার সুবিধা করে দেয় এবং ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় ভারসাম্য রক্ষা করে। এই উদ্ভাবনের ফলে 'শক ক্যাভালরি' বা আক্রমণাত্মক অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আবির্ভাব ঘটে, যারা সর্বোচ্চ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ করতে পারত।
স্পার (একাদশ শতাব্দী)
স্পার নরম্যানদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয় এবং স্যাডলের সাথে প্রায় একই সময়ে ব্যবহার শুরু হয়। স্পার অশ্বারোহীদের তাদের পা দিয়ে ঘোড়া নিয়ন্ত্রণ করার সুবিধা দেয়, যা চাবুকের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দেয় এবং হাতকে মুক্ত রাখে। কাউবয় সিনেমা থেকে পরিচিত Rowel spurs ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই বিদ্যমান ছিল। সোনালী রঙের স্পার ছিল রণবীর বা নাইটহুডের চরম প্রতীক – এমনকি আজও বলা হয় যে কেউ তার উপযুক্ততা প্রমাণ করে "তার স্পার অর্জন" করে।
স্ট্রাইআপ (ষষ্ঠ শতাব্দী)
স্ট্রাইআপ চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান মঙ্গোলিয়া ও উত্তর চীনের স্তেপ যাযাবরদের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল। এটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এবং অষ্টম শতাব্দীতে ক্যারোলিনজিয়ান সাম্রাজ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। স্ট্রাইআপ অশ্বারোহীকে দূর থেকে তরবারি ব্যবহার ও আঘাত করার সুবিধা প্রদান করে; যার মাধ্যমে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের অনেক বেশি সুবিধা লাভ করেন।
কামান (১৩২৪)
১৩২৪ সালে মেটজ অবরোধের সময় ইউরোপে প্রথম কামান ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৩৫০ সালে ফ্রাঞ্চেসকো পেত্রারক লিখেছিলেন, "এই যন্ত্রগুলো ভয়ানক শব্দ ও আলোকচ্ছটার সাথে ধাতুর গোলা ছুঁড়ে দেয়... কয়েক বছর আগেও এগুলো ছিল খুবই বিরল এবং অত্যন্ত বিস্ময় ও শ্রদ্ধার সাথে দেখা হত। কিন্তু এখন এগুলো অন্যান্য অস্ত্রের মতোই সাধারণ হয়ে উঠেছে।"[১১৪]
ভলি গান (Volley Gun)
রিবল্ডিকিন (Ribauldequin) দেখুন।
কর্নেড বারুদ (চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ)
পশ্চিম ইউরোপে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল, কালো গুঁড়োকে কর্নিং (corning) করা কামানের আরও শক্তিশালী এবং দ্রুত প্রজ্বলনের সুযোগ করে দেয়। এটি কালো গুঁড়োর সংরক্ষণ এবং পরিবহনও সহজ করে তোলে। গান-পাউডার যুদ্ধে কর্নিং একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল।
অতি বৃহৎ ক্যালিবারের কামান (চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ)
বর্তমান উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে রট-আয়রনের (wrought-iron) 'Pumhart von Steyr', 'Dulle Griet' এবং 'Mons Meg' এবং কাস্ট-ব্রোঞ্জের (cast-bronze) 'Faule Mette' ও 'Faule Grete' (সবগুলোই পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে)।
ভারসাম্যহীন গুলতি যন্ত্র (Counterweight trebuchet) (১২শ শতাব্দী)
শুধুমাত্র মহাকর্ষ শক্তির সাহায্যে পরিচালিত এই গুলতি যন্ত্রগুলো মধ্যযুগের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার এবং দুর্গ নির্মাণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। কারণ এগুলো বিশাল আকারের পাথর অভূতপূর্ব দূরত্বে নিক্ষেপ করতে পারত। ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে উদ্ভাবিত এই যন্ত্র বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ১১০০ সালের দিকে প্রবর্তিত হয়। পরবর্তীতে ক্রুসেডার রাষ্ট্রসমূহ এবং ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য সেনাবাহিনী দ্বারা এটি গৃহীত হয়।[১১৫]
গ্রিক ফায়ার (৭ম শতাব্দী)
এক ধরণের জ্বলন্ত অস্ত্র (দাহ্য পদার্থ) যা পানিতেও জ্বলতে পারে। এটি বাইজেন্টাইনদের আবিষ্কার বলে ধারণা করা হয়। তারা তাদের জাহাজে এই বিশেষ অস্ত্র ব্যবহার করত। ৭১৭-৭১৮ সালে কনস্টান্টিনোপল অবরোধের সময় উমাইয়া খিলাফতের বিরুদ্ধে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিজয়ে গ্রিক ফায়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রেনেড (৮ম শতাব্দী)
প্রাথমিক ধরনের জ্বলনশীল গ্রেনেড বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে দেখা যায়। বাইজেন্টাইন সৈন্যরা শিখেছিল যে পূর্ববর্তী শতাব্দীতে বাইজেন্টাইনদের আবিষ্কৃত গ্রিক ফায়ার শুধুমাত্র শত্রুর উপর ফ্লেমথ্রোয়ার দিয়ে নিক্ষেপ করা যায় না, পাথর ও মৃৎপাত্রের বোতলেও সংরক্ষণ করা যায়।
সুশৃঙ্খল তীরন্দাজ ব্যবহার করে লংবো (১৩শ শতাব্দী)
দ্রুত নিক্ষেপের হার এবং ভেদনশীল ক্ষমতা থাকার কারণে লংবো মধ্যযুগীয় নাইটদের অবসানে অবদান রাখে।[সন্দেহপূর্ণ ] শত বছরের যুদ্ধে (১৩৩৭-১৪৫৩) ইংরেজরা ফরাসি অশ্বারোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লংবো বিশেষ সফলতার সাথে ব্যবহার করে।
ইস্পাতের তীরচালক (Crossbow) (১৪শ শতাব্দীর শেষার্ধ)
ইউরোপীয় উদ্ভাবনের স্বাক্ষর বহন করে বিভিন্ন ধরনের সহায়ক যন্ত্রাংশ, যা টান সক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। এটিই প্রথম হাতে ধরে ব্যবহারযোগ্য যান্ত্রিক তীরচালক।
মিশ্র অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল (১৪শ শতাব্দী)
১৩৩৩ সালে হ্যালিডন হিলের যুদ্ধে প্রথমবারের মতো ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে মিশ্র অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল প্রয়োগ করা হয়।[সন্দেহপূর্ণ ] ইংরেজ সৈন্যরা তীরন্দাজদের পাশে অশ্বারোহীদের অবস্থান নিয়েছিল। এতে, ভারী পদাতিক বাহিনীর স্থায়িত্ব এবং তাদের দ্বি-হাতের অস্ত্রের আঘাতের শক্তি, লংবো ও শর্টবো ব্যবহারকারী তীরন্দাজদের নিক্ষেপাত্মক অস্ত্র ও গতিশীলতার সাথে একত্রিত হয়। অশ্বারোহীদের নিয়ে গঠিত রণবীর বা নাইট এবং সৈন্যদের তীরন্দাজদের সাথে যুক্ত করা পশ্চিমা মধ্যযুগীয় যুদ্ধের আদর্শ কৌশল ছিল। এই কৌশল ১৫১৩ সালের ফ্লোডেনের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এবং আগ্নেয়াস্ত্রের চূড়ান্ত উত্থানের আগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
|s2cid=
value (সাহায্য)। ডিওআই:10.1088/0957-0233/12/3/706।
Early in the Han dynasty, between 300 and 200 BC, the Chinese fashioned a rudimentary compass out of lodestone. [...] This compass may have been used in the search for gems and in the selection of sites for houses. [...] Their directive power led to the use of compasses for navigation [...]
প্রাচীন সময়কাল:
মধ্যযুগীয় সময়কাল:
সাধারণ: