মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা | |
---|---|
জন্ম | মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ মহাপ্রুম গ্রাম, বুড়িঘাট, নানিয়ারচর থানা, রাঙ্গামাটি |
মৃত্যু | ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ খেদারা ছড়ার থুম, পানছড়ি, খাগড়াছড়ি | (বয়স ৪৪)
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সালের পূর্বে) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ (১৯৭১ সালের পর) |
মাতৃশিক্ষায়তন | চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ |
পেশা | শিক্ষকতা, আইনজীবী |
পরিচিতির কারণ | রাজনীতিবিদ |
অফিস | সাবেক সংসদ সদস্য |
উত্তরসূরী | সন্তু লারমা |
রাজনৈতিক দল | পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি |
পিতা-মাতা |
|
আত্মীয় | কৃষ্ণ কিশোর চাকমা (চাচা) |
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ - মৃত্যু: ১০ নভেম্বর, ১৯৮৩) ছিলেন একজন বাংলাদেশী আদিবাসীদের নেতা ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর[১] শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তার আন্দোলনের সফলতা অর্জিত হয়।[২]
মনবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মাওরাম (মহাপুরম) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, যা এখন কাপ্তাই বাঁধের কারণে কাপ্তাই হ্রদের তলে ডুবে রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরার রাজ্যগুলোয় বসবাসরত চাকমা ব্যক্তি ছিলেন।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রথম বিদ্যালয় ছিল মহাপ্রুম জুনিয়র হাইস্কুল। তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। বিএ ও বিএড ডিগ্রি লাভ করেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে যথাক্রমে ১৯৬৫ ও ১৯৬৮ সালে। তিনি ১৯৬৯ সালে এলএলবি ডিগ্রিও লাভ করেন।[৩]
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৬৬ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে। তিনি ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী কাজ শুরু করেন।[৩]
তার মায়ের নাম ছিল সুভাষিণী দেওয়ান এবং বাবার নাম চিত্তকিশোর চাকমা। তার সহধর্মিনীর নাম পঙ্কজিনী চাকমা এবং ছেলে জয়েস লারমা, মেয়ে পারমিতা লারমা। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার বোন জ্যোতিপ্রভা লারমা, ভাই শুভেন্দু প্রভাষ লারমা এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।[৩]
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাহাড়ী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬০ সালে পাহাড়ি ছাত্র সমাজের নেতা হন। ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। তিনি পাকিস্তান সরকারের হাতে গ্রেফতারও হন ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। পরে ১৯৬৫ সালে শর্তসাপেক্ষে ছাড়া পান।[৪] তিনি ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি ১১টি আদিবাসী গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলেন জনসংহতি সমিতি এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে মোট ৪ দফা দাবি পেশ করেন আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য। তিনি বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের বিরোধিতা করেছিলেন, যা বাঙালি সংস্কৃতিকে আধিক্য দিয়েছিল এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালি নৃগোষ্ঠী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দেয়নি।[৫][৬] লারমার দাবী তখন শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ঐ বছরের ৩১শে অক্টোবর তিনি সংসদ ত্যাগ করেন সংবিধানে পাহাড়ীদের বাঙালী বলার প্রতিবাদে। লারমা আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যান ও বলেন:
কোনও সংজ্ঞা বা যুক্তির অধীনে একজন চাকমা বাঙালি বা একজন বাঙালি চাকমা হতে পারে না। পাকিস্তানে বসবাসকারী কোনও বাঙালিকে পাঞ্জাবি, পাঠান বা সিন্ধি বলাও যায় না ও হতেও পারে না এবং তাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে বাস করেন তাদের কাউকেও বাঙালি বলা যায় না। বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আমরা সকলেই বাংলাদেশি তবে আমাদের আলাদা জাতিগত পরিচয়ও রয়েছে, যা দুর্ভাগ্যক্রমে আওয়ামী লীগের (তৎকালীন শাসকদল) নেতারা বুঝতে চান না[৭][৮]
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।[৯] ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সংসদ প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন ইংল্যান্ডে। তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালেও যোগদান করেছিলেন।
১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ও কর্মীদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলে তিনি পরের দিনই আত্মগোপনে চলে যান এবং গড়ে তোলেন জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তি বাহিনী। একই সাথে তিনি গড়ে তুলেছিলেন মহিলা সমিতি, জুমিয়া সমিতি, যুব সমিতি ও গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী। অনেকের মতে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি গঠিত হয় শান্তিবাহিনী।[১] মার্ক্সীয় আদর্শ তিনি ধারণ করেছিলেন তার আন্দোলনের জন্য। পরে জিয়াউর রহমান নতুন বাঙালীদের পাহাড়ী অঞ্চলে অভিবাসিত করলে তাদের সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে তাদের লড়াই তীব্রতর হয়ে ওঠে।[১০] মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দলেও সৃষ্টি হয় অন্তর্দন্ধ এবং দলটি ২টি ধারা এম এন রায় গ্রুপ ও প্রীতি গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালে এবং ১৯৮২ সালেও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জনসংহতি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালের ১০ই নভেম্বর তিনি বিপক্ষ দলের আক্রমণে ৮ জনসহ মারা যান খাগড়াছড়িতে।[১১]