সংক্ষেপে | মাইজভান্ডারিয়া |
---|---|
গঠিত | ২১ শতকে |
ধরন | তরিকা |
সদরদপ্তর | চট্টগ্রাম, বাংলা |
মূল ব্যক্তিত্ব | সৈয়দ আহমদ উল্লাহ |
মাইজভান্ডারিয়া তরিকা বা তরিকায়ে মাইজভাণ্ডারী (বা কাদেরিয়া মালামিয়া আহমদিয়া) হল ইসলাম ধর্মের একটি সুফি তরিকা (পথ বা পদ্ধতি)। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬), যিনি হজরত মুহাম্মদ (স.) এর বংশধর ছিলেন, মাইজভান্ডারিয়া তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালে সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ওফাতে পর, তরিকায়ে মাইজভাণ্ডারী তার কোটি কোটি অনুগতদের মধ্যে অব্যাহতভাবে বিস্তার লাভ করেছে, যা প্রায়ই উন্মুক্ত তরিকায় (উন্মুক্ত আধ্যাত্মিক পদ্ধতি বা পথ) হিসেবে বিবেচিত হয়।[১]
মাইজভাণ্ডারিয়া তরিকাটি বাংলা অঞ্চল থেকে উদ্ভূত একমাত্র সুফি তরিক। এটি একটি আদি আন্দোলন হিসেবে ২১ শতকেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।[২]
মাইজভাণ্ডারী তরিকা তাদের ঐতিহ্য এবং বৈধতা প্রতিষ্ঠা করে দশম শতাব্দীর সুফি পণ্ডিত ইবনে আরাবীর একটি বাণীর ওপর ভিত্তি করে, যেখানে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে একজন মহান আধ্যাত্মিক নেতা "চীনে জন্মগ্রহণ করবেন" এবং তিনি সেই দেশের ভাষায় কথা বলবেন। মাইজভাণ্ডারী সুফিরা ইবনে আরাবীর এই ভবিষ্যদ্বাণীকে চট্টগ্রামের সাথে সম্পর্কিত বলে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে ইসলামের প্রসার শেষ হয়েছিল এবং যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশ চীনের (প্রাচীন মঙ্গোলিয়ার) প্রভাবের সাথে মিলিত হয়েছিল।[৩] সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী ১৮২৮ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা মাইজভাণ্ডারী সুফিদের মতে, ইবনে আরাবী ছয়শো বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।[৩]
১৯শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মাইজভাণ্ডারিয়া তরিকা একটি "শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে, যার জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব কোনোভাবেই অবহেলার যোগ্য নয়। এটি সমাজের সকল স্তর থেকে অনুসারী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও", এবং এটি ইসলামের উপর তার সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, "যদিও এটি বাংলা অঞ্চলের ধর্মীয় মূলধারার সাথে সংযুক্ত থেকেছে", গবেষক হান্স হার্ডারের মতে।[৪]
মাইজভাণ্ডারিয়া তরিকা বিশ শতকের শুরু থেকেই একটি "বৃহৎ পাঠ্যসম্ভার তৈরির পিছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে জন্য দায়ী ছিল, যার মধ্যে রয়েছে জীবনীগ্রন্থ এবং ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা, যা মনোগ্রাফ, পুস্তিকা এবং সাময়িকীর আকারে প্রকাশিত হয়েছে।[৪]
মাইজভাণ্ডারী ধর্মতাত্ত্বিক এবং জীবনীমূলক রচনাগুলি বিভিন্ন আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ প্রবন্ধ, ফতোয়া বা সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ (প্রবন্ধ)। এই লেখাগুলি একটি স্বতন্ত্র স্থানীয় ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এবং এই লেখাগুলির "বৃহত্তর অংশ" ছিল চট্টগ্রাম বা পূর্ববঙ্গের অন্যান্য এলাকা থেকে আগত লেখকদের স্বাধীন কাজ।[২]
এই ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আমিনুল হক ফরহাদাবাদীর (১৮৬৬-১৯৪৪) "তুহফাত আল-আখিয়ার ফি দাফ্শরারাত আল-শারার" ("অমঙ্গলকারীর অমঙ্গল দূরীকরণে সৎ ব্যক্তির মূল্যবান উপহার", ১৯০৬/৭), যা সামা (আধ্যাত্মিক গান) এবং সংগীত শুনার বৈধতা নিয়ে একটি ফতোয়া বা আইনি মতামত। মূলত আরবি এবং ফারসি ভাষায় রচিত এই পাঠ্যটি পরে বাংলা অনুবাদ সহ একটি পুঁথি হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল।[২]
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আবদুল গণি কাঞ্চনপুরীর "আইনা-ই বারী" (প্রভুর আয়না), একটি উর্দু গ্রন্থ যা ১৯১৫ সালে সৈয়দ আহমদ উল্লাহর জীবনের একটি জীবনীমূলক বর্ণনা এবং ১০০টিরও বেশি উর্দু গজলের (এক ধরনের কবিতা বা স্তুতি) সংগ্রহ হিসেবে রচিত ও প্রকাশিত হয়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার ধর্মতাত্ত্বিক ভিত্তির একটি ব্যাখ্যা হিসেবে এটি আজও "মাইজভাণ্ডারী ধর্মতত্ত্বের সর্বাধিক বিস্তারিত বর্ণনা" হিসেবে বিদ্যমান।[২]
মাইজভাণ্ডারী সুফিতত্ত্বের আরও সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে আবদুস সালাম ইসাপুরীর "ফুয়ুজাত আল-রহমানিয়া ফি তরীকাত আল-মাইজভাণ্ডারিয়া", যা ফারসি ভাষায় রচিত।[২]
এই ঐতিহ্যকে একত্রে নিয়ে দেখা যায়, এর বিভিন্ন সাহিত্যিক উৎস রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মধ্যযুগীয় ইসলামী সাহিত্য, বাংলার মধ্যযুগীয় ফারসি সাহিত্য, এবং "প্যান-সুফিতাত্ত্বিক" লেখক যেমন ইবনে আরাবী (মৃত্যু ১২৪০), জালাল উদ্দিন রুমি (মৃত্যু ১২৭৩), ফরিদ উদ্দিন আত্তার (মৃত্যু ১২২০), মঈন উদ্দিন চিশতী (মৃত্যু ১২৩৬) এবং কাদেরিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা আবদুল কাদের জিলানি (মৃত্যু ১১৬৬) এর মতো লেখকদের রচনা।[২]
মাইজভাণ্ডারী চিন্তা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে, যেমন বাংলাদেশের ব্যবসায় ব্যবস্থাপনায় এই আন্দোলনের নৈতিক নির্দেশিকাগুলি পুনর্ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেখানে আত্মশুদ্ধির আধ্যাত্মিক ধারণাগুলি গ্রাহকদের সাথে বিশ্বাস তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণের নৈতিক মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে।[৫]
মাইজভাণ্ডারী তরিকা নিজেদের উরসের,যা একটি বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশ এবং এটি বিশ্বের অন্তত পঞ্চম বৃহত্তম মুসলিম জমায়েত হিসেবে বিবেচিত হয়, জন্যও পরিচিত।[৬] প্রতি বছর বাংলা পঞ্জিকার মাঘ মাসের দশম দিনে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়, যেখানে পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ কয়েক দিন ধরে আধ্যাত্মিক সংগীত পরিবেশনায় মাইজভাণ্ডারী পীরদের প্রশংসা গাওয়ার জন্য একত্রিত হয়। এই সমাবেশে মুসলিম এবং হিন্দু উভয়েই অংশ নেয়, এবং সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু মাইজভাণ্ডারী শিল্পী হিন্দু ধর্মের লোক।[৬]
উরস সমাবেশের জনপ্রিয় ও ধর্মীয় প্রকৃতির একটি অংশ হিসেবে, মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক শ্রবণ এবং আধ্যাত্মিক সংগীত ব্যাপকভাবে পরিচিত ও বিস্তৃত হয়েছে।[৭][৮] মাইজভাণ্ডারী আধ্যাত্মিক গানগুলির ঐতিহ্য এখন বাংলা অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম জনপ্রিয় গানের সংগ্রহ হিসেবে পরিচিত।[২]
২০শ শতাব্দীর শুরুতে মাইজভাণ্ডারী সংগীতশিল্পী রমেশ শীল প্রায় ৩৫০টি মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেছিলেন, যা তরিকা ও সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ও সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারীর প্রশংসা করা হয়েছে। এই গানগুলি বেশকিছু গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম হলো আশেকমালা, শান্তিভাণ্ডার, মুক্তির দরবার, নূরে দুনিয়া, জীবনসাথী, সত্যদর্শন, ভাণ্ডারে মওলা, মানব বন্ধু এবং ইশকে সিরাজিয়া।[৯]
২০১৬ সালে মৃত্যুবরণ করা আবদুল গফুর হালী, ২০শ শতাব্দীর শেষের দিকে এক প্রখ্যাত মাইজভাণ্ডারী সংগীতশিল্পী, যিনি একইভাবে শতাধিক গান রচনা করেছিলেন এবং ঐতিহ্যের "অতুলনীয় জ্ঞান" জন্য পরিচিত ছিলেন।[১০]
বর্তমানে ১০,০০০টিরও বেশি মাইজভাণ্ডারী গান সংকলিত হয়েছে, যেগুলি অনেকটা মৌখিকভাবে প্রচারিত হলেও বর্তমানে সিডি এবং ভিডিওতে উপলব্ধ, এবং এটি বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র সংগীত ধারার অংশ হয়ে উঠেছে।[৪]
রাহে ভাণ্ডার তরিকা মাইজভাণ্ডারী তরিকার একটি শাখা, যা ছৈয়দ ছালেকুর রহমান শাহ্র নেতৃত্বে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার অন্যান্য শাখার মতোই, রাহে ভাণ্ডার তরিকাও সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে আগ্রহী।[১১]
এই তরিকা রাজানগর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর সঙ্গীত সম্পর্কিত প্রচার এবং প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল গ্রামের ছৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল মালেক শাহ্। তিনি রাহে ভাণ্ডার কধুরখীল দরবার শরীফ যার বর্তমান নাম চট্টগ্রাম দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করে এই তরিকার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই দরবারটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে ছৈয়দ ছালেকুর রহমান শাহ্'র আসন বা খানকাহ হিসেবে পরিচিত ছিল।[১১]
ছৈয়দ জাফর ছাদেক শাহ্ রাহে ভাণ্ডার তরিকার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং এখনও তা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর সঙ্গীত রচনা এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এই তরিকার প্রচারে ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে।[১১]
|তারিখ=
(সাহায্য)