মানফ্রেড ফন আর্ডেন

মানফ্রেড ফন আর্ডেন(২০ জানুয়ারি ১৯০৭-২৬ মে ১৯৯৩) একজন জার্মান গবেষক, ফলিত পদার্থবিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক ছিলেন। তাঁর ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র, চিকিৎসা প্রযুক্তি,নিউক্লীয় প্রযুক্তি, প্লাজমা পদার্থবিজ্ঞান এবং রেডিও ও টেলিভিশন প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত ৬০০টিরও বেশি আবিষ্কারের স্বত্ব বা পেটেন্ট রয়েছে। ১৯২৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি তার ব্যক্তিগত বিজ্ঞানাগার "ফরশুংসল্যাবরোটোরিয়াম ফুর ইলেকট্রোনেন ফিজিক" এর পরিচালক ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দশ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমা প্রকল্পে কাজ করেন। এজন্য তিনি স্ট্যালিন পুরস্কারে ভূষিত হন। পরবর্তীতে পূর্ব জার্মানি ফিরে তিনি আরেকটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম "ফরশুংসইনস্টিট্যুট ম্যানফ্রেড ফন আর্ডেন"।

কর্মজীবন

[সম্পাদনা]

সূচনাপর্ব

[সম্পাদনা]

ফন আর্ডেনের পিতামহী এলিজাবেথ ফন আর্ডেনের (১৮৫৩-১৯৫২) সংগ্রামসঙ্কুল জীবন থিওডোর ফন্টানের "এফি ব্রিয়েস্ট" উপন্যাসের মূল প্রেরণা। এফি ব্রিয়েস্ট জার্মানির অন্যতম বিখ্যাত বাস্তববাদী উপন্যাস।

১৯০৭ সালে হামবুর্গ শহরের এক ধনী অভিজাত পরিবারে ফন আর্ডেন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। ১৯১৩ সালে তার পিতা "ক্রিগসমিনিস্টেরিয়ামে" চাকরি পান, যার ফলে তারা বার্লিন চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ১৯১৯ সালে বার্লিনের "রিয়েলজিমনেসিয়াম" শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন শুরু করেন। বিদ্যালয়ের এক।প্রতিযোগিতায় তিনি ক্যামেরা ও সতর্কঘণ্টার সমন্বয়ে একটি মডেল পেশ করেন, যার ফলে তিনি প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। [][]

১৯২৩ সালে পনের বছর বয়সে ফন আর্ডেন বিশেষ এক ধরনের বৈদ্যুতিক নল আবিষ্কারের জন্য প্রথম পেটেন্ট পান। ঐ নলের অভ্যন্তরে তিনটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম একই সাথে কাজ করত,যা তারবিহীন টেলিগ্রাফিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়। ডিগ্রি লাভের পূর্বেই আর্ডেন জিমনেসিয়ামের পাট চুকিয়ে নেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল উদ্যোক্তা সিগমুন্ড লোয়ের সাথে রেডিওপ্রকৌশলের উন্নয়নে কাজ করা। আর্ডেন-আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক নল ব্যবহার করে লোয়ে "লোয়ে-ওরটসেম্পফ্যাঙ্গার-ওই৩৩৩" আবিষ্কার করেন, যা নামমাত্র মূল্যে ব্যবহার করা সম্ভব হয়। ১৯২৫ সালে, পেটেন্ট বিক্রি ও গ্রন্থ প্রকাশনা থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহার করে তিনি ব্রডব্যান্ড তরঙ্গের জন্য বিবর্ধক আবিষ্কার করেন। এই বিবর্ধক বা অ্যামপ্লিফায়ার রাডার ও টেলিভিশনের মানোন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিদ্যালয় থেকে স্নাতক না হয়েই ফন আর্ডেন বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পড়াশোনায় অভিনিবেশ করেন। তার পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল- পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত। কিন্তু চার সেমিস্টার অধ্যয়ন করেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার ইতি টানেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরা-বাঁধা নিয়মকানুনের সাথে তিনি খাপ খাওয়াতে পারেননি। তিনি নিজের পরবর্তী জীবন বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে ব্যয় করেন।

১৯২৮ সালে তিনি "ফরশুংস ল্যাবোরোটোরিয়াম ইলেকট্রোনেন ফুর ফিজিক" নামক বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করেন।[] টেলিভিশন প্রযুক্তি ও ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। এছাড়াও তিনি স্ক্যানিংকার্যে ব্যবহারযোগ্য ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। বিভিন্ন রকম আবিষ্কার ও চুক্তি হতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি বিজ্ঞানাগারের অর্থায়ন করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- জার্মান ডাক মন্ত্রণালয় আণবিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে ফন আর্ডেন কৃত গবেষণার জন্য অর্থায়ন করে। অনেক উঁচু মানের বিজ্ঞানী তার বিজ্ঞানাগারে কাজ করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিৎস হাউটারম্যানস। ১৯৪৫ সালের ১০ মে কর্নেল জেনারেল ভি এ মাখনজভ,রাশিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী আইজ্যাক কিকোইন, লেভ আর্টসিমোভিচ,গিওর্গি ফ্লিরভ ও ভি.ভি.মিগুলিন বিজ্ঞানাগার পরিদর্শন করেন এবং এর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। []

১৯৩১ সালের বার্লিন রেডিও প্রদর্শনী-তে ফন আর্ডেন ক্যাথোড রশ্মি নল ব্যবহার করে পৃথিবীর প্রথম টেলিভিশন প্রদর্শনী আয়োজন করেন। আর্ডেন ১৯৩৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রথম টেলিভিশন ছবি প্রেরণ করেন। ১৯৩৫ সালে পৃথিবীর প্রথম বৈদ্যুতিকভাবে স্ক্যানকৃত টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়। এর ফলে বার্লিনে আয়োজিত ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হয়।

১৯৪১ সালে প্রুশীয় বিজ্ঞান একাডেমি তাকে লাইবনিজ পদকে ভূষিত করে। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি "রাইখসফরশুংসরাট"বা সরকারের গবেষণা উপদেষ্টা পদে ভূষিত হন। []

সোভিয়েত ইউনিয়ন

[সম্পাদনা]

ফন আর্ডেন, গুস্টাভ লুডভিগ হেরৎস,পিটার অ্যাডলফ থিয়েসেন ও ম্যাক্স ভোলমার নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তি করেছিলেন। যাদের সাথে রুশদের প্রথম দেখা হবে, তিনি নিজেসহ অন্যদেরকে সুরক্ষিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল-

  1. গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুরক্ষাদান
  2. কোনরূপ বিঘ্ন ছাড়াই গবেষণাকার্য অব্যাহত রাখা
  3. অতীতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তি এড়ানো

থিয়েসেন কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগ করেন। ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল একজন সোভিয়েত মেজরের সাথে থিয়েসেন আর্ডেনের প্রতিষ্ঠানে আগমন করেন। তারা আর্ডেন-কে সুরক্ষাপত্র দান করেন। চুক্তি স্বাক্ষরকারী চারজন বিজ্ঞানীকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যাওয়া হয়। আবখাজিয়ার সুখোমি শহরের সিনোপ শহরতলিতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট-এ-তে পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। ল্যাভরেন্তি বেরিয়া তাকে পারমাণবিক প্রকল্পে যোগদানের প্রস্তাব দেন।

১৯৪৭ সালে আর্ডেনকে স্ট্যালিন পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি পুনরায় এ পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কারের অর্থ ১,০০,০০০ রুবল তিনি পূর্ব। জার্মানিতে গবেষণার জন্য ভূমিক্রয়ে ব্যবহার করেন। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি পূর্ব জার্মানি ফিরে আসেন।

ব্যক্তিগত জীবন

[সম্পাদনা]

১৯৩৭ সালে আর্ডেন বেটিনা বার্গেনগ্রুয়েন-কে বিবাহ করেন। তাদের চার সন্তান ছিল। []

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Museum, Stiftung Deutsches Historisches। "Gerade auf LeMO gesehen: LeMO Biografie"www.dhm.de 
  2. Mulvey, Tom (১ অক্টোবর ১৯৯৭)। "Baron Manfred von Ardenne (1907–1997)"Journal of Microscopy188 (2): 94–95। ডিওআই:10.1046/j.1365-2818.1997.2560813.x – Wiley Online Library-এর মাধ্যমে। 
  3. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৪ জানুয়ারি ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০২০ 
  4. "Manfred von Ardenne - Dieter Wunderlich: Buchtipps und mehr"