মহান ইউ | |||||||||||||||||||||||||||
চীনা | 大禹 | ||||||||||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
|
মহান ইউ (চীনা: 大禹; ফিনিন: Dà Yǔ, আনু. খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ অব্দ – খ্রিষ্টপূর্ব ২১০১ অব্দ)[১] ছিলেন প্রাচীন চীনের সিয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। তিনি সে সময়ে চীনের মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।[২] ইউ চীনের অন্যতম একজন শাসক যার নামের পাশে 'দ্য গ্রেট' পদবী দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে।[৩]
ওরাকল হাড় থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে অনুমান করা হয় ইউর রাজত্বকাল শাং সাম্রাজ্য সময়কালেরও পূর্বে ছিল।[৪] পরবর্তীকালে প্রাপ্ত ওরাকল হাড় থেকেও ইউর সময়কালের কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। তার সম্পর্কে কোনো লিখিত তথ্য না পাওয়ায় এ নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। একদল মনে করেন, তার রাজত্বকাল সম্পর্কে মুখে মুখে ছড়িয়ে গল্প ঝাও সাম্রাজ্য সময়কালে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল।[৫] আরেকদল মনে করে তিনি উপদেবতা হিসেবে সিয়া সাম্রাজ্য সময়কালে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাকে ঝাও সাম্রাজ্য সময়কাল থেকে মানুষ হিসেবে ধারণা করা হতে থাকে। তার সম্পর্কে অনেক কাহিনী সিমা কিয়ান রচিত ইতিহাসের আলেখ্য গ্রন্থে পাওয়া যায়। কনফুসিয়াস ও অন্যান্য প্রাচীন পন্ডিতেরা ইউ এবং তার পরবর্তী সময়কালের সম্রাটদের তাদের নৈতিক গুণাবলীর জন্য প্রশংসা করেছেন।[৬]
চীনের প্রাচীন গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায় ইউ ছিলেন পাঁচ সম্রাটদের প্রথম সম্রাট হুয়াংডির ৮ম বংশধর, তার পিতা গুন ছিলেন সম্রাট ঝুয়াংক্সুর ৫ম বংশধর, ঝুয়াংক্সুর পিতা চাংয়ি ছিলেন হুয়াংডির দ্বিতীয় পুত্র।[৭] ইউ ওয়েব পর্বত (汶山), বর্তমান সিচুন প্রদেশের বেইচুনে,[৮] মতান্তরে শিফাং-এ জন্মগ্রহণ করেন.[৯] ইউর মা ছিলেন ইউক্সিন সম্প্রদায়ের, নাম নুজি (女志) বা নুসি (女嬉)।
যখন ইউ ছোট ছিল তার পিতা গুন তার লোকবল নিয়ে মধ্য চীনের সমতল ভূমিতে চলে আসেন। সম্রাট ইয়াও তাকে চং বা সং পর্বতের মধ্যবর্তী এলাকার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন। ধারণা করা হয়, ইউ হুয়াংহো নদীর দক্ষিণে সং পর্বতের পাশে শৈশব কাটিয়েছেন।[১০] তিনি তু পর্বত (চীনা: 塗山) এলাকার তুশান সি (塗山氏; "Lady Tushan") নামে একজনকে বিয়ে করেছিলেন।[১১] তু পর্বতের অবস্থান নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। দু'টি প্রধান মত হল আনহুই প্রদেশ বা চংকিং-এর দক্ষিণ পর্বত। তাদের এক পুত্র, নাম সিয়াকি।[১১]
সম্রাট ইয়াও-এর রাজত্বকালে মহাপ্লাবনের কারণে চীনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল।[১২] ইউর পিতা গুনকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি হুয়াংহো নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করেন কিন্তু নয় বছরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় নি। ইউ প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তিনি নদীর গতিপথ পর্যবেক্ষণ করেন এবং অনুসন্ধান করেন কেন তার পিতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।[১৩]
ইউ পৌরাণিক কৃষিবিদ হৌজিকে নিয়ে প্লাবন নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল আবিষ্কার করেন, যা তখনকার সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরাসরি স্রোতের পথে বাঁধ না তৈরি করে তিনি খাল খনন করে কৃষি জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করেন এবং নদী খনন করেন। কথিত আছে, ইউ সাধারণ মানুষদের সাথে খেতেন ও ঘুমাতেন এবং তেরো বছর তাদের সাথে নিজেও খনন কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। তার এই জলসেচ ও নদী খনন সফল হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে হুয়াংহো নদী, ওয়ে নদী, এবং মধ্য চীনের অন্যান্য জলাশয়কে ঘিরে প্রাচীন চীনের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছিল। ইউ তার এই কাজের মাধ্যমে চীনের ইতিহাসে সুপরিচিত এবং চীনের ইতিহাসে তা গ্রেট ইউর মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণ (চীনা: 大禹治水; ফিনিন: Dà Yǔ Zhì Shuǐ) নামে লিখিত রয়েছে। লংম্যান পর্বত ও হুয়াংহো নদীর মধ্য দিয়ে একটি অপ্রশস্ত বদ্ধ জলাশয় ছিল যা পূর্বে সমুদ্রের দিকে পানির প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করত। কথিত আছে, ইউ তার জনবল নিয়ে জলাশয়টিকে খনন করে, যা পরবর্তীকালে ইউর পরিখা (চীনা: 禹門口) নামে পরিচিতি লাভ করে।[১৪]
চতুর্থ শতাব্দীতে ওয়াং জিয়া রচিত শি য়ি জি গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত পৌরাণিক গল্প থেকে পাওয়া যায় যে, ইউ বন্যা নিয়ন্ত্রণে হলুদ ড্রাগন ও কালো কচ্ছপের সাহায্য লাভ করেছিল।[১৫] অন্য আরেকটি স্থানীয় পৌরাণিক গল্পে বর্ণিত আছে যে বন্যা নিয়ন্ত্রণে ইউ স্বর্গীয় যুদ্ধ-কুঠার দিয়ে উঁচু পাহাড় কেটে সানমেক্সিয়া জর্জ লংম্যান ও ইয়ানজি নদীতে পানির পথ তৈরি করেছিল। ইউ গং গং-এর মন্ত্রী নয় মাথাওয়ালা দানবীয় সাপ জিয়ানলিউকে হত্যা করেছিল বলে কথিত আছে।[১৬] ব্যাম্বু অ্যানালস-এ বর্ণিত আছে যে, ইউ ক্যু চাই পর্বতে সকল উপদেবতাদের সভা ডাকলে, ফেংফেং পরে এসে তাকে অপমান করে। অন্য বর্ণনায় আছে, ফেংফেং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের ভীত সন্ত্রস্ত করত। ফেংফেং ছিল নয় মাথাওয়ালা বিরাটাকার সরীসৃপ, যার বমি থেকে বিষাক্ত উপাদান বের হত। ইউ তখন ড্রাগনের রূপ ধারণ করে ফেংফেংয়ের মাথা ঘাড় থেকে আলাদা করে ফেলেন।[১৭]
পুরাণে বর্ণিত আছে ইউ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তার হাত পা উভয়ই অসাড় হয়ে গিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে, তার বিয়ের চতুর্থ দিনে তাকে মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। বন্যার প্রকোপ চলাকালীন তিনি তেরো বার তার বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেও তিনি বাড়িতে প্রবেশ করেননি। প্রথমবার যখন তিনি তার বাড়ির পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তিনি শুনেছিলেন তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা হচ্ছিল। দ্বিতীয়বার যখন গিয়েছিলেন তখন তার ছেলে বাবা ডাকা শুরু করেছিল। তার পরিবারের সদস্যরা তাকে বাড়িতে আসতে বললে তখনো বন্যার প্রকোপ কমেনি বলে তিনি যাননি। তৃতীয়বার তার ছেলের বয়স দশের বেশি হয়েছিল। মহাপ্লাবনে অসংখ্য মানুষ বাড়িঘর হারাচ্ছে এই কারণে প্রত্যেকবার তিনি বাড়ি যেতে মানা করেন।[১৮]
সম্রাট ইয়াওয়ের পর সম্রাট সুন সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট সুন ইউর কাজে মুগ্ধ হন এবং তার পুত্রের পরিবর্তে তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন।[১৯] ইউ প্রথমে অসম্মতি জানালেও পরে স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের পীড়াপীড়িতে ৫৩ বছর বয়সে সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি আনয়িতে (চীনা: 安邑) তার নতুন রাজধানী স্থাপন করেন, যার ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে শানসি প্রদেশে অবস্থিত।[২০]
মহাপ্লাবন নিয়ন্ত্রণের ফলে ইউ তৎকালীন হান সাম্রাজ্যভুক্ত সকল অঞ্চলে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। ইউ গং বুক অব ডকুমেন্ট পুস্তক অনুসারে, ইউ চীনকে নয়টি ঝাও বা প্রদেশে বিভক্ত করেন। সেগুলো ছিল জিঝাও (冀州), ইয়ানঝাও (兗州), কিংঝাও (青州), সুঝাও (徐州), ইয়াংঝাও (揚州), জিংঝাও (荊州), য়ুঝাও (豫州), লিয়ানঝাও (梁州) এবং ইয়ংঝাও (雍州)। রায়টস অব ঝাও অনুসারে, সে সময়ে সুঝাও ও লিয়াংঝাও নামে কোনো প্রদেশ ছিল না, বরং তা ইউঝাও (幽州) এবং বিংঝাও (并州) নামে পরিচিত ছিল। ইর্যা অনুসারে, কিংঝাও ও লিয়াংঝাও নামে প্রদেশ ছিল না, তা ইউঝাও (幽州) এবং ইংঝাও (營州) নামে পরিচিত ছিল।[২১]
যেই পুস্তকেই বিবেচনা করা হোক না কেন, সব কয়টি পুস্তকে নয়টি প্রদেশের উল্লেখ রয়েছে। ইউ নয়টি প্রদেশ থেকে ব্রোঞ্জ সংগ্রহ করে ডিং নির্মাণ করেন।[২২] ইউ পরে ডেংফেং-এ তার রাজধানী স্থাপন করেন।[২৩]
ব্যাম্বু অ্যানালস অনুসারে, ইউ সিয়া সাম্রাজ্যকে ৪৫ বছর শাসন করেন। ইউয়ে জুয়েশু (越絕書) অনুসারে, ইউ অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। কথিত আছে, তিনি শিকারে গিয়ে খুয়াইজি পর্বতে মারা যান, যা বর্তমান শাওসিনের দক্ষিণে অবস্থিত। তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তার সম্মানে প্রথম তার স্মৃতিস্তম্ভ (大禹陵) নির্মিত হয়।[২৪] স্তম্ভটি শাওসিন শহরের চার কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।[২৪] পরবর্তীকালে আরও কিছু অংশ নির্মিত হয়। স্মৃতিস্তম্ভের প্রধান তিনটি অংশ হল ইউর কবর (禹陵), স্মৃতিমন্দির (禹廟) ও স্মৃতিচিহ্ন (禹祠)।[২৫] তার অনেক মূর্তিতে তাকে প্রাচীন নিড়ানি (耒耜) হাতে দেখা যায়। পরবর্তীকালের অনেক সম্রাটেরা তার সম্মানার্থে আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে খুয়াইজি পর্বতে যান।[২৬]
ইউর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন লিখিত কিছু না পাওয়া যাওয়ায় তার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তার কথিত সময়কালের কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু থেকেও তার সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি, এমনকি তার পরবর্তী সময়কালের ওরাকল হাড় থেকেও না। ইউ সম্পর্কিত প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় আরও হাজার বছর পরে পশ্চিম ঝাও সাম্রাজ্যের সময়কালে প্রাপ্ত মৃৎপাত্র থেকে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ইতিহাসবেত্তাদের তত্ত্ব অনুসারে, ইউ মানুষ নয় বরং কোনো দেবতা বা পৌরাণিক প্রাণী ছিলেন। এই তত্ত্বে বলা হয়, তিনি ব্রোঞ্জের তৈরি সমরাস্ত্র পরিধান করতেন। ঝাও সাম্রাজ্য সময়কালে প্রথম তার মনুষ্য রূপ অঙ্কিত হয়। চীনা পুরাণ অনুসারে, ইউ ছিলেন একজন উপদেবতা। তিনি ড্রাগনের রূপ ধারণ করতে পারতেন।[১৭]
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া যায় যে, হুয়াংহো নদীতে যে প্লাবন সৃষ্টি হয়েছিল তা খ্রিষ্টপূর্ব ১৯২০ অব্দের দিকে হতে পারে। এই বন্যা খুব সম্ভব ২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। এ থেকে ধারণা করা হয়, ইউ দ্য গ্রেট একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন।[২৭]
চীনের গনতান্ত্রিক শাসনামলে সান ইয়াত সেন ইউর মত ইয়ানজি নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ক্যুমিংতান জাপান ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরলে তার এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় নি।[২৮] সিচুয়ান প্রদেশের বেইচুয়ান, ওয়েনচুয়ান ও ডুজিয়াংগান শহরে ইউ দ্য গ্রেটের 'শিফাং' রয়েছে।[২৯]
মহান ইউ
| ||
রাজত্বকাল শিরোনাম | ||
---|---|---|
পূর্বসূরী সম্রাট সুন |
চীনের সম্রাট আনু. খ্রিষ্টপূর্ব ২২০৫ অব্দ – খ্রিষ্টপূর্ব ২১৪৭ অব্দ |
উত্তরসূরী সিয়াকি |