মরুজ উদ্ভিদ বা জেরোফাইট (গ্রীক ξηρός xeros শুষ্ক, φυτόν phuton উদ্ভিদ) হ'ল উদ্ভিদ-এর একটি প্রজাতি, যারা অভিযোজন ক্ষমতার সাহায্যে মরুভূমির মতো শুষ্ক বালুকাময় বা আল্পস, আর্কটিক-এর মতো বরফ অথবা তুষর-আচ্ছাদিত অঞ্চল, যেখানে অতি সামান্য তরল জল মেলে, তেমন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। মরুজ উদ্ভিদের জনপ্রিয় উদাহরণ, ক্যাকটাস, আনারস এবং কিছু জিমনোস্পার্ম উদ্ভিদ।
মরুজ উদ্ভিদের গঠনগত বৈশিষ্ট্য (মরফোলজি) এবং মৌলিক রাসায়নিক প্রক্রিয়া (ফিজিওলজি)গুলির প্রায় সবই হলো মূলত জল সংরক্ষণের জন্য বিভিন্নভাবে অভিযোজিত হওয়া, এবং শুকনো মৌসুমের জন্য প্রচুর পরিমাণে জল সঞ্চয় করা। কিছু প্রজাতির উদ্ভিদ দীর্ঘমেয়াদী প্রচন্ড শুষ্কতায় বা তাদের কলাসমষ্টির বিশুষ্কীকরণ-এও বেঁচে থাকে। সে সময়ে তারা তাদের বিপাকীয় কার্যাবলীকে কার্যত বন্ধ করে দেয়। উদ্ভিদের এই রকম গঠনগত ও শারীরবৃত্তীয় অভিযোজনকে বলা হয় জেরোমরফিক।[১] ক্যাকটাসের মতো মরুজ উদ্ভিদ, মাটির গভীরে তাদের শিকড় প্রসারিত করে জল সঞ্চয় করার ক্ষমতা রাখে এবং শুষ্ক পরিবেশ সামাল দেয়। কাঁটাযুক্ত পাতাগুলিতে মোমের আস্তরণ থাকায়, জল এবং আর্দ্রতা হ্রাস, রোধ করে। এমনকি তাদের মাংসল কাণ্ড, জল সঞ্চয় করতে পারে।
মরুজ উদ্ভিদ নিম্নলিখিত অভিযোজন গুলো দেখা যায়-
উদ্ভিদ মাটি থেকে জল শোষণ করে, যা পরে তাদের অঙ্কুর এবং পাতা থেকে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি বাষ্প নির্মোচন বা প্রস্বেদন নামে পরিচিত। শুষ্ক পরিবেশে, একটি সাধারণ মেসোফাইটিক উদ্ভিদে মাটি থেকে জল শোষণের হারের চেয়ে জলের দ্রুত বাষ্পীভবন হয়। ফলে সেটি নেতিয়ে পড়ে এবং এমনকি তার উইলটিং বা মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
জলের এই রকম স্বল্পতার মধ্যেও, বেঁচে থাকার জন্য মরুজ উদ্ভিদে বহু বিশেষ রকমের অভিযোজিত বৈচিত্র্য দেখা যায়। তারা তাদের নিজস্ব সঞ্চয় থেকে জল ব্যবহার করতে পারে, নতুন কলা বৃদ্ধির জায়গাগুলিতে বিশেষ করে জল বরাদ্দ করতে পারে অথবা বায়ুমণ্ডলে কম পরিমাণ জল ত্যাগ করার জন্য মাটি থেকে শোষিত জলের বড় অংশই সালোকসংশ্লেষ এবং বৃদ্ধির কাজে চালিত করতে পারে। বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি, জল সরবরাহ পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গুণাবলী এবং প্রক্রিয়া অবলম্বন ক'রে, নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে পারে।
ক্যাকটাস এবং অন্যান্য রসাল উদ্ভিদ সাধারণত মরুভূমিতে দেখা যায়, সেখানে খুব কম বৃষ্টিপাত হয়। অন্যান্য মরুজ উদ্ভিদ যেমন নির্দিষ্ট ব্রোমিলিয়াডা অত্যন্ত সিক্ত এবং অত্যন্ত শুষ্ক, উভয় পরিবেশের মধ্যেই বেঁচে থাকতে পারে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয়-আর্দ্র স্থানে (যেমন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্য), মেসোফাইটিক উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য, সেখানের অবিরত জল সরবরাহকে যথাযোগ্য স্থানে শোষণ করে রাখতে পারে। একইভাবে, চ্যাপারাল উদ্ভিদ ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর সিক্ত শীত এবং শুষ্ক গ্রীষ্মের সাথে অভিযোজন করে নিয়েছে।
যে সব উদ্ভিদ আর্কটিক অবস্থায় থাকে, তাদেরও মরুজ উদ্ভিদের অভিযোজনের প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে স্থলভাগ হিমশীতল জমাট বাঁধা বরফ হওয়ায় কারণে, উদ্ভিদ জল গ্রহণ করতে পারে না, যেমন ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ উদ্ভিদ, হাবেলিয়া রোডোপেনসিস এবং রামোন্ডা সার্বিকা।[২]
ম্যানগ্রোভ জলা এবং আধা-মরুভূমির মতো খুব উচ্চ লবণাক্ত পরিবেশে, লবণাক্ত আয়ন স্তরের কারণে গাছপালার জল শোষণ একটি কঠিন সমস্যা। তার উপর, এই জাতীয় পরিবেশ, কোষে অতিরিক্ত আয়ন জমা করতে পারে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক ব'লে বিবেচিত হয়।[৩] এ জাতীয় পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই হ্যালোফাইট এবং মরুজ উদ্ভিদ বিকশিত হয়েছে। কিছু মরুজ উদ্ভিদ, হ্যালোফাইট হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু হ্যালোফাইটমাত্রেই মরুজ উদ্ভিদ নয়। যেমন, রসাল মরুজ উদ্ভিদ জাইগোফাইলাম জ্যান্থোক্সিলাম-এর কোষগুলিতে বিশেষ রকমের প্রোটিন পরিচালিত হয়, যাতে তাদের ভ্যাকুওলে (শূন্যস্থানে) অতিরিক্ত আয়নগুলি সঞ্চিত হ'য়ে, তাদের স্বাভাবিক সিস্টোলিক পিএইচ এবং আয়নিক উপাদান বজায় রাখতে সাহায্য করে।[৪][৫]
জলের প্রাপ্যতা অনেকগুলি বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়, যা বীজের অঙ্কুরোদগম, চারার বেঁচে থাকা এবং গাছের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিষয়গুলির মধ্যে বিরল বৃষ্টিপাত, তীব্র সূর্যের আলো এবং খুব উষ্ণ আবহাওয়া, দ্রুত জলের বাষ্পীভবনের কারণ হয়। একটি চরম পরিবেশগত পিএইচ এবং জলে উচ্চ লবণের পরিমাণও উদ্ভিদের জল-গ্রহণকে ব্যাহত করে।
রসালো উদ্ভিদ তাদের কাণ্ড বা পাতায় জল সঞ্চয় করে। এর মধ্যে ক্যাকটাসি পরিবারের উদ্ভিদ অন্তর্ভুক্ত, যারা গোলাকার ডাঁটায় প্রচুর পরিমাণে জল সঞ্চয় করতে পারে। পাতাগুলি প্রায়ই লুপ্তপ্রায় হয়, যেমন ক্যাকটাসের ক্ষেত্রে, যেখানে পাতাগুলি শিরায় হ্রাস পায়, অথবা তাদের কোনও পাতা থাকে না। এর মধ্যে রয়েছে সি৪ বহুবর্ষজীবী কাঠবাদাম, হ্যালোক্সিলন অ্যামোডেন্ড্রন। এটি উত্তর-পশ্চিম চিনের স্থানীয় উদ্ভিদ।
মাটিতে জলের ঘাটতি দীর্ঘ দিন অবিচ্ছিন্ন সাফল্যের সঙ্গে সহ্য করতে পারে, অ-রসালো বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এগুলিকে তাই 'প্রকৃত মরুজ উদ্ভিদ' বা ইউজেরোফাইট (euxerophytes) বলা হয়। জলের ঘাটতির কারণে, তাদের তাজা ওজন সাধারণত ৬০-৭০% পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে কোষের বর্ধনকালে, পুরো উদ্ভিদের বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বাধা পায়। যে গাছগুলি এই খরায় বেঁচে থাকে, তারা স্বাভাবিকভাবেই হয়, ছোট এবং দুর্বল।
ইফেমেরাল হ'ল 'খরা থেকে বেঁচে যাওয়া' এক ধরনের উদ্ভিদ। তারা প্রকৃত মরুজ উদ্ভিদ নয়। তারা প্রকৃতপক্ষে খরা সহ্য করে না, কেবল এটি থেকে রেহাই পায়। বৃষ্টিপাতের সূত্রপাতের সাথে সাথে, তাদের বীজ অঙ্কুরিত হয়, দ্রুত পরিপক্কতায়, ফুল এবং বীজ গঠন করে, অর্থাৎ, মাটি আবার শুকিয়ে যাওয়ার আগে পুরো জীবনচক্রটি সম্পন্ন করে। এই গাছগুলির বেশিরভাগই হয় ছোট, গোলাকার, ঘন গুল্ম পাপিলিয়নেসি প্রজাতির প্রতিনিধি, কিছু অসম্পূর্ণ কমপোজিটি, কয়েকটি জাইগোফাইলেসি এবং কিছু ঘাস। কিছু উদ্ভিদ কন্দ-এ অথবা মাটির নীচে জল জমা করে। খরা পরিস্থিতিতে এগুলি সুপ্ত হতে পারে এবং তাই এগুলি খরা দমনকারী হিসাবে পরিচিত।
শুকনো এবং আধা শুকনো অঞ্চলে বেড়ে ওঠা গুল্মগুলিও হয় জেরোমর্ফিক। উদাহরণস্বরূপ, কারাগানা কর্শিনস্কি, আর্টেমিসিয়া স্ফেইরোসিফালা এবং হেডিসারাম স্কোপারিয়াম উত্তর-পশ্চিম চীন প্রান্তরের অর্ধ-শুকনো অঞ্চলে জন্মানো শক্ত ঝোপঝাড়। এই স্যাম্মোফিলি গুল্ম কেবলমাত্র ঐ অঞ্চলে চরা জীবজন্তুর ভোজ্য নয়, তারা মরুভূমির বালির টিলাগুলিকে স্থিতিশীল করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৬]
প্রায়ই বেলে প্রান্তর অঞ্চলে, বেশিরভাগই টিলার কিনারায় গভীর বেলে মাটিতে দেখা যায় ঝোপঝাড়, যাকে আধা-ঝোপঝাড়ও বলা হয়। এর একটি উদাহরণ রিমুরিয়া সুনগোরিকা, যা একটি বহুবর্ষজীবী পুনরুত্থান আধা-ঝোপঝাড়। অন্যান্য প্রধান শুষ্ক মরুজ উদ্ভিদের তুলনায়, একটি পূর্ণ বয়স্ক আর. সুনগোরিকা গুল্মের জলের ঘাটতির দৃঢ় প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে বলে, এটি একটি সুপার-মরুজ উদ্ভিদ হিসাবে বিবেচিত হয়।[৬]
যদি পাতার অভ্যন্তরে জলের পরিমাণ বাইরের থেকে বেশি হয়, তবে বাষ্প আকারে পাতার নিচের রন্ধ্র দিয়ে ব্যাপন প্রক্রিয়ার বেরিয়ে যায়। পাতা থেকে জলীয় বাষ্পের এই ক্ষয়কে বলা হয় স্বেদন এবং ব্যাপন প্রক্রিয়ার জলের এই বাষ্প নির্গত হয় খোলা স্টোমাটার মধ্যে দিয়ে। স্বেদন প্রাকৃতিক ঘটনা এবং উদ্ভিদের জন্য তা অনিবার্য। এই প্রক্রিয়ায় তার দেহ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জল বেরিয়ে যায়। তবে, শুষ্ক অবস্থায় বসবাসকারী উদ্ভিদের অভিযোজন ক্ষমতা এমনই, যে ক্ষেত্রে খোলা স্টোমাটার আকার হ্রাস পায়, স্বেদনের হার যায় কমে। এর ফলে পরিবেশে তার জল নির্গমন হ্রাস পায়। পর্যাপ্ত জল ছাড়া, উদ্ভিদের কোষ টারগর হারায়। এটি প্লাজমোলাইসিস নামে পরিচিত। যদি উদ্ভিদের খুব বেশি পরিমাণ জল বেরিয়ে যায়, তবে তা তাকে স্থায়ী উইলটিং পয়েন্ট বা স্থায়ী নিস্তেজ বিন্দু-এর দিকে চালিত করে এবং পরিণামে তার মৃত্যু হয়।[৭]
সংক্ষেপে, স্বেদনের হার স্টোমাটা, স্টোমাটাল ছিদ্র অর্থাৎ স্টোমা খোলার আকার, পাতার তল (আরও স্টোমাটা থাকার জন্য), তাপমাত্রার পার্থক্য, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, বাতাস বা বায়ু চলাচলের উপস্থিতি, আলোর তীব্রতা এবং মোম জাতীয় কিউটিকল বা আবরণের উপস্থিতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি লক্ষ করা জরুরী, স্টোমাটা বন্ধ রাখাই যখন অত্যাবশ্যক, তখন তাদের সালোকসংশ্লেষ এবং শ্বসণের গ্যাসীয় আদানপ্রদানের জন্য খুলেও রাখতে হয়।