মনসা | |
---|---|
সর্প/নাগ দেবী | |
অন্যান্য নাম | কেতকা, পদ্মাবতী |
অন্তর্ভুক্তি | নাগ দেবী |
বাহন | সর্প, রাজহংস |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | |
সঙ্গী | জগৎকারু |
সন্তান | আস্তিক মুনি |
মনসা (সংস্কৃত: मनसा) হলেন একজন পৌরাণিক হিন্দু সর্প/নাগ দেবী। দেবীর উল্লেখ মহাভারত সহ দেবীভাগবত পুরাণ আদি অনেকানৈক পুরাণে দেবী মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি প্রধানত পূর্ব্বভারতীয় অঞ্চল অবিভাজিত বঙ্গদেশ,অঙ্গদেশ, মিথিলা, কামরূপ এবং উৎকলে যেকোনো বিষধর প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা ও বিষের প্রতিকার পেতে, প্রজনন ও ঐশ্বর্যলাভের উদ্দেশ্যে তার পূজা করা হয়। মনসা ঘট স্থাপন করে পুজো করা হয়। মনসা নাগ-রাজ বাসুকীর ভগিনী এবং ঋষি জরৎকারুর স্ত্রী।[১] তার অপর নামগুলি হল বিষহরি বা বিষহরা (বিষ ধ্বংসকারিণী), নিত্যা (চিরন্তনী) ও পদ্মাবতী।[২]
শিবের স্বীকৃতকন্যা মনসা। জরৎকারু মনসাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মনসার মা চণ্ডী (শিবের স্ত্রী পার্বতী) তাঁকে ঘৃণা করতেন কিন্তু পরবর্তীতে মাতা চণ্ডী মনসাকে নিজের মেয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কোনো কোনো ধর্মগ্রন্থে আছে, শিব নয়, ঋষি কশ্যপ হলেন মনসার পিতা। মনসাকে ভক্তবৎসল বলে বর্ণনা করা হলেও, যিনি তার পূজা করতে অস্বীকার করেন, তার প্রতি তিনি নির্দয়।[৩] জন্ম-সংক্রান্ত কারণে মনসার পূর্ণ দেবীত্ব প্রথমে অস্বীকার করা হয়েছিল। তাই মনসার উদ্দেশ্য ছিল দেবী হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করা এবং একটি একনিষ্ঠ মানব ভক্তমণ্ডলী গড়ে তোলা।[৪] তার সাথে মিশরীয় দেবী আইসিসের মিল রয়েছে।
মনসা, কেতকা, পদ্মাবতী—এই নামেই মনসাদেবী সমধিক প্রসিদ্ধ। ইনিই মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাই এই কাব্যকে মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ বলে। মনসা প্রাক্-পৌরাণিক দেবী। ইনি প্রাচীন পুরাণে স্থান পাননি অথচ লোকব্যবহারে ও লোকসাহিত্যে অর্বাচীন বৈদিককাল থেকে বিভিন্ন রূপ পরিবর্তন করে চলে আসছেন। অবশ্য কোন কোন প্রাচীন হিন্দু পুরাণ ও বৌদ্ধ গ্রন্থের সর্প দেবী মনসার বর্ণনা আছে। পদ্মাপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও দেবীভাগবতে মনসার উল্লেখ রয়েছে। সংস্কৃত পুরান সাহিত্যে মনসা একবার ঈষৎ ধরা দিয়েছিলেন। সেটা মহাভারতের আদিপর্বে জন্মেজয়ের সর্পসত্রের পূর্বপ্রসঙ্গক্রমে। কিন্তু প্রাচীন পুরাণ ও মহাভারতে যে সর্ব দেবীর উল্লেখ আছে সেখানে তিনি হচ্ছেন জরৎকারু—আস্তিক তার ছেলে। মহাভারতে মনসার ও তার স্বামীর নাম একই—জরৎকারু। ‘মনসা’ দেবতার ভাবনা ঋকবেদের অজ্ঞাত ছিল না। ঋগ্বেদের একটি শ্লোকে মনসা দেবীর ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ত্রী সপ্ত ময়ুর্যঃ সপ্ত স্বসারো অগ্রু বঃ।
তাস্তে বিষং বিজভ্রির উদকং কুম্ভিনীরিব॥
‘তিন সাত ময়ূরী, সাত ভগিনী কুমারী, তাহারা তোমার বিষ তুলিয়া লইতেছে, যেমন কলসীকাঁখে মেয়েরা (কুপ হইতে) জল (লইয়া যায়)।’[৫]
পুরাণে তাকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ-জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে। খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী নাগাদ মনসা প্রজনন ও বিবাহের দেবী হিসেবে চিহ্নিত হন এবং শিবের আত্মীয় হিসেবে শৈব দেবমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হন। কিংবদন্তি অনুসারে, শিব বিষ পান করার পর মনসা মধ্যে তা সঞ্চার হয় এবং মনসা ‘বিষহরী’ নামে পরিচিত হন। মনসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং তা দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে মনসা-কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোষ্ঠীটি শৈবধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। এর ফলে শিবের কন্যা রূপে মনসার জন্মের উপাখ্যানটি রচিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শৈবধর্মও এই আদিবাসী দেবীকে মূলধারার হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্ভুক্ত করে ।[৬]
মনসার কাহিনী পঞ্চদশ শতাব্দী শেষ হবার আগেই পরিপূর্ণ পাঁচালিরূপ ধারণ করেছিল। এর ইঙ্গিত পাই বিপ্রদাস পিপ্লাইয়ের ‘মনসাবিজয়’ কাব্যে। বিপ্রদাসের কাব্যখানি রচিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে। বাস্তুদেবতার, আরোগ্যের দেবতা অথবা সম্পদের দেবতা—এই বিভিন্ন নামে মনসার পূজা এদেশে বরাবর চলে এসেছে। এখন ইনি বিশেষ করে সাপের দেবতা, তবে নিজে সাপ নন। আরোগ্য ও পুষ্টির রূপকাশ্রিত দেব ভাবনা বলে এঁর মহিমা বেদের সময় থেকেই গীত। মনসা মুখ্যত সরস্বতী। ইঁহারই নামান্তর ইলা, পুষ্টি, শ্রী। ইনি গৌরী যিনি জল কেটে একপদী দ্বিপদী চতুষ্পদী অষ্টাপদী নবমপদী সৃষ্টি করেছিলেন। ইনিই বাক্ যিনি নারীরূপে গন্ধর্বদের ছলনা করে দেবতাদের সোম এনে দিয়েছিলেন, যা অমৃত। দেবীর এই প্রসন্ন রূপ কিন্তু বাংলা সাহিত্যে গোড়া থেকেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। এখানে মনসা চণ্ডীর প্রতিদ্বন্দ্বী, শিবভক্তের বিদ্বেষিণী।
ঋগ্বেদের একটি রূপক ভাবনাও পরে দেবীত্বে মূর্তি পেয়েছিল। তিনি দুর্গম অরণ্যের দেবতা। পৌরাণিক সাহিত্যে ইনি দুর্গতের দেবতা দুর্গা (এবং পার্বতী, চণ্ডী) হয়েছেন। তারও পূর্বে ইনি সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে অভিন্ন ছিলেন। পৌরাণিক যুগের আগেই সরস্বতী ও শ্রীর সঙ্গে বাস্তুনাগ দেবতার পূজা মিশে গিয়েছিল। তখন হতে মনসা নিজে নাগ না হয়েও সর্পরাজ্ঞী। সরস্বতী ও শ্রী দুই পৃথক দেবতায় (মনসা ও লক্ষ্মী) পরিণত হবার আগেই নাগ-পূজার সঙ্গে দেবীর যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল। পরে সরস্বতী ও শ্রী যখন ভাগাভাগি হল তখন মনসার ভাগে পড়ল সর্পনাগ আর লক্ষ্মীর ভাগে পড়ল হস্তীনাগ। মনসা ও লক্ষ্মীর মৌলিকতার অনেক প্রমাণ আছে। দুই জনেরই নামান্তর কমলা ও পদ্মা। পদ্মদলে মনসার উৎপত্তি আর কমলার আসন পদ্মে। লক্ষ্মীর উৎপত্তি সাগরে, মনসার উৎপত্তি হ্রদে।
অর্বাচীন পৌরাণিক সাহিত্যে মনসার ও সরস্বতীর প্রাচীনত্বের ও মৌলিকত্বের বিশেষত্ব অত্যন্ত স্পষ্ট। সরস্বতী অবিবাহিত (মতান্তরে তিনি বিষ্ণুপত্নী), মনসাও স্বাধীন নারী (জরৎকারুর সঙ্গে তার বিবাহ দেবসমাজে কেবল মুখরক্ষা মাত্র)। সরস্বতীকে স্রষ্টা (ব্রহ্মা) কামনা করেছিলেন, মনসাকে পিতা (শিব) কামনা করেছিলেন। সরস্বতী বিদ্যাদেবী, মনসা প্রথমে বাক্ পরে মূর্তিমতী বিষবিদ্যা। সরস্বতী গীতবাদ্যের দেবী, মনসা গীতবাদ্যপ্রিয়—গান-বাজনা না হলে তার পূজা হয় না এবং এই গীতনৃত্য করেই বেহুলা তার (মনসার) প্রসাদ লাভ করেছিলেন। এদেশে মনসা-কাহিনীর সূত্রপাত বৈদিক যুগে, কিন্তু পূর্ব-ভারতে বৈদিক যুগ শেষ হওয়ার আগেই মনসা বাস্তুদেবতায় ও গ্রামদেবীতে পরিণত হয়েছিলেন। তারপর ধাপে ধাপে তার অবনতি ঘটে। আধুনিক সময়ে তিনি ভদ্র দেবসমাজ-বহিস্কৃত নারীপূজিত দেবী রূপেই প্রধানত রয়ে গিয়েছেন। গ্রামদেবীরূপে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চণ্ডী (বিশালাক্ষী) এই নাম এবং ধাম আত্মসাৎ করে ফেলেছেন। অনেক রকম প্রাচীন দেবভাবনা ও রূপকল্পনা নানাদিগ্-দেশাগত কাহিনী মিলেমিশে মনসামঙ্গলে মনসার কাহিনী গঠিত। এতে বহু উপাদান আছে,—
মনসার মূর্তিতে তাকে সর্প-পরিবেষ্টিত নারী রূপে দেখা যায়। তিনি একটি হংস বা পদ্মের উপর বসে থাকেন। তার বাহন হাঁস ও সাপ। তার চার হাত। তার উপরের দুটি হাতে থাকে পদ্ম ও নিচের দুটি হাতে থাকে সাপ। সাতটি সাপের ফনা তার মাথার উপর ছাউনির আকারে বিরাজ করে। কোনো কোনো মূর্তিতে তার কোলে একটি শিশুকে দেখা যায়। এই শিশুটি তার পুত্র আস্তিক।[৮] তাকে ‘একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবী’ বলা হয়। মনসার মা চণ্ডী ক্রোধের বসে তার একটি চোখ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মানব সমজের গতি অর্থাৎ প্রবহমানতার মাধ্যম হলো সৃষ্টি। এই মনসা ঘট হলো গর্ভবতী নারীর প্রতীক। যেখান থেকে প্রাণ সঞ্চার হয়ে মানব জীবন ক্রম বিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। মনসা ঘট যেমন গর্ভবতী নারীর প্রতীক তেমনই ফসলের উর্বরতার প্রতীক,যাকে প্রজনন শক্তির প্রতীক হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।[৯]
মহাভারতে মনসার বিবাহের উপাখ্যানটি রয়েছে। জরৎকারু নামে এক ঋষি কঠোর তপস্যা করছিলেন। তিনি স্থির করেছিলেন যে, বিবাহ করবেন না। একবার তিনি কয়েকজনকে একটি গাছ থেকে হেঁটমুণ্ড উর্ধ্বপদ অবস্থায় ঝুলতে দেখলেন। তারা ছিলেন জরৎকারুরই পূর্বপুরুষ। তাদের সন্তানসন্ততিগণ তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি না করার কারণে তাদের ওই অবস্থা হয়েছিল। তাই তারা জরৎকারুকে বিবাহ করে একটি পুত্রসন্তান উৎপাদনের পরামর্শ দিলেন, যাতে সেই পুত্র তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে তাদের মুক্তি দিতে পারেন। বাসুকী তার ভগিনী মনসার সঙ্গে জরৎকারুর বিবাহ দিলেন। মনসার একটি পুত্রসন্তান হল। তার নাম ছিল আস্তিক। তিনি তার পূর্বপুরুষদের মুক্ত করলেন। এছাড়া রাজা জনমেজয় যখন সর্পকুল বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করছিলেন, তখন আস্তিক নাগ বংশকে রক্ষাও করেছিলেন।[১০]
পুরাণেই প্রথম মনসার জন্ম-সংক্রান্ত উপাখ্যানটি পাওয়া যায় । পুরাণ মতে , মনসা ঋষি কশ্যপের সন্তান তথা কাশ্যপ গোত্রজ । উল্লেখ্য , মঙ্গলকাব্যে শিবকে মনসার পিতা বলা হলেও , পুরাণে সেই তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না । একবার সাপ ও সরীসৃপরা পৃথিবীতে উৎপাত শুরু করলে , ঋষি কশ্যপ নিজের মন থেকে মনসা দেবীর জন্ম দেন । মন থেকে জন্ম বলে তার নাম হয় ‘মনসা’ । সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাকে সর্প ও সরীসৃপদের দেবী করে দেন । মনসা তার মন্ত্রবলে পৃথিবীতে নিজের কর্তৃত্ব বিস্তার করেন । এরপর মনসা শিবকে প্রসন্ন করেন । শিব তাকে বলেন নারায়ণ প্রসন্ন করতে । মনসার প্রতি প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ তাকে সিদ্ধি নামক দৈবী ক্ষমতা প্রদান করেন । এর ফলে দেবী হিসেবে মনসার কর্তৃত্ব সুবিদিত হয় ।
কশ্যপ ঋষি জরৎকারুর সঙ্গে মনসার বিয়ে দেন । জরৎকারু এই শর্তে মনসাকে বিবাহ করতে রাজি হয়েছিলেন যে , যদি মনসা তার কথার অবাধ্য হন , তবে তিনি মনসাকে পরিত্যাগ করবেন । একবার মনসা জরৎকারুর নিদ্রাভঙ্গ করতে দেরি করেছিলেন । এতে সেদিন জরৎকারুর পূজা করা হয়ে ওঠেনি । এই ঘটনায় দুঃখিত হয়ে জরৎকারু মনসাকে ত্যাগ করেন । পরে দেবতাদের অনুরোধে তিনি মনসার কাছে ফিরে আসেন এবং আস্তিক নামে এক পুত্রের জন্ম দেন ।[১১]
খ্রিস্টীয় ১৩শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে মনসা প্রমুখ দেবদেবীদের নিয়ে মঙ্গলকাব্য নামক এক শ্রেণির ভক্তিমূলক লৌকিক গাথাকাব্য রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য ও বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় (১৪৯৫) কাব্যে দেবী মনসার উৎপত্তি ও কিংবদন্তিগুলি বর্ণিত হয়েছে।
মনসাবিজয় কাব্যে আছে, বাসুকীর মাতা একটি বালিকার মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তিতে শিবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হলে তা থেকে মনসার জন্ম হয়। বাসুকী মনসাকে নিজ ভগিনী বলে স্বীকার করে নেন। রাজা পৃথু যখন গাভীরূপী পৃথিবীকে দোহন করছিলেন, তখন তা থেকে বিষের উৎপত্তি হয়। বাসুকী মনসাকে সেই বিষের কর্তৃত্ব প্রদান করেন। শিব মনসাকে দেখে আকৃষ্ট হন। কিন্তু মনসা তাকে নিজ পিতৃপরিচয় দান করলে, শিব মনসাকে গৃহে নিয়ে আসেন। শিবের স্ত্রী চণ্ডী মনে করেন, মনসা শিবের অপর স্ত্রী বা তার জারজ সন্তান। তিনি মনসাকে অপমান করে তার একটি চোখ দগ্ধ করেন। মনসা একচক্ষু-বিশিষ্ট দেবীতে পরিণত হন। পরে সমুদ্রমন্থনের সময় হলাহল বিষের প্রভাবে শিব যখন মৃতপ্রায় হন, তখন মনসা তার প্রাণরক্ষা করেন। একদিন চণ্ডী মনসাকে লাথি মারেন। মনসা তখন বিষদৃষ্টি দিয়ে চণ্ডীকে অজ্ঞান করে দেন। শেষে চণ্ডী ও মনসার বিবাদে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শিব মনসাকে একটি গাছের নিচে পরিত্যাগ করেন। তবে তিনি মনসার চোখের জল থেকে নেতো বা নেতা নামে মনসার এক সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেন।[১২]
পরে ঋষি জরৎকারু মনসাকে বিবাহ করেন। কিন্তু চণ্ডী মনসার ফুলশয্যার রাত্রিটি মাটি করে দেন। তিনি মনসাকে সর্পালঙ্কার পরিধান করতে বলেছিলেন। তারপর তিনি ফুলশয্যার ঘরে একটি ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ফলে সাপগুলি ঘরময় ছুটে বেড়াতে শুরু করে। ভয় পেয়ে জরৎকারু ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। কয়েক দিন পর অবশ্য তিনি ফিরে আসেন। এরপর তাদের পুত্র আস্তিকের জন্ম হয়।[১৩]
নেতোর পরামর্শে মনসা মর্ত্যে নেমে আসেন মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। প্রথম দিকে মানুষ তাকে উপহাস করত। কিন্তু যারা মনসার ক্ষমতা অস্বীকার করল, তাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুলে মনসা তাদের বাধ্য করলেন তার পূজা করতে। মুসলমান শাসক হাসানের মতো বিভিন্ন জাতির মানুষকে মনসা তার ভক্ত করে তুললেন। কিন্তু চাঁদ সদাগর তার পূজা করলেন না। মনসা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো একজন দেবী হতে চাইছিলেন। তাতে সফল হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের হাতে পূজাগ্রহণ তার কাছে বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু চাঁদ সঙ্কল্প করেছিলেন, তিনি মনসার পূজা করবেন না। মনসা চাঁদকে ভয় দেখানোর জন্য একে একে চাঁদের ছয় পুত্রকে হত্যা করলেন। শেষে মনসা ইন্দ্রের রাজসভার দুই নর্তক-নর্তকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলেন। এঁদের নাম ছিল অনিরুদ্ধ ও ঊষা। অনিরুদ্ধ চাঁদ ও তার স্ত্রী সনকার সপ্তম পুত্র রূপে জন্মগ্রহণ করলেন। তার নাম হল লখিন্দর। ঊষা বেহুলা নামে জন্মগ্রহণ করলেন। লখিন্দর ও বেহুলার বিবাহ হল। মনসা লখিন্দরকে হত্যা করলেন। কিন্তু বেহুলা স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে নদীতে ভেসে চললেন। শেষে তিনি চাঁদের সাত পুত্রের প্রাণ ও হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধার করার উপায় জেনে ফিরে এলেন। চাঁদ মনসার দিকে না তাকিয়েই বাঁ হাতে তার দিকে ফুল ছুঁড়ে দিলেন। মনসা এতেই খুশি হলেন। তিনি চাঁদের পুত্রদের জীবন ফিরিয়ে দিলেন এবং তার হারানো সম্পদও ফিরিয়ে দিলেন। মঙ্গলকাব্যে রয়েছে, এরপর মনসার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেল।[১৪]
মনসামঙ্গল কাব্য গ্রন্থে রয়েছে, পূর্বজন্মে মনসা চাঁদকে বিনা কারণে অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাই চাঁদও মনসাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, তিনি মনসার পূজা না করলে, মনসাপূজা মর্ত্যে জনপ্রিয়তা পাবে না। এই কারণেই, ভক্তদের আকর্ষণ করতে মনসার অসুবিধা হচ্ছিল।[১৫]
আনন্দ কে. কুমারস্বামী ও ভগিনী নিবেদিতা লিখেছেন, “[চাঁদ সদাগর] ও মনসা দেবীর কিংবদন্তিটি [...] নিশ্চয়ই এশীয় সমাজের মাইকিনিয়ান পর্যায়ের সমসাময়িক। এই কিংবদন্তিতে শৈবধর্ম ও বাংলার নারী লোকিক দেবীদের সংঘাতটির প্রতিফলন দেখা যা। এরপর মনসা বা পদ্মা ‘শক্তি’র একটি রূপ হিসেবে স্বীকৃত হয় [...] এবং শৈবরা তার পূজা স্বীকার করে নেন। তিনি ঈশ্বরের মাতৃকাশক্তির এমন একটি ধারা, যাঁকে অনেক ভক্ত দূরবর্তী ও নির্গুণ শিব ধারণার থেকে নিকটতর ও প্রিয়তর মনে করেন।...”[১৬]
আষাঢ় মাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিকে বলা হয় নাগ পঞ্চমী । এ-সময় বাড়ির উঠানে সিজগাছ স্থাপন করে মনসাদেবীর পূজা করা হয় । ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাপঞ্চমী তিথিতেও মনসাপূজার বিধান আছে ।[১৭] বর্তমানে সর্বজনীনভাবে মনসাদেবীর মন্দিরে মনসাপূজা করা হয়। আবার পারিবারিক পর্যায়ে পারিবারিক মন্দিরেও মনসাদেবীর পূজা হয়। প্রধানত সর্পদংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে বা সর্পদংশনের প্রতিকার পেতে মনসার পূজা করা হয়।[১]
বাংলা অঞ্চলেই মনসার পূজা সর্বাধিক জনপ্রিয়।[১৮] এই অঞ্চলে অনেক মন্দিরেও বিধিপূর্বক মনসার পূজা হয়। বর্ষাকালে যখন সাপের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়, তখন মনসার পূজা মহাসমারোহে হয়ে থাকে। নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের কাছে মনসা একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন দেবতা। তারা বিবাহের সময় ও সন্তানকামনায় মনসার পূজা করেন। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মনসার সঙ্গে নেতোর (যিনি নেতা, নেতিধোপানি, নেতলসুন্দরী ইত্যাদি নামেও পরিচিত) পূজাও করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে পুরো শ্রাবণ মাস মনসা পূজা হয়।[১৯] পুজো উপলক্ষে হয় পালা গান ‘সয়লা’। এই পালার বিষয় হল— পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল। সারা রাত ধরে গায়ক দোয়ারপি-সহ পালা আকারে ‘সয়লা’ গান গায়।[২০] পুরুলিয়ায় মনসা পূজায় হাঁস বলি দেওয়া হয়।[২১] রাঢ বাঁকুড়ায় জ্যেষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে দশহরা ব্রত পালন করে মনসা পূজা করা হয়।তখন এখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয়।[২২] মনসা পূজার অঙ্গ হল অরন্ধন। রাঢ়ে চৈতন্যদেবের সময়ে মনসাকে মা দূর্গার এক রূপ মনে করা হত। তাই কোনো কোনো জায়গায় পূজায় বলি দেয়া হত।[২৩] আজো অনেক পূজায় পাঠা বলি হয়।
উত্তরবঙ্গ অঞ্চলে রাজবংশী জাতির কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবীদের অন্যতম হলেন মনসা। প্রায় প্রত্যেক কৃষক গৃহেই মনসার ‘থান’ বা বেদী দেখা যায়।দক্ষিণ দিনাজপুরের ফুলঘড়ায় শরৎকালে দূর্গাপূজার পরিবর্তে মনসা পূজা হয়। ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ পূজা হচ্ছে।[২৪] পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যেও মনসাপূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
বাংলার বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও মনসাপূজা বিশেষ প্রচলিত। এর কারণ মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর, যিনি প্রথম মনসার পূজা করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন বণিক। এই কাব্যের নায়িকা বেহুলাও সাহা নামক এক শক্তিশালী বণিক সম্প্রদায়ের গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ভারতের অসম রাজ্যেও মনসাপূজা বিশেষ জনপ্রিয়। এই রাজ্যে ওজা-পালি নামে একধরনের সংগীতবহুল যাত্রাপালা সম্পূর্ণ মনসার কিংবদন্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
নাগপঞ্চমী তিথি,শ্রাবণ সংক্রান্তি,ডাক সংক্রান্তি ও অন্য দিনে মনসার বিধিপূর্বক পূজা প্রচলিত।[১৯][২৫][২৬] এই উৎসবটি হল একটি সর্পকেন্দ্রিক উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে শ্রাবণ (জুলাই-অগস্ট) মাসে এই উৎসব পালিত হয়। বাঙালি মেয়েরা এই দিন উপবাস করে ব্রত পালন করেন এবং সাপের গর্তে দুধ ঢালেন।[২৭]
"[The] legend of [Chand Sadagar and] Manasā Devī, [...] who must be as old as the Mykenean stratum in Asiatic society, reflects the conflict between the religion of Shiva and that of female local deities in Bengal. Afterwards Manasā or Padmā was recognized as a form of Shakti, [...] and her worship accepted by Shaivas. She is a phase of the mother-divinity who for so many worshippers is nearer and dearer than the far-off and impersonal Shiva...".